ঝুমা চট্টোপাধ্যায়
মনার হাতে একটা হাতে লেখা চিঠি ধরিয়ে দিয়ে সোজ্জা অফিসে দেখা করতে বললাম আমি, মনা মানে, মনা পাগলা। দু চার লাইনের চিঠি কাগের ঠ্যাং বগের ঠ্যাং হাতের লেখায়। চিঠি ফিঠির চল তো উঠেই গেছে তবু বিচ্ছিরি হাতের লেখায় রিনাকে চিঠিই লিখলাম, লিখলাম –আমাকে আজ হাসপাতালে ভর্তি করে নিয়েছে আগামী সোমবার দিন বেলা দুটোয় আমার অপারেশন করা হবে।তোমরা আমার ভালোবাসা নিও ভালো থেকো সবাই।‘’ ব্যস্ এই টুকু চিঠি।
নেত্রকোণায় আমাদের বাড়ির পাশেই বকুল গাছ ছিল একটা, ফুল হত প্রচুর।বুক ভরে ফুলের গন্ধ নিতাম। কে একদিন দেখলাম সেই গাছের গুড়ির গায়ে এ্যয় মোটা মোটা হরফে লিখে রেখেছে শুভ্রা + অমুক ( ছেলেবেলায় আমার ডাক নাম অমুক ছিল। ও নামে এখন আর ডাকার কেউ নাই ছিল যারা মারা গেছে সব)। চাকু দিয়ে লেখা। সেই লেখা বাবার চোখে পড়ল ,আর পড়তেই আমাকে জুতোপেটা করল, এ্যাঁ … এই বয়সেই প্রেম পত্তর লেখা? বল লিখবি আর? বাবা পেটাচ্ছিল যখন কেন কি জানি বকুল ফুলের খুব গন্ধ পাচ্ছিলাম ,বাবাকে যতই বলি ও লেখা আমি লিখিনি, ততই আরো জোরে জোরে মার।
আমার ধারণা, আমার এই নির্ভুল ধারণা মানুষ জন্মগতভাবে একা। সে ছোট বড় যেইই হোক যেমন হোক, অভিজ্ঞতার জন্য একলা হওয়ার দরকার হয় না, শুধু সে যে ভিষণ ভিষণ একলা এইটা মনে রাখা খুব জরুরি ,আর বাদবাকি যা যা, সেসব নিজস্ব অভিজ্ঞতা-প্রসূত, সহজাত। তথাকথিত জীবনানুগ একাকীত্বের কত যে একক মৃত্যু দেখলাম তাদের শুধু ‘আমি একা’- সত্যিকারের এই বোধ ছিল না বলে। আসলে হীরে থেকে যে আলো বেরোয় সেটাই তো হীরে, বহুকৌণিক পাথরটা নয়। তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না।
অনেকগুলি চুপ-চাপ মুখ, হালকা নীল মাস্ক পরা,চিৎ হয়ে শুয়ে আমি,একটু শীত শীত করছে আর চারিপাশে কেমন একটা মিহিন সময় মাপক মিষ্টি শব্দ একটানা নিচু সুরে বেজে চলেছে, তবে একটু থেমে থেমে, একটু কিছু নির্দেশ দিতে দিতে। আমাদের বিয়ের সন্ধ্যেয় কিংবা রিনা আর আমার উনতিরিশ বছর একত্র যাপনেও এই রকম শব্দ শুনি নি কখনো, বুলু পুলু দুই ছেলে জন্মায় একে একে। এমনকি কুড়ি –বাইশ সালে ঘরে ঘরে খিল তুলে দেওয়ার কথা ঘোষণা হল , তখনও।রিনার মাথা খুব পরিষ্কার ,এম এস সি ফার্স্ট ক্লাশ ফার্স্ট কিন্তু পি এফ ম্যাচিওরিটি কি এফ ডি ইন্সটল বা হাজারো এমন খুঁটিনাটি আমাদের যুগলবন্দী মতান্তর ,মনান্তর, আলাদা ছাদ কিংবা যার যার নিজের মতন হোম ডেলিভারী – রিনা তো রিনা , আমিও ধুর ছাই!
রিনার মত মানবীরা সোজা স্বর্গে চলে যায়, তারপর আর তাদের খবর পাওয়া যায়না। মূল বক্তব্যটা হল , নিজের জন্য নিজে আমরা যতটুকু জরুরি তেমন আর কোথাও না বা আর কারুর জন্য না। শুধু বেঁচে থাকাটাই যখন একমাত্র আনন্দ বলে মনে অনুভব হবে এসব তখনই বোধগম্য, নাহলে কিছুতেই নয়। মনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম– পূর্ণিমা কবে রে? উত্তর দেয়নি। আবার প্রশ্ন- কি রে? কবে পূর্ণিমা জানিস?
মনা তখন মাঝারি সাইজের ইঁট পাটকেল গুলো চূড়ো করে পাহাড় রাস্তা এসব সাজাচ্ছে। বলল আমি আকাশ দেখি না। একটু জল দেবে ? চিঁড়ে ভিজিয়ে খাব? এই যো চিঁড়ে – , বলে ময়লা কাগজে মোড়ান ধুলি ধূসর কিছু চিঁড়ে এগিয়ে ধরে।
যাইহোক এবার মনে হচ্ছে যবনিকা পড়বার পালা, হাতে গ্লাভস পরে নিচ্ছে ডাক্তার। চিঠিটা পেল কি না রিনা কে জানে ভাবতে ভাবতে দেখলাম কোথা থেকে যেন বকুল ফুলের গন্ধ আসছে।
২.
‘ অপু এ কথা কাহাকেও বলে নাই …এমনকি তাহার দিদিকেও নয়…’
এই সেপ্টেম্বরে কিছু লিখব না ভেবেছিলাম। চতুরাশ্রম অনুযায়ী এখন আমার বানপ্রস্থে থাকারসময় , যাবতীয় জাগতিককে একপাশে সরিয়ে ব্রহ্ম অথবা নিজেকে নিয়ে ভাবা , ভাবা – আমি এখন শিশু বৃ্দ্ধের অতীত , মূর্তি , ভাব – মূর্তির অতীত , হিন্দু মুসলমানের অতীত , সমস্ত নিন্দা স্তুতি যাবতীর হারানো ও প্রাপ্তির অতীত। একাকী কোথাও বসে নির্জনে ঝিমোনোই আমার আশু ও একমাত্র অ্যক্টিভিটি।
বেপরোয়া কিছু লোক বলে দেবে – এইসব ছোটোখাটো ঘটনায় পৃথিবীর কিছু হবে না বরং তা যেমন এ্যদ্দিন চলে এসেছে তেমনই থাকবে। ঠিক । যে যেখানে ছিল সে সেখানেই থাকবে। পাহাড় থেকে নদী বইবে। সুর্য্য থেকে আলো পৃ্থিবীতে এসে পড়বে। পাখি উড়বে। রাস্তায় আচম্বিতে অ্যক্সিডেন্টে মা ও তার তিন বছরের শিশু বাস চাপা পড়ে মারা যাবে। ঠিক যেমন একটা প্রজাপতির ডানা ঝাপটানোর সুদূর প্রসারী ফল – একটা টর্নেডোর ঘনিয়ে ওঠা। কথাটা এডোয়ার্ড লরেঞ্জ ( ১৯১৭ – ২০০৮) বলেছিলেন তাঁর বিখ্যাত বাটারফ্লাই এফেক্ট থিয়োরী প্রসঙ্গে। হার্ডফোর্ডের ম্যথামেটিক্স ফিজিক্সের অধ্যাপক ছিলেন।
এ বছর গরমটা খুব পড়েছে। আকাশে মেঘের ছিটেফোঁটাও নেই। অনাবৃষ্টির ইঙ্গিত নাকি ? বেগুন গাছে পোকা লেগেছে। আলুর দাম একবারে নীচে। দামোদরে জল নেই। কতদিন ধরে মাটির রস শুষছে মানুষ , নদী থেকে বালি ওঠাচ্ছে, আমি খবরের কাগজ রাখিনা। জানলা দিয়ে বাইরে দেখি ইচ্ছেমত। আজ দেখি অনেক গুলো প্রজাপতি একসাথে উড়ছে। কিছু কি হবে?? কি হবে??
বউ রান্নাঘরে, চেঁচিয়ে বললাম – এক কাপ চা হবে?
ততধিক চেঁচিয়ে বউ বলল – চিনি নেই!
ওহ ! বাণপ্রস্থে কেউ চা খায় না। না কি খায় ? কে জানে! থাকগে ! মরুগ গে!
নদী মানেই উলু খাগড়া , শর ঝোপ , উদাস ডিঙি , জলের এলোমেলো বয়ে যাওয়া। তবে জলের খোঁজ কেউ তেমন রাখেনা শুধু দু চারজন পথচলতি চায়ের দোকান আছে কি না সেটাই দ্যাখে। দামোদরের ক্যাচমেন্ট বেসিনটা অনেকটা ফ্যান –শেপড্ , পাখার মত ছড়ানো। ছোটনাগপুরের খামারপাত পাহাড় থেকে জলটা শুরু তবে খুব শীর্ণ জলধারা কিন্তু খরস্রোতা। কাগজে কলমে জলটার নাম দেওনাদ , ঝাড়ঝন্ড। দেওনাদ কিছুটা এগিয়ে গিয়েছে , ডান দিক থেকে এসে মিশেছে বরাকর নদী আর বাঁ দিকে কোনার নদী। আরো কিছুটা এগোনোর পর দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে তিলাইয়া এবং নুনিয়া আর শালি নামে পুঁচকে দুটো জল্ধারা এদের সাথে মিলেমিশে গেছে। খড়ি বাঁকা বেহুলা গাঙ্গুর নামের কয়েকটা উপনদীও ছিল কিন্তু বহু বছর এরা স্বেচ্ছায় স্বাধীনতা ঘোষনা করে নিয়েছে। সমস্ত জল জেলা বর্ধমানের বুকের ওপর দিয়ে দামোদর হয়ে বহমান। পুরো অববাহিকার নিচেই কয়েকশো যুগের কয়লা গচ্ছিত । দ্বারকানাথের কয়লা ব্যবসার জাহাজ এই জলপথেই কোলকাতা যেত। আরো পুরনো ইতিহাসে আরো অনেক পুরনো গাল গল্প রয়ে গেছে , কিন্তু গল্প ফুরিয়ে গেলে হবে না , সুতরাং তারপর প্রশাশনের চোখের সামনেই ভারি মেসিনারিজ ব্যবহার করে মাফিয়ারা বালি তুলে দামোদরকে সাদা করে দিল……
ঝিমন্ত মন দামোদর ছেড়ে ইচ্ছেমত উড়াল দেয়… , ঢাকা মেল বলে একটা ট্রেন হত না অনেক কাল আগে ! সেই ট্রেন ধরে প্রথমে গোয়ালন্দ , তারপর সেখান থেকে স্টিমার …… । পরদিন একদম ভোর ভোর রাজদিয়া , সেখানে স্টিমার ঘাটায় উঁচু পাড় , পাড়ে সারা আকাশময় কালো-সাদা ডানার গাঙচিলেদের ভিড়। দিগন্তে সবুজ বনানী … নোয়াখালি জেলার মাল্লাদের হৈ-হল্লা। কালিগ্রাম শিলাইদহ পতিসর যাওয়ার গাড়িও কি এখান থেকেই ছাড়ে? এদেশে ভাটির দেশ বলেও একটা জায়গা আছে , শুনেছি সেখানে শুধু জল আর জল। কাঁচের মত জল পারাপারহীন সমুদ্র হয়ে দিগবিদিকে ছড়িয়ে … এলোমেলো অস্থির বাতাসের কারণে জলে ছোট ছোট ঢেউ … রাশি রাশি পদ্মপাতা ভাসছে , আছে ঝা
ড়ওয়ালা ধঞ্চে , কালো মুত্রার ঝোপ । আর শাপলা আছে, লাল ফুলে ভরা মান্দার গাছ, , কাউ ফলের গাছ । আকাশ যেখানে ধনুরেখায় মিলেছে , সারি সারি তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে… সমস্ত নিশ্চুপ ,
… আমি কখনও পূর্ববঙ্গ যাইনি , যাওয়ার দরকারও পড়েনি তবু এতদিন পর স্বপ্নের মধ্যে নোয়াখালির মাল্লারা আমায় নিয়ে কোথায় যাত্রা করে কে জানে……