Site icon বাংলা রিভিউ

জীবনানন্দ দাশ ও আবুল কালাম শামসুদ্দীন


মুহম্মদ মতিউল্লাহ্

জীবনানন্দ দাশস্মৃতি সংখ্যা ’ময়ূখ’ প্রকাশের প্রস্তুতিকালে ভূমেন্দ্র গুহ লিখেছিলেন, আবুল কালাম শামসুদ্দীনের লেখা পাওয়া গেল। অরবিন্দ গুহ লিখেছেন, ‘আমার ধারণা শামসুদ্দীনদা সে সময়ে বরিশালে জীবনানন্দের পয়লা নম্বরের ভক্ত ছিলেন।’ আর আবুল কালাম শামসুদ্দীন নিজে লিখেছেন ‘জীবনানন্দ ছিলেন তাঁর ‘অতি শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ও বন্ধু’। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের কথা থেকেও জানা যায় শামসুদ্দীন ও অরবিন্দ গুহ দুই তরুণ লেখক ছিলেন তাঁদেরই সঙ্গী।
অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত লিখেছেন,‘… আরো একবার তার(জীবনানন্দের) হৃদয়ের কাছে স্তব্ধ বোঝাপড়ায় ঘন হই যখন প্রায় দশ বছর আগে নদী-নালার দেশ বরিশালে তার বাড়িতে এসে উঠি একবেলার কটি বৃষ্টি ভেজা সবুজ মুহূর্ত হাতে নিয়ে। মনে আছে আর-আরদের সঙ্গে দুটি তরুণ লেখকও সেদিন আমাদের ঘিরে বসেছিল— অরবিন্দ গুহ আর আবুল কালাম শামসুদ্দীন। একটা সভা মতন হয়েছিল কোথায়। চিরদিন যে সভা সমিতিকে এড়িয়ে গেছে তাকে সেদিন নিয়ে গিয়েছিলাম দলের মধ্যে, যতদূর মনে পড়ে প্রাণ খোলা প্রচুর হাসি সে সেদিন ছড়িয়ে দিয়েছিল মুঠো মুঠো।’
তিরিশ এবং চল্লিশের দশকে জীবনানন্দ বরিশালের ব্রজমোহন মোহন কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। আবুল কালাম শামসুদ্দীন ছিলেন কবির সেই সময়ের ছাত্র।
আবুল কালাম শামসুদ্দীন এর জন্ম ১৯২৬ সালে। বয়সে জীবনানন্দের চেয়ে ২৭বছরের ছোটো। তবু তাঁকে শামসুদ্দীন পরিচয় করিয়েছেন ‘অতি শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ও বন্ধু’ বলে। ১৯৪৬ সালে ব্রজমোহন কলেজ থেকে শামসুদ্দীন বিএ পাশ করেন , জীবনানন্দ সেই বছরই ব্রজমোহন কলেজ ছেড়ে কলকাতা চলে যান। শামসুদ্দীনও উচ্চতর ডিগ্রির জন্য ভরতি হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এর আগেই আবুল কালাম শামসুদ্দীনের কয়েকটি কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল বুদ্ধদেব বসু-র ’কবিতা’ পত্রিকায়। সে লেখা পড়ে খুশি হন জীবনানন্দ। অরবিন্দ গুহ লিখেছেন, ‘একবার শামসুদ্দীনদার কয়েকটি কবিতা ‘কবিতা’ পত্রিকায় ছাপা হল। আমি জীবনানন্দকে জিজ্ঞাসা করলাম —’কবিতা’য় শামসুদ্দীনদার কবিতা কেমন হয়েছে? জীবনানন্দ হেসে বললেন— ভালো। শামসুদ্দীনদাকে খবরটা দিলাম। খুশি না হয়ে শামসুদ্দীনদা বললেন —ভালো নয়। তোকে খুশি করবার জন্য স্যার বলে দিয়েছেন।
হতে পারে। কিন্তু এবিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ যে শামসুদ্দীনদাকে জীবনানন্দ স্নেহের চোখে দেখতেন।’
আবুল কালাম শামসুদ্দীনকে জীবনানন্দ তাঁর ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ বইটি উপহার দিয়েছিলেন। সে ঘটনার কথা উল্লেখ করে অরবিন্দ গুহ লিখেছেন,’শামসুদ্দীনদা একদিন আমাকে বললেন— তুই একবার স্যারের বাড়ি যেতে পারবি? বললাম— পারব। কী ব্যাপার? শামসুদ্দীনদা বললেন— ব্যাপার হচ্ছে স্যার আমাকে একখানা ‘ধূসর পান্ডুলিপি’ পড়তে দেবেন বলেছেন। তুই গিয়ে নিয়ে আসতে পারবি? মনে-মনে হিসেব করে দেখলাম— বইখানা যদি আজ বিকেলে নিয়ে আসতে পারি তো রাত্তিরে পড়ে কাল শামসুদ্দীনদাকে দিয়ে দিলে আমারও ‘ধূসর পান্ডুলিপি’ পড়া হয়ে যায়। বললাম— আজ বিকেলেই গিয়ে— ‘ধূসর পান্ডুলিপি’ নিয়ে আসব। আজ তো আর আপনার সঙ্গে দেখা হবে না কালই বইখানা আপনাকে দিয়ে আসব।
সেদিন বিকেলেই গেলাম জীবনানন্দের বাড়িতে। বলতেই জীবনানন্দ একটা কাঠের বাক্স বা ছোটখাটো সিন্দুক খুলে আমার হাতে একখানা ‘ধূসর পান্ডুলিপি’ দিলেন। আমি গলা বাড়িয়ে দেখলাম কাঠের বাক্স ও ছোটখাটো সিন্দুকে অনেক ‘ধূসর পান্ডুলিপি’ সযত্নে সাজানো আছে। ‘ধূসর পান্ডুলিপি’ প্রকাশিত হওয়ার প্রায় দশ বছর পরের ঘটনা। ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ নিয়ে খুব সাবধানে বাড়ি ফিরে এসেছি। খুব সাবধান— শামসুদ্দীনদার সঙ্গে দেখা না হয়ে যায়। ভাগ্য ভালো দেখা হয়নি।…
জীবনানন্দ ও শামসুদ্দীনদার মধ্যে যদি শ্রদ্ধাস্নেহের অকৃত্রিম সম্পর্ক না থাকত তাহলে ‘ধূসর পান্ডুলিপি’ প্রথম পড়ার মুগ্ধ প্রহরের জন্য আমাকে আরও কতকাল অপেক্ষা করে থাকতে হত কে জানে।’…
আবুল কালাম শামসুদ্দীন কলেজ জীবনে ছাত্র রাজনীতিতে গভীরভাবে জড়িয়ে ছিলেন। নিখিল বঙ্গ ছাত্র কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় কমিটির তিনি সদস্য ছিলেন এবং আরএসপি পার্টির সঙ্গে যুক্ত থেকে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৪৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ পড়তে যান। সাতচল্লিশের দেশভাগের পরও তিনি কলকাতাতেই থেকে যান। এ সময় তাঁর বন্ধু নির্মল সেনও কলকাতায় ছিলেন। নির্মল সেন তাঁকে বরিশাল ফিরতে বললে তিনি বলেন,’নির্মল, ওটা কাঠমোল্লাদের দেশ হবে। আমি যাবনা। তুই ফিরে যা।’ অবশ্য শেষপর্যন্ত ১৯৫০ এ তিনি দেশে ফিরে যান। ১৯৫০-এ ঢাকায় ফিরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের প্রচার ও তথ্য দপ্তরের সহকারী পরিচালক পদে যোগদান করেন এবং পরে তিনি ওই অফিসেই ‘মাহে নও’ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। একই সঙ্গে আলবেরুনী ছদ্মনামে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম ‘সিনেমা’পত্রিকার উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৫৬-৫৭ সালে শামসুদ্দীন ইউনেসকোর ফেলোশিপ লাভ করে পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন এবং ১৯৫৯-এ ইতালির সরকারি প্রতিষ্ঠান ‘সিনেসিত্তা’থেকে ফটোগ্রাফি,সেট ডিজাইনিং, পাশ্চাত্য সংগীত এবং সিনেমাএডিটিং এর ওপর কোর্স সম্পন্ন করে রোমে থেকে যান। ১৯৬১ সালে তিনি রোম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি.লিট উপাধি লাভ করেন।
বিদেশে বসবাসকালেই শামসুদ্দীন তাঁর অধিকাংশ বাংলা লেখালেখির কাজ সম্পন্ন করেন। ঔপন্যাসিক হিসেবে আবুল কালাম শামসুদ্দীন বিশেষ কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন। তাঁর
‘কাশবন কন্যা’ এবং ‘কাঞ্চনমালা’ উপন্যাস দুটিতে পূর্ব বাংলার গ্রামীন দরিদ্র মুসলমান জনজীবনের কথা ফুটে উঠেছে। ‘লালসালু’, ‘সূর্যদীঘল বাড়ি’ কিংবা অমরেন্দ্র ঘোষের ‘চর কাশেম’ উপন্যাসগুলির নাম একসময় একসঙ্গে উচ্চারিত হ’ত। ১৯৪৫-এ প্রকাশিত তাঁর ‘শাহেরবানু’ গ্রন্থটি অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তকে উৎসর্গ করেন। ২০০৬-এ ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর পত্রসংকলন ‘কুসুমেষু’। বইটি সম্পাদনা করেন আবদুল মতিন। ১৯৯৮-এ ঢাকা বুলবুল পাবলিশিং হাউস থেকে সেলিনা বাহার-এর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘শামসুদ্দীন আবুল কালাম স্মারকগ্রন্থ’।
বাংলাদেশের গবেষক আমীন আল রশীদ লিখেছেন, ‘শামসুদ্দীনের পুরো জীবনই ট্রাজেডিতে ভরা। শিক্ষক জীবনানন্দের চেয়ে যা মোটেও কম নয়।’ ব্যক্তিগত জীবনে তিনি দাম্পত্য জীবনে সুখী ছিলেন না। স্ত্রীর সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে গেলে তাঁর স্ত্রী বিয়ে করেন অভিনেতা গোলাম মোস্তফাকে। ’দাম্পত্যজীবনের এই ট্রাজেডিতে শামসুদ্দীন ব্যথা পান।’ রোমে তিনি একাকী নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করতেন। সেখানে একটি নির্জন অ্যাপার্টমেন্টে একাই থাকতেন তিনি। হৃদপিণ্ডে অনিয়মিত রক্তপ্রবাহের কারণে ১৯৯৭ সালে নিঃসঙ্গ প্রবাসে তাঁর মৃত্যু হয়। পুলিশ তাঁর মরদেহ উদ্ধার করে। তাঁর কোনো নিকটজনের খোঁজ না পাওয়ায় রোমের এক খ্রিস্টান কবরস্থানে শেষ পর্যন্ত তাঁকে সমাহিত করা হয়েছিল।
তিরিশ-চল্লিশের দশকে আবুল কালাম শামসুদ্দীন বাস করতেন বরিশাল শহরে। জীবনানন্দ দাশের বাড়ি থেকে এক কিলোমিটারের মধ্যে গোরাচাঁদ দাস রোডে ছিল তাঁর পৈতৃক বাড়ি। জীবনানন্দ দাশের বাড়িটি ছিল বগুড়া রোডে। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত যখন অরবিন্দ গুহকে নিয়ে সাইকেল রিকশা যোগে শামসুদ্দীনের বাড়ি যান, জীবনানন্দ দাশের বাড়ির সামনে দিয়েই তাঁকে যেতে হয়েছিল, সে প্রসঙ্গে আমরা পরে আসব।
জীবনানন্দ দাশের বাড়ির বর্ণনা দিয়েছেন শামসুদ্দীন,‘তাঁর বাড়ি একটা মেয়ে স্কুলের কম্পাউন্ডের মধ্যে। খুব সম্ভবত সে ইস্কুলটা তাঁর পিতারই প্রতিষ্ঠিত ছিল।। বাংলো ধরনের বাড়ির উপরে শনের চাল। বেড়া আধেক ইঁট আর আধেক বাঁশের।’…. অরবিন্দ গুহ-র বর্ণনায় পাওয়া যায় —’বগুড়া রোড ও কলেজপাড়ার মাঝামাঝি জায়গায় ছিল জীবনানন্দের বাড়ি। একটি টিনের দুয়ার পেরিয়ে তবে বাড়ির প্রাঙ্গণ। এলাকার মধ্যে খানিকটা জমি সবুজ ঘাসে আচ্ছন্ন।’…
শামসুদ্দীনের বাড়ির বর্ণনা পাওয়া যায় অরবিন্দ গুহ-র ভাষ্য থেকে,’শামসুদ্দীনদার বাড়ি আলেকান্দা পাড়ায়— গোরাচাঁদ দাস রোডে। বাড়ি মানে কাঁচা ঘর— টিনের কি বাঁশের কি হোগলার বেড়া মনে নেই— টিনের চাল— দোতলা ঘর— দোতলায় কাঠের পাটাতন।’
এই বাড়িতে একবার অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত গেছেন। জীবনানন্দ দাশ গেছেন বেশ কয়েকবার। বাড়ির বর্ণনায় আবুল কালাম শামসুদ্দীন তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন,
‘শহরের এক নিভৃত এলাকায় নতুন বাসা করেছেন বাবা। জাহাজ ঘাটের পর থেকে খালের পর খাল। পাশ দিয়ে লাল সুরকি ঢালা পথে পথে সেই বাসায় পৌঁছেছিলাম। এই এখনকার বিচারেও তা এক তুলনাহীন ঠাঁই। মাটির ভিতের উপর চার চালের টিনের বাড়ি, এক পাশে বৈঠকখানা, পেছনে কিছু গাছগাছালির বাগানের পর পুকুরঘাট। বৈঠকখানার একধারে জায়গীর থেকে স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করছে কয়েকজন ছাত্র।…গাঙ থেকে ভাটার খাল, সেই খাল প্রকাণ্ড সরকারি বাড়ি সার্কিট হাউজের পাশ দিয়ে বিরাট গেটওয়ালা জমিদার বাড়ি, ব্রাউন সাহেবের প্রাসাদ, জমিদার গোরাচাঁদ দাসের বাড়ি এবং বেশ কয়েকটি সুন্দর সুন্দর হিন্দু বাড়ির ঘাট বাড়িয়াল ছুঁয়ে ছুঁয়ে আমাদের বাড়ি পর্যন্ত বিস্তৃত। অন্যদিকটা ঘুরে গিয়েছিল স্বদেশী যাত্রাগানের জন্য বিখ্যাত কবি মুকুন্দ দাসের কাশিপুর গ্রামের বাড়ির দিকে।’ সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের গবেষকরা জানাচ্ছেন আবুল কালাম শামসুদ্দীনের সঙ্গে বরিশাল শহরের সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছিল চল্লিশের দশকে। তাঁকে ওই শহরে যারা দেখেছেন তাদের কাউকেই এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। ফলে বরিশাল শহরের গোরাচাঁদ দাস রোডে ঠিক কোন জায়গায় শামসুদ্দীনের বাড়ি ছিল এখন আর নিশ্চিত করে কারো পক্ষে বলা সম্ভব নয়।
জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে শামসুদ্দীনের পরিচয় গড়ে ওঠে প্রথমত ব্রজমোহন কলেজে, তাঁর ছাত্র হওয়ার সূত্রে। শেষপর্যন্ত শামসুদ্দীন হয়ে উঠেছিলেন তাঁর ‘ছাত্রবন্ধু’। তার আগেই শামসুদ্দীন তাঁর কবিতার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন বুদ্ধদেব বসু-র ‘কবিতা’ পত্রিকায়। শামসুদ্দীন লিখেছেন,‘বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকায় প্রথম জীবনানন্দের কবিতা পড়েছিলাম। তারপর কলকাতায় কবিতার পুরনো সংখ্যাগুলো কেনার জন্য একদিন ‘কবিতাভবনে’ যায়। তখন বুদ্ধদেববাবু প্রথম তাঁর আশ্চর্য কবিত্বশক্তির কথা বারবার উল্লেখ করেছিলেন। স্কুলে পড়ি তখন। ম্যাট্রিক দেব। সেইকালে আমরা দুই বন্ধু তাঁর অনুসরণে কবিতা লেখার প্রয়াস করেছিলাম।’
ব্রজমোহন কলেজে পড়ার সময়েই প্রথম জীবনানন্দের বাড়ি গেছিলেন শামসুদ্দীন। বাইরে কেউ জীবনানন্দের ধারেকাছে যেতনা তাঁর গম্ভীর স্বভাবের জন্য। বাইরে থেকে জীবনানন্দকে তাঁরা ‘অসামাজিক’ মানুষ ভেবে এসেছেন। ‘আধেক ইঁট আর আধেক বাঁশের বেড়া’ টপকে সেদিন বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে দেখেছিলেন ‘বই,বই আর বই। বাংলার, বাংলার বাইরের অসংখ্য পত্রিকা। সবই সযত্নে গুছিয়ে রাখা, দেখে মনে হয় বারবার পড়া। একধারে একটা ছোট টেবিল। হয়তো তাঁর লেখার। অন্দরে ছিলেন তাঁর স্ত্রী এবং বালিকা কন্যা মঞ্জু দাশ। তাঁরাও কবিরই মতো স্বল্পভাষী নির্জনতাপ্রিয়। সেই কালে, মঞ্জু দাশের বয়স দশ কি বারো, ‘বঙ্গশ্রী’পত্রিকায় একটি কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল।’ সেই অভিজ্ঞতার পর মনে হয়েছিল শামসুদ্দীনের ‘সেদিন তাঁর বাড়ি না গেলে
“জীবনানন্দবাবু অসামাজিক মানুষ“ এই ধারণা করেই চিরদিন দূরে দূরে থেকে যেতাম। সে ধারণা অচিরেই ভেঙে গেল। অমন রাসভারী চেহারার ভেতরে একটি সহজ সরল শিশুমন খুঁজে পেয়ে আমরা চমৎকৃত হয়ে গেলাম।’ শামসুদ্দীন আরও লিখেছেন,’মুখ তাঁর সর্বদা ভারি, গম্ভীর, চোখে আশ্চর্য সারল্য এবং তীক্ষ্ণতা। লম্বা লম্বা পা ফেলে চলতেন। আমি আর আমার আর এক বন্ধু নির্মল চট্টোপাধ্যায় তাঁকে অবাক হয়ে দেখতাম। কখনো ক্লাসের অবকাশে মাঠের ধারে শুয়ে শুয়ে পড়তাম তাঁর কবিতা। তখনও পর্যন্ত তাঁর শেষতম কাব্যগ্রন্থ ‘ধূসর পান্ডুলিপি’। কিছুদিন পরে ‘কবিতা ভবন’ থেকে ‘এক পয়সায় একটি’ কবিতা সিরিজে প্রকাশিত হলো তাঁর ‘বনলতা সেন’। আমাদের মধ্যে সেদিন রীতিমতো সাড়া পড়ে গিয়েছিল। নতুন বয়সের অনভিজ্ঞ মনের কাছে ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি ‘যে সাড়া জাগাতে পারেনি, ‘বনলতা সেন’ দ্বারা তা সম্ভব হয়েছিল। ‘বনলতা সেন’ কবিতাটি আমরা যত্রতত্র মুখে মুখে আবৃত্তি করে বেড়াতাম।’
বরিশালে থাকাকালীন জীবনানন্দকে খুব নিবিড়ভাবে পেয়েছিলেন শামসুদ্দীন। তারপর চল্লিশের দশকের শেষের দিকে কলকাতাতেও যোগাযোগ অক্ষুন্ন ছিল তাঁদের। জীবনানন্দ শামসুদ্দীনের বাড়িতে অনুষ্ঠিত সাহিত্যসভাতেও গেছেন বেশ কয়েকবার। শামসুদ্দীন লিখেছেন,’বরিশাল থেকে তিনি চলে গেলেন কলকাতায় দেশভাগের পরেই। বরিশালে আমরা তাঁর অত্যন্ত কাছাকাছি এসেছিলাম। তিনি আমার বরিশালের বাসায় এসেছেন অনেকদিন। আমাদের ছোট টিনের ঘরের দোতলায় তাঁকে সাহিত্যের আড্ডায়ও পেয়েছি। একদিন সেই আড্ডায় অচিন্ত্যকুমারকে দেখে তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে উঠেছিলেন বলে মনে পড়ছে। মনে তাঁর কোন সংকীর্ণতা ছিল না— নিরহংকার ছিলেন তিনি। আরো ছিলেন বিনয়ী।’ অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত আর জীবনানন্দ দাশ একসঙ্গে একদিন গেছিলেন শামসুদ্দীনের বাসায়। সেদিন জীবনানন্দ ছিলেন উৎফুল্ল, খোশমেজাজ। জীবনে কোনদিন ধূমপান করেন নি, সেদিন অচিন্ত্যকুমার এর উপস্থিতিতে অনভ্যস্ত হাতে সিগারেট মুখে তুলে নিয়েছিলেন। এঘটনার চমৎকার বর্ণনা পাওয়া যায় অরবিন্দ গুহ-র জবানীতে। ঘটনাটি এরকম:
অচিন্ত্য সেনগুপ্ত তখন পটুয়াখালি-র মুনসেফ। তিনি শামসুদ্দীনের বাড়িতে আসবেন বলে জানিয়েছেন শামসুদ্দীনকে। তাঁকে রিকশোয় করে নিয়ে আসার দায়িত্ব পড়েছে অরবিন্দ গুহ-র ওপর। অরবিন্দ গুহ নির্দিষ্ট দিনে বরিশালের পথ ধরে অচিন্ত্য সেনগুপ্তকে নিয়ে যাচ্ছেন শামসুদ্দীনের বাড়ি। অচিন্ত্যকুমার মত পরিবর্তন করে ঠিক করলেন আগে জীবনানন্দ দাশের বাড়ি যাবেন, তাঁকে সঙ্গে নিয়ে তারপর যাবেন শামসুদ্দীনের বাড়ি। সেই মতো অরবিন্দ গুহ-কে রিকশো ঘোরাতে বলা হল বগুড়া রোডের দিকে। জীবনানন্দের বাড়ি পৌঁছে তাঁকে শুধুমাত্র পাঞ্জাবি গলানোর সময়টুকু দিয়ে তারপরেই উঠে পড়লেন রিকশোয়। অচিন্ত্য জীবনানন্দ একটি রিকশোতে, আর একটিতে অরবিন্দ গুহ। তাঁরা পৌঁছালেন শামসুদ্দীনের বাড়ি। দোতলায় খাটের উপরে সতরঞ্জি পেতে তাঁদের বসার ব্যবস্থা করা হল। চা-জলযোগের পর শামসুদ্দীনের ব্যবস্থাপনায় রাখা সিগারেট এগিয়ে দিয়ে জীবনানন্দ অচিন্ত্য কুমারকে বললেন সিগারেট খাও। অচিন্ত্যকুমার ঘাড় নেড়ে জানালেন সিগারেট খাওয়া তিনি ছেড়ে দিয়েছেন। ‘জীবনানন্দ যেন আকাশ থেকে পড়লেন। যেন বিশ্বাস করতে পারলেন না কথাটা। আবার বললেন, তুমি সিগারেট পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছ? অচিন্ত্যকুমার আবার গম্ভীরভাবে বললেন হুঁ। বলে একটা ঢাউস মাসিক পত্রের পাতা উলটাতে লাগলেন। অতঃপর জীবনানন্দ বারংবার একই প্রশ্ন করতে লাগলেন, তুমি সিগারেট পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছ? তুমি সিগারেট পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছ? তুমি সিগারেট পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছ?… জীবনানন্দ হাসতে আরম্ভ করলেন। খানিকক্ষণ সশব্দে হাসেন
হঠাৎ হাসি থামিয়ে দেন। আবার সশব্দ হাসি। আবার হঠাৎ ব্রেক… বেসামাল হয়ে পড়লেন জীবনানন্দ। প্যাকেট খুলে নিজেই একটা সিগারেট মুখে দিলেন। দেশলাই জ্বালাতে গিয়ে বারবার ব্যর্থ হলেন। কে একজন দেশলাই কাঠি জ্বালিয়ে জীবনানন্দের সিগারেট ধরিয়ে দিলেন।…কায়ক্লেশে টান মেরেই ধোঁয়া ছেড়ে দেন। একটা সিগারেট জীবনানন্দ পুরোপুরি টানতে পারেননি। আধাআধি নিজের লালায় ভিজে গিয়েছে বলে সিগারেটটা ফেলে দিলেন।’…
তাঁর মৃত্যুর পর এঘটনার স্মৃতিচারণায় ‘ময়ূখ’-এর পাতায় অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত লিখেছিলেন,’চিরদিন যে সভাসমিতিকে এড়িয়ে গেছে, তাকে সেদিন নিয়ে গিয়েছিলাম দলের মধ্যে। যতদূর মনে পড়ে প্রাণ খোলা প্রচুর হাসি সে সেদিন ছড়িয়ে দিয়েছিল মুঠো মুঠো। যদিও যতদূর জানি সিগারেট খেত না, সেদিন কিসের আনন্দে ছেলেমানুষের মত পাখির মত ঠোঁটে টেনে ছিল একটা সিগারেট।’
আবুল কালাম শামসুদ্দীনও স্মৃতিচারণার সূত্রে এ-ঘটনার কথা উল্লেখ করে লিখেছেন,’বরিশাল থেকে তিনি চলে গেলেন কলকাতায়, দেশভাগের পরেই। বরিশালে আমরা তাঁর অত্যন্ত কাছাকাছি এসেছিলাম। তিনি আমার বরিশালের বাসায় এসেছেন অনেকদিন। আমাদের ছোট টিনের ঘরের দোতলায় তাঁকে সাহিত্যের আড্ডায়ও পেয়েছি। একদিন সেই আড্ডায় অচিন্ত্যকুমারকে দেখে তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে উঠেছিলেন বলে মনে পড়ছে। মনে তাঁর কোনো ঘোরপ্যাঁচ বা সংকীর্ণতা ছিল না। সহজ সরল সাদাসিধে এবং নিরহংকার ছিলেন তিনি। আরও ছিলেন বিনয়ী।’
দেশভাগের পর জীবনানন্দ কলকাতায় চলে এলেন। শামসুদ্দীনও তখন কলকাতায়। ফলে তখনও দুজনের যোগাযোগ ছিল। জীবনানন্দ তখন দৈনিক ‘স্বরাজ’ পত্রিকার রবিবারের পাতা সম্পাদনার কাজ করছেন। এই সময় কালে জীবনানন্দ একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতে মনস্থ করেছিলেন, জানিয়েছেন শামসুদ্দীন। ‘স্বরাজ বন্ধ হয়ে যাবার পরে একটা মাসিক পত্রিকা প্রকাশের সংকল্প করেছিলেন তিনি, আমি ও নির্মল চট্টোপাধ্যায় মিলে। কিন্তু বিজ্ঞাপন সংগ্রহে তিনজনই অপটু ছিলাম বলে শেষ পর্যন্ত সাহসে কুলালো না।’ এরপর আবুল কালাম শামসুদ্দীন ফিরে যান ঢাকায়। জীবনানন্দের সঙ্গে আর যোগাযোগ রাখতে পারেননি। ‘দেশভাগের অব্যবহিত পরেই কলকাতার অর্থনৈতিক জীবনে যে আলোড়ন এসে পড়েছিল তাতে করে বেশি দিন আর সম্পর্ক রাখা চলল না। ঢাকায় আসার পর আর তাঁর সঙ্গে আর দেখা হয়নি। গতবছর (১৯৫৩) কলকাতায় বন্ধু নির্মল চট্টোপাধ্যায়ের কাছে শুনেছিলাম তিনি কোথায় (হাওড়া গার্লস কলেজে) অধ্যাপনার কাজ নিয়েছেন। প্রশ্ন করে জেনেছিলাম আমার খোঁজ খবরও তিনি নিতেন নির্মলের কাছ থেকে।’
এরপর ট্রাম দুর্ঘটনায় জীবনানন্দের মৃত্যু সংবাদ আসে। শামসুদ্দীন তখন ঢাকায়। ঢাকার তরুণ কবি সাহিত্যিকেরা শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান একটি শোকসভার আয়োজন করেন। সেই সভায় জীবনানন্দের উপরে মূল প্রবন্ধটি পড়েছিলেন আবুল কালাম শামসুদ্দীন। শোকসভায় তিনি বলেছিলেন,’তাঁর খ্যাতি সাহিত্য মহলের চৌকাঠ পেরিয়ে সাধারণ্যে পৌঁছায়নি। কারণ তিনি ছিলেন স্বল্পবাক, চলতেন ভিড় এড়িয়ে, লিখতেন না ঘন ঘন। সভায় হতেন না সভাপতি, না করতেন বক্তৃতা। সবচেয়ে বড় কথা, না ছিলেন তথাকথিতভাবে ‘ফ্যাসিবাদ বিরোধী’ বা ‘প্রগতিশীল’।…কিন্তু তার জন্য, তাঁকে আমি জানতাম বলেই বলতে পারি, খেদ করতে দেখিনি কোনদিন। বরঞ্চ যাদের কাছে তিনি শ্রদ্ধা পেয়েছিলেন, তাঁরা মুষ্টিমেয় হলেও তাঁদের নিয়েই তিনি খুশি থেকেছেন। তিনি নিজেই বলতেন খ্রিস্টান পাদ্রীরা যেমন জনতার হাজার হাজার বর্গমাইলের দিকে তাকিয়ে বাইবেল বিতরণ করেন, না শ্রেষ্ঠ কাব্য সেরকম ভাবে বিতরিত হবার জিনিস নয়।’
এরপর আবুল কালাম শামসুদ্দীন কলকাতা ছেড়ে, ঢাকা ছেড়ে ইতালি-র রোমে চলে যান। এবং নির্বান্ধব স্বজনহীন বিদেশে ১৯৯৭ সালে তাঁর মৃত্যু হয়।

Exit mobile version