এ কে আজাদ
[বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় সৃজনশীল কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ (১৩ নভেম্বর ১৯৪৮ — ১৯ জুলাই ২০১২) এর প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা।]
…………
হুমায়ূন আহমেদ বাংলা সাহিত্যের ক্ষণজন্মা এক রহস্য পুরুষ, স্বাধীনতা-উত্তরকালে বাংলাদেশে ঝড়োগতির এক কথাসাহিত্যিক। ‘নন্দিত নরকে’ উপন্যাসের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে তার সমারোহে যাত্রা শুরু হয়। মাটির মানুষ, মানুষের জীবন, জীবনের নানান ঘাত-প্রতিঘাত, আনন্দ-বেদনা, যাপিত জীবনের বাঁকে বাঁকে ঘটে যাওয়া নানান ঘটনা ইত্যাদির পাশাপাশি তার লেখায় উঠে এসেছে জীবনের রহস্যময়তা। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর বিচিত্র্য রঙের আঁচড় দিতে দিতে তিনি এক সময় হয়ে উঠেন হলুদ হিমু। গল্প, উপন্যাস, নাটক, সিনেমার চিত্রনাট্য লিখেছেন দু’হাতে। সিনেমা তৈরি করতে গিয়ে লিখেছেন বেশকিছু গান।
গানগুলোর ভাষা খানিকটা ব্যতিক্রমী, গঠনশৈলীও গতানুগতিক ধারা থেকে কিছুটা ভিন্ন রকম। গানের ভাবও হুমায়ূনীয় নিজস্ব ঢঙের অর্থাৎ খানিকটা রহস্যময়ী। হুমায়ূন আহমেদের গানগুলোকে বিভিন্ন পর্যায় ও শ্রেণিতে ভাগ করতে গেলে আমরা দেখতে পাই যে একটা উল্লেখযোগ্য অংশে হুমায়ূন আহমেদ তার মনের মুকুরে গ্রথিত অতীন্দ্রিয়বাদকে আশ্রয় করেছেন। অতীন্দ্রিয়বাদের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো মিস্টিসিজম, যার অর্থ হলো- ধ্যান ও আত্মসমর্পণের দ্বারা সৃষ্টিকর্তার সাথে জীবনের প্রত্যক্ষ যোগ বা লয় হতে পারে এই মতে বিশ্বাস।
হুমায়ূন আহমেদের গানে অতীন্দ্রিয়বাদের প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো “চান্নি পসর রাইতে যেন আমার মরণ হয়,” “উড়াল পঙ্খী রে যা যা তুই উড়াল দিয়া যা,” মরিলে কান্দিসনা আমার দায়” ইত্যাদি।
“চান্নি পসর রাইতে যেন আমার মরণ হয়” গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন এই ময়ের অন্যতম সেরাকণ্ঠ শিল্পী এসআই টুটুল। আলোচনার সুবিধার্থে গানটির লিরিক্স এখানে তুলে ধরা হলো-
ও কারিগর,! দয়ার সাগর! ওগো দয়াময়।
চান্নি পসর রাইতে যেন আমার মরণ হয় ॥
চান্নি পসর চাঁদনী পসর আহারে আলো
কে বেসেছে কে বেসেছে তাহারে ভালো
কে দিয়েছে নিশি রাইতে দুধের চাদর গায়
কে খেলেছে চন্দ্র খেলা ধবলো ছায়ায়॥
(ও কারিগর….. মরণ হয়॥)
এখন খেলা থেমে গেছে মুছে গেছে রঙ
অনেক দূরে বাজছে ঘণ্টা ঢং ঢঙা ঢঙ
এখন যাব অচিন দেশে অচিন কোন্ গাঁয়
চন্দ্র কারিগরের কাছে ধবল পঙ্খী নায় ॥
(ও কারিগর…………… মরণ হয় ॥)
এক অস্থায়ী এবং দুই অন্তরার এই গানটিতে গীতিকার হুমায়ূন আহমেদ একটি প্রার্থনা করেছেন সৃষ্টিকর্তার কাছে। গীতিকার বিশ্বাস করেন যে- “এই পৃথিবীর প্রত্যেকটি জীবকেই মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করতে হবে (আল-কুরআন)”।
অন্যান্য প্রাণীর মতই গীতিকারকেও একদিন বিদায় নিতে হবে এই সুন্দর পৃথিবীর মায়া ছেড়ে। যেতে হবে সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্যে। কিন্তু এই যাবার সময়টা যেন একটা চাঁদনী রাত হয়। কারণ চাঁদনী রাতকে বড় ভালবাসতেন হুমায়ূন আহমেদ। জ্যোৎস্নার মায়াবী আলো ছিল তার কাছে অতি প্রিয়। তার মরণের সময়টা যেন তার প্রিয় সময় চাঁদনী রাত হয়- এমন প্রার্থনা মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে। কেননা চাঁদনী রাত দেখে বড়ই বিস্মিত হয়েছে হুমায়ূন আহমেদের মন। তিনি কল্পনা করেছেন- জ্যোৎস্না ঝলমল রাত যেন দুধের সাদা চাদর গায়ে দিয়ে থাকে। কোন এক রহস্যময় বালক যেন চান্দের আলো নিয়ে খেলা করে চাঁদনী রাতের সাদা ছায়ায় বসে। কারও ভালোবাসার সৃষ্টি যেন এই চাঁদনী পসর রাত-
এমন বিস্ময় গীতিকারের মনে।
গানটির দ্বিতীয় এবং শেষ অন্তরায় এসে নিজের অসহায়ত্বের কথা এবং সৃষ্টিকর্তার কাছে সম্পূর্ণ আত্মসর্ম্পণ তথা সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রত্যক্ষ সর্ম্পণ বা লয়ের কথা বলেছেন গীতিকার হুমায়ূন আহমেদ। তিনি যেন শুনতে পাচ্ছেন এই পৃথিবী থেকে তাঁর বিদায়ের ঘণ্টাধ্বনি। আর তিনিও যেন বিদায়ের জন্যই প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন। কিন্তু বিদায় নিয়ে কোথায় যাবেন তিনি? সে জগৎ যেন অচেনা গীতিকারের কাছে। কোন দেশে যাবেন তিনি?সে দেশ, সে গ্রাম যেন অচেনা গীতিকারের কাছে।
তবে একথা ঠিক যে এই জ্যোৎস্না মাখা ধবল রাত যেন তাঁর কাছে একটা সাদা ময়ূরপঙ্খী নায়ের মত। এই নায়ে চড়েই যাবেন তিনি সেই সৃষ্টিকর্তার কাছে যিনি যতন করে গড়েছেন এই চাঁদনী রাত, এই চন্দ্র। অর্থাৎ একটা সামগ্রিক আত্মসর্ম্পণ যেন এই চন্দ্রকারিগরের কাছে। এখানে সৃষ্টিকর্তার কাছে একটা কমপ্লিট সারেন্ডারের কথা প্রকাশ করেছেন বিশ্বাসী হুমায়ূন আহমেদ। তার এই গানের মাধ্যমে সম্পূর্ণ আস্তিকতার পরিচয় দিয়েছেন গীতিকার হুমায়ূন আহমেদ, কোন অবিশ্বাস বা নাস্তিকতার চিহ্ন তিনি রাখেননি তাঁর এই গানেÑ যা মিস্টিসিজমের প্রধান বৈশিষ্ট্য।
শিল্পী সুবীর নন্দীর গাওয়া হুমায়ূন আহমেদের আরেকটি জনপ্রিয় গান হলো-
ও আমার উড়াল পঙ্খীরে!
যা যা তুই উড়াল দিয়ো যা,
আমি থাকব মাটির ঘরে
আমার চক্ষে বৃষ্টি পড়ে
তোর হইবে মেঘের উপরে বাসা॥
আমার মনে বেজায় কষ্ট
সেই কষ্ট হইলো পষ্ট
দুই চক্ষে ভর করিলো আঁধার নিরাশা
তোর হইলো মেঘের উপ্রে বাসা॥
(ও আমার উড়াল……….. দিয়া যা॥)
মেঘবতী মেঘ কুমারী মেঘের উপ্রে থাকো
সুখ-দুঃখ দুই বইনেরে কোলের উপ্রে রাখো॥
মাঝে মধ্যে কান্দন করা মাঝে মধ্যে হাসা
মেঘবতী আজ নিয়াছে মেঘের উপরে বাসা॥
(ও আমার উড়াল……….. দিয়া যা॥)
এই গানটি একটি স্থায়ী এবং দুইট অন্তরার
সমন্বয়ে লেখা, তবে একে অপরের সাথে তুলনা
করলে অন্তরা দুইটি অনিয়মিত, গঠনের দিক
বিবেচনা করলে প্রথম অন্তরা দ্বিতীয় অন্তরা থেকে
আলাদা,
সুখ-দুঃখের জীবনে আত্মার সাথে দেহের দ্বৈত সম্পর্কই যেন গানটির উপজীব্য, গানটি হুমায়ূন আহমেদের অতীন্দ্রিয়বাদ বা মিস্টিসিজমের আবার একজন মানুষ মারা যাওয়ার সাথে সাথেই তার রুহু বা আত্মা আবার আরশ মহল্লায় ফিরে যায় সেই মহান সৃষ্টিকর্তার দরবারে। জীবনে নতুন প্রাণের সঞ্চারে মানুষ যেমন খুশী হয়, আনন্দের জোয়ারে ভাসে, তেমনি বেদনাক্লান্ত হয় যখন একজন মানুষ মারা যায়। মরণের পরে সীমাহীন অমানিশা ঘিরে ধরে মানুষের দু’চোখ জুড়ে। আর প্রাণ পাখিটা উড়ে যায় মেঘের দেশে, অথচ এই মেঘের দেশে থাকা প্রাণ পাখিকে মর্তের মানুষ কত না ভালোবাসে। মেঘবতী, মেঘকুমারী ইত্যাদি কত না বিশেষণে এই উড়াল পাঙ্খীকে মানুষ বিশেষায়িত করে। কিন্তু যে অতিথি পাখি পোষ মানে না, কেবলই একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। গানটিতে গীতিকার মানুষের রুহু বা আত্মাকে একটা উড়াল পঙ্খীর সাথে তুলনা করেছেন, গীতিকার মনে করেন উড়াল পঙ্খী যেমন সুযোগ পেলেই খাঁচা থেকে বের হয়ে উড়ে যায়। তেমনি মানুষের আত্মাও দেহের খাঁচা ছেড়ে একদিন উড়ে যাবে। আর দশজন মুসলমানের মতই গীতিকার হুমায়ূন আহমেদ বিশ্বাস করেন যে মহান সৃষ্টি কর্তা থাকেন ঐ আকাশে, আর সেই সৃষ্টিকর্তাই সব রুহুকে সৃষ্টি করে রেখে দিয়েছেন ঐ আকাশেই। একজন মানুষকে যখন এই মাটির পৃথিবীতে পাঠানো হয়, তখন ঐ আরশ মহল্লা থেকে মাটির মানুষকে জীবন দেয়া হয়। উড়ে যেতে চায়, সেই পাখিরে কি ধরে রাখা যায়? না, যায় না। সে পাখি আপন হয় না, উড়ে যায়, কিন্তু দুদিনের জন্য সে যেন আপন হওয়ার অভিনয় করে। মানুষকে দু’দেনের জন্য হাসির নদীতে ভাসায়। আবার কান্নার জলে ভাসিয়ে উড়ে যায় মেঘের দেশে।
যখন সেই উড়াল মর্তের মানুষের বুখে বাসা বাঁধে মানুষ তাকে কত আদর করে কত মধুর নামে যাকে, কত না মায়ার বাঁধনে তাকে বাঁধতে চায় মানের মুকুরে। আর হুমায়ূন আহমেদ আদর করে এই পাখির নাম দিয়েছেন ‘মেঘবতী’। তাকে আবার ডেকেছেন ‘মেঘকুমারী’ নামে, যখন সেই মেঘকুমারী তার দিকে মায়ার দৃষ্টিতে তাকায় তখন আনন্দের ঝর্ণাধারা প্রবাহিত হয় জীবনের নদী বেয়ে, আর যখন অভিমান করে উড়ে যায় আকাশে তখন অশ্রুবৃষ্টি হয়, সেই পাখির এক পাখাতে যেন সুখের বসবাস, আর অন্য পাখাতে দুঃখের বজ্র নিনাদ, কিন্তু একদিন পাখিটা মায়ার বাঁধন ছিঁড়ে উড়েই যা। তাইতো গীতিকার হুমায়ূন আহমেদের কণ্ঠে নিরাশার সুরধ্বনি- ‘যা যা তুই উড়াল দিয়া যা।’ গীতিকার মনে করেন যেদিন প্রাণ পাখিটা উড়ে যাবে মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে সেদিন নিষ্প্রাণ দেহ পড়ে রবে অন্ধকার মাটির ঘরে। সেদিন মাটির ভরে ক্রমে ক্রমে পঁচে যাবে মাটির দেহ, মিশে যাবে মাটির সাথে। অনেক বলা আর না বলা কথার ভাষার আধার রঙিন চোখ দু’টো ভরে যাবে বেদনার বৃষ্টিতে। একদিন বৃষ্টি ফুরিয়ে যাবে, চোখের জল শুকিয়ে যাবে, নিরাশার অতল অন্ধকারে চিরতরে হারিয়ে যাবে মানুষের নাম ঠিকানা। আর অবিনশ্বর প্রাণ পাখি-মানুষের রুহু- ফিরে যাবে সৃষ্টিকর্তার কাছে ধরা ছোঁয়ার নাগালের বাইরে থাকা মেঘের দেশে।
রহস্যময় গীতিকার হুমায়ূন আহমেদ মারা যাওয়ার মাত্র কিছুদিন আগে লিখলেন তার অতীন্দ্রিয়বাদের রাজসাক্ষী আরেকটি গানÑ “মরিলে কান্দিস না আমার দায়, রে যাদু ধন।” সেই গানটির ভিডিও ইউটিউবে সহজলভ্য, গানটি প্রথম গেয়েছেন তার দ্বিতীয় স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন। হাসন রাজা, শাহ আব্দুল করিম, লালন ফকিরসহ অনেক মরমী গীতি-কবির মত তিনিও লিখলেন চিরসত্য অলঙ্ঘনীয় মৃত্যু ’নিয়ে মর্মস্পর্শী গান। ইউটিউবে পাওয়া ভিডিওতে দেখা যায় যে খাটের উপর বসে সুললিত কণ্ঠে অত্যন্ত করুণ সুরে গান গাইছেন মেহের আফরোজ শাওন আর জল ছলছল আঁখিতে কি যেন ভাবছেন আর মন্দ্রমুগ্ধ হয়ে নিজের লেখা গান শুনছেন সব্যসাচী লেখক হুমায়ূন আহমেদ। পরবর্তীতে অবশ্য গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন বাংলাদেশের প্রথিত যশা শিল্পী সুবীর নন্দী, গানটির কথা হলোÑ
মরিলে কান্দিস না আমার দায়
রে যাদু ধন! মরিলে কান্দিস না আমার দায় ॥
সুরা ইয়াসিন পাঠ করিও বসিয়া কাছায়
যাইবার কালে বাঁচি যেন শয়তানের ধোঁকায় ॥
(রে যাদু ধন! মরিলে…. দায় ॥)
বুক বান্দিয়া পাশে বইসা গোসল করাইবা,
কান্দনের বদলে মুখে কলমা পড়িবা,
(রে যাদু ধন! মরিলে….. দায় ॥)
কাফনো পিন্দাইয়া যদি কান্দো আমার দায়
মসজিদে বসিয়া রে কান্দো আল্লাহরই দরগায় ॥
(রে যাদু ধন! মরিলে….. দায় ॥)
একজন প্রকৃত মুসলমানের মৃত্যুকালীন যে সাংস্কৃতিক কার্যাদি করা হয় তার প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস পরিলক্ষিত হয় হুমায়ূন আহমেদের এই গানটিতে। সাধারণত: মুসলিম সমাজে একজন মানুষ মারা গেলে যে আচারাদি করা হয় সেগুলো পরিপালন করার জন্যই গীতিকার যেন এই ড্রামাটিক মনোলগ ধরনের গানটিতে অনুরোধ করেছেন তার আপনজনের নিকট। প্রতিটি প্রাণীই এই পৃথিবীতে মরণশীল। প্রতিটি মানুষই একদিন মারা যাবে, যে মানুষটি এই মাত্র মারা গেলো তার জন্য কান্নাকাটি করে তো আর লাভ নেই। বরং মুসলমান রীতিতে মৃত্যুর মুখে পতিত ব্যক্তির পাশে বসে পবিত্র কুরআন শরীফের সূরা ইয়াসিন পাঠ করার ব্যাপারে মহানবী (সাঃ) নির্দেশনা দিয়েছেন। মুমূর্ষুব্যক্তি শয়তানের আছর থেকে মুক্ত হয়। এতে মৃত ব্যক্তির আত্মার প্রশান্তি হয়। আল্লাহ্র রহমত বর্ষিত হয়। হাদীসের এই মর্মবাণী সম্বন্ধে পূর্ণ ওয়াকিবহাল ছিলেন গীতিকার হুমায়ূন আহমেদ। বোধ করি সে কারণেই তিনি লিখেছেন যে- তিনি মারা গেলে কান্না কাটির বদলে তার শয্যার পাশে বসে যেন কলেমা পড়া হয়, পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত করা হয়। তার লাশের শেষ গোসল করানোর সময় যেন বার বার কালেমা পড়া হয়। গোসল শেষে যখন তাকে কাফন পরানো হবে, কবর দেশে নিয়ে যাওয়ার জন্য, তখন যদি তার আত্মীয়-স্বজনেরা কান্নাকাটি করে, তারা যেন মসজিদে গিয়ে দু’হাত তুলে মহান সৃষ্টিকর্তা, দোজাহানের বাদশা সারা বিশ্বের অধিপতি মহানপ্রভূ আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে কান্নাকাটি করে, সেখানে মৃত ব্যক্তির জন্য আল্লাহ্র কাছে তারা যেন ক্ষমা প্রার্থনা করে; তারা যেন সেই রবের কাছে রহমত কামনা করে। রসূলে কারীম (সাঃ) এর বাণী অনুযায়ী মৃত ব্যক্তির কাছে আহাজারী করলে মৃত ব্যক্তির কষ্ট বাড়ে। বরং কুরআন তিলাওয়াত করলে মাইয়েতের জন্য মহান রবের কাছে রহমত কামনা করলে, মাইয়েতের জন্য রহম হয়। তাইতো একজন প্রকৃত মমিনের ন্যয় হুমায়ূন আহমেদ তার মৃত্যু শয্যায় কান্নাকাটি করতে নিষেধ করেছেন। বরং আল্লাহ্র কাছে তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে বলেছেন। অর্থাৎ মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে তার যে আত্মসমর্ণের বাসনা, মহান রবের ক্ষমা লাভ করা এবং তার রহমত লাভ করার জন্য তার যে বাসনা তারই প্রতিফলন যেনএই গানটির প্রতিপাদ্য।
এছাড়াও শিল্পী সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠে গাওয়া
“আমার ভাঙা ঘরে, ভাঙা চালা, ভাঙা বেড়ার ফাঁকে।
অবাক জোছ্না ঢুইকা পড়ে, হাত বাড়াইয়া ডাকে।”
গানটিও যেন অশরীরী তত্ত্ববহুল এবং রহস্যময়তায় পূর্ণ। চান্দের আলোকে যেভাবে তিনি পারসোনিফিকেশন করেছেন, যেভাবে গূঢ় রহস্যের জাল বুনেছেন- তাও যেন গীতিকার হুমায়ূন আহমেদের অতীন্দ্রিয়দেরই পরিচায়ক।
উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে একথাই বলা যায় যে- শেষ জীবনে এসে হুমায়ূন আহমেদ গানের যে জগৎ তৈরি করেছিরেন, তার একটা বড় অংশ জুড়েই ছিল তার মিস্টিসিজম বা অতীন্দ্রিয়বাদ। সৃষ্টিকর্তা তথা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস এবং আস্থা তাঁকে অতীন্দ্রিয়বাদ বা মিস্টিসিজমে দীক্ষায় উদ্বুদ্ধ করেছে। অতীন্দ্রিয়বাদের দীক্ষা তার সাহিত্য কর্মে, উল্লেখযোগ্যভাবে তার লেখা বাংলা গানে বিশেষভাবে পরিলক্ষিত।
ইংরেজি সাহিত্যের রোমান্টিক যুগের কবি শেলি, এসটি কলরিজ, উইলিয়াম ওয়ার্ডস ওয়ার্থ প্রমুখ কবিদের মত আমাদের হুমায়ূন আহমেদও যেন প্রকৃতির মাঝে ঈশ্বরের অদৃশ্য শক্তির প্রতি ছিলেন অগাধ বিশ্বাসী। বোধ করি সে কারণেই নদীর জল, শ্রাবণের বৃষ্টি, চাঁদের জ্যোৎস্না প্রভৃতি প্রকৃতির নানান পরতে তিনি খুঁজে পেতেন একটা অদৃশ্য শক্তিকে যাকে কেবল তিনি অনুভব করতেন, তার কাছে যাহীত চাইতেন, তাকে ধরতে চাইতেন। কিন্তু সেই “অবাক জোছনা” যেন তাকে ধরা দিতে চাইত না। তাকে যেন কেবল হাত ইশরায় ডাকত কিন্তু মুখে কথা বলত না, যে কেবলই অদৃশ্য একটা অচিন সূরে গান গাইত। হুমায়ূন আহমেদ যেন সেগান শুনতে পেতেন। আর সেই অদৃশ্য মনের মানুষটি যেন সুরে সুরে তাকে বলত- “আমার কাছে আইলে বন্ধু আমারে পাইবা না।” তাই তো হুমায়ূনের আফসোম- হাত ভর্তি চান্দের আলো ধরতে গেলে নাই।
অর্থাৎ একটা অদৃশ্য, অধরা কিন্তু প্রবলভাবে অনুভূত একটা শক্তির কাছে গীতিকার হুমায়ূন আহমেদ যেন নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন। তাকে যেন মনের অজান্তেই মনের মণি কোঠায় ঠাঁই দিয়েছিলেন। তার কাছে তিনি বারবার ফিরে যেতেন। তাকেই যেন বানিয়েছিলেন মনের মানসী, সকল শান্তির আধার, স্বস্তির ঠিকানা এমনিভাবেই হুমায়ূন আহমেদ হয়ে গেলেন মায়াবী কথার এক অতীন্দ্রিয়বাদী গীতিকার।
……..
লেখক : কবি ও গবেষক