আহমাদ মাযহার
এ কথা বললে নিশ্চয়ই অন্যায় হবে না যে, বড়দের কবিতা সৃষ্টি শামসুর রাহমানের যতটা প্রাণের স্বতঃস্ফূর্ত উৎসারণ শিশুসাহিত্য ঠিক ততটা নয়। কবিতা লেখার প্রাচুর্যের পাশাপাশি তাঁর সৃষ্ট শিশুসাহিত্যের ক্ষীণকায়া দেখে কিংবা তাঁর কবিতার সর্বব্যাপী ব্যঞ্জনা-অভিঘাতের পাশাপাশি তাঁর শিশুসাহিত্যের অভিঘাতকে তুলনা করতে গেলেই এ-কথা প্রতীয়মান হবে। কিন্তু তারপরও বাংলাদেশের শিশুসাহিত্যে শামসুর রাহমানের অবদানের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হবে। কারণ বাংলাদেশের স্বল্পালোকিত শিশুসাহিত্যে যে সামান্য পরিমাণ উজ্জ্বলতা দৃশ্যমান তারও অনেকটারই অন্যতম প্রতিভূ তিনি।
তিনটি ছড়া-কবিতার বই এবং একটি স্মৃতিকথা সমন্বয়ে সজ্জিত শামসুর রাহমানের শিশুসাহিত্যের সম্ভার। তাঁর ছড়া-কবিতার বইগুলো হচ্ছে ‘এলাটিং বেলাটিং’ (১৯৭৫), ‘ধান ভানলে কুঁড়ো দেবো’ (১৯৭৭), এবং ‘গোলাপ ফোটে খুকীর হাতে’ (১৯৭৭)। আর একমাত্র গদ্যগ্রন্থটির নাম ‘স্মৃতির শহর’ (১৯৭৯) যা তাঁর শৈশবের বিচরণক্ষেত্র পুরোনো ঢাকাকে নিয়ে রচিত।
ষাটের দশকে বাংলাদেশের শিশুসাহিত্যের ক্ষেত্র সমৃদ্ধ হয়ে ওঠার ব্যাপারে দুটি পত্রিকার ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো। রোকনুজ্জামান খান সম্পাদিত মাসিক ‘কচি ও কাঁচা’ এবং এখলাসউদ্দিন আহমদ সম্পাদিত ‘টাপুর টুপুর’ নামের পত্রিকা দুটি আমাদের দেশে প্রধান লেখকদের কাছ থেকে আদায় করে নিয়েছিল শিশুসাহিত্যের বেশ কিছু সোনালি সৃষ্টি। আমাদের অন্যতম প্রধান কবি হিসেবে শামসুর রাহমানও এই পত্রিকদুটির সম্পাদকদের দ্বারা নিয়মিত তাড়িত হয়ে সৃষ্টি করেছেন তাঁর শিশুসাহিত্য-সম্ভারের উল্লেখযোগ্য অংশ। সেইসঙ্গে তৎকালীন দৈনিক পাকিস্তান তথা পরবর্তীকালের দৈনিক বাংলার শিশুসাহিত্য বিভাগ ‘সাত ভাই চম্পা’র, সম্পাদক আফলাতুনও তাঁর কাছ থেকে লেখা আদায় করে নিয়েছিলেন বেশ কিছু ছড়া-কবিতা। তবে আত্মতাড়না না থাকলে বাইরে চাপ দিয়ে কোনো শিল্পীর কাছ থেকে ভালো কিছু সৃষ্টি আশা করা যায় না। ঐ সম্পাদকেরা শামসুর রাহমানের সত্তার মধ্যে যে শিশু বা কিশোর ঘুমিয়ে আছে তাকে জাগিয়ে দেয়ার ভূমিকা পালন করেছেন মাত্র। বাংলার চিরকালের লোকায়ত সাহিত্যের বর্ণচ্ছটা যে শামসুর রাহমানের শিশুসাহিত্যিক সত্তাকে বিপুলভাবে অধিকার করে রেখেছে তা তাঁর শিশুসাহিত্যের দিকে তাকালেই লক্ষ করা যাবে। ছোঁদের জন্য তাঁর লেখা প্রথম বই ছড়া-সম্ভার ‘এলাটিং বেলাটিং’-এর সিংহভাগ ছড়া-কবিতা এই গোত্রের। লোকায়ত ছড়ার আঙ্গিক অনুসৃত শামসুর রাহমানের ছড়ায় বাড়তি যে অনুষঙ্গ বিশেষভাবে আকর্ষণ করে তা হচ্ছে ফ্যান্টাসি, নিরর্থকতা এবং হাস্যরস। এ-সব ক্ষেত্রে তাঁর শৈশব অকৃত্রিম হয়ে ফিরে এসেছে। যেমন,
আঁটুল বাঁটুল শামলা সাঁটুল, শামলা গেছে হাটে
কুচবরণ কন্যা যিনি, তিনি ঘুমান খাটে।
খাট নিয়েছে বোয়াল মাছে, কন্যা বসে কাঁদে,
ঘটি-বাটি সব নিয়েছে কিসে তবে রাঁধে?
আর কেঁদো না, আর কেঁদো না, ছোলা ভাজা খেয়ো
মাটির ওপর মাদুর পেতে ঘুমের বাড়ি যেয়ো!
নিজেদের জন্য ভাবতে পারে না বলেই শিশুরা নিজেরা সাধারণত শিশুসাহিত্যিক হিসেবে সাফল্য অর্জন করতে পারে না। শিশুসাহিত্য সৃষ্টি করেন সেই বড়রা যাঁরা শৈশবকে পেছনে ফেলে এসেও স্মৃতি থেকে শৈশবের স্বপ্ন-কল্পনার অভিনবত্বকে তুলে আনতে পারেন। ফ্যান্টাসি আর নিরর্থকতা বা নির্মল হাস্যরসের মতো শিশুমনের পরম পৃথিবীকে অনেক দূরে ফেলে এসেও শামসুর রাহমান একালের শিশুদের ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছেন তাঁর নিজের শৈশবের পৃথিবীর কাছে অথবা শৈশবের চোখ দিয়ে দেখা কল্পনার পৃথিবীতে; শিশুসাহিত্যিক হিসেবে শামসুর রাহমানের সাফল্য এখানেই!
ফ্যান্টাসি, নিরর্থকতা আর হাস্যরস শিশুদের তখনই আকর্ষণ করে যখন তা তাদের নিজেদের মনের যে ধরন তার মতো করে কার্যকারণ সম্বন্ধহীন হয়ে ওঠে; অপরিণত মন নিয়ে অবলোকন করে এবং তারা তাদের মতো করে সেই কার্যকারণ সম্পর্ককে আবিষ্কার করে; আর তাই তা আমাদের কাছে ফ্যান্টাসি বা নিরর্থকতার প্রতিভূ। যে শিশুসাহিত্যিক শিশুদের অপরিণত চোখ দিয়ে পৃথিবীর দৃশ্যমান বস্তুনিচয়কে দেখতে এবং দেখাতে পারেন শিশুসাহিত্যিক হিসেবে সফল হতে পারেন তিনিই! যদিও সমগ্র বাংলাভাষার শিশুসাহিত্যের প্রেক্ষাপটে বিচার করতে গেলে হয়তো শামসুর রাহমানের সাফল্যকে একেবারেই প্রথম সারিতে বসানো যাবে না, কিন্তু বাংলাদেশের শিশুসাহিত্যের প্রেক্ষাপটে পূর্বোক্ত নিরিখে তাঁকে প্রথম সারির সফল শিশুসাহিত্যিক বলতেই হবে।
শিশুদের জগৎকে উপস্থাপন করতে হবে তার সেই জগতের ছবি আঁকার মধ্য দিয়ে। সেজন্য শিশুর কবিকে চিত্রকল্প অংকনে চাতুর্য দেখাতে হবে। সেই সঙ্গে থাকতে হবে ধ্বনিব্যঞ্জনা সৃষ্টির ক্ষমতা। এই দ্বৈত অনুষঙ্গের সফল প্রয়োগ শামসুর রাহমান অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দক্ষতার সঙ্গে করতে পেরেছেন বলেই তাঁর সৃষ্ট শিশুসাহিত্য শিশুদের কাছে প্রিয় হয়ে উঠতে পেরেছে; আর শামসুর রাহমান হয়ে উঠেছেন শিশুদের কবি, বা শিশুদের লেখকও।
শামসুর রাহমানের ছড়া-কবিতার বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য কী? ছোটদের জন্য তিনি কোন পরিপার্শ্ব থেকে উপকরণ নিয়ে তাঁর শিশুসাহিত্যের জগৎ নির্মাণ করেছেন? এইসব প্রশ্নের উত্তরে সুস্পষ্টভাবেই বলা যাবে যে নাগরিক আবহ তাঁর সৃষ্ট বড়দের কবিতার মতোই প্রধান্য পেয়েছে তাঁর শিশুসাহিত্যেও। গ্রাম-প্রসঙ্গ বা গ্রামের চিত্র এসেছে প্রথানত পাঠ অভিজ্ঞতা বা শ্রুত অভিজ্ঞতা থেকে অথবা দূর থেকে দেখার অভিজ্ঞতা থেকে। নগর আবহের ছোট ছোট ডিটেলের উপস্থাপনা বেশ চমকপ্রদ। চিত্রকল্প সৃষ্টির ক্ষেত্রেও শাহরিক অনুষঙ্গ এসেছে খুবই স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে। যেমন এসেছে ময়লা গলি, ধোঁয়ার গাড়ি, ছাদ, ফুটপাত, গাড়ি, ভাঙা দেয়াল, মোটর গাড়ির কাশি, ধোঁয়ায় ঢাকা ময়লা আকাশ, গলির মোড়ের কলতলার সারিবদ্ধ কলসি–, ইত্যাদি দৃশ্য।
ছোটদের জন্য ছড়া-কবিতা লিখতে গিয়ে অবশ্য শামসুর রাহমান একেবারে সম্পূর্ণ নিজস্ব কোনো ধারার সৃষ্টি করতে পারেননি। তাঁর লেখাগুলো একটু যত্ন সহকারে পাঠ করলেই অনুভব করা যাবে, এসব লেখার পেছনে প্রচ্ছন্নভাবে লুকিয়ে আছেন সুকুমার রায়, এডওয়ার্ড লীয়র বা যেগীন্দ্রনাথ সরকার। প্রবল প্রতাপান্বিত এই দিকপালদের এড়িয়ে গিয়ে সম্পূর্ণ নতুন ধারার সৃষ্টি অবশ্য বিরল ঘটনা। রবীন্দ্র-সুকুমার-যোগীন্দ্র-নজরুল-সুনির্মল-অন্নদাশঙ্কর শিশুসাহিত্যের দিগন্তকে এমন ভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছেন যে এখন যাঁরা সেরা লেখক তাঁরা পূর্বোক্তদের নির্দেশিত পথকেই সম্প্রসারিত করে চলেছেন মাত্র। শামসুর রাহমান ছোটদের জন্য অনেক তাৎপর্যপূর্ণ ছড়া-কবিতা দিয়ে আমাদের শিশুসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করলেও তাঁর এই অপূর্ণতার কথা আমাদের হয়তো মেনে নিতে হবে।
বড়দের জন্য কবিতা সৃষ্টিতে শামসুর রাহমানের যে বিরাট শিল্পী-সাফল্য রয়েছে তার তুলনায় তাঁর মননশীল গদ্য বা কথাসাহিত্যের সাফল্য মোটেও উল্লেখযোগ্য নয়। সে তুলনায় কিন্তু ছোটদের জন্য লেখা তাঁর স্মৃতিচারণামূলক গদ্যরচনা ‘স্মৃতির শহর’ অনবদ্য। বয়স্কজন পাঠ্য গদ্য রচনার সময় অনেক ক্ষেত্রেই তাঁর কাব্যিয়ানা কিশোর পাঠকদের কাছে হয়ে ওঠে সংবেদী। শৈশবের স্মৃতিকথন তাঁর হাতে যেমন কাব্যমাধুর্য এবং স্বাপ্নিকতার স্পর্শে ব্যঞ্জিত হয়ে ওঠে তেমনি গদ্যের প্রসাদগুণ পাঠকের মনে সৃষ্টি করে আনন্দের দ্যোতনা। সেই সঙ্গে ছোটখাট মানবিক ঘটনা উপস্থাপনের ক্ষেত্রে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি কিশোরদের সংবেদনশীল মনকে উন্নত মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধান্বিত হয়ে উঠতে সাহায্য করে।
‘স্মৃতির শহর’ একই সঙ্গে ঢাকার একটা সময়ের ইতিহাস এবং ঢাকা অনুষঙ্গী কাব্যময়তার উদ্ভাস। এক সময় হয়তো ঢাকার ইতিহাসকারেরা এই বইকে তাঁদের তথ্যের আকর হিসেবেও ব্যবহার করবেন। তথ্যের বর্ণনাও যে জীবন্ত এবং কবির স্বপ্ন-কল্পনা-অনুষঙ্গী হয়ে উঠতে পারে স্মৃতির শহর বইটি তারই নিদর্শন।
ষাটোর্ধ্ব শামসুর রাহমান শতায়ু হোন এবং কবিতার নানান নতুন মাত্রা সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের শিশুসাহিত্যের নতুন সমৃদ্ধি আনুন–এই আমাদের সকলের প্রত্যাশা।
১৯৯১
পুনশ্চ:
কবি শামসুর রাহমানের (১৯২৯-২০০৬) ষাট বছর পূর্তি উপলক্ষে তাঁর বন্ধু মীজানুর রহমান নিজের সম্পাদিত বিখ্যাত সাহিত্যপত্র ‘মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা’র একটি বিশেষ সংখ্যা (১৯৯১) অনেক যত্নে প্রকাশ করেছিলেন। মীজানুর রহমানের অনুরোধে ঐ বিশেষ সংখ্যার জন্য আমি এই অকিঞ্চিৎকর রচনাটি লিখেছিলাম। যতদূর মনে পড়ছে তখনো পর্যন্ত কবি শামসুর রাহমানের শিশুসাহিত্য মূল্যায়নের উদ্দেশ্যে সামগ্র্যসন্ধানী কোনো রচনা লেখা হয়নি। রচনাটি প্রকাশের পর তিনি প্রায় ১৫ বছর বেঁচে ছিলেন। এর পরও অনেকবার তাঁর সঙ্গে দেখা হলেও লেখাটির সম্পর্কে তাঁর মতামত কখনো জানতে চাওয়া হয়ে ওঠেনি।
বাংলাদেশে সমালোচনা সাহিত্যের নানা দৈন্য থাকলেও কবি শামসুর রাহমানকে নিয়ে অনেকেই অনেক কিছু লিখেছেন। তাঁর অনেক বই নিয়ে আলোচনাও হয়েছে। কিন্তু আমাদের দীন সমালোচনা-সাহিত্যে সামগ্রিক ভাবেই শিশুসাহিত্যের উপজীব্যতা আরো ক্ষীণ ধারার বলেই হয়তো শামসুর রাহমানের এই বিশিষ্টতাকে বিচার করে দেখার কথা তেমন একটা গুরুত্ব দিয়ে ভাবা হয়নি। সময়চিহ্নকে অবিকৃত রাখার স্বার্থে ১৯৯১ সালে লেখা আমার উপর্যুক্ত রচনাটিকে পরিমার্জনা না করেই এখানে হাজির করা হলো। তবে যাঁরা শামসুর রাহমানের শিশুসাহিত্য নিয়ে ভবিষ্যতে আলোচনা করবেন তাঁদের সুবিধার্থে তাঁর শিশুসাহিত্য চর্চার অবশ্যজ্ঞাতব্য হিসেবে তাঁর ছোটদের বইয়ের নাম ও প্রকাশসাল উল্লিখিত হলো। কবিতার বইগুলো হলো ‘এলাটিং বেলাটিং’ (১৯৭৫), ‘গোলাপ ফোটে খুকীর হাতে’ (১৯৭৭), ‘ধান ভানলে কুঁড়ো দেব’ (১৯৭৭), ‘রামধনুকের সাঁকো’ (১৯৯৪), ‘লাল ফুলকির ছড়া’ (১৯৯৫), ‘নয়নার জন্য’ (১৯৯৭), ‘সবার চেখে স্বপ্ন’ (২০০১), ‘ইচ্ছে হলো যাই ছুটে যাই’ (২০০৫), ‘হীরার পাখির গান’ (২০০৬)। আর ছোটদের জন্য লেখা গদ্যের বই বলতে তাঁর একমাত্র স্মৃতিকথার বই ‘স্মৃতির শহর’ (১৯৭৯)।