আবু তাহের সরফরাজ
যে মানুষের কল্পনার বিস্তৃতি যত বেশি সেই মানুষের চিন্তার পরিসর তত বেশি। কবিদের বেলায় বিষয়টি পুরোপুরি সত্যি। কবির কল্পনাজুড়ে থাকে তার অতলান্তিক অনুভূতির বুদবুদ। যাকে আমরা কবিত্ব বলি সেটা আসলে কবির কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে সেই কল্পনা হতে হয় সুসংহত, এলোমেলো নয়। নদীর মাছকে গাছের ডালে ঝুলিয়ে গাছের ফলকে জলজ কল্পনা কোনো যৌক্তিক কল্পনা নয়। এটা পাগলের কল্পনা হতে পারে। ফলে আমরা দেখি যে, অনেক কবিই তাদের কবিতায় আগামাথা ছাড়া কল্পনার চিত্র এঁকে কবিতাকে হাস্যকর করে তোলেন। কল্পনাকে অনুভূতির বিবিচিত্র রঙে রাঙিয়ে তোলার মতো সৃজনীশক্তি তাদের থাকে না। এরা মূলত নামধারী কবি, মৌলিক কবি নয়। মৌলিক কবিদের কল্পনা হয় সংহত, গোছানো। তাদের কল্পনার সাথে ওতপ্রোত জড়িত থাকে সৃজনীশক্তি। অনুভূতির নানা রঙে সেই কল্পনা রাঙিয়ে পাঠককে শিল্পের সৌন্দর্যে আপ্লুত করে। সৃজনীশক্তি ব্যবহারেই এটি সম্ভব হয়ে ওঠে।
আশির দশকের কবি শাহীন রেজার কবিতায় সুসংহত কল্পনার কারুকাজ ও সৃজনীশক্তির শৈল্পিক মেলবন্ধন দেখা যায়। জীবন-অভিজ্ঞতাকে বিচিত্র বর্ণে রাঙিয়ে তিনি কল্পনাকে শিল্প-কাঠামোয় রূপ দেন। সেই কাঠামো সিক্ত থাকে কবিসত্তার প্রগাঢ় অনুভূতির রসে। ফলে শাহীনের কবিতা কাঠখোট্টা হয়ে ওঠে না। কবিতার বাক্যে প্রকাশিত অনুভূতির ভেতর সবুজাভ মানবীয় সৌন্দর্য দ্যুতি ছড়াতে থাকে। ‘বৈশাখ এবং শিলং দুপুর’ কবিতায় শাহীন রেজা লিখছেন:
দীর্ঘ আলখাল্লার ভেতর একটা দুপুর লুকিয়ে
আপনি ঘুরে বেড়াতেন;
দুপুর মানেই ঘুঘু, কানিবক আর শিরিষের
ডাল থেকে রৌদ্র খসে পড়া
আমি স্বপ্নের ঘোরে একদিন সেই রোদে
শব্দ শুকোতে দিয়েছিলাম।
দীর্ঘ আলখাল্লার ভেতর দুপুর লুকিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঘুরে বেড়াতেন। এমনটাই কল্পনা করে নিচ্ছেন শাহীন রেজা। তার এই কল্পনা কিন্তু সংহত, কাব্যিক। রবীন্দ্রনাথ বাংলা কবিতার কিংবদন্তি। তার অনভূতির জগৎ আকাশের মতো বিস্তৃত। তার অনুভূতিতে প্রকৃতির রূপরসগন্ধ একাকার। তাই শাহীনের কল্পনা অযৌক্তিক নয়। দুপুরের অনুষঙ্গ হিসেবে শাহীন ঘুঘুর নাম উল্লেখ করছেন। বলছেন, দুপুর মানেই ঘুঘু। এই বাক্যটি দুপুরের নির্জনতা ভেঙে ঘুঘুর ডাক আমাদের কানে ধ্বনিত করে। কবি কল্পনা করছেন, কানিবক ও শিরিষের ডাল থেকে খসে পড়ছে রোদ। এই চিত্রকল্প যে সৌন্দর্য ছড়িয়ে দিচ্ছে তা অনন্য। পাঠক হিসেবে আমরা একটি দুপুরকে চোখের সামনে দেখতে পারি। মানে, কবির তৈরি চিত্রকল্প স্নিগ্ধতার আনন্দে পাঠকের কাছেও চিত্রকল্প হয়ে ওঠে। কবি বলছেন, স্বপ্নের ঘোরে তিনি সেই রোদে শব্দ শুকোতে দিয়েছিলেন। শব্দ কি শুকোনো যায়? এর জবাব পেতে গোটা কবিতাটি পাঠককে পড়ে দেখতে হবে। ওপরের কবিতাংশে শাহীনের কবিত্বের যে পরিচয় আমরা পাই সেই পরিচয়ে তাকে আশির আরসব কবি থেকে সহজেই আলাদা করে চিনে নেয়া যায়। বুঝতে পারি যে, তার কবিতার ভাষা ও বিষয়-প্রকরণ সম্পূর্ণ তার নিজস্ব ঢঙে নির্মিত। আশির দশকের আর কোনো কবির সাথে কোথাও সাদৃশ্য নেই।
বৃষ্টির চুমু লাগা পীচে
নির্বিঘ্নে আরামে শুয়ে ছিল সে
অশ্বত্থের হলুদ পাতা
ঝরাপাতা
রাস্তার ভেজা চোখে
যেন একটুকরো হলুদ কাজল
আমি তাকে তুলে এনে
গুঁজে দিলাম মেঘের খোঁপায়
ধূসরে হলুদ খাম
চিঠি আঁকে শ্রাবণ দুপুর
গন্তব্য কতটা দূর
কুটুমপুর কুটুমপুর।
(কুটুমপুর)
সহজ ও পরিচিত শব্দের বুননে সরল উপায়ে চিত্রককল্প নির্মাণ করেছেন শাহীন রেজা। অশ্বত্থের ঝরে পড়া হলুদ একটি পাতা পড়ে ছিল পীচঢালা রাস্তায়। এই পাতাটি নিয়েই একটি কবিতা। ছোট্ট কবিতা, কিন্তু পাঠকের অনুভূতিকে নানা ব্যঞ্জনায় অনুরণিত করে যায়। পাতাটি হয়ে ওঠে একটি চরিত্র। বৃষ্টির ছাপ পীচের সড়ককে চুমু খেয়ে যাচ্ছে! এই দৃশ্য নিশ্চয়ই প্রকৃতির চমৎকার একটি উপমা। এই বৃষ্টির ভেতর আরামে সড়কের ওপর ঝরাপাতাটি শুয়ে ছিল। কবি কল্পনা করছেন, পাতাটি যেন সড়কের ভেজা চোখে একটুকরো হলুদ কাজল। পাতাটি তুলে এনে কবি গুঁজে দিলেন মেঘের খোঁপায়। ‘মেঘের খোঁপা’ অভূতপূর্ব চিত্রকল্প। বিমূর্ত হলেও এই চিত্রকল্পটি পাঠকের কল্পচোখে বাঙ্ময় হয়ে ওঠে।
দ্যাখা যাচ্ছে, জীবনকে মানুষের বাইরে নিয়ে গিয়ে প্রকৃতির নানা অনুষঙ্গে মিলিয়ে দিচ্ছেন শাহীন রেজা। এই কৃৎকৌশলে তার কল্পশক্তি যেমন শৈল্পিক, একইসঙ্গে সৃজনীশক্তিও অনন্য। এরই পাশাপাশি কবিতার বাক্যে শব্দের কারুকাজ যেন মৃৎপাত্রে মৃৎশিল্পীর তুলির সূক্ষ্ম আঁচড়। শাহীনের কবিতায় প্রকৃতি বিশেষ বৈশিষ্ট্যে চিহ্নিত হয়। প্রকৃতির স্নেহনীড়ে মানুষের বসবাস। প্রতিমুহূর্তে প্রকৃতির আলো-হাওয়া থেকে মানুষ বেঁচে থাকার উপাদান সংগ্রহ করছে। সেই প্রকৃতির গহন-সত্তার সাথে মানুষের মিথষ্ক্রিয়ার যোগসূত্র শাহীনের কোনো কোনো কবিতায় খুঁজে পাওয়া যায়। ‘ছায়া শৈশব’ কবিতায় তিনি লিখছেন:
দেখে আসি বুনোলতা প্রজাপতি
নীরব নিশিন্দা ভোর
সারি সারি কাশফুল, ফুটে থাকা
শুনে আসি দোয়েলের মৃদু শিস
ঘুম ভেঙে চড়ুইয়ের ডাকাডাকি
পরপর প্রকৃতির কয়েকটি উপাদান দেখে আসার আহ্বান জানাচ্ছেন কবি। আমাদের শৈশবে এসব উপাদান ছিল আমাদের দুরন্তপনার সাথি। বুনোলতা ধরে ঝুল খেলেছি। প্রজাপতির ধরতে ছুটেছি মাঠে। বাগানে হাঁটতে হাঁটতে শুনতে পেয়েছি দোয়েলের শিস। আবার, খুব ভোরে চড়ুই পাখির ডাক শুনে ঘুম ভেঙে গেছে। এই সবই এখন আমাদের কাছে অতীত। সচ্ছলতার জীবন কাটাতে আমরা এখন শহুরে মানুষ। নাভিশ্বাস তুলে দৌড়চ্ছি জীবিকার খোঁজে। এরই কোনো অবসরে ফেলে আসা শৈশব হয়তো আমাদের স্মরণে আসে। আর তখন আমাদের বুক ভেঙে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। ওপরের বাক্যগুলো সেই রকমই দীর্ঘশ্বাস। এর ভেতর দিয়েই আমরা উপলব্ধি করি প্রকৃতির উপাদানগুলোর প্রতি শাহীন রেজার গভীর মমত্ববোধ। জনারণ্যে থেকেও নিজের ভেতরকার নিঃসঙ্গতাকে শাহীন উপলব্ধি করতে পারেন। আর তাই তার কবিতায় ধ্বনিত হয় প্রকৃতির বুকে ফিরে যাবার আন্তরিক বাসনা।
কবিতা আসলে জানা ও বোঝার কোনো শিল্প-মাধ্যম নয়। কবিতা আত্মোপলব্ধির সারাৎসার। বোধের ভেতর ফুটে থাকা অন্তর্গোলাপ। যে গোলাপ শব্দরূপ পাপড়ি মেলে ফুটে থাকে আমাদের চোখের সামনে। আমরা তার সৌন্দর্যে অভিভূত হই। ব্যস, এই-ই হচ্ছে কবিতা। আশির দশকের কবিতায় এই সৌন্দর্য নানা আঙ্গিকে কবিতায় ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করেছেন কবিরা। সত্তর দশকের উত্তুঙ্গ সময় পেরিয়ে পরের দশকে কবিতা নানা বৈচিত্র্যে বাঙ্ময় হয়ে ওঠে। একটু খেয়ার করলেই দেখা যাবে, বাংলা কবিতার মূল প্রবণতা রোমান্টিকতা। অবশ্যি সেই রোমান্টিকতায় মিলেমিশে রয়েছে প্রকৃতির সবুজাভ দীপ্তি। সত্তরের রক্তাক্ত কবিতাপর্ব পেরিয়ে আশির দশকে রোমান্টিকতাকে কবিরা নতুন রূপে উপস্থিত করলেন তাদের কবিতায়। শাহীন রেজার কবিতায় প্রকৃতির অন্তর্গহনের যে সুর ধ্বনিত হয় সেই সুর আসলে তার শৈশব থেকে উঠে আসে। কেননা, তিনি বেড়ে উঠেছেন সুন্দরবনের কোল ঘেঁষা রূপবৈচিত্র্যে। ফলে তার কবিতা ভাষাশৈলী সহজ ও প্রাণবন্ত। সাবলীল। যেন আবহমান বাংলার লোকজ ভাষা। প্রতিদিনের জীবনযাপনের প্রতিটি মুহূর্ত তার কবিতায় মূর্ত হয়ে ধরা দ্যায়।
জীবন ছিল যে জীবনের কাছে নত
বুক জুড়ে তার জোছনার ক্ষত শত
নদী মেঘ নারী তার সাথে ছিল প্রাণ
শ্রাবণের পাখি বুক জুড়ে কত ঘ্রাণ
পিপাসাতে ছিল সুনিপুণ কিছু জল
অধরের তালে নেচেছিল পরিমল
প্রেমের আকুতি আঁকা ছিল দুটি চোখে
জেগেছিল রাত কুয়াশার মায়া শোকে
মেঘনায় ছিল অপরূপ কিছু ঢেউ
তার তালে তালে ডেকেছিল আহা কেউ
এর মাঝে তুমি বোধনের প্রজাপতি
উড়ে এলে আহা কি নিপুণ তার গতি
আলুথালু মেঘ ঈষাণের কোণে ঝড়
বাতাস কাঁপিছে প্রকৃতিটা থরথর
এভাবেই বুঝি প্রণয়েরা নেমে আসে
অদেখার ফুল আঁধারেও হাসে কাঁদে
জীবনের গতি ক্রমাগত বাড়ে শুধু
ডাহুকের ডাকে বালুচরে জাগে ধু ধু।
ছয় মাত্রার মাত্রাবৃত্ত ছন্দে নির্মিত কবিতাটি। লক্ষ্যণীয় যে, ছন্দের আশ্চর্য কারুকাজ প্রতিটি বাক্যে এনে দিয়েছে আনন্দদায়ক গতি। পাঠের ঝোঁক কোথাও সামান্য বিঘ্নিত হয় না। যেন আনন্দ পাঠ। ছন্দের আনন্দে পাঠক জীবনকে উল্টে-পাল্টে দেখতে থাকেন। সত্যি বলতে কী, যে জীবন মানুষ যাপন করে সেই জীবন মানুষ যাপন করতে চায় না। এরপরও বাধ্য হয়েই মানুষকে হিমালয় সদৃশ জীবনকে বহন করে নিয়ে যেতে হয়। শাহীন তাই লিখছেন, যে জীবনের কাছে জীবন নত হয়ে ছিল সেই জীবনের বুকে জোছনার শত ক্ষত। আমরা দেখেছি, আকাশে যখন ঝকঝকে চাঁদ ওঠে আর তার আলো ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর বুকে তখন কী অপার্থিব মনে হয় বিশ্ব চরাচর। কিন্তু জোছনার সেই সৌন্দর্যও জীবনের বুকে ক্ষত-বিক্ষত। তবু বেঁচে থাকতেই হয় মানুষকে। বেঁচে থাকাই যে তার নিষ্ঠুর নিয়তি! এই বেঁচে থাকার পথযাত্রায় মানুষকে প্রকৃতির ভেতর থেকে কত কিছুই যে কুড়িয়ে নিয়ে হয়! সেসব বর্ণনা শাহীন সুনিপুণ ছন্দের দোলায় শব্দে শব্দে আমাদেরকে জানিয়ে দিচ্ছেন। এরপর কবিতার শেষে এসে বলছেন, এতকিছুর পরও জীবনের গতি ধীরে ধীরে বাড়তেই থাকে। অবশ্যি মৃত্যুর আগপর্যন্ত। জীবন যেন ধু-ধু বালুচর। সেই চরে ডাহুক ডাকে। কিন্তু জীবনের ভার এতই দুঃসহ যে, ডাহুকের ডাক শুনে আমাদের আনন্দ হয় না। বরং কী রকম যেন আর্তনাদ আমাদের বুকের ভেতর থেকে হাহাকার তোলে। জীবনকেও ওই বালুচরের মতো ধ-ধু প্রান্তর বলে মনে হয়।
দার্শনিক প্রজ্ঞাও শাহীন রেজার কবিতার আরেক বৈশিষ্ট্য। কবিতার ভেতর দিয়ে যেন তিনি নিজের আমিত্ব আবিষ্কারের পরিখা নির্মাণ করেন। ‘তোমারই ইচ্ছায়’ কবিতায় তিনি লিখছেন:
তোমার আদেশে আসি চলে যাব তোমারই ইচ্ছায়
তবে কেন এই ঘর এইসব মায়া আয়োজন
কেন এই জায়াপুত্র কেন এই রমণীর মন
দিন শেষে সব পাখি যদি ফেরে আপন কূলায়।
সৃষ্টিকর্তার কাছে গুরুতর প্রশ্ন শাহীনের। জীবনের যন্ত্রণা ভোগের পর মৃত্যু এসে নিয়ে যাবে আরেক জগতে। মাঝখানের এই জীবনে তবে কেন এত মায়ার বন্ধন? কেন? কেন? কেন? হিসাব মেলে না। সত্যিই কোনো সমীকরণ দিয়ে জীবনের মানে আমরা উদ্ঘাটন করতে পারি না। যদিও অনেক তত্ত্বকথা আছে বিষয়টি নিয়ে। এরপরও জীবনযাপনের চূড়ান্ত কোনো মুহূর্তে মানুষ গভীরভাবে উপলব্ধি করে, পৃথিবীর জীবন যেন মানুষের একটি অভিশপ্ত অধ্যায়। শিশু সন্তানের মুখে আধো আধো বোল। কী মায়াবী কচি চেহারা। তার মুখে একটু খাবার তুলে দিতে কতই না পিতা বুনো ষাঁড়ের মতো হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে যাচ্ছে। কেন যাচ্ছে? মায়া। জগৎ-সংসার কি তবে মায়ার খেলা? খেলা জেনেও মানুষকে খেলেই যেতে হয় জীবনের খেলা। ‘কিছু মেঘ কিছু রৌদ্র’ কবিতায় শাহীন লিখছেন:
বাকি পথ যেতে হবে এভাবেই
বুকের সুড়ঙ্গ ঘেঁষে একটি হলুদ সাপ
শুয়ে আছে বহুকাল মরা নদীটার মতো।
কী সাঙ্ঘাতিক! বুকের সুড়ঙ্গ ঘেঁষে নাকি একটা সাপ শুয়ে আছে! এই ভীতি নিয়েও জীবনের বাকি পথ আমাদের হেঁটে যেতে হবে! কেননা, মৃত্যু ছাড়া জীবন থেকে পালানোর আর কোনো পথ আমাদের সামনে খোলা নেই। আবার, এই জীবনের মালিক আমি নই, সৃষ্টিকর্তা। ফলে, সৃষ্টিকর্তার জীবনকে আমি নিজের ইচ্ছায় হরণ করতে পারি না। সেটা পাপ। তার মানে, সৃষ্টিকর্তা নির্ধারিত মৃত্যু না আসা পর্যন্ত জলজ্যান্ত একটা সাপকে বুকে নিয়ে আমাদেরকে বেঁচে থাকতে হবে। এরচেয়ে ভীতিকর আর কী হতে পারে! বিষয়টি নিয়ে কখনো কি আমরা ভেবেছি? শাহীন রেজা তার কবিতায় জীবনকে খুঁড়ে জীবনের কঙ্কাল বের করে আনেন। তাই তার দার্শনিক বয়ানের সাথে পাঠকও শিহরিত হয়। কেঁপে ওঠে ভয়ে। নতুনভাবে জীবনকে উপলব্ধি করতে উদ্বুদ্ধ হয়।
জীবন কুৎসিত জেনেও কবিকেই খুঁজে নিতে হয় স্বপ্ন-সুন্দরের ঠিকানা। এই আয়োজনে শাহীন রেজা কবিতাকেই করেছেন পরম আরাধ্য। ‘স্মৃতির মিনার’ কবিতায় তিনি লিখছেন:
আমার সমস্ত ভালোবাসায়
একটি প্রজাপতি কেবলই উড়ছে
কেবলই উড়ছে।
মায়ার পৃথিবীতে ভালোবাসাই মানুষের বেঁচে থাকার পরম আশ্রয়। বুকে আজদাহা একটা সাপ নিয়েও ভালোবাসার নির্ভরতায় মানুষ শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়তে পারে। কেননা ভালোবাসায় প্রজপাতি উড়ছে। কেবলই উড়ছে। প্রজাপতি এখানে সুন্দরের প্রতীক। রমণীয় জীবনের রূপকে শাহীন প্রজাপতিকে চিত্রিত করেছেন। আর তাই ভালোবাসার আশ্রয়ে আমরা বেঁচে থাকতেই পারি। এই নির্ভরতার আশ্বাস কবিতার ভেতর দিয়ে শাহীন তার পাঠককে জানিয়ে দিচ্ছেন। ভয়ংকর সুন্দর জীবনের গোলকধাঁধা নির্মাণ করেন শাহীন রেজা তার কবিতায়। সেই গোলকে ঘুরতে ঘুরতে পাঠক তার অন্তর্গহনে ভীতির কম্পন অনুভব করেন। আবার একইসঙ্গে বেঁচে থাকার আয়োজনও তৈরি করে নিতে পারেন। আশির দশকের কাব্যভুবনে শাহীনের মতো জীবনের মরমে প্রবেশ করার ক্ষমতা খুব কম কবির কবিতাতেই চোখে পড়ে। যা বলার সহজে কোনো ঘোরপ্যাঁচ না কষেই শাহীন কবিতার ভেতর বলে দেন। যার ফলে তার কবিতা পাঠে পাঠক বিরক্ত হয়ে ওঠে না।