spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদপ্রবন্ধচুমুকরোজ্জ্বল স্নিগ্ধতায় ভেজা ঘাস

লিখেছেন : কাজী জহিরুল ইসলাম

চুমুকরোজ্জ্বল স্নিগ্ধতায় ভেজা ঘাস


কাজী জহিরুল ইসলাম


ঘটনা যে একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে এটা তিনি জানতেন। বিনয়ের সাথে ঘটনাটিকে তিনি “ঘাসের ঘটনা” বলেই জানালেন পৃথিবীকে। সেই ঘাসই যে একদিন মহীরুহ হয়ে উঠবে তা টের পেয়েছিলো বাংলা সাহিত্য। সেই শুরুতেই আবিদ আজাদ স্বপ্নের ভেতর মানুষের হাত ধরতে গিয়ে জেনে ফেলেন স্তব্ধতার অর্থ; আর আমরা দেখি সেই স্তব্ধতার ভেতর থেকে জাদুমন্ত্রের মতো বেরিয়ে এলেন একজন পরিপূর্ণ কবি। আবিদ আজাদের কবিতার শরীর যেন এক পাহাড়ি নদী, খলবল করে ছুটে চলে সমতলের বুক চিরে; ক্রমশ তা প্লাবিত করেছে, উর্বরা করে তুলেছে আমাদের কাব্যাঙ্গন। যে “ঘাসের ঘটনা” দিয়ে তার এই নতুন জন্মযাত্রা সেই ঘটনাটি তিনি ঘটান এভাবে,

স্বপ্নের ভিতর আমার জন্ম হয়েছিল

সেই প্রথম আমি যখন আসি
পথের পাশের জিগা-গাছের ডালে তখন চড়চড় করে উঠছিল রোদ
কচুর পাতার কোষের মধ্যে খন্ড-খন্ড রুপালি আগুন
ঘাসে-ঘাসে নিঃশব্দ চাকচিক্য-ঝরানো গুচ্ছ গুচ্ছ পিচ্ছিল আলজিভ
এইভাবে আমার রক্তপ্রহর শুরু হয়েছিল
সবাই উঁকি দিয়েছিল আমাকে দেখার জন্য
সেই আমার প্রথম আসার দিন
হিংস্রতা ছিল শুধু মানুষের হাতে,
ছিল শীত, ঠান্ডা পানি, বাঁশের ধারালো চিলতা, শুকনো খড়
আর অনন্ত মেঝে ফুঁড়ে গোঙানি –
আমার মা
স্বপ্নের ভিতর সেই প্রথম আমি মানুষের হাত ধরতে গিয়ে
স্তব্ধতার অর্থ জেনে ফেলেছিলাম,
মানুষকে আমার প্রান্তরের মতো মনে হয়েছিল-
যে রাহুভুক।
অন্যমনস্কভাবে আমার এই পুনর্জন্ম দেখেছিল
তিনজন বিষণ্ণ অর্জুন গাছ।
সেই থেকে আমার ভিতরে আজও আমি স্বপ্ন হয়ে আছি-

মা, স্বপ্নের ভিতর থেকে আমি জন্ম নেব কবে?
(জন্মস্মর)

পিবি শেলী কবিতাকে স্বর্গীয় বিষয় বলেছেন। তিনি বলেন, “সুন্দর মনের সুখকর অনুভূতিগুলোর রেকর্ডই হচ্ছে কবিতা”। ‘জন্মস্মর’ কবিতায় আমরা সেইরকম কিছু সুখকর অনুভূতির রেকর্ড দেখতে পাই। এই কবিতাটিই কবি আবিদ আজাদের কবি হিশেবে আত্মপ্রকাশের জন্মবৃত্তান্ত। নতুন জন্মের ইতিকথা। প্রকৃতির মধ্যে অবগাহনের মধ্য দিয়ে যে এই কবির জন্ম হয়েছে এবং সেই প্রকৃতি যে আধাশহুরে বাংলাদেশের প্রকৃতি তা আমরা সুস্পষ্টভাবেই দেখতে পাই যখন জিগা গাছের ডালে চড়চড় করে ওঠে রোদ, কচুপাতার কোষের মধ্যে জ্বলে ওঠে খন্ড খন্ড রুপালি আগুন। বাঁশের ধারালো চিলতা, শুকনো খড় আর অনন্ত মেঝে (অর্থাৎ বাংলাদেশের মাটি) ফুঁড়ে বেরিয়ে আসেন কবি আবিদ আজাদ। তিনি স্বপ্নের ভেতর কী অবলীলায় মানুষের হাত ধরে ফেলেন, সেই হাত নিরুত্তাপ; কবি জেনে ফেলেন স্তব্ধতার নতুন ভাষা। তার এই পুনর্জন্ম প্রত্যক্ষ করেন তিনজন অগ্রজ কবি যাদেরকে তিনি চিহ্নিত করেছেন তিনটি অর্জুন বৃক্ষ হিশেবে। ‘তিন’ সংখ্যাটির প্রতি কবি আবিদ আজাদের দুর্বলতা অন্য কবিতায়ও লক্ষ্যনীয়।

খুব কম কবিই তার প্রথম কাব্যগ্রন্থে নিজস্ব একটি কাব্যভাষা তৈরী করে ফেলতে পারেন। নিজস্ব কাব্যভাষা কেবল বই পড়ে তৈরী হয় না, এজন্য দরকার অভিজ্ঞতা এবং পৃথিবীকে, পরিবেশ ও প্রতিবেশকে দেখার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গী। কবি আবিদ আজাদের সেই অভিজ্ঞতা এবং চোখ ছিল বলেই তিনি “ঘাসের ঘটনা” দিয়েই কাঙ্ক্ষিত ঘটনাটি ঘটিয়ে ফেলেছেন। এই দক্ষতাই তাকে বাংলা ভাষার একজন প্রধান কবি বা মেজর পোয়েট করে তোলে।

একটি ভাষার কাব্যসাহিত্যে নতুন কিছু যোগ করতে না পারলে কেউ মেজর পোয়েট হয়ে উঠতে পারেন না। আবিদ আজাদের বলার ভঙ্গিটিই সত্তরের দশককে পূর্ববর্তী কবিতার ধারা থেকে বের করে আনে। ত্রিশে নির্মিত আধুনিক বাংলা কবিতার ধারাকে চল্লিশ, পঞ্চাশ এবং ষাটের কবিরা কেবল অনুকরণ করেছেন। ত্রিশ থেকে ষাট, এই সময়ের মধ্যে বাংলা কবিতায় নতুন কোনো তরঙ্গ দেখা যায় নি। হ্যাঁ, একথা ঠিক যে একটি নতুন ধারাকে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে সময়ের প্রয়োজন, ত্রিশের কবিরা যে ধারাটি নির্মাণ করেছেন সেটিকে গণমানুষের (কবিতাপ্রেমী জনগোষ্ঠীর কথা বলছি) কাছে পৌঁছে দেবার কাজটি করেছেন পঞ্চাশ এবং ষাটের কবিরা। সময়ই তাদেরকে দিয়ে সেই কাজটি করিয়েছে। সময়ই আবার আবিদ আজাদকে নির্বাচন করেছে বাংলা কবিতায় নতুন তরঙ্গ তোলার জন্যে। দক্ষ নাবিকের মতোই তিনি নিষ্ঠার সাথে সেই কাজ করেছেন।

মেঘেরাও যৌনকর্ম করে
গোধুলিবেলায় যখন ওদের শরীরে প্রচুর অবসর
যখন নির্মল থাকে মন
তখনই কেবল মিলিত হয় ওরা আকাশ-শৃঙ্গারে

একটি মেঘের কোমর জড়িয়ে ধরে এসে আরেকটি মেঘ
চুমু খায় স্তনান্তের নীলে, আলিঙ্গন ব্যবহার করে – শুদ্ধললাটিকা
তারপর মিশে যায় অনাবৃত সুন্দর আসনে।

মেঘদের এই চুমুকরোজ্জ্বল অলস পদ্ধতি
মানুষের জন্যে হতে পারে সর্বোত্তম কামকলা
লিপ্ত থাকা দুটি মেঘ মনে হল যেরকম গভীর অযৌন।

(মেঘদের কামসূত্র)

সাহিত্যে বহুল ব্যবহৃত এবং সুপ্রাচীন ‘কামসূত্র’ শব্দটির সঙ্গে ‘মেঘদের’ জুড়ে দিয়ে তিনি প্রাচীন শব্দটিকে আধুনিক করে তোলেন কবিতার শিরোনামেই। এটিই কবির কাজ। মেঘের সাথে মেঘের সংঘর্ষ, যা থেকে তৈরী হয় বিদ্যুৎ, তাকে কবি দেখছেন মিলনের দৃশ্যে এবং সেই মিলন চুমুকরোজ্জ্বল অলস পদ্ধতির মিলন, যা আবার মানুষের জন্য সুপারিশও করছেন। এটিই তার কালের অর্থাৎ সত্তরের দশকের কবিতায় অভিনবত্ব নিয়ে আসে। লক্ষনীয় যে এই কবিতায় তিনি ‘চুমুকরোজ্জ্বল’ এর মতো একটি নতুন শব্দও উপহার দিয়েছেন বাংলা ভাষাকে। শুধুমাত্র এই শব্দটিই একটি ভীষণ ইতিবাচক চিত্রকল্পের জন্ম দেয়। পাঠকের মন ইতিবাচক শক্তিতে ভরে ওঠে। ছন্দকে তিনি ভেঙ্গেছেন যদিও, সঠিক ছন্দে পয়ার রচনায়ই তাকে অধিক প্রত্যয়ী দেখা গেছে। ‘মেঘদের কামসূত্র’ কবিতাটিও তিনি নির্ভুল অক্ষরবৃত্তে লিখেছেন।

কবিতায় নতুন নতুন চমক তৈরীতে আবিদ আজাদ ছিলেন তার সামসময়িক কবিদের মধ্যে সবচেয়ে সিদ্ধহস্ত। অপ্রচলিত বিষয়, শব্দ, পঙক্তিবিন্যাস সবই পাওয়া যায় আবিদ আজাদের কবিতায়। এমন কি তিনি মৃদু গালাগালিও কবিতায় ব্যবহার করেছেন খুব দক্ষতার সাথে।

দে শালাকে গুনে-গুনে লাগিয়ে দে ক’খানা অদ্ভুত-
প্রথমে পাছায় দু’টো জোর পদাঘাত
তারপর শার্টের কলার ধরে দুই গালে বাছাই থাপ্পড়
দে শালাকে লাগিয়ে দে ক’খানা নির্মম অপরূপ

আবোল-তাবোল ঘুষি, কিলচড়, যা খুশি নিখুঁত
বেদম দুর্বোধ্য মার, শালা জাতপাখি
ঘুঘুর বাবার বাবা, যে কোনো মোহন
ফাঁদ দেখলেই ঢুকে যাবে তস্যঘুঘুদের মতো নির্বিকার
অবিরাম বজ্জাত সে, মজ্জায়-মজ্জায় উদাসীন।

দেখিস বাঞ্চোৎ যেন মরণকে রাজকুমারীর
মতো ফুসলিয়ে নিয়ে চম্পট না দেয়
চরম পরম পেলে আরও বেশি একরোখা গোঁয়ারের মতো
যাবে সে মৃত্যুর দিকে যেন মৃত্যু বাল্যসঙ্গী তার-

সেই কবে কোন বাল্যে সুন্দরের পায়ের পাতায়
একটা রক্তের ফোঁটা দেখেছিল রাংচিতাবনে
খুচরো পয়সার মতো সেই রাঙা ঝলমলানি ভাঙিয়ে ভাঙিয়ে খাবে
আরও যতদিন বাঁচে চোখ বুজে বেঁচে চলে যাবে।

দে শালাকে পাই-পাই করে গুণে খরচ করে দে!
আমাদের মতো জীবনের ভিতরে উপুড় হয়ে পড়ে পড়ে
বাস্তবের রংবাজি আর গোয়ামারা খেতে-খেতে
আমাদের মতো শুধু-শুধু বেঁচে থেকে দেখে যাক
গোধূলির রাঙা-মৃত্যু, দেখে যাক উজ্জ্বল যন্ত্রণা..।

(গোধূলির হত্যাকান্ডে প্রতিদ্বন্দ্বীদের সংলাপ)

এই কবিতার কিছুটা ছিটেফোঁটা আমরা দেখি আরও দুই দশক পরে নব্বুইয়ের তরুণদের হাতে স্ফূর্তি পাচ্ছে। প্রচলিত ধারা থেকে তিনি কতখানি বের করে এনেছেন কবিতাকে এটি তার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বিষয়বস্তু তেমন জোরালো কিছু নয় কিন্তু উপস্থাপন কি অসাধারণ। নিজের ভেতরের আরও একটি সত্ত্বার কথা হয়ত বলেছেন, যা প্রায়শই চতুর রংবাজ হয়ে ওঠে। অথবা এমনও হতে পারে, পাড়ার কোনো মাস্তান, বন্ধুদের মধ্যে কেউ, অথবা কোনো অসৎ রাজনীতিক। বিষয়টিকে নানান প্রেক্ষাপটেই উপস্থাপন করা যায়। কিন্তু মুন্সিয়ানাটা হচ্ছে এর উপস্থাপন কৌশলে, যা এটিকে একটি মাস্টারপিস কবিতা করে তুলেছে। এই কবিতায় তিনি প্রচুর গালি ব্যবহার করেছেন, প্রায়োগিক মুন্সিয়ানার কারণে যা হয়ে উঠেছে সুখপাঠ্য এবং আমি বলবো নান্দনিকও। “গোয়ামারা”র মতো অশ্লীল শব্দের প্রয়োগ যখন এভাবে হয়ঃ “বাস্তবের রংবাজি আর গোয়ামারা খেতে-খেতে/ আমাদের মতো শুধু-শুধু বেঁচে থেকে দেখে যাক/ গোধূলির রাঙা-মৃত্যু, দেখে যাক উজ্জ্বল যন্ত্রণা” তখন অশ্লীল শব্দ প্রয়োগের দায় থেকে আমরা তাকে অনায়াশের মুক্তি দিতে পারি, বরং এই অশোভন এবং অপ্রচলিত শব্দের সাহসী প্রয়োগের জন্য, যা হয়ে উঠেছে নান্দনিক, তাকে খানিকটা প্রশংসাই করতে চাই। সত্যি বলতে কি এই কবিতা পড়ে আমি বরং অনুপ্রাণিত হচ্ছি বাংলা গালিসমুহকে কবিতায় পুনর্বাসনের। অনেক গালি হারিয়ে যাচ্ছে। এগুলোতো আমাদের ভাষার গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। মনে আছে, একবার কবি নির্মলেন্দু গুণ গালির অভিধান তৈরী করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কাজটি করতে পারলে খুব ভাল একটি কাজ হতো। উত্তর প্রজন্ম জানতে পারতো তাদের পূর্বপুরুষেরা কিভাবে নেতিবাচক আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতেন। অপ্রচলিত প্রেক্ষিতে চেনা শব্দের ব্যবহার কবিতাটিকে দিয়েছে অসাধারণ এক কাব্যিক দ্যোতনা। যেমনঃ ‘গুনে-গুনে লাগিয়ে দে ক’খানা অদ্ভুত’, ‘দুই গালে বাছাই থাপ্পড়’, ‘লাগিয়ে দে ক’খানা নির্মম অপরূপ’, ‘আবোল-তাবোল ঘুষি’, ‘সুন্দরের পায়ের পাতায়’, ‘জীবনের ভিতরে উপুড় হয়ে পড়ে পড়ে’, ‘উজ্জ্বল যন্ত্রণা’। আগেই বলেছি কবিতায় নতুন চমক সৃষ্টিতে আবিদ আজাদের দক্ষতা ছিল ঈর্ষনীয়। আর কি টনটনে ছন্দ সচেতনতা, কী নিটোল অক্ষর বৃত্তের বুনন পুরো কবিতাটির শরীর জুড়ে।

আমরা অনেক ছন্দ সচেতন কবির কবিতায় শুদ্ধ ছন্দ ঠিকই পাই কিন্তু কবিতা পাই না, পাই কিছু আরোপিত শব্দরাজি। কিন্তু আবিদ আজাদ যেন এক জাদুকর, তার হাতে স্বতঃস্ফূর্ত ভাষাটি বাঙময় হয়ে ওঠে সঠিক ছন্দে। একটি পাঁচ মাত্রার মাত্রাবৃত্ত ছন্দের কবিতার উদ্ধৃতি দেয়া যাক।

যে বাড়িটার খোপার নিচে ছুরিকাঘাতে
একটি মেয়ে খুন হলো কাল মধ্যরাতে
সেই বাড়িটার চোখে মুখে হাত বা কাঁধের
কোথাও কোনো চিহ্নও নেই আর্তনাদের।
সেই বাড়িটার গলায় ভোর, বুকের কাছে
তাকিয়ে দেখি পাতাবাহার তেমনি আছে
নির্জনতার কোমরে সেই আগের মতোই
ছায়াছন্ন লেপ্টে আছে পাতার অথৈ-
ভিতরে কে টেলিফোনে বলছে কী-কী
বন্ধ গ্যারেজ, বৃষ্টিতে খুব ভিজছে দেখি
সাড়া দুপুর অলিভ রঙের একটি গাড়ি।
মাঠের পাড়ের আটপৌরে সেই বিজন বাড়ি
গ্রীবায় তার একটি নখের আঁচড়ও নেই।
আজকে দেখে মনেই হয়না গতরাতেই
একটি মেয়ে খুন হয়েছে এই বাড়িতেই।

একটি খুনের গল্প কি সুন্দর মিষ্টি ছন্দে তিনি তুলে এনেছেন, সেই সঙ্গে অলংকার হিশেবে উপহার দিয়েছেন মনোমুগ্ধকর বেশ কিছু উপমা/উৎপ্রেক্ষা। “যে বাড়িটার খোপার নিচে” কী চমৎকার নান্দনিক উৎপ্রেক্ষা। “সেই বাড়িটার গলায় ভোর” আরেকটি সুন্দর উৎপ্রেক্ষা। হয়ত কবি দেখছেন এক চিলতে ভোরের আলো এসে পড়েছে অন্য বাড়ির দেয়ালের ফাঁক দিয়ে এই বাড়িটির গেটের কাছে। এভাবে তিনি জানাচ্ছেন, সকাল হয়ে গেছে, সব কিছু তেমনি আছে, শুধু সেই মেয়েটি নেই। আবার এও হতে পারে আক্ষরিক অর্থে খুন হয় নি মেয়েটি কিন্তু খুন হয়ে গেছে তার স্বাধীনতা, খুন হয়ে গেছে তার প্রেম, খুন হয়ে গেছে তার কৈশোর। “মাঠের পাড়ের আটপৌরে সেই বিজন বাড়ি” পঙক্তিটিতে এসে “আটপৌরে” শব্দটিতে ছন্দটা কিছুটা হোঁচট খায় যদিও কিন্তু একটু টেনে পড়লে তা কাটিয়ে ওঠে। এ ছাড়া পুরো কবিতাটিতেই নিটোল মাত্রাবৃত্তের বুনন পাঠক হিশেবে আমাকে মুগ্ধ করেছে।

নানান বিষয়ে লিখেছেন তিনি। আধানাগরিক জীবনকে উপজীব্য করে তার বিষয়বস্তুর ঘূর্ণাবর্ত কিন্তু সত্তরের যে নিজস্বতা, যে উচ্চকন্ঠ, যে দামামা, যে দ্রোহ তা থেকে মোটেও বিচ্ছিন্ন থাকেন নি কবি আবিদ আজাদ, যেমনটি আমরা দেখেছি শিহাব সরকারের বেলায়।

“এখন যে কবিতাটি লিখবো আমি” কবিতায় কবি আবিদ আজাদ ফেটে পড়েছেন তার সমস্ত দ্রোহ এবং সাহস নিয়ে, সার্থক করে তুলেছেন সত্তরের কাব্যাঙ্গনকে। দশকটি হয়ে উঠেছে সাহসী সত্তর।

এখন যে কবিতাটি লিখবো আমি
সেই কবিতাটি এক্ষুনি বাজেয়াপ্ত করা হবে
এক্ষুনি বেআইনি বলে ঘোষিত হবে সেই কবিতার
প্রতিটি শব্দ
প্রতিটি দাঁড়ি কমা
প্রতিটি সেমিকোলন
এক্ষুনি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হবে সেই কবিতার প্রতিটি চরণ।
এখন যে কবিতাটি লিখবো আমি
তার জন্যে মুহূর্তের মধ্যে সারাদেশ জুড়ে নেমে আসবে আরো
একটি উত্থানের প্রাক-মুহূর্তের স্তব্ধতা
নেমে আসবে রাইফেলের নলের মতো
মৃত্যু –
আর সেই মৃত্যুর স্তব্ধতায় বাংলাদেশের আবহমান সবুজ রং
অন্ধকারের মতো কালো হতে হতে ভয়াল গর্জনে ফেটে পড়বে
সমুদ্রের মতো।
এখন যে কবিতাটি লিখবো আমি
তার জন্যে হঠাৎ বোমাবাজির পর
ভরদুপুরের ভীষণ ভৌতিক গলির মতো শান্ত হয়ে যাবে
আমাদের প্রিয়তম এই রাজধানী
বাজতে থাকবে চারিদিকে বুটের আওয়াজ
শুধু বুটের
আওয়াজ
এখন যে কবিতাটি লিখবো আমি
তার জন্যে নিমিষের মধ্যে সারা শহর জুড়ে শুরু হয়ে যাবে
খানাতল্লাশি
তার জন্যে আর্মি-ইন্টেলিজেন্স রুম থেকে বিমানবন্দরে ছড়িয়ে
দেওয়া হবে গোপন নির্দেশ
তার জন্যে বন্ধ করে দেওয়া হবে বিমানের সমস্ত নির্দিষ্ট ফ্লাইট
তার জন্যে চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে সারাদেশে জারি হয়ে যাবে
জরুরি অবস্থা –

এখন যে কবিতাটি লিখবো আমি
তার জন্যে এক্ষুনি দিকে দিকে এসে যাবে চেকপোষ্ট
এক্ষুনি শাহবাগের মোড়ে
টিকাটুলির তেমাথায়
ফার্মগেটের সামনে থামিয়ে দেওয়া হবে
সমস্ত চলন্ত বাস, কোচ আর কোস্টার
লাইন করে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হবে সমস্ত রিকশা ও ঠেলাগাড়ি
আর মুহূর্তের মধ্যে শুরু হয়ে যাবে খানাতল্লাশি
চেক করা হবে সারি সারি যাত্রীদের শরীর
চেক করা হবে মহিলার চামড়ার ব্যাগ
চেক করা হবে কিশোরের খেলনার বল
চেক করা হবে গাড়ির পাদানির নিচ থেকে কার্পেটের অতল অবধি
চেক করা হবে সাইকেলচারী যুবকের প্লাস্টিকের থলি
চেক করা হবে বেতার ভবনের গেটে ঘোষিকার কণ্ঠ
তরুণ কবির বুকপকেট,
বলপেনের দাগভরা আঙুলের ভাঁজ
কেরানীর খাতা
অধ্যাপকের উড়োচুল
কৃষকের কোঁচড়
শ্রমিকের চোখ
পোড়া গাঁর স্কুল
গঞ্জের ক্যানভাসারের গলা
হকারের বগল
গরু-পাইকারের খতি
বেশ্যাপাড়ার দাগী-খুনির লুঙ্গির গাঁট
সেন্ট্রাল জেলের সব সেল
রেশনকার্ডের পরতে পরতে
এমনকি মুদ্দাফরাশের জবানবন্দির ভেতরেও চলবে তল্লাশি
এখন যে কবিতাটি লিখবো আমি
তার গতি রোধ করতে গিয়ে সীমান্ত পুলিশের হাতে
ধরা পড়বে কয়েক লক্ষ টাকার গুঁইসাপের চামড়া
তার গতি রোধ করতে গিয়ে সীমান্তরক্ষীর হাতে
আটকা পড়বে তিন জন চোরাচালানিসহ কয়েক লক্ষ টাকার
বিদেশী শাড়ি
এখন যে কবিতাটি লিখবো আমি
তার জন্যে মুহূর্তের মধ্যে ছদ্মবেশে টহল দিতে শুরু করবে
পুলিশ ভ্যান
তার জন্যে তছনছ হয়ে যাবে ইউনিভার্সিটির হলগুলি
তার জন্যে প্রচন্ড সন্ধ্যাবেলা মেডিকেল কলেজের হোস্টেলের
টিভি রুমের ভিতর থেকে সন্দেহবশত ধরে নিয়ে যাবে
দুজন ছাত্রকে
তার জন্যে বস্তিতে বস্তিতে আগুনের মতো
লেলিয়ে দেওয়া হবে গুন্ডাপান্ডা –
এখন যে কবিতাটি লিখবো আমি
সেই কবিতাটি যখন পড়বে কোনো এক পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা
আমি জানি তার ব্যর্থ কাঁধের পাশে দাঁড়িয়ে তখন অসমাপ্ত
মুক্তিযুদ্ধ ফেলবে দীর্ঘশ্বাস
সেই কবিতাটি যখন পড়বেন চশমার-কাচ-ফাটা গ্রামের কোনো
এক প্রৌঢ় স্কুল মাস্টার
আমি জানি তার শূন্য চোখের সামনে তখন ভেসে উঠবে
এক শীতের ভোরে শিমুলগাছের নিচে উদ্ধার-করা হঠাৎ
নিখোঁজ হয়ে-যাওয়া তার ছেলের লাশ –
সেই কবিতাটি যখন পড়বে কোনো এক কলেজ ছাত্রী
আমি জানি তখন তার মনে পড়বে প্রেমিকের উষ্ণ চুম্বনের ভিতরে আবিস্কার করা
প্রথম পৃথিবী প্রদক্ষিণের আলোড়ন নয়
তার মনে পড়বে পলায়নপর এক যুবকের প্রতিশ্রুতিভঙ্গের কথা –
সেই কবিতাটি যখন পড়বেন কোনো চল্লিশোত্তীর্ণ মহিলা
আমি জানি তার বিগত দিনের পশমকাঁটায় তখন জেগে উঠবে আকণ্ঠ পরিতাপ
সেই কবিতাটি যখন পড়বেন কোনো এক বজ্জাত অধ্যাপক
আমি জানি তখন তার মনে পড়বে তার হওয়ার কথা ছিল পুলিশ
কিন্তু তিনি হয়ে গেছেন অধ্যাপক –

সেই কবিতাটি যখন পড়বেন কোনো এক পত্রিকার সম্পাদক
আমি জানি তখন ঘুমের মধ্যে তার মাথার ভিতর থেকে বেরিয়ে
আসবে একটি ছায়ামূর্তি
আর তার মনে পড়বে – তার হওয়ার কথা ছিল সওদাগরি অফিসের অ্যাকাউন্টেন্ট
কিন্তু তিনি হয়ে গেছেন সম্পাদক
এখন যে কবিতাটি লিখব আমি
তার জন্যে দৈনিক পত্রিকাগুলোর নাইট শিফটের টেবিলে টেবিলে
গুঞ্জরিত হয়ে ফিরবে চাপা গুঞ্জন
তার জন্যে চাকরি যাবে তথ্য সচিবের
তার জন্যে আপন পদে ইস্তফা দিতে হবে তথ্যমন্ত্রীকে

এখন যে কবিতাটি লিখব আমি
তার জন্যে অপেক্ষা করছে দুটো লোহার ঠান্ডা হাতকড়া
তার জন্যে অপেক্ষা করছে একটি ঘাতক ছুরি
তার জন্যে অপেক্ষা করছে
ভাড়া করা গুন্ডাদের একটি কালো গাড়ি
তার জন্যে অপেক্ষা করছে
উচ্চাভিলাষী কয়েক জন জেনারেলের ষড়যন্ত্রের
একটি নির্মম নির্জন মধ্যরাত্রি –
এখন যে কবিতাটি লিখব আমি
তার জন্যে আমার সন্তানের জন্মের যন্ত্রণা মুখে নিয়ে
আমার প্রিয়তমা নারীর মতো
অপেক্ষা করছে আমার বাংলাদেশ।
(এখন যে কবিতাটি লিখবো আমি)

মানুষ প্রকৃতপক্ষে অনেকের ভিড়ে থেকেও ক্ষণে ক্ষণে একা হয়ে যায়। এই একাকীত্ব কখনো কষ্টের আবার কখনো আনন্দের। একজন সৃজনশীল মানুষের একাকীত্ব সমাজের জন্য কল্যাণকরও বটে কারণ তখনি তৈরী হয় মহৎ সৃষ্টি। একাকীত্ব নিয়ে কে না লিখেছে, কবি আবিদ আজাদও একাকীত্বের কথা আমাদের জানান এভাবেঃ

যে পথে যাই আমার আজ নিজের সাথে দেখা
যেখানে যাই আজকে আমি আমার সাথে একা।
জটলা-ছায়া জটলা-ছায়া, মেঘলা ঘরবাড়ি
বুকের নিচে ঢালু হাওয়া ধরেছে তরবারি।’
(অবেলা)

এই একাকীত্বের মধ্যেও যখন তিনি বলেন “মেঘলা ঘরবাড়ি/ বুকের নিচে ঢালু হাওয়া ধরেছে তরবারি।” তখনি এটি আবিদ আজাদের কবিতা হয়ে ওঠে, হয়ে ওঠে আবিদের একাকীত্ব, যা আর সকলের চেয়ে আলাদা। এটিই তার নিজস্ব কাব্য ভাষা।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ