তাজ ইসলাম
কামাল আহমেদ, জন্ম ১৯৬২ সালের ৩১ মার্চ।
শিক্ষা জীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি নিয়ে এম এ ডিগ্রি অর্জন করেন। এরই মধ্যে ধানমন্ডি ল’ কলেজ থেকে এল এল বি ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। ছাত্র জীবনেই জড়িয়ে পড়েন প্রিন্টিং ও প্যাকেজিং ব্যবসায়। তারপর দীর্ঘ আড়াই যুগেরও বেশি সময় নিয়োজিত আছেন একটি প্রিন্টিং ও প্যাকেজিং প্রতিষ্ঠানের ডিরেক্টর হিসেবে কর্মরত। কৈশোরে,যৌবনে তার লেখা দেশের নাম করা পত্রপত্রিকায় প্রকাশ হত। তারপর সাহিত্য থেকে দূরে সরে পড়েন। বর্তমানে তিনি অসুস্থ হয়ে ঘরবন্দী। তিনি ২০২০ সাল থেকে বিছানায় শায়িত।বিছানাই তার সঙ্গী। বিরক্তিকর অবসর জীবন। সে সময় আবার সক্রিয় হয়ে পড়েন সাহিত্য চর্চায়। দীর্ঘ বিরতি হওয়ায় সাহিত্যের মূলস্রোত থেকে হারিয়ে যান তিনি। সাহিত্যের গতিপ্রকৃতি ধারণ করাও দুরূহ হয়ে পড়ে তার জন্য। অখন্ড অবসরকে অতিক্রম করতে আপন মনে লিখে যান কবিতার পঙক্তি। কামাল আহমেদ এখানে এ পর্যায়ে হয়ে পড়েন স্বভাবকবির অনুগামী। কবিতার নীতি অথবা কবিদের সাথে প্রতিযোগীতায় নামেননি তিনি। লিখে যান অবসরের গান। লেখার বিষয় কবিতা। কবিতা, পদ্য,ছড়ার অবয়বে অঙ্কন করেন জীবনের চিত্র। সময় অতিক্রম করেন কবিতার পথে। জীবন উপভোগ করেন কবিতার ছন্দে।অবসর উদযাপন করেন কবিতা কথায়। কে কবি বলল, কবিতা কেমন হল এ যুগ জিঙ্গাসার ফুসরত নেই তার।
ষাটোর্ধ বৃদ্ধ এখন কবিতা নবিশ। তিনি লিখেন,
‘বিক্ষিপ্ত শব্দের বিশাল ভান্ডার/ কুড়িয়ে কুড়িয়ে জোগাই/ লেখার আহার( শব্দের মালা)।’
কবিতা আহার কিংবা কবিতা ভ্রমণে তিনি আবিস্কার করেন নিজেকে।
তখন লেখেন,
‘জীবন যুদ্ধে পরাজিত,
এক লড়াকু সৈনিক/ ভুল হিসাবের অনুশোচনায়,/ ক্ষয়ে যায় দৈনিক।( অনুতপ্ত হৃদয়)’।
জন্ম তার অখন্ড পাকিস্থানের সরকারী হাসপাতালে। বাবা সরকারী কর্মকর্তা ছিলেন। গ্রামের বাড়ি নোয়াখালী। গ্রামে বসবাস হয়ে ওঠেনি ঠিক সেভাবে । শহরে শহরেই কেটেছে জীবন। গ্রামে গিয়েছেন বেড়াতে। স্মৃতিতে তবু গেঁথে আছে গ্রাম। স্মৃতি কাতরতায় রচনা করেন পঙক্তি। বলেন,
‘বিল জুড়ে শাপলার/ বসতো যে মেলা/ ঢেউয়ে ঢেউয়ে সারাদিন/ করতো যে খেলা/( গ্রাম্য স্মৃতি)।’
রোগে শোকে তিনি কাতর কিন্ত হতাশ নন। স্রষ্টার অসংখ্য,অগণিত নিয়ামত প্রাপ্তি তাকে কৃতজ্ঞ করে রাখে। কবি কবিতা লেখেন পাঠকের জন্য। নিজেও নিজের পাঠক। হতাশাগ্রস্ত সময়ে নিজেকে শান্তনা দেন,পরামর্শ দেন।রচিত হয় কবিতা। বলেন,
‘সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা করো/ একটা একটা করে/ অণু থেকে শুরু করো/ হৃদয় যাবে ভরে/( নির্ধারিত রিজিক)।’
সমাজ ভাবনা চিত্রিত করেন নিজের বয়ানে,
‘ঘুম পাড়ানির গানে যেমন /
শিশুরা ঘুম পায়/ আজও তেমন নেশার ঘোরে/ ধ্বংস পিছে ধায়।( ভদ্র নেশা ধসছে আশা)’।
অতীত পাড় হয়ে তিনি বাস করেন বর্তমানে। কামাল আহমেদ ভাবনায় বাস্তববাদী। বয়স ও বার্ধক্যে স্মরণ করেন অনন্ত যাত্রার কথা।তার আগে হিসাব করেন সমুদয় দেনা পাওনার হিসাব। চিন্তায়, আদর্শে তিনি বিশ্বাসী মানুষ।বান্দার হক নিয়ে তার চিন্তা সে বিশ্বাসেরই অংশ। অতীতের বিষয় নিয়ে বিষন্ন নন। তাই তিনি বলতে পারেন,
‘যে দিন গেছে, তা তো গেছেই/ আসবে না কভু ফিরে/ হক্কুল ইবাদের দাবিগুলো/ রেখেছে সর্বদা ঘিরে/( ক্ষমা প্রার্থনা)।’।
পল্লি, প্রকৃতি, গ্রাম, বাংলাদেশ কামাল আহমেদ’র স্বল্প কথায় বিবৃত হয়
‘সবুজ ঘেরা ফুলে ফলে/ সারি সারি গাছ/ পুকুর জলে উঠছে বেড়ে/ নানা জাতের মাছ।( বাগান বাড়ি)।’
তার বইয়ের নাম ‘ অবসরের খসড়া : স্মৃতি সাগরের ঢেউ’। করোনা কাল,বিছানাবদ্ধ জীবন। কবিতা থেকে কক্ষচ্যুত এক কবিজীবন। আবারও ফিরে এলেন কবিতা গ্রহে। অবসরকে কাছে লাগালেন স্বতঃস্ফূর্ত চর্চায়। কলমের খোঁচায় লিখে রাখলেন নিজের স্মৃতি,অভিজ্ঞতা, বেদনা,হাহাকার,ব্যর্থতা,আশা আকাঙ্খা, পাওয়া – নাপাওয়া সব। সবকিছুই তিনি লিখে গেলেন স্বভাব সুলভ ভঙ্গিমায়। বার্ধক্যের চেয়ে অসুস্থতায় ঘায়েল হলেন বেশি। সবকিছুই বলে গেলেন অনর্গল কবিতা সুন্দরীর কাছে। আর এসব বলা না বলা কথারমালাকে রেখে যাবার বাসনা থেকে বইয়ের আত্মপ্রকাশ। মৃত্যু মানুষকে নিয়ে যায় চিরতরে।পৃথিবী থেকে দূরে বহু দূরে। অথচ মানুষ থেকে যেতে চায় পৃথিবীতে। মানুষ জানে থেকে যাওয়ার বাসনা পূরণ হয় না মানুষের। তাই রেখে যেতে চায় স্মৃতিচিহ্ন। বই তার একটি। এসব ভাবনাই হয়তো কামাল আহমেদের বই। এখন তার সময় কাটে,
‘শুয়ে বসে সারাদিন/ ঘরেই তো থাকি/ শব্দের মালা গেঁথে/ মনে মনে রাখি।( দিনাতিপাত)।’
মনে মনে রাখেননি।মন থেকে ছড়িয়ে দেন সোশ্যাল মিডিয়ায়,বইয়ের পাতায়। আমরাও আশাবাদী তার বই সযতনে থাকবে পাঠকের বুকশেলফে,বন্ধু স্বজন,সুহৃদ,শুভাকাঙ্ক্ষী, আত্মীয়দের মনের মনিকোঠায়। বই তাকে বাঁচিয়ে রাখবে প্রজন্মের কাছে। কবি সুস্থ হোন,জীবনে সাহিত্যে তুমুল সরব থাকুন এই প্রার্থনা মহান রবের কাছে। রবের প্রতি নিবেদিত কবি। তার শক্তি ও দানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। মহান প্রভুর নির্দেশের প্রতিও তিনি একান্ত অনুগত।
স্রষ্টার ক্যাটালগে/ চলি যদি সবে/ শান্তি সুখের ধারা/ আসবে যে ভবে।( সুদৃঢ় শপথ)।’ ২২৫ পৃষ্ঠার বড় মলাটের একটি বই। এক জীবনের খসড়াই যেন মলাটবদ্ধ। প্রচ্ছদ করেছেন শিল্পী মোমেন উদ্দীন খালেদ। প্রকাশ ২০২৩। প্রকাশক: কাউসার সুলতানা।মূল্য : ৩৩০ টাকা।