আরিফ আজাদ
প্রথম আলোর বিরুদ্ধে ইলিয়াস হোসাইনের করা ভিডিওটা শুধু ইউটিউবে ভিউ হয়েছে সাড়ে তিন মিলিয়নের কাছাকাছি। বাদবাকি সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোর হিশেব যদি বাদও দিই, একটা নির্দিষ্ট পত্রিকার বিরুদ্ধে একটা ‘অভিযোগ’ এতো পরিমাণ কাভারেজ পাওয়ার পরেও, সরকার তো দূরের কথা, প্রথম আলো পত্রিকা নিজেও কোনো দায় অনুভব করলো না একটা আধা পাতার বিবৃতি দেওয়ার৷ অন্তত এটুকু বলার যে—ভিডিওতে যা দাবি করা হয়েছে তা সম্পূর্ণরূপে মিথ্যা।
লাখ-লাখ মানুষ প্রথম আলোর বিরুদ্ধে কথা বলেছে, আওয়াজ তুলেছে, কিন্তু সরকারের তরফে কেউ অন্তত এটুকুও বললো না যে—যা অভিযোগ এসেছে সেগুলোর বিষয়ে আমরা তদারকি করে দেখছি। অভিযোগ প্রমাণের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সরকার একটা বিবৃতি দেওয়ার দায় অনুভব করেনি, প্রথম আলো নিজে একটা বিবৃতি দেওয়ার দায় অনুভব করেনি। কিন্তু কেন?
এই ‘কেন’ প্রশ্নের মাঝে লুকিয়ে আছে বাংলাদেশের রাজনীতি, সরকার, সংস্কৃতিতে মুসলমানদের (বা, আরো নির্দিষ্টভাবে ইসলামপন্থীদের) স্টেইক কেমন সেটার বোঝাপড়া।
রাষ্ট্র হিশেবে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে ডোমিনেট করে আসছে সুশীল সেক্যুলার মধ্যবিত্ত সমাজ। এবং তিক্ত হলেও সত্য যে—এই দেশের মেইনস্ট্রীম ধারা হিশেবে তারা নিজেদের প্রতিষ্ঠা করে ফেলতে পেরেছে সুচারুভাবে।
এই দেশের যেকোনো আন্দোলন সংগ্রামে যারা রক্ত দেয় এবং দিয়ে আসছে তাদের ৯০ ভাগই মুসলমান এবং ধর্মপরায়ণও। কিন্তু, সেই আন্দোলনের ফসল ভাগাভাগির সময় এর ৯৯% উঠে যায় সুশীল সেক্যুলার মধ্যবিত্ত সমাজের হাতে। এই মেকানিজমটা এভাবে কাজ করে কেন?
দেখেন, আমরা সকলে জানি প্রথম আলো শেখ হাসিনা বা আওয়ামিলীগ বিরোধি কখনোই ছিল না। আওয়ামিলীগ তো প্রথম আলোরই সরকার। প্রথম আলোর কিবলা যে পুরোদমে আওয়ামিলীগের দিকে ঝুঁকে ছিল, সেটা আমি জানি, আপনি জানেন, সবাই জানে, তাহলে শেখ হাসিনা কি এটা জানতো না? অবশ্যই জানতো। নিজেদের পক্ষের লোক জেনেও, প্রথম আলোর হালকা ‘নিরপেক্ষতা’কেও কেন শেখ হাসিনা ভয় পেতো?
২০২৩ সালের বিজয় দিবসের দিন সাভার স্মৃতিসৌধ এলাকার এক ফুল বিক্রেতা ছেলে, যার নাম ছিল সবুজ মিয়া, ওর একটা ছবি আর ক্যাপশান কাভার করে প্রথম আলো। সবুজ মিয়ার বরাতে প্রথম আলো লিখেছে—‘আমাগো মাছ, মাংস ও চাইলের স্বাধীনতা লাগব’।
প্রথম আলোর এই এক টুকরো সংবাদ আগুন ধরিয়ে দেয় আওয়ামিদের মনে। শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে পর্যন্ত এই ঘটনার নিন্দা জানাতে বাধ্য হয়।
আচ্ছা, সবুজ মিয়ার বরাতে এই একই লাইন যদি যুগান্তর লিখতো, বা নয়াদিগন্ত, বা ইনকিলাব পত্রিকা—আওয়ামি পরিমণ্ডলে এটা কি একই প্রতিক্রিয়া তৈরি করতো? শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে এটা নিয়ে নিন্দা করতো?
প্রথম আলো এমন কাদের কাছে পৌঁছায় যাদের কাছে সবুজ মিয়ার এই এক লাইনের কথাটা পৌঁছাতে দিতে চাইতো না আওয়ামিলীগ? প্রথম আলো এমন কাদের কাছে পৌঁছায় যাদের কাছে সবুজ মিয়ার এই একই কথা নিয়ে যুগান্তর, ইনকিলাব বা নয়াদিগন্ত পৌঁছাতে পারে না?
তারা কারা? তারা কী এমন শক্তি রাখে যে—যাদেরকে ভয় পেতো স্বয়ং আওয়ামিলীগ?
প্রথম আলো যা করে তা হলো বয়ান তৈরির খেলা। বাঙালি মধ্যবিত্ত সেক্যুলার সমাজের শিরায় শিরায় তার প্রবেশাধিকার। এই সেক্যুলার সমাজের চোখে প্রথম আলো আওয়ামিলীগকে ভিলেন বানিয়ে দিতে পারে, বিএনপিকে মাইনাস করে দিতে পারে, জামায়াতকেও ধ্বসিয়ে দিতে পারে। এই ক্ষমতা প্রথম আলোর আছে। আছে নয় ঠিক, এই ক্ষমতা সে অর্জন করেছে।
ফলে, আওয়ামিলীগ বলেন, বিএনপি বলেন, জামায়াত বলেন কিংবা জনগনের অন্তবর্তীকালীন সরকার, কেউ প্রথম আলোর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে না। প্রথম আলোর বিরুদ্ধে কোটি কোটি মানুষ কথা বললেও, কেউ একটা বিবৃতিও দেওয়ার তাগাদা অনুভব করে না।
ইসলামপন্থীরা যদি প্রথম আলোকে নিষিদ্ধ করতে চায়, সেটা হবে অশ্বডিম্ব আশা করার মতো ঘটনা৷ বাংলাদেশের কনটেক্সটে, প্রথম আলোকে কোনোদিন নিষিদ্ধ করা যাবে না৷ তবে, প্রথম আলোর বিকল্প যদি তৈরি করা যায়, সেটাই হবে একটা মোক্ষম পদক্ষেপ।
সেক্ষেত্রে, প্রথম আলোর এই শক্তির জায়গাটাকে স্টাডি করতে হবে। তার বয়ান তৈরির ক্ষমতাকে বুঝতে হবে৷ প্রথম আলো কেন প্রথম আলো, কেন এই দেশের মধ্যবিত্ত সেক্যুলার সুশীলেরা প্রথম আলো না পড়ে ঘুমাতে পারে না—সেগুলো নিয়ে গবেষণা করতে হবে।