আবু রাইহান
দুই বাংলার সাহিত্য সমালোচকরা একটি বিষয়ে সহমত পোষণ করতে বাধ্য হন- কবি জীবনানন্দ দাশের পর থেকে কবি আল মাহমুদ এবং শামসুর রাহমানের সময় কাল থেকে বাংলা কবিতা চর্চার ধারা দুই বাংলায় দুই দিকে বাঁক নিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট বিতর্কের অবকাশ থাকলেও দুই বাংলায় পঞ্চাশের দশক থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়ের বাংলায় কবিতা চর্চার ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে এই সত্য স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়।বাংলাদেশের কবিরা বেশ কিছু মহৎ কালজয়ী কবিতা লিখেছেন।কিন্তু মহৎ কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা হাতেগোনা।এই মহৎ কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কবি মজিদ মাহমুদের ‘মাহফুজামঙ্গল’। আশির দশকের অন্যতম প্রধান কবি মজিদ মাহমুদের কবিতার বই ‘মাহফুজামঙ্গল’ এর ভূমিকায় লেখা হয়েছে-’মাহফুজামঙ্গল’ এখন আর শুধু একটি কাব্যগ্রন্থ নয়। প্রথম প্রকাশের মাত্র তিন দশকের মধ্যে এটি একটি ক্লাসিক গ্রন্থে রূপ নিয়েছে। এই সময় কালে আর কোন কাব্যগ্রন্থ বিষয়েও বাচনে এতটা ব্যাপ্তি নিয়ে পাঠক মহলে হাজির থাকেনি। একইসঙ্গে মধ্যযুগের নিগড় ভেঙে যেমন এর বিষয় সৌন্দর্য্য প্রকটিত, তেমনি আধুনিকতার সীমা সরহদদাতা ও এটি যথাযথ মান্য করে নি। তাই বলে উত্তর উপনিবেশ ও উত্তরাধুনিক পাঠ প্রপঞ্চের ভেতর এর বিষয় ও অঙ্গ শৈলী হারিয়ে যায় না। ব্যক্তি ও জাতীয় মানুষের ব্যথা বেদনা বাঙালি মানুষের বাঙালি হয়ে ওঠা এবং অতীত ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারিত্ব ধারনের মাধ্যমে এ গ্রন্থটি হয়ে উঠেছে একের ভেতর বহু স্বরের প্রকাশ।মানুষের প্রেম-ভালোবাসা সংগ্রাম ও স্বপ্নযাত্রা এ গ্রন্থে প্রকীর্ণ হলেও পাঠক সহজ আনন্দ থেকে বঞ্চিত হন না। তিন দশকের প্রেক্ষাপটে গ্রন্থটি ক্রমান্বয়ে খাঁটি বাঙালি কাব্য হিসাবে জনপ্রিয়তায় এগিয়ে রয়েছে। শব্দ চয়ন বিষয় নির্বাচন বাচনিক দিক দার্শনিকতার বয়ান সব মিলিয়ে মাহফুজামঙ্গল কাব্যগ্রন্থটি বাংলা কবিতার ইতিহাসে এক অভিনব উপাদান।ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সূচনা পর্বে এ দেশের কবিতা হারিয়ে ফেলেছিল যে নিজস্ব ধারা মাহফুজামঙ্গল এ তার কিছুটা পুনর্জাগরণ ঘটেছে বলে মনে হয়। এই কাব্য পাঠ এর মাধ্যমে পাঠক এক অনাস্বাদিত আনন্দের সম্মুখীন হন।সাম্প্রতিক বাংলা কবিতা যেভাবে অ্যাবসার্ডনেস ও অ্যাবস্ট্রাকশনে ভর দিয়ে নতুন কোনো উন্মোচনের দিকে যেতে চাইছে, সেখানে মজিদ মাহমুদের কবিতা চিন্তা ও দর্শনের সাথে লড়াই করবার জন্য পাঠককে আত্মখননের দিকে নিয়ে চলে।১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে ‘মাহফুজামঙ্গল’ প্রকাশের পরে মজিদ মাহমুদের কাব্য পাঠকের দৃষ্টি কাড়তে সমর্থ হয়েছিলেন।২০০১ সালে বাংলা কবিতার কিঞ্চিত স্বাতন্ত্র্য কাব্যগ্রন্থ ‘বল উপাখ্যান’ এবং ২০০২ সালে ‘আপেল কাহিনী’ নামে অপর একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়।২০১৪ সালে মাহফুজামঙ্গল কাব্যগ্রন্থের পঁচিশ বছর পূর্তি উৎসব অনুষ্ঠানে ঢাকায় কবি মজিদ মাহমুদ স্পষ্টভাবে জানিয়ে ছিলেন-তাঁর মাহফুজামঙ্গল কাব্যগ্রন্থের জনপ্রিয়তা এবং পাঠকপ্রিয়তা দেখে মনে হয় ‘বল উপাখ্যান’ এবং ‘আপেল কাহিনী’ নামে কাব্যগ্রন্থ গুলির লেখক তিনি হলেও তাঁর মাহফুজামঙ্গল কাব্যগ্রন্থের লেখক আসলে পাঠকরাই।পাঠকরাই তাঁর কাব্যগ্রন্থ মাহফুজামঙ্গলকে জনপ্রিয় করে তুলেছেন। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় তিনি বলেছেন, মাহফুজামঙ্গল কাব্যগ্রন্থ তার প্রথম দিকের লেখা।এই লেখায় তাঁর অনেক দুর্বলতা রয়ে গেছে। অথচ এই কাব্যগ্রন্থটি পাঠকপ্রিয়তা এবং জনপ্রিয়তা প্রকাশের সাড়ে তিন দশকের বেশি সময় পরেও যে কমেনি, তার প্রমাণ হলো কাব্যগ্রন্থটির একুশতম সংস্করণের প্রকাশ।অথচ ‘বল উপাখ্যান’ এবং ‘আপেল কাহিনী’ এই দুটি কাব্যগ্রন্থ তাঁর পরিণত লেখা এবং উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ হওয়া সত্ত্বেও মাহফুজামঙ্গল কাব্যগ্রন্থের জনপ্রিয়তা এবং পাঠকপ্রিয়তার কাছে চাপা পড়ে গিয়েছে। এ নিয়ে কবির মনে কিছুটা বেদনা থাকলেও তিনি পাঠকের মান্যতাকেই স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়েছেন। কারণ একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের সাড়ে তিন দশকের বেশি সময় পরও কবিতা প্রিয় পাঠক অবাক বিস্ময়ে পাঠ করছেন এবং এবং আলোড়িত হচ্ছেন। এর চেয়ে একজন জীবিত কবির আর কি বড় প্রাপ্তি হতে পারে। এক সাক্ষাৎকারে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল-‘আপনার ‘‘মাহফুজামঙ্গল’’ যে বয়সে প্রকাশিত হয়েছে,নজরুলের ধুমকেতুও মনে হয় ১৯ বছর বয়সে প্রকাশিত হয়নি।কবি মজিদ মাহমুদের কবিতার আলোচনা এলেই কিন্তু ‘মাহফুজামঙ্গল’ সামনে এসে সবকিছুকে ঢেকে দেয়।‘মাহফুজামঙ্গল’ যেহেতু একটা চুড়ান্ত জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে, সেটা জনপ্রিয়তার দিক থেকে,মননধর্মী কবিতার দিক থেকে, খ্যাতির দিক থেকে, সব দিক থেকে এবং এটা কি কোনোভাবে আর বাকি কাব্যগ্রন্থ সম্পর্কে হয়তো মাহফুজামঙ্গলের মত করে বলা যাচ্ছে না, তো সেটা কি একটা একজন কবির ক্ষেত্রে কোন সংকট? নাকি কবি এটাকে তার একটা প্রাপ্তি হিসেবেই দেখেন?এই প্রশ্নের উত্তরে কবি মজিদ মাহমুদ বলেছিলেন- ‘আমার কাছে মনে হয় এটি কবি ব্যাপ্তির জন্য খুবই সংকট এবং আমরা ধারণা ‘মাহফুজামঙ্গল’ এরকম কবিতার বই। আসলে এরকম একটি বইই একজন কবির জন্যে বিড়ম্বনা তৈরি করে বলেই আমার মনে হয়। তার কারণ হলো কবি নিজেও তো তার কবিতাকে অনুভব করতে চায়, উপলব্ধি করতে চায় এবং সে যদি স্বল্পায়ূ হয়, এই লেখার পরে যদি আর না লেখেন, তা হলে কবির জন্য ভালো। কিন্তু কবি যখন একের পর এক, তাকে বা তার সময়কে উদ্বোধন করতে চান ,সেটি আসলে তিনি উপভোগ করতে পারেন না।কবিতার এনজয় বলতে আমারা যেটা বুঝি, সেটা তিনি করতে পারেন না। এমনকি পাঠকরাও প্রচন্ডভাবে বিশৃঙ্খল এবং অস্থির একটা জায়গার মধ্যে দিয়ে প্রবেশ করে। যেমন আমি নিজে মনে করি যে, আমার জন্য সেটা হয়েছে। আমি প্রায়ই আমার নিজের সঙ্গে এবং আমার কবিতা পাঠকদের সঙ্গে, এমন কি আমার বন্ধুদের সঙ্গেও এই সমস্যার মুখোমুখি হই। হয়তো আমার এক বন্ধু বলছেন যে ‘মাহফুজামঙ্গল’ হলো তাদের পড়া সেরা বইয়ের একটি। হয়তো আবার কিছুদিন পর বললো, আমি যদি ‘বল উপাখ্যান’ আগে পড়তাম তাহলে এই কথাটি বলতাম না। আবার কিছুদিন পরে বললেন, ‘আপেল কাহিনী’ পড়ার পরে এই কথাটি বলতাম না, যদি ‘আপেল কাহিনী’ আগে পড়তাম। একজন সৃষ্টিশীল মানুষ, তিনি মনের আনন্দে লেখেন।কিন্তু পাঠকের তো দায় নেই যে, তিনি একজনই লেখকের সমস্ত লেখা সংগ্রহ করবেন, পড়বেন এবং তাকেই বলেতে থাকবেন যে, এইটা এই রকম, এইটা এই রকম।যদিও এটি আমাদের বহুমুখী বিকাশের ক্ষেত্রে সংকট, তবে আমি এই প্রশ্নের উত্তরে এটাই বলতে চাই –আমি ‘মাহফুজামঙ্গল’ লিখে আর তেমন না লিখলেও বা আর তেমন ভালো কবিতা নাও যদি লিখতাম, তাহলে ভালো হতো বেশি। তাহলে মাহফুজাকে সর্বদায় উৎকর্ষে অধিষ্ঠিত করা যেতো।’
মজিদ মাহমুদ লেখেন আইডিয়া-নির্ভর কবিতা। কথা বলেন পরিচিত ভঙ্গিতে। বিশেষ বাগভঙ্গি নয়, চিত্রকল্প বা ধনিব্যঞ্জনাও নয়, তার কবিতার ভাববস্তুই কবিকে চিনিয়ে দেয় পাঠকের কাছে। নিজ ভূগোলের ভাব-পরিমণ্ডলে বাস করে তিনি গ্রহণ করেছেন ভেতর ও বাইরে থেকে সুপ্রচুর। ইসলামি সংস্কৃতির চিহ্ন উদ্ধারে, বিশেষত সিমেটিক সভ্যতার মিথ বিচূর্ণীভবনে তার ঝোঁক লক্ষণীয়। উল্টোমিথ সৃষ্টিতেও সমান আগ্রহ। তাকে যথার্থভাবে চেনা যায় ‘মাহফুজামঙ্গল’ কাব্যে।এই কাব্যগ্রন্থে কবি মজিদ মাহমুদ অসংখ্য স্মরণীয় পঙক্তি লিখেছেন। তার মধ্যে বাছাই করা উল্লেখযোগ্য কিছু পংক্তি পাঠ করলেই পাঠক বুঝতে পারবেন কেন মাহফুজামঙ্গল এত পাঠকপ্রিয়তা লাভ করেছে।কবি ‘মাহফুজামঙ্গল’ কাব্যগ্রন্থে মাহফুজা নামক এক রক্ত মাংসের নারীকে প্রেমিকা হিসাবে উপস্থাপন করেছেন।
‘আমি তো দেখি তোমার সবুজ স্তন, আগুনের খেত
অসম্ভব কারুকাজে বেড়ে ওঠা তাজমহলের খুঁটি
তোমার চুলের অরণ্যে পাই না কল্যাণ এর ঘ্রাণশক্তি…
এমন অযোগ্য কবিকে তুমি সাজা দাও মাহফুজা
যে কেবল খুঁজেছে তোমার নরম মাংস
তবু তোমার স্নেহ আমাকে ঘিরেছে এমন
এই অপরাধে কখনো করোনি সান্নিধ্য ত্যাগ।’ (খবর)
‘আমি জানিনা কি করে মুক্তি পেতে পারি এই ক্লেদাক্ত জীবন
আজ রাতে সৌম্যমান কান্তিমান বৃদ্ধ বলে গেল এসে
তোমাকে জানতে হবে পৃথিবীতে জীবন্ত লোক কিভাবে আসে
সেই ইতিহাসে লেখা আছে তোমার মুক্তির সঠিক কারণ।
ঘুমের মধ্যেই মাহফুজা তুলে নিল হাত, বলল, এখানে
এই বুকের আর নাভির নিচে বেদনায় লেখা স্বপ্নের মানে। (মাহফুজামঙ্গল-১)
‘মাহফুজা আমার বিপরীতে ফিরাইওনা মুখ
যেন কোনদিন বঞ্চিত না হই তোমার রহম
সারাক্ষণ আমাকে ঘিরে থাকে যেন তোমার ক্ষমা
তুমি বিমুখ হলে আমাকে নিক সর্বহারী যম
তাহলেই খুশি হব বেশ তুমি জেনো প্রিয়তমা
তুমি নারাজ হলে বেড়ে যায় আমার অসুখ।’ (মাহফুজামঙ্গল-৩)
কবি মজিদ মাহমুদ তাঁর কবিতায় মিথের বিনির্মাণ করেন। যা পাঠককে চমকিত করে এবং অদ্ভুত এক ঘোরের মধ্যে টেনে নিয়ে যায়।
‘আমাকে সারাক্ষণ ধরে রাখে মাহফুজার মাধ্যাকর্ষ টান
এ ছাড়া সংসার পৃথিবীতে নেই আমার আর কোন বাঁধন
প্রবল স্রোতের মুখে ও আমার মাঝিরা দাঁড় টানে উজান
এ আলেকজান্ডার জানে না মানা শোনে না সম্রাট শাসন।
আমি যেখানেই থাকি না কেন পতিত হই তোমার বুকে
কোন শক্তি নেই তোমার অভিকর্ষ টান থেকে বিচ্ছিন্ন করে…’
(মাহফুজামঙ্গল-৫)
‘তোমার অনাঘ্রাত শরীর আমাকে ডেকেছিলো পৃথিবীর পথে
আমরাই তো প্রথম শুরু করেছিলাম পাহাড় নির্মাণের গল্প
দুর্গম পর্বতের গুহা থেকে কাখের কলসিতে
পানি ঝরিয়ে দিয়েছিলাম তোমার সন্তানের উপর
তবু বহুমাত্রিক সভ্যতা আমাদের দিয়েছে বিচ্ছেদ…’ (গল্প)
‘এবার আমি ফিরে যাচ্ছি মাহফুজা
তোমার সেই সব স্মৃতিময় সম্পদের ভেতর
যার ছায়া ও শূন্যতা আমাকে দিয়েছে অনন্ত বিশ্বাস
একদিন অসংখ্য ছায়াপথ ব্ল্যাকহোল অতিক্রম করে
যেসব ফেরেশতা আমাদের শূন্যতায় ভাসিয়ে দিয়েছিল
এবার আমি ফিরে যাচ্ছি তাদের আলিঙ্গনের ভেতর…’ (ফিরে যাচ্ছি)
আবার মাহফুফা নামের প্রেমকে ইসলামী অনুষঙ্গি যুক্ত করে আধ্যাত্মিকতায় উত্তীর্ণ করেন। যা পাঠককে একই সঙ্গে প্রেম ও আধ্যাত্মিক বোধে জারিত করে।
‘তুমি আছো এরচে বড় প্রমাণ কি হতে পারে ঈশ্বর আছে
মানুষের শিল্প কোনকালে পারে কি বলো এমন নিখুঁত
ঈশ্বরের প্রতিনিধি হয়ে সশরীরে তুমি থাকো কাছে
আমি শুধু তোমার মাহাত্ম্য ভাবি প্রভু কি যে আশ্চর্য অদ্ভুত।(মাহফুজামঙ্গল-৪)
‘তোমাকে পারে না ছুঁতে
আমাদের মধ্যবিত্ত ক্লেদাক্ত জীবন
মাটির পৃথিবী ছেড়ে সাত- তবক আসমান ছুঁয়েছে তোমার কুরসি
তোমার মহিমা আর প্রশংসা গেয়ে
কি করে তুষ্ট করতে পারে এই নাদান প্রেমিক
তবু তোমার নাম অঙ্কিত করেছি আমার তসবির দানা
তোমার স্মরণে লিখেছি নব্য আয়াত
আমি এখন ঘুমে জাগরনে জপি শুধু তোমার নাম।’ (কুর্সিনামা)
‘মাহফুজা তোমার শরীর আমার তসবির দানা
আমি নেড়েচেড়ে দেখি আর আমার এবাদত হয়ে যায়
তুমি ছাড়া আর কোন প্রার্থনাই
আমার শরীর এমন একাগ্রতায় হয় না নত…
তোমার সান্নিধ্যে এলে জেগে ওঠে প্রবল ঈশ্বর
তুমি তখন ঢাল হয়ে তার তীর্যক রোশানি ঠেকাও
তোমার ছোঁয়া পেলে আমার আযাব কমেছে সত্তর গুণ
আমি রোজ মকশো করি তোমার নামের বিশুদ্ধ বানান-’(এবাদত)
তোমাকে জানলে মানুষের নষ্ট হবে আহারে রুচি
করবে না আবাদ বন্ধ্যা জমিন
নিজেরাই পরস্পর মেতে রবে ভ্রুণ হত্যায়
তোমাকে জানলেই কিয়ামত হবে
মানুষের পাপ ছুঁয়ে যাবে হাশরের দিন
তুমি যেন আমার পরে হইও না সদয়
আদরে রেখো না ললাটে হাত
বরং অনাকাঙ্ক্ষিত তিক্ততায় ছুঁড়ে দাও নাগালের ওপার। (তোমাকে জানলেই)
‘মাহফুজামঙ্গল’-একটি স্বতন্ত্র স্বরের মৌলিক কবিতার বই। এই কাব্যগ্রন্থে কবি মজিদ মাহমুদ মাহফুজা নামের এক নারীকে একই সঙ্গে দেবী এবং প্রিয়ার ভূমিকায় উপস্থাপন করেছেন। মজিদ মাহমুদ যখন বলেন : ‘তোমার সান্নিধ্যে এলে জেগে ওঠে প্রবল ঈশ্বর’-তখন প্রেমের শারীরিক কাঠামো ভেঙেচুরে যায়। শরীর ছাপিয়ে অশরীরী ঈশ্বরের প্রবল দাপট পাঠক টের পান। ফলে প্রেম হয়ে ওঠে একই সঙ্গে শারীরিক এবং প্লেটোনিক। এই প্রেম প্লেটোনিক, কেননা ঈশ্বরের সঙ্গে একমাত্র আধ্যাত্মিক প্রেমই সম্ভব। আবার এই প্রেম শারীরিক, কেননা শরীর ছুঁয়ে যে স্পর্শসুখ অনুভূত হয়, তার বর্ণনাও তার কবিতায় অগণিত। দুইটি সাবলীল পঙ্ক্তির মধ্য দিয়ে এই ভালোবাসার দ্বৈতরূপ তিনি রূপায়ণ করেছে।‘মাহফুজা তোমার শরীর আমার তছবির দানা/
আমি নেড়েচেড়ে দেখি আর আমার এবাদত হয়ে যায়।’
শরীর হচ্ছে মাধ্যম। শরীরী প্রেমের মধ্য দিয়ে পৌঁছানো যাবে ঈশ্বরে। মজিদ মাহমুদও তার শারীরিক তথা জাগতিক প্রেমকে একটি মহাজাগতিক পরিণতির দিকে ঠেলে দিয়েছেন। ফলে তাঁর কবিতা একরৈখিক গণ্ডিতে বাঁধা পড়ে নি। বহুরৈখিক মাত্রায় উপনীত হয়েছে। আর তাই মাহফুজা এবং ঈশ্বর একই সত্তায় লীন হয়ে গেছে। ঈশ্বর তথা মাহফুজা তো তারই মানস-দেবতা। আর তাই হয়তো ‘ঈশ্বরকে ডাক দিলে মাহফুজা সামনে এসে দাঁড়ায়’ ।মাহফুজামঙ্গলে মজিদ মাহমুদের প্রেমপ্রবণতা একই সঙ্গে একেশ্বরবাদী এবং পৌত্তলিক ঘরানার। তাঁর প্রেমের কবিতার এটিও একটি বহুমাত্রিক দিক বলে মনে হয়। তাঁর ধ্যানে, জ্ঞানে, কর্ম-পরিকল্পনায় তথা জীবনের সকল স্তরে মাহফুজার একচ্ছত্র অবস্থান। মাহফুজা আছে বলেই অন্য কোনো ‘দেবতা’র অবস্থান পোক্ত হয় নি মজিদ মাহমুদের জীবনসত্তায়। হৃদয়বৃত্তির সকল স্তরেই পলকা হয়ে গেছে অন্য কোনো দেবদেবীর অধিষ্ঠান। আর অত্যন্ত সরলভাবেই তিনি বলেন : ‘মাহফুজা তুমি তো দেবী/ আর আমরা তোমার গোলাম’। আর শেষটায় জুড়ে দেন : ‘পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হোক তোমার শাসন’। অর্থাৎ মাহফুজাকে তিনি তাঁর প্রেমপ্রলুব্ধ হৃদয়ের অধিপতি হিশেবেই দেখতে চান না, তিনি চান মাহফুজার মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হোক এক ঐশ্বরিক শাসন। মাহফুজা ঠিক এই জায়গায় একেশ্বরের প্রতীকী ব্যঞ্জনায় সমাদৃত হয়ে ওঠে মজিদ মাহমুদের প্রেমের দর্শনে। রোমান্টিক ব্যক্তিনিষ্ঠতা ডিঙিয়ে এক বস্তুনিষ্ঠ ক্লাসিক্যাল পরিণতির দিকে তাঁর প্রেম যেন আরও বলিষ্ঠ হয়ে ওঠে। প্রেমের এই উপলব্ধি নতুন এবং স্বতন্ত্র তো বটেই।সুফিবাদে আমরা যেমনটি দেখি- প্রেমের মধ্য দিয়ে ঈশ্বরে বিলীন হবার আকাঙ্ক্ষা। ‘ফানাফিল্লা’র অনন্য জগতে ঈশ্বরের সঙ্গে মিলিত হবার প্রয়াস। কিন্তু প্রেম পরিণতি পেলেই ভক্তিমার্গে উচ্চকিত সেই প্রেম। তারও আগে শুরু হয় মান-অভিমান, বিরহ প্রহর। চলমান হাহাকার সেই প্রেমের বিরহকে প্রজ্বলিত করে দেয়। মজিদ মাহমুদের কবিতাতেও সেসবের প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়-
‘তুমি অক্ষত অমীমাংসিত থেকে যাও শেষে
তখন আমার গগনবিদারী হাহাকার অতৃপ্তিবোধ
আরও হিংস্র আরও আরণ্যক হয়ে
ক্রুদ্ধ আক্রোশে তোমাকে বিদীর্ণ করে
তোমাকে ছিন্নভিন্ন করে
তুমি ছিন্নভিন্ন হয়ে
তুমি ক্ষয়িত ব্যথিত হয়ে
আবার ফিরে আস অখণ্ড তোমাতে
আমার বিপক্ষে অভিযোগ থাকে না তোমার
কারণ তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে পারে না যেতে
আমাদের দাসের জীবন।’ (দাসের জীবন)
‘তুমি চলে যাবে?
তুমি চলে যাও মাহফুজা
কাঙালের মতো আর বাড়াব না হাত
শুধু সাথে করে নিও না যদি
কোনোকালে অজান্তে করে থাকি পাপ।’ (কেন তুমি দুঃখ দিলে)
‘মিলনের শুভদিন কোনোদিন আসবে না আমাদের
অপেক্ষায় কেটে যাবে আহ্নিক গতি
বছর বছর যাবে নতুনের সমাগমে
অবনত রয়ে যাব সনাতন বিষয়ের কাছে
আমার বয়স যদি বেড়ে যায় একশ বছর
সত্তর হাজার কিংবা অনন্তকাল
তুমি তত দূরাস্ত হয়ে যাবে আমার কাছে
কেননা তোমার গতি সমদূরবর্তী সমান্তরাল লাইনের মতো।’ (শুভদিন)
এই গ্রন্থভুক্ত ‘মঙ্গলকাব্য’ অংশে ভক্তিমার্গ যেন উচ্চকিত হয়ে উঠেছে :
‘যেন কোনো দিন প্রবঞ্চিত না হই তোমার ওম
সারাক্ষণ ঘিরে থাকে আমাকে যেন তোমার ক্ষমা।’ (তিন)
‘এমন অভিকর্ষের কথা নিউটন শোনেন নি কোনোদিন
আমার তো জানা নেই কিভাবে শোধ হবে মাহফুজার ঋণ।’ (চার)
‘মাহফুজা আমার জীবন আমার জবান তুমি
করেছ খরিদ, তাই তোমার গোলাম আমি
তোমার হুকুমের বিরুদ্ধে কেউ পারবে না আমার
স্বাতন্ত্র্য ছুঁতে, আমার ধ্বনি, আমার কবিতা, আর
আমার সন্তান, সব সম্পদ তোমারই নামে।’ (পাঁচ)
‘আমার মতো হয়তো শত কোটি মানুষের প্রণাম
তোমার পায়ে আসলে শুভক্ষণে পেতে পারি ক্ষমা।’ (ছয়)
মাহফুজামঙ্গল-এ মজিদ মাহমুদের একেশ্বরবাদী প্রবণতা একমাত্রিক নয়, বহুমাত্রিক। এর বাইরেও তার প্রেমের একটা পৌত্তলিক ঘরাণা আছে। সেখানে মাহফুজা একই সঙ্গে দেবী এবং মানবী। মাহফুজামঙ্গল-এ মাহফুজা একটি রূপক বা প্রতীকের ব্যঞ্জনায় প্রতিষ্ঠিত বলে কোনো কালসীমানায় আটকে নেই। বিশেষত আমাদের ঐতিহ্যগত মিথের ব্যবহারে অতীতকে সমসাময়িকতায় এবং সমসাময়িকতাকে অতীতের মূল্যায়নে লীন করে দিয়েছেন মজিদ মাহমুদ। তাঁর কবিতা-ভাষায় বোধগম্য কিন্তু ভাবে গভীর। ফলে কোনো আরোপিত টেকনিকের দ্বারস্থ হতে হয়নি তাঁকে।সাধারণ মানুষের মুখের ভাষায় একটি স্বতঃস্ফূর্ত সংবেদনশীলতা থাকে।আরো থাকে দার্শনিক ঋদ্ধতা। বাংলাদেশের মানুষের আটপৌরে মুখের ভাষাকে কবিতায় ব্যবহারের মধ্য দিয়ে মজিদ মাহমুদ সেই দার্শনিক ঋদ্ধতাকে নতুন করে যাচাই করেছেন। ভাষার সেই ব্যবহার সরল কিন্তু সিদ্ধ। সেই ভাষাকে তিনি কোনো বিশেষ ছাঁচে ফেলে পরিশীলনের চেষ্টা করেননি। এই ক্ষেত্রে তাঁর সাহস এবং পারঙ্গমতা আশির কবিতার মৌলধারার দিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। তাঁর শক্তিই প্রমাণ করেছে, তিনি স্বতন্ত্র এবং নিজের জায়গায় মৌলিক। সাড়ে তিন দশকের বেশি সময় পরেও ‘মাহফুজামঙ্গল’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলিতে পাঠ করলে পাঠকের মনে হয়, এই কবিতাগুলি কবি মজিদ মাহমুদের নতুন লেখা কোনো আধুনিক কবিতা। এই কারণেই এই কাব্যগ্রন্থের কবিতা গুলির পাঠকীয়তা আজও ক্রমবর্ধমান।‘মাহফুজামঙ্গল’ কাব্যগ্রন্থের কবিতার ভিন্ন স্বরের মৌলিকতাই এই কাব্যগ্রন্থকে মহৎ কাব্যগ্রন্থে পরিণত করেছে।
………..
লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক, দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য পাতার সম্পাদক এবং অধ্যাপক।
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।