তাজ ইসলাম
২৬ অক্টোবর শনিবার ২০২৪ গিয়েছিলাম ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক আয়োজিত ইসলামী বইমেলায়। তার আগে বিকেলে ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটে ইরান কালচারাল সেন্টার ও জাতীয় কবিতা মঞ্চের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত ‘পোয়েট্রি ফর ফিলিস্তিন কনফারেন্সে ছিলাম সন্ধ্যা পর্যন্ত। এ অনুষ্ঠানে মফস্বল ও রাজধানী মিলে হল ভর্তি কবি লেখকদের উপস্থিতি ছিল। অনুষ্ঠানের অব্যবস্থাপনা ছিল চোখে পড়ার মতো।বহিঃরাষ্ট্রের সাথে কোন অনুষ্ঠান’র অর্থ হল নিজের দেশকে অন্য দেশে প্রেজেন্ট করা। এ ক্ষেত্রে আয়োজকদের থাকতে হয় শৃঙ্খলার প্রতি খুবই কড়া নজর। বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি আয়োজকদের ব্যর্থ করে হাজির করে,দেশের সুনাম ক্ষুণ্ন হয়। পূর্ব নির্দেশিত নীতি মেনে চললেই অনুষ্ঠানের সৌন্দর্য রক্ষা হয়। শেষের দিকে কবি লেখকদের ফটোসেশানের জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়া অনুষ্ঠানকে একেবারে হ য ব র ল করে ফেলে। এওয়ার্ড প্রদানে তীব্র বিশৃঙ্খলা স্কুল ছুটির পর কচিকাঁচাদের হাউকাউয়ের দৃশ্য স্মরণ করিয়ে দেয়। অনুষ্ঠানে প্রবেশ করেই মন ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। ৫ আগস্ট বাংলাদেশের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য দিন। এই দিনের কথা ঢোল পিটিয়ে বলতে হবে না। আগস্টের ইতিহাস অতীত হয়নি।বর্তমানের ঘটনা। অনুষ্ঠানটি ফিলিস্তিনিদের স্মরণে।ফিলিস্তিনের কথা বললেই সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে ইসরাইলের কথা। ইসরাইলের বর্বরতার পরিণতি আজকের ফিলিস্তিন। ৫ আগস্টের দুপুর ২ টার আগে এদেশকে,এই রাজধানীকে ফিলিস্তিন করে তুলেছিল শেখ হাসিনার সরকার ও তার দল। হাসিনা সমর্থক,অনুসারীরা বাংলাদেশীদের সামনে আবির্ভূত হয়েছিল বাংলাদেশী ইসরাইল হিসেবে।মঞ্চে বাংলাদেশের ইসরাইল বা তার সহচরকে অতিথি বা বিশেষ অতিথির চেয়ারে দেখে মন বিক্ষুব্ধ হয়ে গেল। যে লোক ছড়াকারের চেয়ে তার মশহুর পরিচয় আওয়ামীলীগের নির্লজ্জ দালাল। রক্তের দাগ তার চেতনা জুড়ে। তার অবস্থান স্পষ্ট। খুনির এমন একজন সমর্থক এমন অনুষ্ঠানে বেমানান। ধৈর্য্য ধরে বসে রইলাম। শেষের পণ্ডপরিস্থিতি দেখে চলে আসলাম। আগেই সিদ্ধান্ত ছিল ইসলামী বইমেলায় যাব। হয়তো কাউকে সাথে করে নিয়ে যেতাম। অনুষ্ঠানের অব্যবস্থাপনা, স্বৈরাচারের দোসরের উপস্থিতি মনের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। কাউকে কিছু বলার মন ছিল না, কিছু না বলে একাই চলে গেলাম বায়তুল মোকাররম।
বায়তুল মোকাররম উত্তর গেট। ব্যস্ত জায়গা, পরিচিত অঙ্গন।বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটের তুলনায় উত্তর গেট অধিক গুরুত্বপূর্ণ। এ গেটেই জনগণের পদচারণা বেশি। এখানে গিয়ে মেলার কোন চিহ্ন পাওয়া যায়নি। নবাগত কেউ,যে ইতোপূর্বে ইসলামী বইমেলায় যায়নি তার জন্য ভীমড়ি খাওয়ার অবস্থা। অংশগ্রহণকারী স্টল মালিকেরা ইচ্ছে করলে বড় আকারে এক দুটো ব্যানার করে নির্দেশ চিহ্ন টানিয়ে রাখতে পারতেন। তীর চিহ্ন নির্দেশ করতো সামনে যান,ডানে মেলা।আয়োজক প্রতিষ্ঠানদের জন্যই এটি ছিল উত্তম।এটি না দেওয়াতে কোন আগন্তক ওখান থেকে ফিরে আসবে না,খুঁজে বের করতে পারবে।দিলে পথচারীদের চোখেও একটি বিজ্ঞাপন হয়ে যেত।
মেলাটি হতে পারতো উত্তর পূর্ব জুড়ে।এতে মেলা জনচোখে পড়তো বেশি। পূর্ব দক্ষিণে হওয়ায় সর্বসাধারণের চোখের অগোচরেই রয়ে গেছে। পূর্ব পাশের মেলা মসজিদের উপরে হওয়ায় নারী দর্শনার্থীরা ইজি ফিল করেনি। পূর্ব দিকের দর্শানার্থী মসজিদ পার হয়ে পূর্ব পাশে যেতে হয়। অতি উৎসাহী ছাড়া কেউ পূর্ব থেকে দক্ষিণে যাবে না। অনেকে জানবেও না।
বিগত দিনের মেলা থেকে এবারের মেলার অংশগ্রহণকারীরা নির্ভার ও নির্ভয় মনে হচ্ছে। উপস্থিতি অন্যবারের তুলনায় অধিক ও স্বতঃস্ফূর্ত। তবে উপস্থিতিদের প্রায় সবাই মাদ্রাসা সংশ্লিষ্ট।
ইসলামী বইমেলায় অংশগ্রহণকারী স্টলগুলোর
সবই ইসলামী দল ও প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট। মোটাদাগে কওমি আলেম ও ছাত্রদের প্রাধান্য। জামায়াত ই ইসলামী,ইসলামী ছাত্র শিবির,ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন ও তাদের ছাত্র সংগঠনের নেতা কর্মীদের তৎপরতায় মেলা প্রাঙ্গণ সরব। ইসলামী বইমেলা আলেম ওলামা,ইসলামী প্রতিষ্ঠানের লোকজনের উপস্থিতি বেশি। স্টলগুলোও ঐ ধরণের জনশক্তিরই বলা যায়। সেখানে পরিবেশিত কিতাবাদির অধিকাংশই ধর্মীয়।সাহিত্যের যেসব কিতাবাদি আছে তার লেখককুলও নির্দিষ্ট ঘরানার।ফলত মূলধারার সাহিত্য রচনা করলেও ঘরানা দোষে দুষ্ট। প্রথমত তারা ইসলামী বইমেলা বলে সর্বসাধারণ থেকে নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছে। তারপর ইসলামী সাহিত্য বলে সাহিত্যিক হিসেবে নিজেদেরকে আরও একধাপ দূরে সরিয়ে নিয়েছে। তারা যুক্তি দেয় অমর একুশে বইমেলায় ইসলামী ভাবধারার প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্টল না দেওয়ার বিকল্প হিসেবে এই মেলার যাত্রা শুরু।
শ্রেণী পৃথক না করে স্রেফ একটি পৃথক মেলাও তারা প্রবর্তন করতে পারতো।এতে সর্বস্তরের ইচ্ছুকরা অংশ গ্রহণ করতে পারতো,যার উদ্যোক্তার শক্তি থাকতেন তারা। ইসলামী বইমেলা একটি পক্ষের মেলা হওয়ায় এতে উপস্থিতি ও জমজমাটের আলো থেকে দূরে। আমরা এ নিয়ে কয়েকজনের সাথে কথা বলেছি।
আমরা প্রশ্ন করি একজন কবিকে। তিনি বলেন ইসলামী বইমেলা তাকে টানেনি। একপেশে মনে হয়। তিনি ঢাকায় আছেন ৭/৮ বছর।কোথায় হয় তাও তিনি সঠিক বলতে পারেনি।
অন্যজন বলেন, তিনি এবার মেলায় বউ বাচ্চাসহ গিয়েছিলেন।তার স্ত্রী মসজিদের দোতলায় মেলা হওয়াতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করেননি।হুজুরদের উপস্থিতিও তাকে ইতস্ত করে।তিনি ধার্মীক। হুজুরদের হেয় অর্থে বলেননি।সম্মানের সাথেই তাদের উপস্থিতিতে মেলায় ঘোরাঘুরির আনন্দে অনীহা।
তার মতে মেলার ইসলামী নামকরণে আলাদা না করে সর্বজনীন করলে মেলা ও স্টল মালিকদের লাভ বেশি হত।লেখকদেরও উপকার হতো। তবে তিনি এবারের মেলায় স্টলের ডেকোরেশনের প্রশংসা করেন।পরিচ্ছন্ন পরিবেশ,গোছানো স্টল, আধুনিকায়নে গতবারের তুলনায় এবার এগিয়ে।পটপরিবর্তনে আগত দর্শক ও অংশগ্রহণকারীদের মাঝে আনন্দঘন পরিবেশ। সোশ্যাল মিডিয়ায় একজন পোস্ট করেছেন,
‘ইসলামী বই মেলা নিয়ে আপনাদের আগ্রহ এত কম কেন? এই মেলাটা ফেব্রুয়ারি মাসেরটার মত জমজমাট হচ্ছে না কেন?
এ বই মেলায় নানা রঙের শাড়ী চুড়ি পরে ও খোঁপায় ফুল লাগিয়ে মেকাপ করা সুন্দরীরা আসে না বলে? ‘
বিভিন্নজন বিভিন্ন রকমের কমেন্ট করেছেন।আমরা কথাশিল্পী নাসীমুল বারীর কমেন্টটি এখানে উদ্ধৃত করলাম। তিনি বলেন:
‘হবে না। কারণ এখানে এক ধারার বইয়ের সমাহার। শুধুই ধর্মীয় আবহের বই। আর একুশের বইমেলায় থাকে সাহিত্যের সব ধারার বই।
স্বাভাবিক কারণেই এটা একপেশে বইমেলা। উপস্থিতি হবে একপেশে সংখ্যক মানুষের।
বরং শুকরিয়া আদায় করুন বিগত বছরগুলোর তুলনা এবার অনেক অনেক বেশি জমজমাট।
আর শেষ অংশে যে যুক্তিটা দিয়েছেন সেটা ছোট চিন্তার প্রতিহিংসামূলক যুক্তি। এসব না দেওয়াই ভালো।’
মেলায় অনেকগুলো লিটলম্যাগ দেখতে পাওয়া যায়।লিটলম্যাগের নামকরণেও ইসলামী ঐতিহ্যের ছোঁয়া আছে। ইসলামী বইমেলা সকলের হোক।গণ্ডি থেকে বেরিয়ে সর্বজনীন হোক এই আকাঙ্খা সুহৃদ সুজনের।মেলায় যান, বই কিনুন।