তাজ ইসলাম
আমাদের দেশে প্রায় প্রতিটা শিশুর মতো তার একটা ডাকনাম ছিল। বাবা মায়ের আদরের কমল। আদর করে ডাকতেন কমল। কমলের ডাকনাম একসময় হারিয়ে যায়। বাংলাদেশের মানুষের কাছে পরিচিত ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে মেজর জিয়া নাম। তারপর পরিচিতি পান শহীদ জিয়া নাম। তার নামের সাথে শহীদ অভিধা লেপ্টে আছে মূল নামের মতো। অবিচ্ছিন্ন অংশ হয়ে গেছে।
রাজনৈতিক শহীদদের মাঝে শহীদ জিয়া নামটি বহুল পরিচিত।
তার জন্ম ১৯ জানুয়ারি, ১৯৩৬ বাগবাড়ি, বগুড়া, পূর্ব বাংলা, ভারত। ১৯৩৬ সালে বগুড়া ছিল ভারতের একটি অংশ।
তখনকার ভারতের যা দেশ ভাগের পরে পূর্ব বাংলা আরও পরে স্বাধীন বাংলাদেশের একটি সুপরিচিত জেলা। বগুড়া ঐতিহাসিক একটি স্থান। পুণ্ড্রনগর বগুড়ার ঐতিহ্য, বাংলাদেশের ঐতিহ্য। খ্রীস্টপূর্ব আড়াই হাজার বছর পূর্বে বগুড়ার মহাস্থানগড় ছিল রাজধানী।
এই বগুড়ার সন্তান কমল একদিন নিজের ঔজ্জ্বল্যতার আলো ছড়ান বাংলাদেশের ইতিহাসে।
ইতিহাসে তিনি স্বাধীনতার ঘোষক বলে পরিচিত। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর একজন মেজর। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অনেক বিস্তৃত। সংক্ষেপে যুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে বাংলাদেশের মানুষ ছিল নিরস্ত্র ও নেতৃত্বহীন। নেতাহীন দিশাহীন জাতীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ২৫ মার্চ দিবাগতরাতে বর্বর পাকবাহিনী। তখন জাতীর কাণ্ডারী হিসেবে আবির্ভূত হলেন দেশপ্রেমিক,অসীম সাহসী বীর সেনানী মুক্তিযোদ্ধা মেজর জিয়াউর রহমান। চট্টগ্রাম, কালুরঘাট বেতারকেন্দ্রের ইথার থেকে ভেসে আসলো একটি জলদগম্ভীর কণ্ঠ :
‘ আমি মেজর জিয়া বলছি’।
বাঙালি,বাংলাদেশীরা সহসায় সচকিত হলেন। সহসা সামনে দেখলেন এক সাহসী নেতৃত্বের দৃঢ়চেতা উপস্থিতি। লড়াকুু সমরনায়ক।
তার নেতৃত্বে ঝাঁপিয়ে পড়লেন মুক্তিযোদ্ধারা। যুদ্ধের মাঠে তিনি জেড ফোর্সের অধিনায়ক। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করে।
জিয়াউর রহমানের বাবার নাম মনসুর রহমান
এবং জাহানারা খাতুন ওরফে রানী ছিল তার মাতার নাম । পাঁচ ভাইদের মধ্যে জিয়াউর রহমান ছিলেন দ্বিতীয়। বাবা মায়ের কমল হয়ে গেলেন জিয়া। জিয়াউর রহমান, মেজর জিয়া। মেজর জিয়া হিসেবে ব্যাপক পরিচিত। জিয়াউর রহমান মূলত সফল মানুষদের একজন। যেখানেই পদচারণা করেছেন সেখানেই আলো ছড়িয়েছেন। তাই তার আলোকোজ্জ্বল পরিচিতি বহুবিধ। তিনি সেক্টর কমান্ডার, বীর মুক্তিযোদ্ধা, মেজর, সিপাহীজনতার বিপ্লবের নায়ক, রাষ্ট্রপতি,রাজনীতিবিদ, দেশপ্রেমিক সব পরিচয়েই সমান দ্যুতি ছড়িয়েছেন। মরণেও তিনি অমর হয়ে আছেন মানুষের মণিকোঠায়। তিনি বাংলাদেশের মানুষের কাছে শহীদ জিয়া নামে পরিচিত। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ হিসেবে খ্যাত। যুদ্ধ মাঠে অসীম সাহসীকতা আর সফলতার জন্য অর্জন করেন ‘বীর উত্তম’ খেতাব।
তিনি দিনাজপুরের মেয়ে খালেদা খানমকে বিয়ে করেন। তাদের বিয়ে হয় ১৯৬০ সালে। খালেদার জন্মস্থান পূর্ব পাকিস্তানের দিনাজপুর শহরে। তার বয়স তখন ১৫ বছর। ১৫ বছরের কিশোরীর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন ২৪ বছর বয়সী জিয়াউর রহমান। জিয়াউর রহমানের যেমন একটি ডাকনাম আছে, বেগম খালেদা জিয়ারও একটি ডাকনাম আছে। তার ডাকনাম ‘পুতুল’।
এই দম্পতির দুই সন্তান।
প্রথম পুত্র তারেক রহমানের জন্ম ১৯৬৫ সালের ২০ নভেম্বর। দ্বিতীয় ও কনিষ্ঠপুত্র আরাফাত রহমান কোকোর জন্ম ১৯৭০ সালের ১২ আগস্ট।
জিয়াউর রহমানের শৈশব শুরু হয় বগুড়ায়। তারপর কিছু সময় কাটে কলকাতা শহরে। এরপর ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হয়। পাকিস্তান নামে একটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। অপর রাষ্ট্রের নাম ভারত। অধিকাংশ হিন্দুরা থেকে যায় ভারতে। মুসলমানরা চলে আসে পাকিস্তানে। জিয়াউর রহমানের বাবা কলকাতা ছেড়ে চলে আসেন জন্মস্থান পাকিস্তানে। পাকিস্তানের বগুড়ায় তার আবাস। তিনি বসবাস শুরু করেন পাকিস্তানের করাচীতে। কিছুদিন করাচীতে ভাড়াবাসায় বসবাস করেন।
করাচীতে ছিলেন মাসখানেক সময়। তারপর বসবাস করতে থাকেন জেকব লাইনে। কমলকে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি করান ‘ করাচী একাডেমী স্কুলে’। সময় ১৯৪৮ সালের জুলাই মাস।
এই স্কুল থেকেই ২য় বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন জিয়াউর রহমান ১৯৫২ সালে। এরপর ভর্তি হন ডি.জে কলেজে।
সে বছরই তিনি কাকুল মিলিটারি একাডেমীতে অফিসার ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন।
তিনি কাকুল পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে ১৯৫৩ সালে অফিসার ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন ।
সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে কমিশন প্রাপ্ত হন ১৯৫৫ সালে। সেখানে দুই বছর চাকুরি করার পর ১৯৫৭ সালে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে বদলি হন।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগে ছিলেন তিনি ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত।
দেশ ভাগের পর পাকিস্তান ও ভারতের মাঝে সহাবস্থান থাকেনি। নানা সংঘাতের পর শুরু হয় পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ। ১৯৬৫ সালের পাক – ভারত যুদ্ধের সময় জিয়াউর রহমান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি কোম্পানীর সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। কমান্ডার হিসেবে খেমকারান সেক্টরে তিনি অসীম বীরত্বের পরিচয় দেন। যুদ্ধে অসীম সাহসীকতা ও বীরত্বের জন্য সরকার তাকে ‘হিলাল-ই-জুরাত’ খেতাবে ভূষিত করে।
পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি তাকে পেশাদার ইনস্ট্রাক্টর হিসেবে নিয়োগ দেন ১৯৬৬ সালে।
পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটার স্টাফ কলেজে কমান্ড কোর্সে যোগ দেন ঐ বছরই। তারপর মেজর পদে পদোন্নতি পান। এবং ১৯৬৯ সালে জয়দেবপুরে সেকেন্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড পদের দায়িত্ব লাভ করেন। পরবর্তীতে উচ্চ প্রশিক্ষণের জন্য যান পশ্চিম জার্মানিতে ।
প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরে আসেন ১৯৭০ সালে। তিনি তখন একজন চৌকস মেজর। যোগ দেন কর্মক্ষেত্রে। তিনি দায়িত্ব পান চট্টগ্রাম অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের। সেখানে তিনি সেকেন্ড-ইন-কমান্ড পদের দায়িত্ব লাভ করেন।
৭০ এর রাজনৈতিক অস্থিরতা,পাকিস্তানীদের নির্মমতা জনগণকে পাকিস্তান থেকে দূরে সরিয়ে নেয়। তারা নিজেদের পথ তৈরী করতে থাকেন। স্বাধীনতার পথে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে চলে বাঙালি জাতি। আওয়ামীলীগ ছিল সামনে। জনগণের আশা ছিল শেখ মুজিবের নেতৃত্বের প্রতি। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে শেখ মুজিব নেতৃত্ব দিবেন। কিন্তু বিশ্ব ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়ার রীতি ভেঙে শেখ মুজিবুর রহমান কারাবরণ করে সেনা হেফাজতে চলে যান।
দেশবাসী হয়ে পড়েন নেতৃত্বহীন। তাদের সামনে কোন অভিভাবক রইল না। ২৫ মার্চ নিরস্ত্র বাঙালির উপর চালায় বর্বরোচিত হামলা পাকিস্তান হানাদার বাহিনী।
জিয়াউর রহমান বিদ্রোহ করেন। জীবন বাজি রেখে, মরণ পণ করে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠেন। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। জিয়াউর রহমান ও তার বাহিনী পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে সফল হন।
গঠন করেন প্রথম সশস্ত্র ব্রিগেড জেড ফোর্স।
১ম, ৩য় ও ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এই তিনটি ব্যাটালিয়নের সমন্বয়ে গঠিত হয় এই ব্রিগেড। জিয়াউর রহমান ছিলেন জেড ফোর্সের অধিনায়ক।
১ নং সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন ১৯৭১ সালের এপ্রিল হতে জুন পর্যন্ত। জুন হতে অক্টোবর পর্যন্ত যুগপৎ ১১ নম্বর সেক্টর কমান্ডার, ও জেড-ফোর্সের কমান্ডার হিসেবে তিনি যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।
১৬ ডিসেম্ব ১৯৭১ সাল বাংলাদেশ স্বাধীন হয়।
তিনি ফিরে যান ব্যারাকে।
তাকে কুমিল্লা ক্যান্টনম্যান্টে সেনাবাহিনীর ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ করা হয়। ১৯৭২ সালের জুন মাসে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ-অফ-স্টাফ নিযুক্ত হন।
পরবর্তীতে ব্রিগেডিয়ার হন, আরও পদোন্নতি পেয়ে মেজর জেনারেল পদে আসীন হন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান। ক্ষমতার মসনদে বসেন শেখ মুজিবেরই ঘনিষ্ঠজন খন্দকার মোশতাক।
১৫ আগস্ট থেকে ৭ নভেম্বর বাংলাদেশের ইতিহাসে বহু ঘটনার জন্ম হয়। অভ্যুত্থান,পাল্টা অভ্যুত্থানের পর ক্ষমতায় আসেন বীর মুক্তিযোদ্ধা, মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান।
রাষ্ট্রপতি হন ১৯৭৭ সালের ২১শে এপ্রিল।
রাজনীতিতে সক্রিয় হন। গঠন করেন রাজনৈতিক দল। তার প্রতিষ্ঠিত দলের নাম বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল সংক্ষেপে বিএনপি। বিএনপি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর। শেখ মুজিবুর রহমান বাকশাল গঠন করে সকল দল নিষিদ্ধ করেছিলেন। গণতান্ত্রিক রাজনীতির পথও রুদ্ধ করে গিয়েছিলেন। জিয়া ক্ষমতায় এসে বহুদলীয় গণতন্ত্র আবার চালু করেন। দেশে নানাবিধ উন্নয়নমূলক কাজের জন্য ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। খাল খনন কর্মসূচি তার সময়ের উল্লেখযোগ্য কাজ ।
দেশে বিদেশে জিয়া পরিচিতি পেতে থাকেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে।
তিনি প্রায় চার বছর রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিলেন। এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে ১৯৮১ সালের ৩০শে মে তিনি নিহত হন। দেশ হারায় এক মহান শাসক। ৩০ মে বাংলাদেশের ইতিহাসে এক শোকার্ত দিন। জাতি আজও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন ইতিহাসের মহানায়ক শহীদ জিয়া’র নাম।
তাহ ইসলামের লেখাটি অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত, কিন্তু তথ্যগুলো ঠিকভাবেই এসেছে। রাজনৈতিক চিন্তার বিষয়টি আরো বিস্তৃত হতে পারতো, সেই দাবি পূরিত হলে পাঠকেরা জিয়ার ন্তিার স্বাধীনতাটি বুঝতে পারতো। খালকাটা কর্মসূচি কেবল তার রাজনৈতিক ও সামাজিক দূরদৃষ্টিরই পরিচায়ক নয়, আমাদের উৎপাদনের রাজনীতির ডাইমেনশনার কীর্তিও। কৃষির উন্নয়নে পানি যে কি প্রয়োজন, শুকনো মওসুমে সেটা আমরা হাড়ে হাড়ে জেনেছি। জিয়ার চিন্তা যে কৃষি আর কৃষকের জন্য ছিলো নিবেদিত, খালখনন কর্মসূচি তার একটি প্রমাণ। ধন্যবাদ সাজ্জাদ বিপ্লব শহীদ জিয়াকে নিয়ে লেখা ছাপানোর জন্য।