আরিফ রহমান
…….
মজার ব্যাপার কি, বাংলাদেশে আম্লিগের লোকজন গণহত্যা নিয়ে চেতনার অনেক কথা বলে কিন্তু নিজেরাই যে একটা বিরাট ন্যারেটিভ তৈয়ার করে, ধাপে ধাপে সমাজে বৈধতা সৃষ্টি করে নিজের দেশের মানুষের উপরের নির্মম এক গণহত্যা চালাইসে, এখন তার হাতেই যে রক্ত- সেটা ঘটে যাওয়ার পরেও বুঝতে পারতেসে না।
এই ২০২৩ সালে নতসি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে সিকিউরিটি গার্ডের কাজ করার অপরাধে এক শতবর্ষী লোকের পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হইসে। প্রতি বছরেই এরকম শতবর্ষী সোলজার, গার্ড, টেকনিশিয়ানদের বিচার হয়।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার যুদ্ধাপরাধের বিচারের এঙ্গেল যদি দেখেন আপনারা ভিমরি খাবেন। শিল্পপতি, সাহিত্যিক, কবি, কলামিস্ট, এলাকার মেম্বার, পাতি মাস্তান, রেডিও এংকর, মুদির দোকানদার, পুলিশের বড় কর্তা, ছোট কর্তা, মন্ত্রী, জেনারেল কেউই ছাড় পায় নাই।
কেউ যদি লিটারেচার তৈরি করে বৈধতা নির্মাণ করে থাকে তারও সাজা হইসে কেউ যদি পাশের বাড়ির নিরীহ লোকটারে ক্যারেক্টার এসাসিন কইরা নতসি-ছাত্রলীগের কাছে বিষ দিছে তারও সাজা হইসে।
এরপরে তো আছে জেনসাইড ডিনায়াল। হিটলার অপরাধ করে নাই এই কথা কইলে এখনো ৩১ দেশে জেল-জরিমানার বিধান আছে।
এই যে ছাত্রলীগ আর আওয়ামী সিম্পেথাইজারদের উগলে উগলে হাসিনা পিরিত, হাসিনা কিছু করে নাই বলা, ছাত্র-জনতাকে সন্ত্রাসী বলা- এইসবই মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ।
আপনারা এই দেশের জন্য অনেক করছেন ভাই সকল, শহীদ ছাত্রদের রক্ত নিয়ে সকাল-বিকাল রসিকতা কইরা নিজেদের হাতে আর রক্তের দাগ নিয়েন না।
২.
একাত্তরে ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার বাঙালি নারীদের চিকিৎসা দেয়ার জন্য অস্ট্রেলিয়া থেকে নিয়ে আসা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক জিওফ্রে ডেভিস একবার কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে আটক এক পাকিস্তানি আর্মি অফিসারকে প্রশ্ন করেছিলেন- তারা তো সৈনিক, কোন খুনি, রেপিস্ট বা ডাকাত না, তাহলে তারা কেন বাঙালি নারীদের ওপর এমন নিপীড়ন চালালো?
অষ্ট্রেলিয় চিকিৎসক বিচলিত হলেও সেই পাকিস্তানি সেনা অফিসারকে একটুও বিচলিত হতে দেখা যায়নি। তার সরল জবাব ছিলো-
“আমাদের কাছে টিক্কা খানের নির্দেশনা ছিলো- একজন ভালো মুসলমান কখনোই তার বাবার সাথে যুদ্ধ করবে না। তাই আমাদের যত বেশী সম্ভব বাঙালী মেয়েদের গর্ভবতী করে যেতে হবে।”
সেই দিনের তিপান্ন বছর পর বাংলাদেশে শেখ হাসিনার নির্দেশে এক হাজার ছাত্র-জনতাকে হত্যা করে ফেলা আর ১০ হাজার মানুষকে ভয়াবহ নির্যাতন করার পরেও এই দেশের আওয়ামী লীগ, ছাত্র লীগ, সুশীল সমাজ আর পুরাতন ন্যারেটিভের বুদ্ধিজীবীদের মনে এই ঘটনা বিন্দুমাত্র মানবিক রেখাপাত করতে পারেনি।
তথ্য মন্ত্রী আরাফাত শহীদ আবু সাইদকে বলেছেন ড্রাগ এডিক্ট, বিসিএস ক্যাডার ঊর্মি বলেছেন জঙ্গি। পুলিশ অফিসার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ভিডিও দেখিয়ে বলেছেন একটারে মারলে দশটা আসে সেটাই মূল সমস্যা। ওনার কাছে মনে হয় নাই তারা যে মানুষ মারছে সেটাও একটা সমস্যা।
ইভেন এখন দেখেন প্রতিটা বুদ্ধিজীবী ছোট ছোট ছাত্রদের কথা টুইস্ট করে কিভাবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করবেন সেই চেষ্টাতেই সবচেয়ে বেশি সময় দিচ্ছেন।
আমরাও অষ্ট্রেলীয় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক জিওফ্রে ডেভিসের মতো করে ভাবছি এই ছাত্রলীগ, এই সুশীল সমাজ- এরাও তো কারো বাবা, কারো ভাই, কারো মা।
তাহলে তারা কিভাবে এই নিপীড়নকে বৈধতা দিয়ে যাচ্ছে?
কেন তাদের অনুশোচনা হয় না?
১৯৭১ আর ২০২৪ তিপান্ন বছরের ব্যবধানেও এই দুই ক্ষেত্রেই জবাব একই। উগ্র জাতীয়তাবাদ।
উগ্র জাতীয়তাবাদ আপনাকে অন্ধ করে দেবে। আপনার মতের সাথে একমত না হলেই তাকে আদারায়ন করবে, অপর করবে। অপরের নির্মূল আপনার মনে শান্তি দেবে।
বাঙালি নারীকে ধর্ষণ করার সময় পাকি অফিসারের মনে নিজের কন্যার ছবি আসবে না। খুনি আসাদুজ্জামান খান কামাল ভ্যান ভরা লাশ দেখে একবারও নিজের মেয়ে বা ছেলের কথা ভাববেন না। শেখ হাসিনা শোয়া দু’শ খুন করে নিজের কোটা পূরণ করতে বদ্ধ পরিকর হয়ে ওঠেন।
যুগে যুগে উগ্রবাদ পাকিস্তান হয়ে, জঙ্গি হয়ে, আওয়ামী লীগ হয়ে ফিরে ফিরে এসে আমাদের নির্মূল করেছে কিন্তু আমরা উগ্র জাতীয়তাবাদ থেকে বের হইতে পারি নাই। আমরা কেবল নিজের মতের বাইরের মানুষটাকে অপর করে গেছি।
৩.
“ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের ভেসে থাকা কিছু অংশ রোমন্থন করা যাক!”
২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ছাত্রলীগের হামলায় কমপক্ষে ৩৩ জন নিহত এবং ১৫০০ জন গুরুতর আহত হন। এরপর ২০১৪ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ছাত্রলীগের সহিংসতায় ১২৯ জন নিহত হন। এর মধ্যে ২০১৭ সালে ৩১ জনের প্রাণহানি ঘটে। এই সময়ে ছাত্রলীগ নিজেদের মধ্যে ৫০০টি সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, যার ফলে নিজেদের কর্মীদের মধ্যেও ৫৫ জন নিহত হন।
প্রকাশ্যে মানুষ হত্যার কিছু নজির
ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ প্রকাশ্য দিনের আলোতে পিটিয়ে মানুষ হত্যা করা। নিচে কিছু ঘটনার কথা উল্লেখ করছি:
আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড (২০১৯)
বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদকে শিবিরের সাথে সম্পৃক্ততার সন্দেহে ছাত্রলীগের কর্মীরা জিজ্ঞাসাবাদ করে, এবং পরে তাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। আবরারের মৃত্যুর ঘটনায় দেশব্যাপী তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
বিশ্বজিৎ দাস হত্যাকাণ্ড (২০১২)
বিশ্বজিৎ দাস ছিলেন একজন সাধারণ দর্জি, যাকে ঢাকায় বিরোধীদলের সমর্থক সন্দেহে ছাত্রলীগের কর্মীরা নির্মমভাবে হত্যা করে। বিশ্বজিৎকে ধাওয়া করে ছুরি, লোহার রড এবং হকি স্টিক দিয়ে আক্রমণ করা হয়। এই নির্মম হত্যাকাণ্ড সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করে।
নাহিদ হোসেন হত্যাকাণ্ড (২০২২)
ঢাকার নিউ মার্কেট এলাকায় দোকানদারদের সাথে সংঘর্ষের সময় ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের কর্মীরা দরিদ্র ডেলিভারি ম্যান নাহিদ হোসেনকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করে। ঘটনাস্থলে নাহিদকে রক্তাক্ত অবস্থায় ফেলে রাখা হয়। এই ঘটনা দেশের মানুষকে গভীরভাবে মর্মাহত করে।
জুবায়ের হত্যাকাণ্ড (২০১২)
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র জুবায়ের আহমেদকে ছাত্রলীগের আভ্যন্তরীণ সংঘর্ষের ফলে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডের ফলে ছাত্রলীগের পাঁচজনকে মৃত্যুদণ্ড এবং দুইজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
সাদ ইবনে মমতাজ হত্যাকাণ্ড (২০১৪)
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সাদ ইবনে মমতাজকে ছাত্রলীগের কর্মীরা নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করে। তাকে কয়েক ঘণ্টা ধরে কার্পেট দিয়ে মোড়িয়ে, লোহার রড, লাঠি এবং হকিস্টিক দিয়ে অত্যাচার করা হয়। মারাত্মকভাবে আহত হয়ে সাদ মারা যান। এই ঘটনায় সাধারণ শিক্ষার্থীরা ব্যাপক বিক্ষোভ করে এবং ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে।
ধর্ষণ ও নারীর প্রতি সহিংসতা
ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ধর্ষণ এবং যৌন সহিংসতার বহু অভিযোগ রয়েছে। কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা নিম্নরূপ:
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণ উৎসব (১৯৯৮)
১৯৯৮ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা একাধিক ছাত্রীকে ধর্ষণ করে এবং ধর্ষণের পর “শতধর্ষণ” (সেঞ্চুরি ধর্ষণ) নামে একটি উৎসব পালন করে। এই ঘটনাটি ব্যাপক আন্দোলনের জন্ম দেয় এবং ছাত্রলীগের নেতারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পলায়ন করে।
পহেলা বৈশাখে নারী হয়রানি (২০১৫)
২০১৫ সালে ঢাকার টিএসসিতে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের সময় ছাত্রলীগের কিছু কর্মী নারীদের উপর যৌন হয়রানি চালায়। পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী উপস্থিত থাকলেও তারা ঘটনাটির কোনো প্রতিরোধ করেনি। এই ঘটনার পরে দেশব্যাপী ক্ষোভের সৃষ্টি হয় এবং ছাত্রলীগের কার্যকলাপ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়।
ইবিতে ফুলপরী খাতুন নির্যাতন (২০২৩)
২০২৩ সালে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেত্রী সানজিদা চৌধুরী ফুলপরী খাতুনকে শারীরিক ও যৌন নির্যাতন করে। ফুলপরীকে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করা হয় এবং ময়লা গ্লাস চাটানোসহ নানা ধরনের মানসিক অত্যাচার করা হয়। এই ঘটনা জাতীয় মানবাধিকার কমিশন কর্তৃক “বর্বর ও কুরুচিপূর্ণ” আখ্যা পায় এবং সারা দেশে নিন্দা জাগায়।
মুরারিচাঁদ কলেজ ধর্ষণ (২০২০)
সিলেটের মুরারিচাঁদ কলেজে এক গৃহবধূকে ছাত্রলীগের কর্মীরা ধর্ষণ করে। গৃহবধূর স্বামীকে আটকে রেখে ছাত্রলীগের নেতারা তাকে ধর্ষণ করে।
কক্সবাজার পর্যটক ধর্ষণ (২০২০)
কক্সবাজারে একটি পর্যটক নারীকে তার পরিবারের সামনে ছাত্রলীগের কর্মীরা ধর্ষণ করে। এই ঘটনায় তিনজন ছাত্রলীগ কর্মী জড়িত ছিল এবং তারা পর্যটক পরিবারকে ভয় দেখিয়ে তাদের জিম্মি করে রেখে নারীকে ধর্ষণ করে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণ চেষ্টা
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে উলঙ্গ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসের সামনে থেকে ছাত্রলীগের গুন্ডা তাকে তুলে নিয়ে ধর্ষণের চেষ্টা চালায়। পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদন্তে দেখা যায়, অভিযুক্ত পাঁচজনই শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী রেজাউল হকের কর্মী। রেজাউল হক ওই ছাত্রীকে অভিযোগ দায়ের করতে বাধা দেন।
ইডেন কলেজে যৌন শোষণ (২০২২)
২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ইডেন মহিলা কলেজে ছাত্রলীগের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে মহিলা ছাত্রীদের যৌন শোষণের অভিযোগ মিডিয়াতে উঠে আসে। ইডেন কলেজের ছাত্রলীগ নেতাদের একাংশ দাবি করেছেন যে সংগঠনের ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের আশীর্বাদপ্রাপ্ত ইউনিটের সভাপতি তরুণ ছাত্রদের তাদের আপোষমূলক ছবি এবং ভিডিও দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে ‘দলের পুরুষ নেতা ও উচ্চপদস্থদের কাছে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের জন্য’।
সহিংসতা ও নির্যাতন
হত্যা-ধর্ষণ ছাড়াও ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে আছে নির্মম নির্যাতনের অভিযোগ:
এহসান রফিক নির্যাতন
২০১৮ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি রাতে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে ধার দেওয়া ক্যালকুলেটর ফেরত চাওয়ায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মী দ্বারা নির্যাতিত শিকার হন এহসান রফিক। এতে তার চোখের কর্ণিয়া মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হল সহসভাপতি আরিফুল ইসলাম তাকে নিয়ে ছাত্রলীগের কিছু ছাত্ররা মিলে তাকে দেড় ঘন্টা নির্যাতন করে হল থেকে বের করে দেন। পরে ওমর ফারুকের নেতৃত্বে আবারও তাকে মারধর করা হয়। এতে তার একটি চোখ মারাত্মক জখম হয় এবং কপাল ও নাক ফেটে রক্ত বের হয়ে যায়।
মাহাদি জে আকিব নির্যাতন
২০২১ সালের অক্টোবর মাসে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মাহাদি জে আকিবকে প্রধান ফটকের সামনে পিটিয়ে গুরুতরভাবে আহত করা হয়। কাঁচের বোতল, ছুরি, রড, ক্ষুর, ক্রিকেটের স্ট্যাম্প প্রভৃতি দিয়ে তার উপর আক্রমণ করা হয়। ক্ষুর দিয়ে তার মাথা থেঁতলে দেওয়া হয়, এতে মাথার হাড় ভেঙ্গে যায় এবং মস্তিষ্কে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। তার মাথা ফেটে যাওয়া খুলির একটি অংশ আলাদা করে পেটের চামড়ার নিচে রাখা হয়। মাথা পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে মাথায় একাধিক অস্ত্রোপচার করাতে হয়।
কুয়েটে জাহিদুর নির্যাতন
২০২২ সালে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জাহিদুর রহমানকে ছাত্রশবির সন্দেহে নির্যাতন করা হয়।১০-১২ জন মিলে তাকে পাইপ দিয়ে পাগলের মত পেটাতে থাকে। শব্দ যেন বাইরে না যায় এইজন্য রুমে সাউন্ড বক্সে উচ্চস্বরে গান বাজানো হয়। তাকে কিল, লাথি, চড়, ঘুষি মারতে থাকে, এক পর্যায়ে অবস্থা গুরুতর হলে তাকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
ঢামেকে শিক্ষার্থী নির্যাতন
২০২১ সালের জানুয়ারিতে ঢাকা মেডিকেল কলেজের শহীদ ডা. ফজলে রাব্বি হলে ইন্টার্ন চিকিৎসক এএসএম আলী ইমাম শীতলকে তার কোমর থেকে পা পর্যন্ত রড দিয়ে পিটিয়ে রক্তাক্ত করাসহ হাঁটুর নিচের হাড় ভেঙে দেয়া হয়।মাথায় আঘাতের ফলে বমি শুরু হলে তাকে বের করে দেওয়া হয়। এর সঙ্গে কলেজ ছাত্রলীগ এবং ইন্টার্ন চিকিৎসক পরিষদের নেতারা জড়িত। শীতল নিজেও ঢামেক ছাত্রলীগের সাবেক উপদপ্তর সম্পাদক ছিলো।
নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে হামলা (২০১৮)
নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় ছাত্রলীগের কর্মীরা আন্দোলনকারীদের উপর হামলা চালায়। এছাড়াও সাংবাদিকদের আক্রমণ করা হয়, যা সারা দেশে তীব্র সমালোচনার জন্ম দেয়।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে হামলা (২০১৮)
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে হওয়া আন্দোলনের সময় ছাত্রলীগ আন্দোলনকারীদের উপর হামলা চালায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কর্মীরা আন্দোলনকারীদের লাঠিসোঁটা ও আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে আক্রমণ করে।
২০২৪ আন্দোলনে হামলা ও মানুষ হত্যা
এই আন্দোলনে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে শিক্ষার্থী ও আন্দোলনকারীদের উপর রড, লাঠি, হকিস্টিক, রামদা, আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলা করা হয়। ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে হামলা করে ছাত্রলীগ। এতে শতাধিক ছাত্রের আহত হওয়ার ঘটনা ঘটে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা ছাত্রলীগের হামলার ভয়ে উপাচার্যের বাসভবনের ভেতরে আশ্রয় নেন। সেখানেও ছাত্রলীগ ঢুকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মারধর করে।
কোটা আন্দোলনকারীরা টাঙ্গাইল পৌরসভার সামনে থেকে মিছিল নিয়ে শহীদ মিনারের কাছে পৌঁছালে ছাত্রলীগ লাঠি ও লোহার রড নিয়ে তাদের ওপর হামলা করে। ১৫ জুলাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার দুইজন কোটাবিরোধী বিক্ষোভকারীর মৃত্যু দাবি করে ছাত্রলীগের বিক্ষোভকারীদের উপর হামলার নিন্দা করেন। বিশেষজ্ঞরা শেখ হাসিনার পতনের জন্য ছাত্রলীগের নির্যাতনকে একটি কারণ হিসাবে চিহ্নিত করেছে।
সাংবাদিকদের উপর হামলা
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস এর ২০২০ কান্ট্রি রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে যে ২০২০ ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের সময়, ছাত্রলীগের গুন্ডারা নির্বাচনের সময় ব্যাপক কারচুপি কভার করার চেষ্টা করার সময় কমপক্ষে ১০ জন সাংবাদিককে নির্মমভাবে আক্রমণ করে এবং মারধর করে।
মোদী বিরোধী বিক্ষোভে হামলা
২০২১-এ বাংলাদেশে মোদী-বিরোধী বিক্ষোভে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ শাখার নেতা সঞ্জিত চন্দ্র দাস বিক্ষোভকারীদের “চামড়া তুলে নেওয়া হবে” বলে ঘোষণা করেন যদি তারা ২০২১ সালের মার্চ মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে।
সাম্প্রদায়িক সহিংসতা
২০২১ সালের বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সহিংসতা চাঁদপুর ও রংপুরে অন্তত দুটি জেলায় বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর সমন্বিত হামলায় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া যায়। রংপুরে কারমাইকেল কলেজের দর্শন বিভাগ ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সৈকত মন্ডল, যার সাথে স্থানীয় এক হিন্দু যুবক পরিতোষ সরকারের ব্যক্তিগত বিরোধ ছিল, স্থানীয় একটি মসজিদের ইমামের সাথে যোগসাজশ করে স্থানীয় মুসলিম জনগণকে উসকানি দেয়। এই ছাত্রলীগের কর্মীর উসকানিতে ওই এলাকার হিন্দু গ্রামে হামলা চালায় স্থানীয় বিক্ষুব্ধ জনতা।
চাঁদপুরে, দুই ছাত্রলীগ কর্মী কথিত মিথ্যা “কুরআনের অবমাননা” এর প্রতিবাদে বিক্ষোভ শুরু করে যা স্থানীয় মন্দির ও প্যান্ডেলে হামলার দিকে পরিচালিত করে।
এসব ঘটনা কেবলই বরফের ভেসে থাকা অংশ। বাংলাদেশের প্রতিটি প্রান্তে পঞ্চাশ বছর ধরে ত্রাস-সন্ত্রাস সৃষ্টি করে যাচ্ছে এই সংগঠনটি।