spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদপ্রবন্ধবহুমাত্রিক ব্যঞ্জনার ভাষা-ইশারা কবি খসরু পারভেজের কবিতা

লিখেছেন : আবু তাহের সরফরাজ

বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনার ভাষা-ইশারা কবি খসরু পারভেজের কবিতা

আবু তাহের সরফরাজ

কবিতা মূলত মরমের অভিঘাত। যাপিতজীবনের প্রতিমুহূর্তে কবির অন্তর্জগতে ধ্বনিত হতে থাকে কত কত কলস্বর। সেসব স্বর অস্ফুট ইশারার মতো কিছু বার্তা যেন প্রকাশ করতে চায়। সেই ইশারা ভাষায় রূপ পায় কবিতার মধ্য দিয়ে। কবিতার ভাষা আসলে কেবল শব্দের যথেচ্ছ বুনন না। বরং শব্দ ব্যবহারের পরিমিতিবোধেই কবিতার কারুকাজ নান্দনিক হয়ে ওঠে। এরই পাশাপাশি কবির অন্তর-গহনে নানা রকম কলস্বর কী উপায়ে ঢেউ তুলছে সে বিষয়টি দিয়েও কবিতার শিল্পমূল্য বুঝে নেয়া সম্ভব। সত্যি যে, বোধের কলস্বর শব্দের বাহনে চড়িয়ে কবিতায় তুলে আনা খুবই মুশকিলের কাজ। বোধের স্ফুরণ তো সহজে ধরা দ্যায় না। অন্তর-গহনের স্ফুরিত বোধ যে কবির কবিতায় যত স্বতঃস্ফূর্ত সেই কবিতা শিল্পোৎকর্ষে তত বেশি অনন্য। আশির দশকের অনেক কবির কবিতাতেই আমরা এই মৌলিক বৈশিষ্ট্য দেখতে পাই। তবে তাদের প্রত্যেকেই আলাদা-আলাদা ভাষারীতি ও কাব্যনির্মাণ শৈলী তৈরি করে নিতে পেরেছিলেন। সেই অর্থে আশির কবিদের প্রত্যেকের কবিতাই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে উদ্ভাসিত। তবে খসরু পারভেজের কবিতায় শব্দের যে কারুকাজ তা বিশেষভাবে পাঠকের চোখে পড়ে। বাংলা ভাষার শব্দ-ভাণ্ডার সুবৃহৎ। সেসব ভাণ্ডার থেকে দরকার মতো শব্দ নিয়ে খেলাচ্ছলে খসরু তার কবিতায় বুনে দেন। মানে, শব্দকে নিয়ে কৌশলগত এক ধরনের খেলা টের পাওয়া যায় খসরুর কবিতায়। শব্দের এই খেলায় থাকে কবির স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দ। ফলে তার কবিতায় শব্দের বুননও স্বতঃস্ফূর্ত। আরোপিত শব্দের প্রহেলিকা তার কবিতাকে পাঠকবিমুখ করে না। বরং সেসব শব্দের বিন্যাস শিল্প-সৌন্দর্যে পাঠককে মুগ্ধ করে। কবিতার এই এক মজা। পাঠক হয়তো এই মজাকে আস্বাদন করতেই খসরু পারভেজের কবিতা পড়েন। ‘শিলালিপি’ কবিতায় তিনি লিখছেন:

কী আছে শিলালিপির নিচে
বিক্ষিপ্ত করোটি আর ক্ষয়ে যাওয়া কংকাল ছাড়া
মৌচাকের মধু ফুরিয়ে গেলে মিলিয়ে যায় মোমের অহংকার
ফুলের জীবন নিয়ে তোমরা অনর্থক খেলা করো
মনে রেখো, ফুলের সুগন্ধ বা রঙ
গহীনে যাওয়ার আগেই ফিকে হয়ে যায়
অদৃশ্য ইথারে ভাসতে ভাসতে ফুলের কান্নারা হাসে
আগরের গন্ধ হাওয়ায় হারাবেই
জীবনকে অবহেলা করে স্মৃতি।

বাক্যে বিন্যাস্ত শব্দেরা যেন এক একটি জাদুর কাঠি। জাদুকর যেমন জাদুর কাঠি চোখের সামনে ঘুরিয়ে মোহগ্রস্থ করেন, একইভাবে ওপরের কবিতাংশের বাক্যগুলোর শব্দেরা আমাদের চোখের ভেতর দিয়ে যখন মস্তিষ্কে পৌঁছায় তখন ঘোরের মতো আবেশ আমাদের অন্তর্জগতে তৈরি হয়। এরপর শব্দের খোলস ভেঙে একের পর এক বেরিয়ে আসতে থাকে ভাষাচূর্ণ উপলব্ধি। আমরা বুঝতে পারি, শিলালিপি আসলে জীবনের প্রতীকী রূপ। এই যে জীবন আমরা কাটাচ্ছি পৃথিবীর আলো-হাওয়ায়, এই জীবন কি সত্যিই আমাদের জীবন? আমরা কি এই জীবনের গূঢ় উপলব্ধির ভেতর দিয়ে যেতে পারি? তা কিন্তু পারি না। জীবনের অন্তর্গত গহীনে ঢুকে যদি তাকে উলটে দেখি তাহলে আমরা দেখতে পাবো জীবনের নিচে আসলে আমাদের বিক্ষিপ্ত করোটি আর ক্ষয়ে যাওয়া কংকাল ছাড়া কিছুই নেই। অথচ এই জীবনে নিয়ে কতই না উচ্ছ্বাস আমাদের! আরেক মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার হরণ করে আমরা নিরন্তর গড়ে তুরছি ভোগ ও সম্ভোগের প্রাচুর্য। মোমের প্রাচুর্য মধুতে। মধু আছে বলেই আমাদের কাছে মোমের কদর। তা না-হলে মোম তো আমাদের তেমন কোনো কাজেই আসে না। মধু ও মোমের উপমার আড়ালে খসরু আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, জীবন আছে বলেই জীবনকে ঘিরে আমাদের অহংকার, উচ্ছ্বাস। জীবন না থাকলে আমাদের কিছুই থাকবে না। পাঠক এখানে মৃত্যুকে ভেবে নিতে পারেন। কিন্তু বিষয়টি আরেকটু গভীরভাবে ভেবে দেখলে মৃত্যু ছাড়াও আরও যেন কোনো ইশারা আমাদের মননকে কাঁপিয়ে যায়। জীবন থাকতেও যে জীবনশূন্যতার উপলব্ধি ঘটতে পারে সেই সত্য আমাদেরকে কবি শিলালিপির প্রতীকে প্রথমেই জানিয়ে দিয়েছেন। ফুল সৌন্দর্যের প্রতীক। ফুল নিয়ে আমাদের উচ্ছ্বাসের যেন শেষ নেই। ফুল নিয়ে নানা দেশে নানা ভাষায় লেখা হয়েছে অসংখ্য কবিতা। কিন্তু সেই ফুলের সৌন্দর্যও চিরন্তন নয়। খসরু আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, ফুলের সৌন্দর্যের গভীরে যাওয়ার আগেই সেই সৌন্দর্য ফিকে হয়ে যায়। সৌন্দর্য হারিয়ে আমাদের অগোচরে ফুল কাঁদতে থাকে। আমরা সেই কান্না অবশ্যি শুনতে পাই না। এর পরপরই খসরু পারভেজ বোমা বিস্ফোরণের মতো দুম করে বলে ফেললেন, জীবনকে অবহেলা করে স্মৃতি। যেন স্মৃতিই আমাদের মহামহিম। আমরা স্মৃতির অনুগত। মনে পড়ছে মহাদেব সাহার কবিতার একটি বাক্য, ‘স্মৃতি ছাড়া আর কোনো নোটবুক নাই’। জীবন যেন শূন্যগর্ভ। মানুষ নিতান্তই বাধ্য হয়ে জীবনকে কাঁধে নিয়ে বহন করে চলেছে। আর তাই জীবনের মহামূল্যবান সম্পদ স্মৃতির কাছে বারবার হোঁচট খেয়ে জীবনকে ফিরে আসতে হয় শূন্য-গহ্বরে। ‘শিলালিপি’ কবিতায় এভাবেই নানা উপমা ও উৎপ্রেক্ষা ব্যবহার করে খসরু পারভেজ জীবনের স্বরূপ পাঠকের চোখের সামনে উপস্থাপন করেছেন। কবিতার বাক্যগুলো যে ভাষায় নির্মিত সেই ভাষাশৈলী আমাদের প্রতিদিনের ব্যবহারিক জীবনের সাথে ঘনিষ্ঠ। অথচ এক-একটি শব্দ যে অর্থময়তা ছড়িয়ে দিচ্ছে তা হৃদয়ঙ্গম করতে পাঠককে বোধের অতলে ডুব দিতে হয়। প্রতীক ও রূপকের এই খেলা কবিতা ছাড়া আর কোনো শিল্প-মাধ্যমে খেলে যাওয়া সম্ভব নয়। কবিতায় নানা মাত্রার স্পেস থাকে। মহাশূন্যের নিঃসীম বিস্তৃতির মতো কবিতার বিস্তার। ফলে, কবিতার প্রতিটি শব্দের শব্দগত অর্থ ছাড়াও আরও বহুমাত্রিক অর্থদ্যোতনা অব্যক্ত থাকে। তাকে ব্যক্ত করে পাঠকের অনুভূতির রঙে ওই শব্দ জারিত হয়েই সেই অব্যক্ত অর্থদ্যোতনা ব্যক্ত হয়। প্রকাশ ঘটায় অনুভূতির চিত্র-বিচিত্র রূপ ও রঙ। কবিতা পাঠের আনন্দ আসলে এখানেই। এজন্যই কবিতার আবেদন কখনোই নিঃশেষিত হবে না। সেই প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকেই সুললিত বাণীর ভেতর মানুষ আত্মা-অনুভূতির স্ফুরণ টের পেতো। এখনো পায়। মানুষের অন্তর্জগৎ অতলান্তিক। কত বিচিত্র আর নানা বর্ণিল ঢেউ যে সেই জগতে প্রতিমুহূর্তে ঘূর্ণি তোলে, তার হিসাব তো আমাদের কারো জানা নেই। কবিতায় কবির অন্তর্জগতের ঢেউ আছড়ে পড়ে। সেই কবিতা পাঠে পাঠক তার অন্তর্জগতে আলোড়ন উপলব্ধি করে। এই আনন্দ আসলে শিল্পের আনন্দ। যাপিতজীবন থেকে কিছু সময় অবসর নিয়ে আত্মমগ্ন হয়ে নিজের আমিত্ব আবিষ্কারের আনন্দ। জীবনের নানা অভিজ্ঞতা ও মুহূর্তকে নানা প্রতীক ও রূপমের মধ্য দিয়ে প্রকাশ ঘটে কবিতায়। যে কবি যত মেধাবী তার কবিতায় প্রতীকের ব্যবহার তত বেশি শিল্প-সৌন্দর্যে মণ্ডিত। কবিতায় প্রতীকের ব্যবহার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, প্রতীকের আবডালেই কবি ব্যক্ত করেন অনুভূতির অনুক্ত ব্যঞ্জনা। আধুনিক কবিতা খুব ষ্পষ্ট করে পাঠকের চোখে প্রতীককে চিহ্নিত হতে দ্যায় না। যে দুটো বিষয়ের মধ্যে তুলনা করা হচ্ছে সে দুটি বিষয়ের ভেতর থেকে একটি বিষয়কে অনুক্ত রাখতেই সাম্প্রতিক কবিদের প্রচেষ্টা আমাদের চোখে পড়ে। খসরু পারভেজের প্রতীক ব্যবহারের নৈপুণ্য কী রকম, সে বিষয়ে একটু ধারণা নেয়া যাক।

১. বৃষ্টির বীর্য থেকেই পৃথিবী গর্ভবতী হয়
অথচ মুখ ভার করে আছে সঙ্গমহীন বর্ষাবউ।
২. হে ঘুম, তুমি ঘুমাবে কবে!
৩. পাথরের চেয়েও ভারি রাষ্ট্রযন্ত্র।
৪. পৃথিবীর সমস্ত প্রেমিকা একদিন চাঁদ হয়ে যায়।
৫. পৃথিবীকে দু’হাতে আঁকড়ে ধরি।
৬. একটি চোখের তারায় ফুটে থাকে অজস্র চোখ।
৭. আয় চাঁদ নেমে আয়
পুরুষ পোকায় খাওয়া আমার বোনটির পাশে দাঁড়া।
৮. আমার মৃত্যুকে আমি ঘুম পাড়িয়ে রেখেছি ঘরে।

ওপরের বাক্যগুলোতে আমরা দেখতে পাই, বৈচিত্র্যপূর্ণ নানা রূপকে খসরু পারভেজ জীবনের পৃষ্ঠা একটার পর আরেকটা উল্টে চলেছেন। এসব রূপক কবির অনুভূতিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনায়। বৃষ্টির জল ভূমিকে ঊর্বর করে। উদ্ভিদ জন্মানোর আয়োজন তাতে তৈরি হয়। এই অবস্থাকে কবি গর্ভবতী শব্দে রূপায়িত করেছেন। সন্দেহ নেই, দারুণ চমৎকার এই রূপক। মজা যে, বৃষ্টি পৃথিবীর ভূমিকে গর্ভবতী করছে আর ওদিকে তার বউ সঙ্গমহীন অবস্থায় মুখ ভার করে বসে আছে। কী দারুণ চিত্রকল্প, না? কবির কবিত্ব তো এখানেই। পরের বাক্যে ঘুম কখন ঘুমোবে সেই প্রশ্ন তুলেছেন কবি। কেন তার এই জিজ্ঞাসা, সেই জবাব ওই কবিতার ভেতরই পাঠক পেয়ে যাবেন। আসলে গোটা কবিতা না পড়লে এসব রূপক কিংবা প্রতীকের ব্যবহার কী চমৎকার ব্যঞ্জনা প্রকাশ করছে, সেটা ধরা সম্ভব নয়। যেসব পাঠক খসরু পারভেজের কবিতা নিয়মিত পড়েন, তারা এই শিল্প-সৌন্দর্য বুঝতে পারেন।
খসরুর বেশির ভাগ কবিতা যদিও গদ্য প্যাটার্নের, এরপরও ছন্দের সাবলীল প্রাণস্পন্দন শব্দের বুননে পাঠককে দোলা দিয়ে যায়। মানে, তার কবিতার বাক্য ছন্দায়িত। আর, সেসব কবিতা তিনি ছন্দের শৃঙ্খল অনুযায়ী লেখেন সেসব কবিতার বাক্য পাঠককে চুম্বকের মতো টেনে ধরে রাখে। এক টুকরো পড়া যাক:

কত হাসি কত কান্না
কত কলরব!
পবিত্র এক হৃদপুরাণে
লেখা আছে সব।

মানুষ প্রকৃতির সন্তান। প্রকৃতির বুকে যেমন এই রোদ এই ছায়া, মানুষের জীবনেও তেমনই সুখ ও দুঃখ অঙ্গাঙ্গি জড়িয়ে রয়েছে। যাপিত জীবন ঘিরে প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে কত কত যে সুখ-দুখের স্রোত বয়ে চলেছে, তার হিসেব তো আমরা করতে পারি না। তবে সেই স্রোতের অভিঘাতে নিত্য-নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে চলেছি আমরা। জীবনের নানা কলস্বর এইভাবে কবিতায় শিল্পরূপে চিত্রিত করেন খসরু পারভেজ। মূলত জীবনকে ভেঙেই তৈরি হয় তার কবিতার অন্তর্গত রূপচিত্র। প্রতিমুহূর্তে যা-যা ঘটে চলেছে আমাদের জীবনে সেসব লেখা আছে পবিত্র একটি হৃদপুরাণে। ইসলামি বিশ্বাস অনুযায়ী, পৃথিবীর সবকিছুর পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ লিপিবদ্ধ হয়ে আছে লাওহে মাহফুজে। সেই স্থানকেই কি কবি পবিত্র হৃদপুরাণ বলে রূপায়িত করেছেন? হতে পারে। আবার নাও পারে। হয়তো মানুষের হৃদয়কেই কবি পবিত্র জ্ঞান করেন। হৃদয়লিপিকেই হয়তো তিনি হৃদপুরাণ বলতে চান। বিষয়টি অমীমাংসিত। তবে কবিতা যেহেতু বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনার শৈল্পিক প্রকাশ সেহেতু পাঠক হিসেবে আমাদের সুযোগ থাকে নিজের মতো কবিতাকে উপলব্ধি করার। সেই উপলব্ধি যদি ছন্দের আনন্দে তৈরি হয় তাহলে পাঠক তৃপ্ত হয়। খসরুর কবিতায় ছন্দের সেই আনন্দ রয়েছে। তার কবিতায় জীবনের বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনা রয়েছে। শব্দের বুননে সেসব ব্যঞ্জনার ইশারা খসরু তার অনন্য ভাষাশৈলীতে রূপায়িত করেন। তার এই রূপায়ণ কৌশল আশির আরসব কবি থেকে তাকে স্বতন্ত্র মর্যাদা দিয়েছে।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

কাজী জহিরুল ইসলাম on বাংলা একাডেমির মুখোস উন্মোচন
কাজী জহিরুল ইসলাম on বাংলা একাডেমি এবং আমার গ্লানি
কাজী জহিরুল ইসলাম on ‘প্রথম আলো’র বিকল্প