তাজ ইসলাম
‘ ওই সময় এমভি হেমলকে শ্রীলংকান সরকারের বড় একজন এজেন্ট ছিল যিনি ভারতীয়। ত্রিমুখী তথ্য পাচার করে টাকা কামাত লোকটা।অর্থাৎ ভারত সরকার,শ্রীলংকান সরকার এবং তামিলের কাজও করত গোপনে।’
একজন ভারতীয় নাগরিকের চরিত্র তুলে ধরা হয়েছে এই অংশে। স্পষ্টত চরিত্রহীন। লোভী,স্বার্থপর ও কপট। তার চরিত্রের বিশ্লেষণে তাকে নিঃসন্দেহে কপট বলা যায়। এটি উপন্যাসের একটি চরিত্রের বয়ান। লেখক বাংলাদেশী কথাসাহিত্যিক। কথাসাহিত্যের জাল বিস্তারে তিনি বয়ান করে যান নিজের স্বপ্ন,অভিজ্ঞতা, ইচ্ছা ও কল্পনা। একটি চরিত্র নির্মাণ করেন জ্ঞাতসারে। কোন চরিত্রকেই তার অজ্ঞাতসার বলতে আমরা ইচ্ছুক নই। আর অজ্ঞাতসারেও যদি শিল্পীর কলমে,কলামে কোন বিষয় চিত্রিত হয় তখন তা ধরতে হবে প্রাত্যহিক জীবনের দেখা, বুঝা,শোনার অর্জিত জ্ঞানের প্রতিফলন বা প্রতিবিম্ব। লেখক উপন্যাস লিখছেন।একটি চরিত্র দিয়েই অঙ্কন করবেন সেই চরিত্রের দেশ,সমাজ,পরিবেশের অবস্থা। এই চরিত্রটি তখন একজন প্রতিনিধি। উপমহাদেশের রাজনীতিতে এই চরিত্র দিয়েই চিত্রিত হয়েছে ভারতীয় নীতি। আমরা পাঠক এভাবেই এগিয়ে যাব উপন্যাসের পাতা ও পর্ব পাঠ করে করে।
যেমন উপন্যাসের আলোচিত চরিত্র ফজলু। গল্পের বিস্তারে ফজলুর আবির্ভাব ও প্রভাব উপন্যাসের বিশাল অংশ জুড়ে। পাঠক ধরে নিতে পারেন শেষ পর্যন্ত ফজলুই উপন্যাসের নায়ক।ফজলুই কেন্দ্রীয় চরিত্র। শেষ পর্যন্ত ফজলু নায়ক হয়নি। ফজলুর উত্থান, জন্ম,পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে উপন্যাসিক তাকে করেছেন খলনায়ক। কেন্দ্রের পাশে ঘোরা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। লেখক ইচ্ছে করলে প্রথা থেকে বের করে নিয়ে নায়ক করতে পারতেন।তা হত লেখকের চিন্তার স্বাতন্ত্র্য শক্তির পরিচায়ক। তিনি প্রথার প্রতি নিবিষ্ট থেকে ফজলুকে রেখেছেন প্রথাগত। ফজলু মূলত জন্ম থেকেই দরিদ্র,হতভাগ্য,ও ভাগ্যবিড়ম্বিত মানব সন্তান। পরিবেশ প্রকৃতির সাথে লড়াই করতে করতে বেড়ে ওঠেছেন। সবশেষে ক্ষমতা,প্রতিপত্তি,কুটচালের কাছে পরাজিত হয়ে জেলখানার বন্দি হয়েছেন । সামাজিক প্রতিপত্তি শফিক মন্ডল তার নিজের পাপ গছিয়ে দিয়েছেন ফজলুর কাঁধে।ফজলুকে করেছেন ফেরারী, ফজলু বাধ্য হয়েছেন হতে খলিল। ফজলু এখানে প্রতিবাদী হতে পারতো।পারেনি,হলেই উত্তম হতো।কাহিনী মোড় নিত চমকের দিকে।চমক অবশ্য লেখক দেখিয়েছেন অন্যত্র। ঘরের ভেতরেই জাগিয়ে তুলেছেন দ্রোহ।দ্রোহ করেছেন কন্যাতুল্য ভ্রাতুষ্পুত্রী সুপ্তা।
আমরা কথা বলছিলাম জান্নাতুল বাকী’র ‘ মন পাথরে জলছবি’ উপন্যাস নিয়ে। লেখকের নামটাতেও একটা ধোঁয়াশা আছে।আমাদের দেশে কিছু নাম আছে এমন দু ধারণার অর্থ বহন করে। নামটির লিঙ্গ নির্ণনয়ে পাঠক দ্বিধা দ্বন্দ্বে হাবুডুবু খান। জান্নাতুল বাকি একজন পুরুষ লেখক। এটি বলা প্রয়োজন না,তবু এক ফাঁকে বলে ফেললাম। নাম শোনে প্রথম আমিও ভাবনার বেকায়দায় পড়েছিলাম। ফ্ল্যাপে তার পরিচয় লেখা জন্ম ২১ মে।কত সাল? কোন সালের একুশে মে তা বলা নাই। তবে লেখা আছে কুষ্টিয়ার কুমার নদ ঘেঁষা গজনবীপুর গ্রামের ছেলে তিনি। তার প্রথম উপন্যাস ‘ এভাবেও ভোর হয়’ প্রকাশ হয় ২০২২ এর বইমেলায়। দ্বিতীয় উপন্যাস ‘ অন্দরের অরণ্য’। এটি তার তৃতীয় উপন্যাস। ক্রমাগত লিখে যাওয়া লেখক। ধারাবাহিকতা ধরে রাখাও একজন লেখকের এক ধরণের সাফল্য।
‘এই দুপুরে নাজিমুদ্দিন গলির ভিতরে অপ্রশস্ত রাস্তার ভিড় থাকে না বললেই চলে।’ উপন্যাসের শুরুর লাইন।শুরু হয়েছে নাজিমুদ্দিন রোড দিয়ে। শেষও হয়েছে ‘নাজিমুদ্দিন রোডের পুরাতন বাড়ির সামনে ট্যাক্সি এসে’।
উপন্যাসে বর্ণিত চরিত্র হয় একজন প্রতিনিধি। এই প্রতিনিধি হতে পারে কোন সমাজ,গোষ্ঠী, গ্রুপের। তা হতে পারে সামাজিক কিংবা রাজনৈতিক প্রতিনিধিও। ‘মন পাথরে জলছবি’ তে ওয়াসিম একজন ইতিহাসের অংশ। আটকে পড়া পাকিস্তানী বিহারীর প্রতিনিধিত্ব করছেন তিনি । ‘ কথিত আছে, ওয়াসিম ভাইয়ের বাবা- মা বিহারি ছিল।দেশ স্বাধীনের আগে তার রাজশাহীতে বাস করত।’
যুদ্ধের সময় ওয়াসিম ছিল ছোট শিশু।সবাই পালিয়ে গেলেও সে আর পালাতে পারেনি।তারপর জীবন যুদ্ধে লড়াই করতে করতে সে এখন ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডে ড্রেনের উপর বাঁশের মাচানে বুট জুতা পালিশকারক। ‘ বয়স ষাট ছুয়েছে’। গল্প সামনে এগিয়ে যাচ্ছে লতাগুল্মের মতো। গল্পে গল্পে চলে আসছে
‘ ফ্লাওয়া ডি টিউলিপ’। এই বাড়ি একজন সমুদ্রে ঘোরা মানুষের। ‘ সমুদ্রের বুকেই কেটে গেছে তার প্রয়াত বসন্ত।’
তিনি জাহাজে চাকরি করা আজগর আলী।আজগর আলীই পরবর্তীতে হয়ে যান মিঃ আলী।
‘আজগর আলী ফিরে গেছে আজ থেকে বিশ বছর পূর্বের এক রাতে।’ সে রাতেই জাহাজ জীবনে ঘটে এক ঘটনা। আজগর আলী তখন ইন্দোনেশিয়ান জাহাজ ‘ এমভি হেমলক’ এর নবাগত ইঞ্জিনিয়ার। জাহাজ হাম্মানটোটায় বন্দরে নোঙর করে।সেখানে ‘ ডি কুইন পাব’ মনোরঞ্জন গৃহে সাক্ষাৎ ঘটে এক তরুণীর সাথে। আজগর আলী সোজা বাংলায় তার খদ্দের। এসব মনোরঞ্জন গৃহের সুন্দরতম নাম স্টার হোটেল। যেখানে নারী,নেশা ভোগ উপভোগের সব উপকরণ মিলে অর্থের বিনিময়ে।নারী তার দেহ বিক্রি করে টাকার কাছে।আজগর আলী এমন এক তরুণীকে পেয়েছিলেন সে রাতে।যার কথা কুড়ি বছর পরও স্মৃতিতে গেঁথে আছে। আজগর আলীর জীবনে এ নারীই পুরুষ জীবনের প্রথম নারী। তাকে ঘিরেই গল্পের প্লট।অবশিষ্ট ঘটনা গল্পের ডালপালা। আজগর আলী অবশ্য ছাত্র জীবনেও প্রেম ও প্রেমিকার মুখোমুখি হয়ছিলেন । তার প্রেমিকা ছিল শিখা। শিখার সাথে প্রেম ছিল এক পাক্ষিক। আজগর আলী সে প্রেমের কথা প্রকাশ করেনি। শিখা প্রকাশ করেছিল।তারপর আজগর আলী মেরিন একাডেমিতে ট্রেনিংয়ে চলে যায়।শিখা বর নিয়ে চলে যান ভারত।জাহাজে সমুদ্রে কেটে যায় জীবন।হোটেলে সহকর্মী জোসেফের সহযোগীতায় সাক্ষাৎ পান আইরার।আইরা অবশ্য পেশাগত দেহ পসারিণী নন। সে অন্য গল্প। এসব গল্পের ঘনঘটায় সবশেষে সমাপ্ত হয় আইরা আর আজগর আলীর বহুবছর পর মিলনের মাধ্যমে। জান্নাতুল বাকী সাবলীল বয়ানে বলে গেছেন সকল কাহিনী।গদ্যের সাবলীলতায় সুখপাঠ্য হয়ে ওঠে সমগ্র উপন্যাসটি। জীবনের কাহিনী বলতে বলতে তিনি নিজের গদ্যে প্রকাশ করেন জীবনের দর্শন। নিজের কথা গল্পের কল্পিত চরিত্রের মুখ দিয়ে বলানো কথাসাহিত্যিকের কৃতিত্ব।শিখা একদিন বলেছিল, ‘কাপুরুষের জন্য পিরিত শুধুই একটি কাব্য মাত্র।’ অথবা তিনি যখন লেখেন,’ মাঝ বয়সে বর হারালে নারী বড় বেওয়ারিশ হয়ে যায়’। তখন ভাবনায় নাড়া দেয় বাণী চিরন্তনী হয়ে এসব কথা।
‘ সে যেই হোক, আমি তার সাজা দেখতে চায়’। এই ভুল অজ্ঞতা কিংবা অসতর্কতার।তবু প্রশ্নবিদ্ধ করে লেখককে। দু তরফেই গাফিলতি থেকে যায়।লেখক ও প্রুফরিডার যত্নবান হলে এসব থাকে না।
কলম্বো বিমান বন্দরে নেমে গন্তব্যে পৌছলেন।পিকলুর জন্য সেতো বিদেশ। বিদেশবিভুঁইয়ে পিকলু ‘ কোনো লক সিস্টেম নেই।গেট খুলে পিকলু ঢুকে পড়ল বাড়ির ভিতরে।’ আবার বাংলাদেশেও নাজিমুদ্দিন রোডে পুরাতন বাড়ির সামনে ট্যাক্সি থামল। ‘ গেট খোলা ছিল।পিকলুর সাথে আইরা ঢুকে পড়ল বাড়ির ভিতর।’উপন্যাসিকের বয়ানে বাড়িগুলো অনিরাপদ মনে হয়।সবচেয়ে অবাক লাগে ভিনদেশী একজন নাগরিক সাঁই সাঁই করে বিদেশের একটি বাড়িতে প্রবেশ করা।হয়তো হতেও পারে।
উপন্যাস হল আস্ত জীবনের কথা। এক জীবনের নানা অলিগলি থাকে। তার বয়ানই বিস্তৃত থাকে উপন্যাসের পাতায় পাতায়। আলোচনায় সব নিয়ে আসা একটু জটিল। তবে আলোচক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আলোচনা করলে তা অসম্ভব না।’ মন পাথরে জলছবি’ কাহিনীর বয়ানে,চরিত্র চিত্রায়নে জান্নাতুল বাকী দক্ষ কথাকারের পরিচয় দিয়েছেন। তার গদ্য সহজ ও সাবলীল। জীবন, যৌবন,প্রেম,প্রতারণা, সারল্য,দ্রোহ মানব জীবনেরই অংশ। বাকী তার গল্পের চরিত্রদের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন দক্ষ শিল্পীর মতো মানব জীবনের এসব চিত্র ।আমরা তার বইটির বহুল প্রচার কামনা করি। প্রকাশ হয়েছে ফেব্রুয়ারী ২০২৪ এ।প্রচ্ছদ করেছেন: আইয়ুব আল আমিন। ‘ মন পাথরে জলছবি’ জান্নাতুল বাকী। পৃষ্ঠা ১৪৪, মূল্য ৪০০ টাকা। বাঁধাই,ছাপা,কাগজ সবই উন্নত মানের।আপনারা কিনুন। যা বলিনি তা পাঠ করে জেনে নিন।
Thanks to Almighty who give us peace. Love forever Taz vai.