কাব্যভাবনা
কবির কাজ কবিতায় কোনো অর্থ তৈরি করা অথবা কবিতার মাধ্যমে একটা ম্যাসেজ দেয়া নয়। কবিতা কোনো paraphraseও নয়।
বুকের মাঝে যে অনুরণন তৈরি হয়, সেটাকে শব্দের মাধ্যমে প্রবাহিত করা।
সেই প্রবাহ আমাকে নিয়ত কবিতা লিখতে সহায়তা করে।
এই প্রবাহ আবার প্রতিনিয়ত বাক নিচ্ছে–সময় ও জীবনের প্রয়োজনে। এসে যোগ হচ্ছে নতুন কবিতায়ও। আমি মনে করি, যে কবি, শব্দে, চেতনায়, উপলব্ধিতে তার সময়কে ধারণ করতে পারবে না, তার কবিতা
অনেকটা পরিত্যাক্ত জাহাজের মতোই।
কবিতা বরাবরই আঞ্চলিক। তাই আমি যেখানে অবস্থান করি সেখানকার মাটি ও মানুষের সাথে
বেড়ে ওঠার চেষ্টা করি। যেটা কবিতাকে প্রাণ দেয়।
তাই কবিকে তার সামনে বয়ে-চলা জীবনকে পাঠ করতে হবে বেশি।
আলিঙ্গন
কোনো মৃত্যুকে আমি
ছুঁয়ে রেখে আসি নদীর ওপারে।
চৈতন্য এসে ডাক দেয়।
সূর্যস্নাত আলোতে পাখিদের
কোলাহল এসে থেমে যায়।
উজানের ঢেউ তড়পায় স্রোতে।
বিপন্ন আঙুল বেয়ে উঠে আসে
মেঘ ও নৈশব্দ।
তারপর ধীরে চলে যায়
নির্নিমেষ ছায়ার বিবরে।
একটি মৃত্যু নীরবে শুয়ে আছে।
একটি ছায়া তার পাশে।
নদীর এপার থেকে দেখি আমি।
পেছনে তাকিয়ে দেখি
ফেলে-আসা মাইলের পর মাইল দূরে চিম্বুক পাহাড়।
অনন্ত ক্লান্তি তার–ছায়ার।
রেখেছে তবু মৃত্যুকে ছুঁয়ে গভীর আলিঙ্গগনে।
নদী
জাহাজ ডুবির গল্প বলতো বয়স্ক লোকেরা।
তাদের চারপাশে আমরা
চোখের আগুন জ্বালিয়ে রাখতাম মাঘের রাতে।
আজ তোমার গ্রীবার মতো ঢেউ এসে
প্লাবিত করেছে আমাদের শহর!
এই শহরে কিইবা আছে বলো?
একটি নদী–শেওলায়, কাদায় থকথকে;
সে-ও আজ জলে পরিপূর্ণ।
আমরা সাঁতরাতে জানলে, ডুব দিয়ে মাছ হয়ে যেতাম।
মাছের জীবন নিয়ে বেঁচে থাকতাম নদীর গভীরে।
কিন্তু কেউ আমাদের নিয়ে ভাবেনি।
শুনেছি শুধু অন্ধলোকটি চলে যেতে
নিযুত ঢেউ গুনে-গুনে।
আমরা এখন সূর্য কত দূর দেখে নি
–একদিন জল নেমে যাবে ভেবে।
এই শহরে একটি নদী।
ফনিমনসার মতো তার বুক।
জলপাই-এর মতো গাঢ় হয়ে গেলে জলের রঙ,
সে নদীর কান্না আমার কানে বাজে।
দূরের মিনারের আলো যেন স্তব্দতায় ঢাকা মৃত্যুর শূন্যতা।
হয়ত একদিন জল নেমে যাবে।
গাঢ় রঙের একটি ফড়িং এসে বসবে চরে।
মেয়েলি অসুখে পাতাগুলো
ভারাক্রান্ত হয়ে পড়বে ব্যথায়।
তবুও নদীটির কথা কেউ মনে রাখবে না।
নদীর কান্না দ্রাবিড় হয়ে পড়ে থাকবে পাড়ে।
হরিণের শিঙের মত চাঁদ উঠবে।
ছোট-ছোট স্রোত ভিজিয়ে দিয়ে যাবে পড়ে-থাকা শেওলা।
আমার ভালবাসা এই মরা নদীতে শুকিয়ে যাবে,
কেউ জানবে না, কোনো দিন জানবে না।
পোকা
তারপর তিনি তার ছায়াটিকে গড়িয়ে দেন।
একটি জাহাজ ডক ছেড়ে চলে যাচ্ছে দূরে।
জানো কোন্ উপগ্রহে সে চলে যায়? জানো কি তার নাম?
একটি পোকা ধীরে-ধীরে হাঁটতে-হাঁটতে চলে এসেছিল
আমার খুব কাছাকাছি।
এখানে কোনো মানুষ নেই।
একটি ক্ষয়িষ্ণু সকাল।
একটি হরিণের পদচীহ্ন।
কিছু অসহায় রোদ।
পোকাটি একবার মাত্র তাকিয়েছিল চোখে-চোখে।
সে কি কিছু বলতে চেয়েছিল?
নাকি কোনো দিয়েছিল অভিসম্পাত?
মনে পড়ে একদিন এক প্রবল বৃষ্টিপাতের রাতে
একটি পোকা আমার ঘরে আশ্রয় নিয়েছিল;
আমি তাকে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম।
আজ এই বিধ্বস্ত গোধূলিতে আমার কেউ নেই।
চুলোয় একা সিদ্ধ হচ্ছে মাছ।
বাইরে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে চাঁদ।
অনাথ বালকের খুব ইচ্ছে ছিল ছুঁবে তাকে।
আলোর কাছে আমার দেনা পাহাড় সম।
আমি আত্নহনের মতো নিঃসঙ্গ হয়ে আছি।
পোকাটি ধীরে-ধীরে চলে যাচ্ছে অন্য কোথাও।
হাতের মুঠোয় আটকে ছিল সব দীর্ঘশ্বাস।
আমি কাউকে কিছুই বলিনি,
শুধু ছায়াটিকে নীরবে গড়িয়ে দিয়েছিলাম।
বৃষ্টি
কাল কোনো বৃষ্টি হবে না,
নিশ্চিত জেনেও মৃত মেঘ ছিল উঠোনে।
নীলিমার ছাদে বৃষ্টি নামে বিনয়ে
–প্রপাতের মতো।
আমার ঘরে নয়।
যত দূর দেখি, শূন্যতার দ্রাঘিমা, বিষুবরেখা।
পাখিদের পালকভাঙা উড়ে যায় তুমুল বাতাসে।
আমারও পীড়ন জাগে বুকে।
চোখ বুজে রাখি বালকের মতো।
যদি বৃষ্টি হতো–
ভেজা রোদে–জলছাপ-এ-বুক বিছিয়ে দিতাম।
বৃষ্টি হয় নি। নদীতে এসে সব স্রোতগুলো ভীড়ে।
বাঁশির করুণ সুরের মতো গোধূলী হয়ে ওঠে একা।
কপালের ভাঁজে কালো দাগগুলো
লুকিয়ে থাকে সংকোচে।
টাঙিয়ে রাখি গ্লানি পাঁজরে।
দ্বৈরথ-রাত এলে–তারাদের শুধু বলে রাখি
এইসব ঘোর বেদনাগুলো।
শাহেদ সাদ উল্লাহ‘র জন্ম কক্সবাজার শহরে
–৬ই নভেম্বর, ১৯৭২ সালে। তিনি একাধারে কবি, শিশুসাহিত্যিক, অনুবাদক, চিত্রশিল্পী ও সংগীতশিল্পী। তিনি মূলত নব্বই দশকের কবি।
তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা চারটি;
‘যেতে-যেতে পাতালসড়ক’, ‘জনান্তিকে জলরেখা‘, ‘পাথরের মতো চোখ’ ও শিশুতোষ গল্পগ্রন্থ,‘ বাঘের পিঠে ১০০ মাইল’। ‘মেঘ ডট ক্লাউডস’ নামে তার একটি গানের সিডিও রয়েছে।
নব্বইয়ের দশকে তিনি লিটলম্যাগ ‘কুয়াশা‘ সম্পাদনা করতেন।
বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন।
কবিতাগুলো চমৎকার।
কবিতকে চিনতাম, কিন্তু দীর্ঘদিন বিচ্ছিন্ন। শুভেচ্ছা নিরন্তর!