আবু তাহের সরফরাজ
কবির রক্তমোক্ষণ হচ্ছে কবিতা। শাদা কাগজের বুকে কবিতার অবয়বকে আমরা কালো রঙে দেখি। এই রঙ কবিতার বাইরের চেহারা। ওই কালো রঙের ভেতর প্রতিটি অক্ষর আসলে রক্তাভ। সেই আভা পাঠকের খোলা চোখে ধরা পড়বে না। গভীর অন্তর্চোখের অধিকারী না হলে পাঠক সেই রক্তাভা দেখতে পারবে না। চোখের সামনে একটি কবিতা পড়লাম এরপর পাঠকের পাঠ সমাপ্ত হলো, পাঠকের কাছে কবির চাওয়া এটা নয়। প্রত্যেক কবিই চান, তার অনুভূতির রঙে পাঠক রঞ্জিত হোক। সহানুভূতি তৈরি হোক পাঠকের ভেতর।
কবির বোধের জগতে প্রতিমুহূর্তে ভেসে ওঠে নানা রঙছবি, কলস্বর। কবি শুনতে পান, অচেনা গ্রহ থেকে ভেসে আসা অস্ফুট স্বর। তারা প্রকাশ চায়। আর তখন বেগ তৈরি হয় কবির ভেতর। কবি তাদেরকে প্রকাশ করতে বাধ্য হন। প্রকাশ ঘটে গেলে কবি আরাম পান। নিজেকে তখন তার নির্ভার লাগে। জননী যখন সন্তান প্রসব করেন তখন তার প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। একইভাবে কবি যখন কবিতা প্রসব করেন তখন কবিতার সাথে প্রচুর রক্তপাত ঘটে। সেসব রক্তে রাঙানো থাকে কবিতার প্রতিটি অক্ষর ও শব্দ। এই রক্ত আসলে কবির অন্তর্জগতের জীবন-অভিজ্ঞতার ক্ষরণ। পৃথিবীর জীবনকে যাপন করতে গিয়ে প্রতিমুহূর্তে কবি আক্রান্ত হচ্ছেন যন্ত্রণার নানা অভিঘাতে। নিজের অস্তিত্ব কোনোমতে টিকিয়ে রাখার দরকারে কবি চালিয়ে যাচ্ছেন আপ্রাণ লড়াই। কখনো পর্যুদস্ত হচ্ছেন, কখনো টিকে যাচ্ছেন। ভাঙাগড়ার বিচিত্র অভিজ্ঞতা কবিকে প্রতিমুহূর্তে ঋদ্ধ করে তুলছে। পাশাপাশি তার অন্তর্বোধের গহনে তৈরি হচ্ছে পুঞ্জিভূত জীবনবোধ। এই বোধকে শব্দের নিগড়ে বেঁধে কাগজের ওপর উগড়ে দিতে পারলেই কবি আরাম পান। ঠিক যেমনটি আরাম পান প্রসবোত্তর জননী।
আশির দশকের কবি হাসান আলীমের কবিতা পড়তে গেলে সূক্ষ্ম অনুভূতির পাঠকমাত্রই টের পান, কবির ভেতরকার রক্তমোক্ষণ। কারণ, হাসান আলীম কেবল শব্দের দরকারে শব্দের বুনন তৈরি করেন না। অন্তর্জগতের বিবিধ ক্ষরণ থেকে নির্ভার থাকতেই তিনি প্রসব করেন তার কবিতার শব্দপুঞ্জ। ‘অপার দুখের নদী’ কবিতাটি পড়া যাক:
আমি সুখ-সম্পদের মধ্যে জন্মেও আরও এক অনিন্দ্য কষ্টের মধ্যে, আরেক অপার সমুদ্র দুখের ভেতর আজীবন চলে যাচ্ছি— কী এক অপূর্ব বেদনার কষ্টজলে জ্বলে যাচ্ছি না-বলা সে কথা। ভীষণ অন্ধকারের জোছনায় আমাকে বিভূষিত করছেন সেই পরম প্রভু অনন্ত অসীমা! আমি এখনো সচল, সৃষ্টি-বেদনার সমুদ্র মন্থনে হয়তোবা এমন দুঃখ-কষ্টের হয় প্রয়োজন। হে পরম প্রিয়, অলোকার সুগন্ধি পরশে আমাকে এভাবে মাঝে মধ্যে সান্নিধ্যে উন্মুখ করে দিও, আমাকে অনিন্দ্য পরশ দিও।
ধন-সম্পদের প্রাচুর্যে জন্ম নিয়েও তীরহীন সমুদ্রের মতো দুঃখ বহন করে চলেছেন কবি। কী সেই দুঃখ তা ভাষায় তিনি প্রকাশ করতে পারেন না। কোনো মানুষই আসলে তা পারেন না। এই দুঃখ প্রত্যেক মানুষেরই অন্তর্গত বোধের স্ফুরণ। খুব প্রিয়জন, যার সাথে মানুষ জোড়া বেঁধে থাকে, তাকেও সেই অন্তর্গত বেদনার বোধ ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না। এই বোধের ক্ষরণ কেবল একক ওই মানুষকেই বহন করে যেতে হয়, যতক্ষণ না মৃত্যু এসে তাকে পরম সত্তায় লীন করে দিচ্ছে। হাসান আলীম আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাসী মানুষ। তাই তিনি বিশ্বাস করেন, অব্যক্ত দুঃখ তার জন্য অন্ধকারে জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকা জোছনার প্লাবনের মতো। মানুষের জীবনের উপরিভাগের দৃশ্যজগৎ থেকে সেই জোছনা দ্যাখা সম্ভব নয়। একাকিত্বের অন্ধকারে ডুব দিলেই কেবল অন্তর্চোখে ধরা পড়ে জোছনার ওই প্লাবন। আর তাই, গভীরতম দুঃখকে পরম স্রষ্টার কৃপা হিসেবেই কবি উপলব্ধি করছেন। দুঃখের প্রহারে জর্জরিত হচ্ছেন। আবার, রক্তাক্ত হতে হতে পরমের সত্তাকে উপলব্ধি করছেন। কেননা, কবি বুঝতে পারছেন তার অস্তিত্ব এখনো চলমান। তিনি মৃতবৎ নন। জীবনকে মন্থন করেই তিনি দুঃখকে স্বাগত জানাচ্ছেন মানব-জীবনের দরকারি অনুষঙ্গ হিসেবে। তাই সৃষ্টিকর্তার কাছে তার প্রার্থনা, নিবিড় উপলব্ধিজাত দুঃখের অনিন্দ্য স্পর্শ যেন স্রষ্টা তাকে মাঝে মধ্যে দান করেন। কেননা, ওই স্পর্শের ভেতর দিয়েই স্রষ্টার অস্তিত্ব তার কাছে অনুভূত হয়। অন্তর্বেদনার এই রকম দার্শনিক উপলব্ধি হাসান আলীমের কবিসত্তার দার্শনিক মননকে পাঠকের সামনে উদ্ভাসিত করে। তার কবিতা পাঠে আমরা বুঝতে পারি, জীবন ও দর্শন আলাদা কোনো ধারণা নয়। জীবনের ভেতর দিয়েই দার্শনিক বোঝাপড়া বাঙ্ময় হয়ে ওঠে।
দীর্ঘকবিতা, সনেট, কাব্যনাটক, সঙ্গীত, ছন্দবদ্ধ ও ছন্দমুক্ত গদ্য-আঙ্গিকসহ নানা আঙ্গিকে ও রূপে কবিতা লিখেছেন হাসান আলীম। সেসব কবিতার বিষয়-বৈচিত্র্য যেমন অভিনব, একইসঙ্গে কবিতার ভেতর দিয়ে তিনি চালিয়েছেন নানা নীরিক্ষা। ফলে তারা কবিতা হয়ে উঠেছে বহুবর্ণিল। পরাবাস্তবতার ঐন্দ্রজালিক ঘেরাটোপে কখনো তার কবিতা পাঠকের মুগ্ধতার দৃষ্টিকে করেছে প্রসারিত, আবার বৈজ্ঞানিক অনুষঙ্গে তিনি তার কবিতাকে দিয়েছেন নীরিক্ষাধর্মী প্রকরণ-মাত্রা। আশির দশকে কবিতায় নীরিক্ষা সকল কবিই কমবেশি করেছেন। এটা ছিল সময়ের দাবি। আগের দশকের কবিতার রূপ ও ভাষাশৈলী থেকে আশির কবিরা ভিন্নতর কিছু একটা কবিতায় উপস্থিত করতে সচেষ্ট হন। সেই চেষ্টা থেকেই নানা ভাঙচুরের ভেতর দিয়ে আশির দশকের কবিতা রচিত হতে থাকে। এই যাত্রায় হাসান আলীম নিভৃতের কাব্যশ্রমিক। কবিদের ডামাডোলে না থেকে তিনি নিজের মতো করে কবিতার আঙ্গিক ভেঙেছেন, আবার গড়েছেন। নীরিক্ষা করে গেছেন নানা শৈল্পিক উপায়ে। ফলে তার প্রথম কবিতার বই থেকেই আমরা দেখি যে, প্রচল-ধারার বাইরে ভিন্ন ভিন্ন প্রকরণে এক একটি কবিতার অঙ্গসৌষ্ঠব।
হাসান আলীমের প্রথম কবিতার বই ‘শ্বাপদ অরণ্যে অগ্নিশিশু’। ৯০০ পঙক্তির দীর্ঘ একটি কবিতা দিয়েই বইটি। গদ্যের আঙ্গিকে লেখা এই কবিতায় সমাজ বিপ্লবের নানা ধারা উপধারা প্রতীকী ব্যঞ্জনায় অনুরণিত হয়েছে। প্রথম বইতেই গদ্যকবিতা, এই উদ্যোগ যে কোনো কবির জন্যই একটু সাহসী পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে। কারণ, আমাদের দেশের কবিতার পাঠক সাধারণত ‘কবিতার মতো কবিতা’কেই কবিতা হিসেবে সহজেই গ্রহণ করে। এই আঙ্গিকের একটু এদিক-ওদিক হলেই সেই বইয়ের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে পাঠকের ভেতর শংসয় তৈরি হয়। অথচ দ্যাখা গেছে, ‘শ্বাপদ অরণ্যে অগ্নিশিশু’ বোদ্ধা পাঠক বেশ আন্তরিকতার সাথে পাঠ করেছে। বিচ্ছিন্নভাবে প্রশংসা করেছে এই কবিতার আঙ্গিক নির্মাণে কবির শৈল্পিক দক্ষতার। একইসঙ্গে কবিতার ভাষাশৈলী যে অনবদ্য সে বিষয়েও কেউ কেউ আওয়াজ তুলেছে।
কবিতার মূল সম্পদ কবির অন্তর্জগতের ভাব। ভাব মানে জীবন অভিজ্ঞতার বুদবুদ। কিংবা বলা যেতে পারে, জীবন উপলব্ধির সারাৎসার। শব্দের শৃঙ্খলে সেই ভাবকে বেঁধে কবি নির্মাণ করেন কবিতার শরীর। কোনো কোনো কবিতায় ভাবের মূর্ত প্রকাশ আমরা দেখি। আবার কোনো কবিতায় ভাব থাকে বিমূর্ত। এক্ষেত্রে পাঠকের বোঝার সুবিধার জন্য কবি ইশারা-ভাষায় কিছু সংকেত রেখে দেন পঙক্তির ফাঁকে-ফাঁকে। সেসব ফাঁকে পাঠকের অনুপ্রবেশ ঘটে শিল্পবোধের মাত্রা অনুযায়ী। হাসান আলীমের বেশ কিছু কবিতায় ভাবের এই রূপবৈচিত্র্য আমাদের চোখে পড়ে। বিশেষ করে ‘মৃগনীল জোছনা’ ও ‘বৃষ্টিমুখর চোখ’ বইয়ের কবিতাগুলো পড়লে আমরা দেখতে পাই, বিমূর্ততার ভাষা-ইশারায় সেসব কবিতায় কবির ভাবের স্ফুরণ ঘটেছে অনন্য ধ্বনির ব্যঞ্জনায়।
বিশ্বাসী কবিসত্তার আশ্লেষে নির্মিত হয়েছে ‘তোমার উপমা’ কবিতার বইটি। হাসান আলীমের সূক্ষ্ম বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে উঠেছে এই বয়ের প্রতিটি কবিতায়। কবিতাগুলোতে কবির আধ্যাত্মিক চেতনার সাথে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির শৈল্পিক অভিযোজন ঘটেছে। ‘সবুজ গম্বুজের ঘ্রাণ’ ও ‘যে নামে জগৎ আলো’ বইয়ের কবিতাগুলোতে হযরত মুহাম্মদের (স.) প্রতি কবির আন্তরিক প্রেম আমরা দেখতে পাব। শেষের বইটি সনেটধর্মী কবিতার সঙ্কলন। ইসলামের সুমহান আদর্শে উজ্জীবিত হাসান আলীম বিশ্বাস করেন, পৃথিবীর বুকে যে অশান্তি বিরাজ করছে সেই অশান্তি দূর হতে পারে মহানবির আদর্শ অনুসরণের মাধ্যমে। ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে সমাজ ও রাষ্ট্রকাঠামো যদি কোরআন ও হাদিসের বিধানে পরিচালিত হয় তাহলে মানব সভ্যতা সুসংহত হয়ে উঠবে। প্রতিমুহূর্তে শৃঙ্খলা ও শান্তির জন্য আমরা হাহাকার করতে থাকলে মহানবির দেখানো পথে আমরা কেউই চলতে রাজি নয়। এই হঠকারিতার ফলও আমরা হাতেনাতে পেয়ে যাচ্ছি। হাসান আলীম শিল্পের আবরণে সেই সত্য তার কবিতার ভেতর দিয়ে আমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন।
‘কিউব কবিতা ও অন্য চাঁদ’ এবং ‘ছুমন্ত্র সরল অঙ্ক’ বই দুটিতে জ্যামিতিক ত্রিমাত্রিক অবস্থানকে নানা উপমায় ও অনুষঙ্গে শব্দরূপ দিয়েছেন হাসান আলীম। কবিতাগুলোর প্রধান বৈশিষ্ট্য কিউবিজম। গাণিতিক নানা ফর্মুলাকে এসব কবিতায় অভিনব চিত্রকল্পে রূপ দিয়েছেন কবি। দুটি বইয়ের কবিতাগুলোতে ব্যাপক নীরিক্ষা চালিয়েছেন হাসান আলীম। বলা দরকার, নীরিক্ষাধর্মী কবিতানির্মাণে খানিক ঝুঁকি আছে। পাঠক কবিতা কেন পড়ে? ভালো লাগে, তাই পড়ে। ভালো কেন লাগে? কবিতার ভেতর দিয়ে পাঠক জীবনবোধের নানা স্পেসে পরিভ্রমণ করেন। এই পরিভ্রমণ করতে করতে পাঠক অনুভূতির নানা রঙে ও রসে জারিত হন। আর এ কারণেই কর্মব্যস্ত জীবনের কোনো এক ফাঁকে পাঠক খুলে বসেন তার প্রিয় কোনো কবির কবিতার বই। সেই কবিতায় যদি নিরীক্ষার নামে খটোমটো কোনো বিষয় এসে জুড়ে বসে, তাহলে তা পাঠকের জন্যে বিরক্তির কারণ হয়ে উঠবে। কিন্তু নিরীক্ষাধর্মী সার্থক কবিতার শিল্প-উৎকর্ষতা হচ্ছে, পাঠক ধরতেই পারবে না যে, সেখানে নীরিক্ষা চালানো হয়েছে। জগতের প্রতিটি মহৎ কবিতার বিশেষ বৈশিষ্ট্য এখানেই। বাংলা কবিতায় নীরিক্ষাধর্মী অসংখ্য কবিতা লেখা হয়েছে। সেসব কবিতায় বিভিন্ন দশকের কবি পাঠকের অগোচরে নিরীক্ষাধর্মী ভাঙচুরের কাজ করেছেন। তবে এজন্য শিল্পের বহুমাত্রিক কৌশল কবির আয়ত্বে থাকতে হয়। তা না থাকলে নীরিক্ষার নামে যা ঘটানো হয় তা খেলো হয়ে পড়ে। নীরিক্ষা তখন আর কবিতার কারুকাজ থাকে না। হাসান আলীমের নীরিক্ষাধর্মী কবিতাগুলো পাঠ করলে পাঠক বুঝবেন, শৈল্পিক উৎকর্ষতায় তার ভাঙচুর কতটা সুসংহত ও ঋদ্ধ।
ঘাসান আলীমের উল্লেখযোগ্য কবিতার বইগুলো হচ্ছে: কোথায় রাখি এ অলংকার, আকাশের অজগর, হৃদয়ে রেখেছি যারে, ফানাফিল্লাহ, দাও সে সোনার গাঁও ও একটি চেয়ারের গল্প। এসব বইয়ের কবিতায় প্রতীকী রূপকল্পে যাপিত জীবনের নানা বিষয় শৈল্পিক ব্যঞ্জনায় ভাষারূপ পেয়েছে। প্রতিদিনকার জীবনযাপনে আমরা যে নৈতিকতা-বর্জিত সেই সেই সত্য উদ্ঘাটিত হয়েছে। নৈতিকতা-বর্জিত সমাজ ও রাষ্ট্র-ব্যবস্থার কাঠামো কী রকম, সেই রূপচিত্রও হাসান আলীম শব্দে শব্দে চিত্রিত করেছেন। কবি হিসেবে তিনি যে ভাবের আকাশে ভেসে বেড়ানো মেঘমালা, তা কিন্তু নয়। সাধারণ মানুষর শ্রমেঘামে মিশে থাকে হাসান আলীমের শিল্পচেতনা। তার স্বপ্নসাধ সাম্যের পৃথিবী গড়ে তোলার। ফলে, তার কবিতার বিষয় হিসেবে উঠে আসে বিশ্বরাজনীতি ও কূটনীতি। এরই পাশাপাশি তার কবিতায় আমরা দেখতে পাই চিরন্তন প্রেমের প্রতিকৃতি। বাদ পড়ে না বাংলার লোকজ ঐতিহ্য ও লোকপ্রেম। ‘ফানাফিল্লাহ’র কবিতাগুলো তার আধ্যাত্মিক চেতনার শৈল্পিক প্রকাশ। বিষয় হিসেবে পাওয়া যায় সৃষ্টিতত্ত্ব, রাসূলতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব ও রূপতত্ত্ব।
ইসলামি ভাবাদর্শ হাসান আলীমের কবিতার বিশেষ বৈশিষ্ট্য। জীবনের নানা ঘটনার অভিঘাত তিনি ইসলামি বিধানের নিরিখে যাচাই করেন। তার কবিতা পাঠে বোঝা যায়, স্রষ্টার কাছে আত্মসমর্পণের মাধ্যমেই তিনি খুঁজে পান জীবনের সৌন্দর্য। ‘একদিন শুক্রবার ভোরে’ কবিতায় কবি লিখছেন:
ও প্রভু, আমি তোমার পবিত্র সুন্দর
তুমি আমাকে আগুনে দগ্ধ করো না
তুমি আমাকে তেত্রিশ বছর পর্যন্ত
পুড়িয়ে পুড়িয়ে খাদহীন সোনা করছো কী!
আল হামদুলিল্লাহ
তোমার ফয়সালা অতি উত্তম আমার জন্য।
কোরআনে উল্লেখ আছে, আল্লাহর যে গুণাবলি সেই গুণাবলির রঙে রাঙিয়ে আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। সেই অর্থে পরম সুন্দর আল্লাহর প্রতিরূপ মানুষ। তাই কবি নিজেকে আল্লাহর পবিত্র সুন্দর প্রতিরূপ হিসেবে মান্য করছেন। এরপর বলছেন, জাহান্নামের আগুনে সেই সুন্দরকে তুমি পুড়িয়ো না। জাহান্নামের আগুনে পোড়াবে না বলেই কি পৃথিবীর জীবনে তুমি আমাকে দুঃখ-যন্ত্রণায় পুড়িয়ে পুড়িয়ে নিখাদ সোনা বানিয়ে তুলছো! স্রষ্টার উদ্দেশ্য যদি তা-ই হয় তাহলে কৃতজ্ঞতার সাথে স্রষ্টার উদ্দেশ্যকে মেনে নিচ্ছেন হাসান আলীম। এবং বলছেন, স্রষ্টার ফয়সালা নিশ্চয়ই তার জীবনের জন্য খুবই উত্তম।
প্রতীকের রূপকল্পে হাসান আলীম কবিতায় প্রতিদিনের জীবনের টুকরো টুকরো ছবি ও ঘটনা উপস্থাপন করেন অভিনব উপায়ে। তার ১৭তম কবিতার বই ‘একটি চেয়ারের গল্প’র ‘খাটমল’ কবিতার কয়েক পঙক্তি পড়া যাক:
ছারপোকায় ভরে গেছে বিছানা-বালিশ
লেপ-তোষক, সোফার গদি
টেবিল-চেয়ার, খাটপালঙ্ক, চৌকির কোনাকানছি।
চেয়ারে বসে পড়ার সুযোগ নেই
কামড়ে পশ্চাৎদেশ লাল করে দেয়,
যেন নামতা ক্লাসের পণ্ডিত স্যারের
শপাং শপাং বেত্রাঘাত।
গোটা কবিতা পাঠের পর আমরা বুঝতে পারি, ছাড়পোকা এখানে প্রতীক। ছারপোকার আড়ালে কবি উপস্থাপন করেছেন মানুষরূপী কিছু ছারপোকাকে। এসব ছারপোকা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনকে কিভাবে বিষাক্ত করে তুলছে সেই বিবরণ আমাদের সকলেই জানা। কিন্তু কবির ভাষ্য, আমরা মানুষ। আর ছারপোকা ক্ষুদ্রাকৃতির জীব, যদিও তারা মানুষরূপী। কিন্তু মানুষের চেয়ে ছারপোকার ক্ষমতা কখনোই বেশি নয়। তাই তাদের বিরুদ্ধে লড়তে হবে। এরপর নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড।
ফানাফিল্লাহ ইলমে তাসাউফের পারিভাসিক আরবি শব্দ। এর মানে, নিজেকে আল্লাহর আনুগত্যে বিলীন করে দেয়া। এই প্রেক্ষাপটে দুই পদের পদ্য দিয়ে হাসান আলীম সাজিয়েছেন ‘ফানাফিল্লাহ’ বইটি। একটি পদ্য পড়া যাক, ‘প্রভুর রঙের চেয়ে আর কে রঙিন/তাহার রঙেই তুমি হও না মোমিন।’ এই পদ্য পাঠের সাথে সাথেই কোরআনের সেই বাক্যটি আমাদের স্মরণ হয়, ‘তোমরা আল্লাহর রঙে রঙিন হও।’ আবার, আত্মজ্ঞানের দিকে ইঙ্গিত দিচ্ছে হাসান আলীম এই পদ্যে, ‘যারে আমি খুঁজতেছি জনম ধরে/সে নাকি লুকিয়ে আছে আমার আপন ঘরে।’
আধ্যাত্মিক উপলব্ধির নানা মাত্রায় এভাবেই হাসান আলীম পর্যটন করেছেন তার কবিতা-যাত্রায়। মূলত নিজের অন্তর্জগতে প্রতিমূহূর্তে যে রক্তক্ষরণ ঘটে চলেছে, সেই ক্ষরণকে তিনি শব্দের ঐন্দ্রজালিতক আবহে কবিতায় চিত্রিত করেন। সেসব কবিতার অন্তর্বয়নে থাকে রক্তাভা। সংবেদী পাঠকের চোখেই কেবল সেই রক্তিক ছটা ধরা পড়ে।