| মাহমুদ নোমান |
গীতলস্পর্শে ভেতরে-বাইরে সৌন্দর্য চেতনে জীবনের শেষপথকে এতোই উদযাপিত আনন্দে লেখা যায় কাজী জহিরুল ইসলামের কবিতার বই – ‘শেষ বিকেলের গান’ না-পড়লে অনুধাবন করতাম না। বইটির আগাগোড়া স্বরবৃত্ত ছন্দের বন্ধনে নিবীড় এক যাদুটোনা করেছেন, যেখানে বিন্দুমাত্র হতাশায় বাহিত করেনি অনুভবকে; কেবলি উদযাপনে প্রত্যেক ঘটনের বিবিধ রূপ রহস্য উন্মোচিত করেছেন আর শুদ্ধ স্বরবৃত্ত ছন্দে মরণের পথের দিকে ইঙ্গিতে একটি বিষয়ে এমনই বৈচিত্র্যময় ভাবিত-কল্প আর জ্ঞান জাহির করা একজন মাদারজাদ কবির পক্ষেই সম্ভব; কবি কাজী জহিরুল ইসলাম সেই কবি – যিনি নিজের কবিতা’কে একেক ব্যঞ্জনায় বিচিত্র রূপের অভিজ্ঞতার সম্মুখে বাংলার কবিতা দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন; যিনি ইচ্ছে করলে ক্ষণে কান্নার মাঝে ক্ষণে হাসির মজলিস এনে দিতে পারেন!
‘শেষ বিকেলের গান’ কবিতার বইটিতে ১০০টি কবিতা একই শিরোনামে কেবল সারি সারি পরিবেশিত হয়েছে পরপর কোনও গ্যাপ না-দিয়ে; কেবল নতুন কিছু থেকে আবার নতুন কিছুতে চলে যাচ্ছি, এই যে এই ক্ষণও ফিরে আসবে না, সেই ধারাকে ন্যাচারালি উপস্থাপন কাজী জহিরুল ইসলামকে আলাদা করে বুঝতে বাধ্য করে; স্বরবৃত্ত ছন্দকেও নিজের মতো অন্তমিলের বিভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থিত করে ভাঙা আর অতিপর্বের চমৎকার কিছু খেলা পাঠককে বিমোহিত করবে শুধু নয়, এই বইটি এখনকার বাংলা সাহিত্যে অবশ্যই পাঠের তালিকায় রাখা উচিত; এমনকি এই বইয়ের শুরুতে স্বরবৃত্তের শুরু আর শেষ ‘ভূমিকা’য় লিখে এমন বুঝিয়ে দেওয়া নতুন লিখিয়েদের কাজে দেবে সুনিশ্চিত;
কাজী জহিরুল ইসলামের কবিতা সুস্থির বক্তব্যের মোলায়েম স্বরের রিদমিক সৃজনের কামিয়াবি সত্যি… চিত্রকল্পের স্মার্ট খেয়াল আর উপমার সুদৃঢ় সংকল্পিত বন্ধন কখনও অন্তমিলে কখনও নিজে নিজে কবিতাগুলো বয়ে গেছে সারল্যে স্বরবৃত্তের পোশাকে-
অন্ধকারে জ্বলে একা আঁধারমানিক,
বুঝি কোনো মহাগ্রন্থে রয়েছে তার নিভু নিভু আলোর কথা লেখা?
যখন আমি অন্ধকারে যাচ্ছি ডুবে
হঠাৎ তখন এই জোনাকির সঙ্গে আমার দেখা।
- ৫৪নং কবিতা; ৬৬পৃ.)
দেখেন অন্ধকারে কেমন আলোর জোনাকি দিয়ে জীবন এক সহজ সরলে এগিয়ে দিয়েছেন ‘শেষ বিকেলের গান’ গেয়ে; এমন বিমোহিত করার কবিতা বহুদিন পরে আবার ভুলে গিয়ে পড়তে হয় এমনই প্রাঞ্জল অথচ হৃদয়গামী যাত্রার যাত্রী হয়ে-
দ্রাক্ষারসের কারসাজিতে আজকে কুপোকাত
দিনে-দুপুরে দেখছি তারা, অন্ধকারের রাত।
রসের জাদু কেমন করে রাতকে বানায় দিন,
জানার ইচ্ছে খুব।
অন্ধকারের যাত্রাপথে
এমন রসের অথই জলে সহাস্যে দিই ডুব।
-৫৫নং কবিতা)
খ.
ঠিক বয়সের অক্ত নেই আর
এখন শুধু পড়তে হবে কাজা।
যাচ্ছি ডুবে মন্দ্র-ভিড়ে
অস্তরাগে আস্তে-ধীরে ডাইভারসিটি প্লাজা
খলসে, পুঁটি, ইলিশ, বোয়াল দিচ্ছে গোঁফে তা
রূপের হাটে রঙ-পশরা;
হাঁটছে দেহে ঢেউ তুলে সব রঙের বিক্রেতা।
-৬৮ নং কবিতা)
গ.
স্বপ্নে দেখা শীতল নদী সাঁতার কেটে কে দিয়েছে পাড়ি?
সবই ছিল জানা প্রশ্ন
কলম কেন চলছিল না পরীক্ষকের বাড়ি?
কিংবা হঠাৎ খানাখন্দে হড়কে দুপা পিছলে গেলেই
প্রাণান্তকর চেষ্টাতেও যায় না ওঠা কেন?
কষ্টগুলো স্বপ্নে এসে
কেবল শুধু কষ্ট বাড়ায়, জীবন যেনতেন।
- ৭৯ নং কবিতা)
কবি কাজী জহিরুল ইসলাম এই বইয়ে স্বরবৃত্তের অতি পর্ব, অপূর্ণ পর্বেরও শ্রুতিমাধুর্য ধ্বনি-দ্যোতনার বৈচিত্র্য এনেছেন বেশ সাবলীল ঢঙে,যেন একটা পাঁচ দিনের নান্দনিক টেস্ট ম্যাচ; চোখে দেখার তৃপ্তি তো আছে, বিষাদচূড়ায় মেঘ ছু্ঁয়ে দেখার সেই তীব্র আনন্দও পেতে পারেন; এছাড়া কোনোকিছু বেশি ভালো লাগলে সেটিকে নিয়ে বেশি বলবার জো থাকে না। সেটি পুরোটা উদযাপনের হয়ে যায়….
‘জলধি’ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত এই বইটি পাঠকদের অবশ্যই পড়া উচিত..