১.জীবন কি? আপনার বর্তমান জীবন, অবস্থান– যা হতে চেয়েছিলেন বা যা হয়েছেন–এসব নিয়ে কোন আক্ষেপ, অনুশোচনা বা গর্ব হয়?
মাসুদুল হক: জীবন আসলে পিছিয়ে পড়া বোঝাটাকে সামনের দিকে টেনে টেনে গাধার মতো আফসোস করে বেঁচে থাকা। জীবন আসলে গতকালের মধ্যেই আগামীকালে যাবার স্বপ্ন;আসলে আগামীকালে যেতে পারবো না জেনেও অতীতের ভেতর নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা।
ছোটবেলায় ভাবতাম কবে বড় হব।আর এখন নিমেষেই দিনের পর রাত আর রাতের পর দিন চলে যাচ্ছে!
তবে অনেকের ভালোবাসা পাচ্ছি। শিক্ষকতা ও শিক্ষা প্রশাসনে আছি বলে আনন্দ পাই। আক্ষেপ আছে শিক্ষকতার পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা চালিয়ে যাবার ইচ্ছেকে পূর্ণ করতে পারিনি বলে। পাশাপাশি গবেষক তৈরিতে প্রাতিষ্ঠানিক ভূমিকা পালন করতে চেয়েছিলাম, সে সুযোগ জীবনে ঘটছে না বলে অনুশোচনা হয়, এই ভেবে যদি আরেকটু জীবনে সিরিয়াস হতাম! এই জীবনে গর্ব করার মতো কোনো প্রাপ্তি নেই।আবার আমার নিজেরও গর্ব করার মতো কিছু নেই।ফলে নিজের কাছে নিজে শূন্য হয়ে বসলে অনুশোচনার পাল্লাটাই ভারি!
২. আপনার শৈশব-কৈশোর কোথায় কেটেছে? কীভাবে কেটেছে? কোন অব্যক্ত কথা বা স্মৃতি কি মনে পরে? তাড়িত করে?
মাসুদুল হক: আমার শৈশব কেটেছে পুরোনো ঢাকায়। বিখ্যাত চিত্রশিল্পী পরিতোষ সেনের জিন্দাবাহারে। সৈয়দ আলী আহসানও তাঁর শৈশবে জিন্দাবাহারে ছিলেন। আরমানিটোলা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। তাঁর একটা বই আছে “জিন্দাবাহারের গলি”। আমার শৈশব কেটেছে সে অঞ্চলে। সৈয়দ আওলাদ হোসেন লেন, তাঁতি বাজার, শাঁখারি বাজার, নবাবপুর,ইসলামপুর, কদমতলী, মিটফোর্ড,চক, সোয়ারীঘাট, মৌলভীবাজার,নবাববাড়ি, আরমানিটোলা, মাহুতটুলি,ধোলাইখাল,ওয়ারী, চাঁনখারপুল,নারিন্দা, সদরঘাট,ওয়াইজঘাট, বেচারাম দেউরী কত কত জায়গায় বিস্তৃত ছিল আমার চলাচল। কত বিচিত্র মানুষ দেখে বড় হয়েছি।রিক্সাওয়ালা, ঠেলাগাড়ির চালক, মুদিদোকানি,মদখোর,মুচি, ফেরিওয়ালা,চোর-বাটপার, ইমাম-মোয়াজ্জেম,মেরাসিন গায়ক,পাড়ার মস্তান।এখন মনে হয় আক্তারুজ্জামান ইলিয়াসের “চিলেকোঠার সেপাই”-র হাড্ডিখিজির,জুম্মন,জুম্মনের মা, ওসমান, রঞ্জু,রহমতউল্লাহ,ফালু মিস্ত্রীদের দেখে দেখে আমি বড় হয়েছি।শৈশবে মা মারা যাওয়াতে নানির কাছে বড় হয়েছি নানা বাড়িতে। অনেক বড় জায়গা নিয়ে বিশাল বাড়ি ছিল আমার নানার।৪০/৪১ জিন্দাবাদ প্রথম লেন।প্রাচীর তোলা বাড়ির পেছনে ফুলের বাগান, গোয়াল ঘর, কুয়োতলা,হাউজপার।রাস্তাসংলগ্ন বড় প্রবেশদ্বারসহ দুতলা বাড়ি।সাদা বাড়িটা আজো অমলিন আমার স্মৃতিতে।বিশাল বড় ছাঁদে আমরা খেলাধুলা করতাম।ফুটবল খেলতাম।মনে পড়ে বর্ষাকালে ফুটবল খেলছি, হঠাৎ বৃষ্টি,তারপর শুরু হয় শিলাবৃষ্টি। ছাঁদটা বরফ টুকরোয় শাদা হয়ে যেত।আমরা আশ্রয় নিতাম সিঁড়িঘরে।ঐ বড় ছাঁদের রেলিং টপকে পেছনে আরেকটা বিল্ডিংয়ে যাওয়া যেত। ওখানে ভাড়াটিয়া থাকতো।ঐ বিল্ডিংর পর আরেকটা বিল্ডিং।এটা তিন তলা। তিন তলায় ওঠার আলাদা সিঁড়ি।ঐ সিঁড়ি দিয়ে তিন তলায় যেতে হলে নিচে নেমে ঘুরে যেতে হতো।আমরা অনেক সময়ই দোতলার ছাঁদ বেঁয়ে তিনতলার ছাঁদে উঠতাম। পড়ে গেলে দুর্ঘটনা অনিবার্য ছিল। কিন্তু আমরা বানরের বাঁশ বাওয়ার মতো উঠতাম। এখন ঐ স্মৃতিটা আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়।এই সময় অবসরে আমরা গভীরে আমি শৈশবে চলে যাই।তপ্ত দুপুরে সবার অলক্ষ্যে আমি দোতলা থেকে তিন তলায় থামের বেড়িয়ে থাকা ইটের খাঁজগুলো বেঁয়ে উঠছি। আমি উঠছি।আমার শরীর উঠছে।আমি অনুভব করছি।আমার মাথা চলছে। আমি শৈশবের আমি।চৌতন্যপ্রবাহের ভিতর আমি আজও সেই খাঁজ বেঁয়ে উঠে পড়ি দোতলা থেকে তিনতলায়।আমরা মাথার ভেতর দৃশ্যকল্পটি আটকে আছে।মাঝে মাঝে মনে হয় এই বুঝি পড়ে যাচ্ছি।একদম
স্ট্রিম অব কনসাসনেস(Stream of consciousness)।
আরেকটা স্মৃতি খুব মনে পড়ে।যা শুধু আমার কাছেই গোপন হয়ে আছে।শৈশবে চার/পাঁচ বছর বয়সে। ফরিদপুর বৃন্দাবনের মোড়ে দাদা বাড়ির পেছনে একটা গাবগাছে সন্ধ্যার সময়; একটা দড়িতে ফাঁস লাগা ঝুলন্ত মানুষের পা দুলতে দেখে পালিয়ে এসেছিলাম।ঐ বয়সে বাড়ির আশেপাশে আমি কৌতুহলবশত একা একা ঘুরে বেড়াতাম। বিশেষকরে ভর দুপুর আর ঘোর সন্ধ্যায়।ব্যাস, ঐ দেখা হয়ে গিয়েছিল।তখন ভয়ে কাউকে কিচ্ছু বলিনি। কিন্তু আজও ঐ দৃশ্য জেগে ওঠে আমার চোখের সামনে বিভিন্ন নিরালায়?
৩. সাহিত্যে এলেন কেন? কীভাবে এলেন? অর্থাৎ শুরুটা কীভাবে? কোথায়?
মাসুদুল হক:ছোটবেলায় মা মারা গেল একা হয়ে গেলাম।নানির সংগ পেয়ে ,তার আদরে আর রূপকাথার গল্প শুনে শুনে মনটা প্রস্তুত হয়ে ওঠে কথা বলার। অনুভূতি প্রকাশের ব্যাকুলতা জাগে। মাঝে মাঝেই নিশ্চুপ হয়ে যেতাম।কোনো কোনো ফুলের রং বিমোহিত করতো। কবুতরের সৌন্দর্য,পাখির ডাক আমাকে মুগ্ধ করতো! একবার বর্ষার সময় ডেমরায় খালার বাড়িতে গিয়েছিলাম।একটা বৃষ্টির পর সোনালী একটা রোদ উঠে আসে। উঠানে কয়েকটা পায়রা বাকুম বাকুম রবে খুদ খাচ্ছিল আর মাঝে মাঝে ডানা ও পা টেনে শরীরের যত্ন নিচ্ছিল, ঠোঁট দিয়ে ডানা মাকশো করছিল।সে দৃশ্যের পাশেই দেখলাম ভেজা লাল ও হলুদ কলাবতি।আমি বিমোহিত হয় যাই দৃশ্যচিত্রে!মনে হয় শৈশবের নিঃসঙ্গতা আমার একটা অসুখ ছিল।সেই অসুখ থেকে মুক্ত হতেই কবিতার মতো বাক্য আওড়াতাম।কোনো কোনো দৃশ্য ও স্মৃতি মনের গভীরে ছাপ ফেলতো,তা purgation( বিমোক্ষণ) ঘটাতেই লিখতে শুরু করেছিলাম।
প্রথম লেখা প্রকাশ হয় স্কুলের দেয়ালিকায়। বাড়ির কাছেই পাটুয়াটলীতে ছিল “বেগম” পত্রিকা অফিস। মোহাম্মদ নাসিরুদ্দীন সম্পাদিত কোলকাতার ‘সওগাত’ পত্রিকা পরবর্তীতে এখান থেকেই প্রকাশিত হত।এই পত্রিকা অফিসে শামসুর রাহমান,হাসান হাফিজুর রহমান, আব্দুল গাফফার চৌধুরী প্রমুখ কবি ও সাহিত্যিকগণ আড্ডা মারতেন। অষ্টম শ্রেণীতে পড়াকালীন সময়ে আমি আমার কবিতা নিয়ে মোহাম্মদ নাসিরুদ্দীনের কাছে গিয়েছিলাম। মনে পড়ে ছাপার অক্ষরে প্রথম ছড়া প্রকাশিত হয় ‘খেলাঘর’-এ। এরপর স্কুলে পড়া অবস্থায় দৈনিক আজাদ, ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা, ইনকিলাব-এ আমার ছড়া ও কবিতা প্রকাশিত হয়।
৪. বাংলা ভাষার তথা বাংলাদেশের প্রধান কবিবৃন্দ যেমন : ফররুখ আহমদ, আহসান হাবীব, সৈয়দ আলী আহসান, আবুল হোসেন, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, ফজল শাহাবুদ্দীন, শহীদ কাদরী, আবদুল মান্নান সৈয়দ, আবিদ আজাদ প্রমুখ– তাদের সাহিত্যকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করেন? আর কার-কার সঙ্গে আপনার সখ্যতা বা বন্ধুত্ব বা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে উঠেছিলো বা আছে? তাদের সম্পর্কে আপনার অভিজ্ঞতা বা তাদের সাহিত্য নিয়ে আপনার মতামত জানতে চাই।
মাসুদুল হক: যাঁদের কথা আপনি উল্লেখ করলেন এঁরা সবাই বাংলাদেশের চল্লিশ, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের কবি। চল্লিশের প্রধানতম কবি হচ্ছেন ফররুখ আহমদ, আহসান হাবীব, সৈয়দ আলী আহসান ও আবুল হোসেন। এদের হাতেই বাংলাদেশের কবিতার আধুনিকতার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। ফররুখ আহমদ ‘মুসলিম রেনেসাঁর কবি’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তিনি বাংলা কাব্যজগতের সর্বাধিক সনেট রচয়িতা। তাঁর কবিতা প্রকরণকৌশল, শব্দচয়ন এবং বাক্প্রতিমার অনন্য বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল।আধুনিকতার সকল লক্ষণ তাঁর কবিতায় পরিব্যাপ্ত। তাঁর কবিতায় রোমান্টিকতা থেকে আধুনিকতায় উত্তরণের ধারাবাহিকতা পরিস্ফুট। ‘সাত সাগরের মাঝি’ কাব্যগ্রন্থে তিনি যে-কাব্যভাষার সৃষ্টি করেছেন তা স্বতন্ত্র এবং এ-গ্রন্থ তার এক অমর সৃষ্টি।
আহসান হাবীব “রাত্রিশেষ” থেকে “বিদীর্ণ দর্পণে মুখ” কাব্যগ্রন্থে কবিতায় নির্মাণ করেছেন স্বদেশলগ্নতা, জীবনঘনিষ্ঠতা, মানবিক বেদনাবোধ, প্রেমানুভবের উৎসারণ, নিজস্ব আত্মজৈবনিক কাব্যশৈলী। নিজস্ব কাব্যশৈলীর আধুনিকতার সঙ্গে রবীন্দ্র-নজরুল যুগের কাব্যকলার সংমিশ্রণে দেশ ও জীবনবোধের সাহচর্যে আধুনিক কাব্য আন্দোলনের সূচনাক্রম উদ্ভাসিত হয়েছে তাঁর সব রচনাকর্মে। তাই আমার মনে হয় তিনি শুধু আমাদের প্রকৃত আধুনিক কবি নন, উত্তরাধুনিকতার এক পথপ্রদর্শক। কারণ তিনি কবিতায় তুলে ধরেছেন সমকালীন ইতিহাস, সমাজ, জীবন বাস্তবতা, কাব্য নিরীক্ষা, ঐতিহ্যের নবরূপায়ণ, দার্শনিকতার নতুনবোধ ও শিল্পরীতি। তিনি দীর্ঘদিন দৈনিক বাংলার সাহিত্য সম্পাদকের দায়িত্ব পালন সূত্রে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সাহিত্য অঙ্গনে অভিভাবকের ভূমিকা রেখেছেন।আমি তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছি।অল্প বয়সেই তাঁর সঙ্গে দেখা হয় আমার দৈনিক বাংলায়।তার শ্বেত- শুভ্র চুল আর ব্যক্তিত্ব আমাকে দারুণ আকর্ষিত করেছিল। তাঁর দপ্তরে খুব ভয়ে ভয়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম।আমি জীবনানন্দ দাশ পড়েছি কি না জানতে চেয়েছিলেন।আবুল হাসানের কথা তাঁর কাছেই জানতে পারি।
বুদ্ধি-বিবেচনা, সৃজনক্ষমতা ও মননসত্তায় সৈয়দ আলী আহসানের তুলনা বিরল।একজন খ্যাতনামা সাহিত্যিক, কবি, সাহিত্য সমালোচক, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ হিসেবে বার বার তাকে অনুসরণ করি আমি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তিরিশের পঞ্চপাণ্ডব কবিদের কবিতার উপর বেশ কয়েকটি লেকচার আমার শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল, যা আমার চিন্তাকাঠামোকেই পাল্টে দিয়েছিল। ইংরেজি সাহিত্যের আধুনিক কবিতার আঙ্গিক ও প্রকরণ নিয়ে তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল। ফলে কবিতায় তিনি ইংরেজি সাহিত্যের প্রচ্ছায়ায় আধুনিক শিল্পরীতি প্রয়োগ করতে পছন্দ করতেন। পাশাপাশি শব্দ, অলঙ্কার, উপমা-রূপক, চিত্রকল্প ব্যবহারে তাঁর নিজস্ব রুচি, দৃষ্টিভঙ্গী ও বিবেচনা কাজ করেছে। কবিতায় আহরিত উপকরণসমূহ বিন্যাসের ক্ষেত্রে তিনি যে নৈপুণ্য প্রদর্শন করেন তা আমাকে সবসময়ই আকর্ষণ করে।
“নববসন্ত”- এর কবি রআবুল হোসেন। আমাদের প্রথম আধুনিক মানসিকতার, চেতনা-অবচেতনার কবি। ছন্দবদ্ধ সমিল গদ্য কবিতারও পথিকৃৎ তিনি। দীর্ঘদিন বেঁচে ছিলেন। তাঁর কবিতা নিয়ে আমার গবেষণাও রয়েছে। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য আমি তাঁর সান্নিধ্য পাইনি।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর মুক্তচিন্তার উচ্চকণ্ঠ কবি শামসুর রাহমান। তাঁর কবিতার শরীরে রোমান্টিকতার সঙ্গে প্রতিবাদের মেলবন্ধন ঘটেছে, যা তার একান্ত নিজস্ব কাব্যবোধে জারিত। তিনি নিজে ছিলেন আত্মমগ্ন ও নিভৃতচারী। তার আত্মমগ্নতার ভেতরে শহুরে মধ্যবিত্ত জীবনাচরণ, প্রেম-ভালোবাসা, সাধারণ মানুষের জীবনসংগ্রাম–এক কথায় বাঙালির জীবনচিত্র উঠে এসেছে। সমকালীন বাংলা সাহিত্যে সর্বাধিক কবিতার রচয়িতা হিসেবে তিনি খ্যাতি পেয়েছেন। ঢাকার অধিবাসী শামসুর রাহমান, যিনি বাংলাকাব্যে নাগরিকতার ধারক, তাঁর সঙ্গে আমার সান্নিধ্য শৈশব থেকে। তাঁর পুরাতন ঢাকার সৈয়দ আওলাদ হোসেন লেনের পাশের গলি জিন্দাবাহারে আমি বেড়ে উঠেছি। তিনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে তাঁর অফিস দৈনিক বাংলায় যাবার সময় প্রায়ই দেখা হতো,কথা হতো।পরে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে আমি যখন “শ্রাবণের আড্ডা” লিটলম্যাগ বের করি পারভেজ চৌধুরী ও রবিন আহসানের সঙ্গে তখন রাহমান ভাইয়ের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম তাঁর শ্যামলী বাড়িতে।
বাংলা কবিতার লোকঐতিহ্যের গভীরে শেকড় পরিব্যপ্তকারী আধুনিক মননের কবি আল মাহমুদ।
লোকজ, গ্রামীণ পটভূমি এবং ভাবাত্মক-রূপাত্মক শব্দ প্রয়োগে বাংলা কবিতার ভূগোলকে বিস্তৃত করেছেন তাঁর অসাধারণ নৈপুণ্যে। তার কবিতায় যতটা না আবেগ থাকে তার চেয়ে বেশি থাকে বাস্তবতা, প্রকৃতি ও নারীর সুষমা রূপ।এই কবির সঙ্গে আড্ডা ও সান্নিধ্য আমাকে ঋদ্ধ করেছে।আমি তাঁর গদ্য ও গদ্যচিন্তার অসম্ভব ভক্ত।
পঞ্চাশের দশকের কবি ফজল শাহাবুদ্দীন। যাপন করেছিলেন সাহিত্য-সাংবাদিকতার এক বিরল জীবন। তিনি কবিতার পরতে পরতে যুক্ত করেছেন প্রেম, রমণী , একাকিত্ব ও আধ্যাত্মিক চেতনা– যা বাংলাদেশের কবিতায় নতুন মাত্রা দিয়েছে। সেই সঙ্গে তার রচিত দীর্ঘ কবিতার অধিকাংশ প্রকৃতি ও প্রেমের আন্দোলনের দ্যুতিতে উজ্জ্বল।
মাত্র ৪টি কাব্যগ্রন্থ দিয়ে বাংলা কবিতার ভুবনে চিরস্থায়ী আসন গড়ে নেওয়া বিরলপ্রজ কবি শহীদ কাদরী।
কৃতিত্ব বিচার্য নয়, তাঁর সৃষ্টিটাই আসল। পৃথিবীবিখ্যাত অনেক কবি-সাহিত্যিক আছেন, যাঁদের গ্রন্থসংখ্যা খুবই অল্প। যেমন জগদ্বিখ্যাত ফরাসি কবি বোদলেয়ারের বইয়ের সংখ্যা একটাই (লে ফ্লর দ্যু মাল)। কবিতার সংখ্যা ১৮০টি। আর একজন বিখ্যাত কবি জঁ আর্তুর র্যাঁবো। তাঁর বই মাত্র দুটি। এই বিরলপ্রজ কবিদের ধারায় এক সংযোজন বলতে পারি শহীদ কাদরীকে। বাংলা কবিতায় নাগরিক চেতনার অনুষঙ্গ প্রয়োগের মাধ্যমে আধুনিকতাবোধের সূচনাকারি এই কবি নগরকে আরো গভীর অবলোকনে আমেরিকায় গিয়ে যাপন করেন মহানাগরিক জীবন।যে কারণে আমার আফসোস হয় আমি তাঁর সান্নিধ্য পাইনি। তবে তাঁর:
“বন্য শূকর খুঁজে পাবে প্রিয় কাদা
মাছরাঙা পাবে অন্বেষণের মাছ,
কালো রাতগুলো বৃষ্টিতে হবে শাদা
ঘন জঙ্গলে ময়ূর দেখাবে নাচ
প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সাথে ঠিক-ই
কিন্তু শান্তি পাবে না, পাবে না, পাবে না…”
এই কবিতা প্রতিনিয়ত আমাকে ভাবায়।কী আশ্চর্য উপলব্ধি আর মনস্তাত্ত্বিক বাস্তবতা উঠে এসেছে কবিতার চরণে!
বিচিত্রধর্মী, গভীর ও প্রজ্ঞাময় শিল্পান্বেষী চেতনায় আচ্ছন্ন নিমগ্ন ধ্যানী কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ। যাঁর লেখায় খুঁজে পাই নান্দনিক শুদ্ধাচারের সশ্রম পারঙ্গমতা, স্বজ্ঞানতা, মোহময় প্রহেলিকার কারুপ্রতিবেশ সৃষ্টি-জগৎ, ফ্রয়েডিয় শিল্পচৈতন্য, অস্পষ্টতার ধোঁয়াশা, রঙের আচ্ছন্নতা, নগ্নবাস্তবতার প্রসারতা, অনিশ্চয়তার শৈল্পিক প্রমূর্তির উদ্ভাস, পরাবাস্তবতার মুগ্ধতা।আমার লেখক ও কবিসত্তায় তাঁর প্রভাব ব্যাপক। আমি যখন বাংলা একাডেমির রিসার্চ ফেলো হিসেবে ” বাংলাদেশের কবিতার নন্দনতত্ত্ব” গবেষণার কাজ করছিলাম ১৯৯৭ সালের দিকে।তখন মান্নান ভাই প্রায়ই বাংলা একাডেমিতে আসতেন।এলেই আড্ডা হতো।
আবিদ আজাদের কবিতার আমি একনিষ্ঠ ভক্ত পাঠক। তাঁর কবিতা লিরিকধর্মী, অনুচ্চকণ্ঠ এবং চিত্রময় হিসাবেই সমধিক প্রসিদ্ধ। কাঁঠালবাগানে ‘শিল্পতরু’ অফিসে তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছি।তিনি শিল্পতরুতে আমার কবিতা ছেপেছিলেন। তাঁর “ঘাসের ঘটনা” আর “বনতরুদের মর্ম” কাব্যগ্রন্থ দুটি আমার পাঠক সত্তায় অমোচনীয় সম্পদ।
৫. আপনি একাধারে একজন কবি ও সাহিত্য বিশ্লেষক–অর্থাৎ বহুমাত্রিক। আপনার অভিজ্ঞতা ও বিচরণ ক্ষেত্র ব্যাপক ও বর্ণিল। বিচিত্র। এই সামগ্রিক সত্তাকে কিভাবে দেখেন? কিভাবে উপভোগ করেন?
মাসুদুল হক: নিজেকে জানতে গিয়ে কবিতাযাপনের সূচনা। আত্মোপলব্ধির দর্পণে যখন অন্যদের কবিতা,বাক্য বা চিত্রকল্পের ছায়া এসে পড়েছে , তখন তার এক ধরনের মূল্যায়ন তৈরি হয় নিজের কাছে।তা থেকেই সাহিত্য-বিশ্লেষণের পথে আসা। নিজেকে শূন্য শূন্য মনে হয়, ফাঁপা লাগে। কোথায় যেন অস্তিত্বের কী রেখে এসেছি। কবিতার ঘোরের মধ্যে জীবনের গল্প এসে বাসা বাঁধে,তখন নিজেকে খুঁজতে গিয়ে গল্প লিখে ফেলি।সে গল্পের মধ্যেও দৃশ্যের ভাব চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক দ্যোতনায় উপস্থিত হয়। গল্প লেখা হয়ে গেলে, বহুদিন পরে আবার পড়ে মনে হয়েছে এতো আমি লিখিনি, আমাকে দিয়ে কেউ লিখিয়ে নিয়েছে।গদ্য-পদ্যের মধ্যে আমি বিভাজন দেখতে পাই না।গল্পের বাক্যের কাঠামোর মধ্যে কবিতা থাকে; কবিতার ভাবনার মধ্যে কাহিনী থাকে।এক অভেদ্যাত্মক রূপ এই গদ্য-পদ্য।অনেক সময় যখন গল্প বা কবিতা কিছুই আসে না আমার ভেতর,তখন অনুবাদে মন দিই।অন্য কবি বা গল্পকারের চিন্তার ভেতরটা দেখতে চাই।আমি অভিভূত হয়ে যাই কীভাবে কবিতা হয়,কী ভাবে একটা উপন্যাসের ভেতর মানুষ আর প্রকৃতি একটা বিশ্ব গড়ে তোলে।ঐ কবিতা বা গল্প বা উপন্যাসের চরিত্র,তার পারিপার্শ্ব আমাকে প্রভাবিত করে।একটা ছায়ামূর্তি হিসেবে আমার ভেতর জেগে থাকে।তার সন্ধানেই সাহিত্য বিশ্লেষণ অথবা গবেষণায় আত্মস্থ হই।এই বহুমাত্রিকতা আমাকে মুক্তি দেয়। নিজের অপূর্ণতার স্বরূপ খুঁজতে গিয়েই বহুরূপের মধ্যে নিজেকে সন্ধান করি।
৬. আদি বাংলা তথা চর্যাপদ থেকে আজ অবধি বাংলা সাহিত্য কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে–আপনার বর্ণনা ও বিশ্লেষণে?
মাসুদুল হক: চর্যাপদ প্রজ্ঞাময় বাক্যের সুর তরঙ্গ। যাপিত চর্যাসমগ্রই জীবনবোধ। যে জীবনবোধ আজও বাঙালির মর্মমূলে প্রোথিত। মর্মগ্রাহী সেই বোধস্রোত বাঙালির অস্তিত্বে ও শোণিতে প্রবহমান। কালের স্রোতে হয়তো নদীর বাঁক পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু উৎসমূল শাশ্বত এবং সারগর্ভপূর্ণ। স্বকালতাড়িত ভাবনার মিথস্ক্রিয়ায় একই দর্শন বহু চিহ্ন ধারণ করে। সাংখ্যের পুরুষ প্রকৃতি, বৌদ্ধের প্রজ্ঞা উপায়, রাধাকৃষ্ণের প্রেমতত্ত্ব, লালনের মর্মস্পর্শী জারণ-বিজারণ, রবি ঠাকুরের মানসপ্রিয়ার ঋতাকাঙ্ক্ষা–এসব একই সুরের প্রতিধ্বনি। যেন একই সহজিয়া ক্যানভাসে ভিন্ন ভিন্ন রঙের পরিস্ফুটন। চর্যাপদ বিষয় দর্শনে মিস্টিক-রূপ কিন্তু প্রকরণে গীতিকাব্য। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এই পুঁথিটির নাম দিয়েছিলেন ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়’। মুনিদত্তের টীকায় এই পুথিটির নাম ‘চর্যাগীতি কোষ’। শুধু চর্যাপদ নয়, সেসময় ধর্ম-দর্শন, কলা-বিজ্ঞান সবকিছুই গীতিকাব্যে প্রকাশ করা হতো। তার সুবিধাও ছিল। মুদ্রণযন্ত্র না থাকার কারণে মানুষ তার যাপিত জীবনের সবকিছু সুরে সুরেই গেঁথে রাখতো। প্রার্থনায় বা আর্তনাদ প্রকাশে গানই ছিল প্রজ্ঞার কমল-কুলিশ। চর্যাকবিরা তাই গীতিকাব্যের ভঙ্গিমায় সমগ্র জীবনকে গেঁথে দিয়েছেন এই চর্যাপদে। স্বসংবেদন অনুভবের এক সহজ রস-পরতান্ত্রিকতায়। চর্যাপদ তাই জীবন ও সময়স্বভাবী শৈল্পিক মনস্তত্বের শিল্পীত সাক্ষ্য। চর্যা কবিতায় বোধ ও চৈতন্যের সীমা সম্প্রসারিত হয়েছে জীবন অভিপ্সা, পরিস্থিতি ও প্রকৃতির সুষমায়। যাকে বলা যায় শিল্পীর সত্তা অভিজ্ঞানে বাঁধা প্রকৃতি ও মনস্তত্ত্বের এক কসমিক মিথস্ক্রিয়া।এই নিরিখে রবীন্দ্রনাথের জীবিতাবস্থায় ত্রিশের কবিরা কবিতা বদলে দিয়েছেন। এই রেশ কাটতে না কাটতেই হাজির হয়েছেন চল্লিশ-পঞ্চাশ-ষাটের কবিরা। প্রতিটি দশকেই কবিতার উন্নতি অনেক স্পষ্ট হয়েছে। দশকওয়ারি এই বিবর্তনধারায় বাংলা কবিতা সমৃদ্ধ হয়েছে। তবে অনেক কবিকেই দশকের ছকে বেঁধে ফেলা যায় না। তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে ভালো কবিতা লেখার একটি চেষ্টা সবার মধ্যেই ছিল। এই চেষ্টার পেছনে রয়েছে মানুষ যাতে কবিতা থেকে দূরে চলে না যায়, সাধারণ মানুষের ভাষা থেকে বিচ্ছিন্ন না হয়ে যায়। গদ্য ভাব প্রকাশের সবচেয়ে কার্যকর মাধ্যম। ছন্দবদ্ধ কবিতা যথাযথ ভাব প্রকাশের গতির সঙ্গে চলতে পারত না। তাই অনিবার্য ছিল অক্ষরবৃত্ত বা গদ্য কবিতার। এতে কবিতার সুসময় ফিরে এসেছে তা নয়। তবে কবিতা মাঝে মাঝে তীব্র আলোর ঝলকানি ছড়িয়েছে। আমি মনে করি চর্যা থেকে বর্তমান পর্যন্ত কবিতার ভাষা হয়তো পাল্টে গেছে কিন্তু চর্যার যে জীবন বোধ ও দার্শনিক অনুধাবনের গভীরতা তা থেকে বাংলা কবিতা খুব এগিয়ে যেতে পারেনি।আমরা শুধু প্রকাশে আধুনিক হয়েছি, কিন্তু গভীরতায় চর্যা থেকে পিছিয়ে যাচ্ছি।এ জন্য কবিদের উচিত বাঙালি জীবনবোধের দার্শনিক গতিপ্রকৃতির অন্বেষণ করে কাব্যে মনোনিবেশ করা।
৭. সাম্প্রতিক বাংলাদেশে, শিল্প-সাহিত্যচর্চায় কোন-কোন চ্যালেঞ্জ বা সুবিধা-অসুবিধা আছে বলে আপনার মনে হয়? কীভাবে এগুলি মোকাবিলা করেন?
মাসুদুল হক:শিল্প-সাহিত্যে উত্তরাধিকার বলে একটা কথা আছে, বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম সে উত্তরাধিকার পেয়েছে বলে অন্তর্গত রক্তস্রোতে সে দায় অনুভব করে।এটা একটা সুবিধা,বিধায় শিল্প-সাহিত্য চর্চা করছে।তাই তার অভিজ্ঞতাকে সাহিত্যে কি শিল্পে তুলে আনছে। কিন্তু এই তুলে আনা বড় একরৈখিক। সেখানে রং-এর ব্যবহার আছে কিন্তু নেই পরিমিতি আর উপলব্ধির গভীরতা। মানুষের জীবন,তথা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রতিনিধিত্ব নেই সাহিত্যে। জীবনের দ্বন্দ্ব সংঘাত ও যৌন জীবন যেভাবে বদলে যাচ্ছে,তার নির্মোহ দার্শনিক উপলব্ধিগত সাহিত্য রূপায়ণ দেখতে পাচ্ছি না কবিতা, গল্প কি উপন্যাসে।যারা সাহিত্য করছে তারা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর হয়েও উচ্চবিত্ত জীবনের চমকের পেছনে ছুটছে। নিজের অস্তিত্বের মধ্যে স্ট্রাগল(struggle)কে ধারণ করে সাহিত্যের ভেতর নিজেকে বিলীন করতে চাইছেন না।
লক্ষণীয়, আজকের যুগে সব ধরনের সৃজনশীল প্রচেষ্টার বা ক্রিয়ার একটি ‘চাহিদা ও সরবরাহে’র দিক রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, আগেরকার যুগে ‘প্রয়োজন’-ই ছিল একটি এমন চালিকা শক্তি যা আগেকার কালে চাহিদা ও সরবরাহের অর্থনৈতিক বোঝাপড়ার দিকটা দেখে নানান ধরণের সিদ্ধান্ত নিত। ভাল লেখা, গ্র্যান্ড থিয়েটার, প্রশান্তিদায়ক সঙ্গীত বা শিল্পের দুর্দান্ত বহিঃপ্রকাশ — এ-সবই আমাদের জীবনের ‘প্রয়োজন’ হিসাবে এক সময়ে বিবেচিত হয়েছিল। তাই ১৯-শতক পর্যন্ত লেখালেখির দুনিয়া এবং লেখকরা এ থেকে খুব সুযোগ-সুবিধা পেয়ে উন্নতি লাভ করেন ।বিংশ শতকে দেখা গেল এসেছে একটা বিশাল পতন ও পরিবর্তন, রক্তাক্ত যুদ্ধ এবং মহান বিশ্বাসঘাতকতা ,আবার সেই সঙ্গে শিল্প-বিপ্লবও দেখা গেছে। এই শিল্প বিপ্লবই প্রধান অর্থনৈতিক চালক হিসেবে আমাদের ‘চাই’-কে বা চাওয়া-কে তুলে ধরেছে। তাই ধরে নিচ্ছি যে লেখা এখন একটি বিলাসবহুল সামগ্রীতে পরিণত হয়েছে, এর পরিণতি হল তারা এখন চাহিদার যুগের প্রয়োজনীয়তাগুলিকে পূরণ করে দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হবে। প্রকাশকরা এখন বিপুল পরিমাণে সম্ভাব্য ক্রেতাদের চিহ্নিত করে তাদের বাজারের ভিত্তিতে কোনও রচনা বা রটনা বা ছায়াছবি বিক্রি ও সম্প্রসারণের চেষ্টা করবে। এই চ্যালেঞ্জকে নিয়ে আমাদের শিল্প-সাহিত্য করতে হচ্ছে।
আমরা বিশ্ব সাহিত্যের খোঁজ রাখি কিন্তু স্ট্রাগলের খোঁজ করি না।আমরা পশ্চিমা সাহিত্যতত্ত্বের নকল করি কিন্তু তা না করে আমাদের দরকার নিজস্ব সাহিত্যতত্ত্বানুসন্ধান।
অর্থাৎ, নতুন ধরনের সৃজনশীলতার মানচিত্র তৈরি করার জন্য আমাদের আরও শক্তিশালী সাহিত্য-তাত্ত্বিক পদ্ধতির প্রয়োজন হবে।
৮. আপনার প্রথম প্রকাশিত বই কোন টি? কবে প্রকাশিত হয়েছিলো? প্রথম বই প্রকাশের অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি কেমন ছিলো?
মাসুদুল হক: “টেনে যাচ্ছি কালের গুণ” আমার প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ।১৯৮৮ সালে প্রকাশিত হয় আগামী প্রকাশনী থেকে।বইটি প্রকাশের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন কবি ব’নজীর আহমেদ। তাঁর ৩০ হায়দার বক্স লেনে যেতাম।বইয়ের স্তূপের পাশে বসে আড্ডা হতো। ওখানটায় কবি মোস্তফা হাবীব,আসলাম সানি,কাফি শেখসহ আরো অনেকে আসতেন। তখন এরশাদের শাসন। সেইসঙ্গে চলছে তার পতনের আন্দোলন।সেই সময় খুব স্বৈরাচার বিরোধী কবিতা ছিল আমাদের কলমে। তাঁর মধ্যে ব’ নজীর ভাই কবিতা প্রকাশের ব্যবস্থা করলেন।অল্প বয়স আমার বিস্ময়ের শেষ নেই।লেটার প্রেসে বইটি ছাপা হয়েছিল।প্রচ্ছদ শিল্পীর সঙ্গে বসে থেকে প্রচ্ছদ করিয়ে নিয়েছি।প্রচ্ছদ দেখতে গেছি ছাপাখানায়।বই যখন বাইন্ডিং কারখানায় , কাঁচা বই নিয়ে তার সাইজ,ছাপা আর বানান — কত বার যে পরখ করেছি।আজ ভাবলে ঐ দিনগুলোর কাছে চলে যেতে ইচ্ছে করে।
এখন মনে হয় প্রথম সন্তানের মতোই ছিল প্রথম কাব্যগ্রন্থ।
৯. সাহিত্যে আপনি কার উত্তরাধিকার বহন করেন?
মাসুদুল হক: বিশেষ কোনো উত্তরাধিকার বহন করতে চাই না।যখন যাকে ভাল লাগে তাঁর চর্চা করি। বিশেষ কোনো ঘারানা বা মতাদর্শে আমার আস্থা নেই। মতাদর্শে বিশ্বাসী হলে অনেক রস ও শৈলী থেকে বঞ্চিত হতে হয়। আমার যেমন ক্লাসিক সাহিত্য ভালো লাগে,তেমনি উত্তরাধুনিক সাহিত্যেও রস খুঁজি। সেই অর্থে আমি নাগরিক কবি শামসুর রাহমানের নগর যাপনেও আছি; আল মাহমুদের শেকড় অনুসন্ধানী অভিযাত্রায়ও সঙ্গী হব। অসংখ্য ব্যক্তি মানুষের নিষ্ঠা দিয়েই আমাদের হাজার বছরের বাঙালি শিল্প ও সাহিত্য গড়ে উঠেছে।ভুসুকুও আমার আলাউলও আমার। চণ্ডীমঙ্গল থেকে ইসলামী সাহিত্যে বাঙালির পরিপুষ্টির রুধির রয়ে গেছে।
১০. এ যাবৎ সর্ব মোট আপনার কতটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে? এর মধ্যে কোনটি বা কোন-কোন কাজকে বা কোন বইকে আপনি আপনার উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি বলে মনে করেন?
মাসুদুল হক: এ যাবৎ আমার ছোত্রিশটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। কাব্যগ্রন্থ:৯টি, গল্প গ্রন্থ:৪টি, গল্পসমগ্র: ১টি, উপন্যাসে:১টি ,প্রবন্ধগ্রন্থ:১২টি, অনুবাদগ্রন্থ:৫টি, সাক্ষাৎকার:১টি,সম্পাদনা:৩টি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থ: “তামাক বাড়ি”, “ঢুলকিপুরাণ” ও “গল্পসমগ্র”; উপন্যাস: “দিনমুলুক”; কাব্যগ্রন্থ: “সার্কাসের মেয়ে ও অন্যান্য কবিতা”, “লজ্জা ও বোতামের কবিতা”; প্রবন্ধ: “বাংলাদেশের কবিতার নন্দনতত্ত্ব “; “বাংলা সাহিত্যে নারী”, “জীবনানন্দ দাশ ও অন্যান্য” , “টি. এস. এলিয়ট ও অন্যান্য”, “বাংলাদেশের কথাসাহিত্য: পাঠ ও অন্বেষণ ” প্রভৃতি।
১১. সম্প্রতি প্রকাশিত আপনার নতুন বই সম্পর্কে বলুন।
মাসুদুল হক: এ বছর “উলগুলান ও অন্যান্য কবিতা” নামে একটি কবিতাগ্রন্থ প্রকাশ পেয়েছে ‘শুদ্ধপ্রকাশ’ থেকে।এই বইটা সমতলের আদিবাসীদের জবীন ও সংস্কৃতি বিষয়ক কবিতা রয়েছে।আমার গবেষণা ও অন্বেষণের বিষয় সমতলের আদিবাসী জীবন ও বৈচিত্র্য। দীর্ঘদিনের নিরিখের ভেতর থেকে গবেষণার পাশাপাশি এই কবিতাগুলো তৈরি হয়ে উঠেছে।
টি. এস. এলিয়ট নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছি।তাঁর
“Four Quartets” ও “Ash Wednesday” অনুবাদ করেছে অনেক আগে।সেই থেকে টি. এস. এলিয়ট পড়ছি। বিভিন্ন সময় এলিয়ট নিয়ে লিখেছি ও গবেষণা করেছি।এবার এলিয়ট বিষয়ক চারটি প্রবন্ধ, রবীন্দ্রনাথ ও ইয়েটস-এর তুলনামূলক আলোচনা, রোলাবার্থ, কাহলিল জিবরান, তাইওয়ানের কবিতা নিয়ে একটি প্রবন্ধের গ্রন্থ “টি. এস. এলিয়ট ও অন্যান্য” নামে গ্রন্থ প্রকাশ করেছে প্রতিকথা প্রকাশনী।
১২. আপনি নিজেকে কোন দশকের কবি-লেখক বলেন? কেন?
মাসুদুল হক: এরিস্টটল তাঁর ‘পলিটিক্স’ গ্রন্থে বলেছেন, মানুষ একটা রাজনৈতিক প্রাণী, কারণ সে ভাষা-ব্যবহারকারী এবং নীতি-নৈতিকতা-সচেতন একটি সামাজিক জীব। সেই বিবেচনায় লেখকও তাই। লেখক বা কবি মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন না, তাই কবি বা লেখকের লেখা তার দেশ ও কালের ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, রাজনীতি, নিজস্ব ভাষা এবং নিজের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলকে ধারণ করে।
নব্বইয়ের গল্প কিংবা কবিতায় মরমিবাদ, বাউলতত্ত্ব ও লোকজধারা দৃশ্যমান। সেইসঙ্গে নাগরিকবোধ আর জৈবিক স্খলন ও সংকটের আবর্তে জীবনের রহস্যময়তা এবং বিমূর্ত ভাবকল্পও লক্ষণীয়।জাদু-বাস্তবতা, অধিবাস্তববাদ, উত্তরাধুনিকতা, কাঠামোবাদ, বিনির্মাণবাদ ও ডিসকোর্সের অনুষঙ্গ-তাড়িত প্রকরণশৈলীও ব্যাপক অর্থে নব্বইয়ের নব্বইয়ের প্রজন্মের মধ্যে স্পষ্ট।সেই হিসেবে আমিও নিশ্চয়ই আমার সময় ও সমকালীনদের ধারণ করি। যদিও আশি দশকের শেষ থেকে আমার লেখা প্রকাশিত হতে থাকে। কিন্তু আমরা স্ফূরণ ঘটেছে নব্বইয়ের দশকে। আমার লেখা ও চিন্তায় নব্বইয়ের দশক স্পষ্ট।সেই বিবেচনায় আমি অবশ্যই নব্বইয়ের দশকের।
১৩. আপনার সমকাল নিয়ে বলুন।
মাসুদুল হক: যৌথ সমাজ ব্যবস্থা অনেক দিন হলো ভেঙে পড়েছে। বিদায় নিয়েছে মূল্যবোধ। মানবিক সূক্ষ্ম অনুভূতি অনেক আগেই হারিয়ে গেছে আমাদের জীবন থেকে। বিশ্বায়নের স্রোতে গা ভাসিয়ে আমরা বিশ্বজয়ের অলীক স্বপ্নে বিভোর। এদিকে, নিজেদের ঘর যে স্রোতে ভেসে যেতে চলেছে, নিরাশ্রয় হতে চলেছি আমরা, সেদিকে কারোরই দৃষ্টি নেই। অনেকটা সেই একচক্ষু হরিণের অবস্থা।আমার সমকালের পরিবেশ বিপর্যস্ত। রাজনৈতিক অসহিষ্ণু পরিবেশ, গণতন্ত্র মৃত।শ্রেণি বৈষম্য ব্যাপক। সমাজ কাঠামো ভেঙে যাচ্ছে।চারিদিকে ছায়া শিক্ষিত মানুষে ভরপুর।আল মাহমুদের ভাষায় কাব্য ঈর্ষা নেই, শুধু ব্যক্তি ঈর্ষা! এই বিষয়গুলো গভীরভাবে আমলে নিলে মহৎ রচনা বা সৃষ্টি হওয়া সম্ভব। অবশ্য আমার সমকালের কবি ও সাহিত্যিকগণ অনেক মেধাবী।আমাদের নব্বইয়ের দশকেই কবিতা ও কথাসাহিত্যের প্রধান উর্বর ভূমি হয়ে ওঠে সামরিক জান্তাদের দুরাচারের দিনলিপি। তাঁদের লেখায় স্থান পায় গণমানুষের যাপিত জীবনের কথা, মানবেতর জীবনগাথা তথা রাজনীতি। স্বাধীনতার পর যেমন সমাজতান্ত্রিক মতবাদের প্রেক্ষাপটে দেশের প্রায় সব কবি-সাহিত্যিক লিখেছেন ঠিক তেমনই আশির দশক থেকে সেই ধারা মুখ থুবড়ে পড়ে। একটি কথা উল্লেখ না করলেই নয় যে,সাহিত্যে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে মানবতাবাদ সব সময়ই প্রাসঙ্গিক ছিল, আমার সমকালেও রয়েছে।
বাংলাসাহিত্য পশ্চিমা সাহিত্য দ্বারা প্রভাবিত এই অভিযোগকে অস্বীকার করা যায় না। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর উপন্যাসে পশ্চিমা প্রভাব রয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পশ্চিমাদের উপন্যাসের কাঠামো অনুসরণ করেছেন, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর সাহিত্যে চেতনাপ্রবাহ রীতির প্রভাব রয়েছে। কমলকুমার মজুমদার এই ধরনের অভিযোগ থেকে মুক্ত রয়েছেন বলে অনেকেই মনে করেন। তারপরও তাঁর বাক্যগঠন ফ্রান্স বাক্য নির্দেশিত। আবার মার্কেসসহ আরও কয়েকজন লাতিন আমেরিকান সাহিত্যিকদের জাদুবাস্তবতার সাহিত্যের প্রভাব বাংলা সাহিত্যে প্রবলভাবে স্থান করে নিয়েছে যা এখনও চলমান রয়েছে। গত দুই দশকে জাদুবাস্তবতা, পরাবাস্তবতা, আধুনিকতা ও উত্তরাধুনিকতার স্রোতধারায় আমাদের কবিসাহিত্যিকদের মধ্যে বিস্তর প্রভাব ফেলেছে। প্রায় সব কবিসাহিত্যিকই এসব মতবাদের ভিত্তিতে সাহিত্য রচনা করতে প্রয়াসী হয়েছেন এবং কেউ কেউ সফলও হয়েছেন। কিন্তু আমাদের ঐতিহ্য নির্ভর সাহিত্যতত্ত্ব দাঁড় করাতে পারিনি। জাদুবাস্তবতার ভিত্তিতে রচিত কথাসাহিত্যে শহীদুল জহিরই এখন পর্যন্ত একজন সফল লেখক হিসেবে স্বীকৃত এবং অনেক নবীন লেখক তাঁর অনুসারী হয়েছেন বলে বিভিন্ন মাধ্যমে লক্ষ করা যায়। তবে ইমতিয়ার শামীম, শাহাদুজ্জামান,মামুন হুসাইন,জাকির তালুকদার,সাদ কামালী, মশিউল আলম, প্রশান্ত মৃধাসহ অনেকেই বাংলা গল্প ও উপন্যাসের নিজস্ব প্যাটার্নে কাজ করছেন।
বাংলা কবিতা অনেক দূর এগিয়ে গেছে। কবিতার সঙ্গে পাঠক এগুতে পারেননি বলেই কবিতার বিরুদ্ধে প্রতিনিয়তই বিষোদাগার হচ্ছে এই মর্মে যে এখনকার কবিতা বোধগম্য নয়। বাংলা কবিতাতেও জাদুবাস্তবতা, পরাবাস্তবতা, উত্তরাধুনিকতা শিকড় গেড়েছে বলে পাঠককুল তাল মিলাতে পারছেন না। তবে একথাও সত্য পাঠকের অনগ্রসরতার জন্য শিল্পসাহিত্য থেমে থাকতে পারে না; বরং আশা করতে পারি পাঠকও একসময় তৈরি হয়ে যাবেন। সবশেষে নাটক-সিনেমার কথাও উল্লেখ করা যেতে পারে। মঞ্চ নাটকগুলো ইতিহাস ও মিথের প্রাধান্য লাভ করলেও সিনেমা ও টিভি নাটকগুলো সমাজবাস্তবতারপ্রেক্ষাপটে নির্মিত হলেও হালকা জলো প্রেমের রসিকতাই প্রাধান্য বিস্তার করে আছে বলে এগুলো বোদ্ধা শ্রেণির মানুষকে আকৃষ্ট করতে পারছে না। নাটকে সৈয়দ শামসুল হক, মামুনুর রশিদ, সেলিম আল দীনের পর তেমন কাউকে পাচ্ছি না আমার সমকালে।শিল্পের চর্চা করতে এসে আত্মত্যাগী প্রকৃত শিল্পী হতে হবে এবং সমকাল বিবেচনায় রেখে শিল্পের উন্নয়নের জন্য নিজস্বতা তৈরি করতে হবে। নিজস্বতা বা মৌলিক ধারা তৈরির জন্য মৌলিক চিন্তার দ্বার উন্মোচন করা অত্যাবশ্যক।
১৪. আপনি কবিতায় মিথ, ধর্ম ও ধর্মীয় অনুষঙ্গ ব্যবহার করা বিষয়ে কি ভাবেন? বিশেষত ইসলামিক বিষয়, ইতিহাস, ঐতিহ্য ইত্যাদি ব্যবহার করা বিষয়ে।
মাসুদুল হক:মিথ একটা জাতির অবদমিত ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ। আমাদের বাংলা কবিতায় মিথের সার্থক প্রয়োগ ঘটেছে মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ, বিষ্ণু দে,সুধীন দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসুর হাতে। বাঙালি জাতির ঐতিহ্যের সঙ্গে হিন্দু ও মুসলিম জাতিসত্তার ধর্ম, বিশ্বাস,প্রথা,মিথ মিলেমিশে ভাষার সমৃদ্ধ কাঠামো গড়ে উঠেছে। মধ্যযুগের পুঁথি সাহিত্যে মুসলমানদের অবিস্মরণীয় কাজ ও ভূমিকা রয়েছে। পুঁথিসাহিত্যের ভেতর বিস্তর মিথ ও রূপকথা ছিল। যেগুলোর এক্সটেনশন ও বিনির্মাণে আধুনিক কবিতা ঋদ্ধ হতে পারতো।আমরা সে পথে যাইনি। শুধু ফররুখ আহমদ পরবর্তীতে চেষ্টা করেছিলেন। বাঙালি মধ্যবিত্ত মুসলমান শিক্ষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইসলামি মিথ ও ঐতিহ্যকে শুধু ধর্মচর্চার বিষয় মনে করেছে।যে কারণে উর্বর একটি জমিন পতিত রয়ে গেছে।যারা শুরু ধর্মকেন্দ্রিক সাহিত্য পাঠ ও চর্চায় আছে,তারা কোনো এক্সপেরিমেন্টে যায় নি।এই দুই পক্ষের সমন্বয়ের অভাবে সমকালে একটা বিচ্ছিন্ন বিশ্বাস তৈরি হয়েছে যে, ইসলামে মিথ নেই।আর ইসলামি ঐতিহ্য নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করা যায় না। ধর্ম ও ধর্মীয় অনুষঙ্গ নিয়ে কবিতা চর্চা একটা মধ্যযুগীয় ব্যাপার।কেননা নতুন এক্সপেরিমেন্ট করলেই বাঁধা আসবে। অথচ বোরাক, দুলদুল ঘোড়া,আসহাবে কাহাফের ঘটনা নিয়ে অনেক এক্সপেরিমেন্ট হতে পারে। কোরানে অনেক কাহিনী আছে যার পুনঃ তত্ত্বতালাশ হতে পারে কবিতায় সাম্প্রতিক সময়ের প্রেক্ষাপটে। ইসলামের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের নতুন বিনির্মাণ ঘটতে পারে কবিতায়।এর জন্য প্রয়োজন মুক্ত পাঠ ও নিরীক্ষা।কবিরাই পারেন তাদের কবিতায় মিথ, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের উত্তরাধুনিক ও পুনরাধুনিক বয়ান নির্মাণ করতে।
১৫. আধুনিকতা ও উত্তর আধুনিকতা বলতে আপনি কি বোঝেন? বাংলাদেশের কবিতার পরিপ্রেক্ষিতে এই বিষয়ে আপনার মতামত জানতে চাই।
মাসুদুল হক:কবিতার আধুনিকতা হলো কবিতার সাম্প্রতিকতা। অর্থাৎ যে-কবিতা সাম্প্রতিক সময়ের সমাজ, জীবন, সংস্কৃতি, রাজনীতি, ধর্ম, দর্শন, রাষ্ট্র, ভাষা প্রভৃতি ধারণ করে থাকে, তাই আধুনিক কবিতা। এদিক দিয়ে বলতে গেলে পৃথিবীর সব দেশের, সব ভাষার সমস্ত কালের কবিরাই আধুনিক কবি। আধুনিক শব্দটি কেবল বিংশ বা একবিংশ শতাব্দীর কবিদের জন্য নির্ধারিত, এমনটি নয়।আধুনিক কবিতার নানা লক্ষণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য লক্ষণসমূহ বিবেচিত হয় বিষয়ের বৈচিত্র্য, সমকালীন জীবনজটিলতা, অস্তিত্বের অনুসন্ধান, রাজনীতি, সামাজিক বিষয়াদি, প্রকৃতি, প্রেম, হতাশা, মানবিক অভিজ্ঞতা প্রভৃতি। বাংলাদেশ পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা করলে রবীন্দ্রনাথ থেকে সাম্প্রতিক সময়ের নতুন কবি যদি উক্ত লক্ষণগুলো তাঁর কবিতায় পরিস্ফুট করতে পারে, তবে সে আধুনিক কবি।তবে কেউ যদি আধুনিক সময়ে থেকে পুরনো রীতির অনুসরণ করে, তবে তাকে আধুনিক কবি বলা যাবে না। যেমন, নব্বইয়ের দশকের কবিরা আধুনিকতাকে ব্যক্তির উপলব্ধির মধ্যে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন, যেমনি প্রথম পেরেছিলেন তিরিশের আধুনিক কবিরা। নব্বইয়ের দশকের কবিরা তাদের কবিতায় গ্রহণ করেছিলেন সমগ্রতাকে। কোনো এক নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে তাদের ভাব-উপলব্ধি আবদ্ধ থাকেনি। সবকিছুকে ধারণ করেছিলেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে। কিন্তু প্রকাশ করেছিলেন নিজস্ব ভঙ্গিমায়। আর প্রত্যহ-জীবনের নানান উপলব্ধিকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশ করারই তাদের আধুনিকতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তবে প্রকাশ-রীতির মধ্যেই যে আধুনিকতার বিকাশ ঘটেছিল পরিপূর্ণরূপে তা নয়, বরং এর অন্তর্নিহিত ভাবও ছিল কবির একান্ত নিজস্ব বিষয়। উদাহরণ নব্বইয়ের কবি মজনু শাহ থেকে দেই:
“সৌন্দর্যবোধ মরে গেলে একেকটা ফুল রাক্ষুসে জ্যামিতির
বেশি নয়,
তখন অফুরন্ত পথ সাপের চামড়া দিয়ে মোড়া। কাটা মুণ্ডুগুলো
খেলার ঘুঁটি। চেনা ময়দান, একটা উল্টানো বই। কী বই এটা,
জগদ্বিখ্যাত সব গাড়লের? পাকা আতা ফল পড়ে আছে চতুর্দিকে,
তুমি চতুর লাফিয়ে পার হচ্ছ সেসব, আর সমস্ত পরিচিত মৃতেরা
দীর্ঘতম তোমার এই মার্বেল পাথরের বারান্দায় একে একে এসে বসছে
কারুকাজ করা চেয়ারে।
কোথায় আর যাবে তুমি এমন সূর্যহননের দিনে, এলাচ লবঙ্গ দারুচিনি
নিজ নিজ গন্ধ হারিয়ে হয়ে গেছে অন্যকিছু, এখন ছায়ার মাছ
ছায়ার বাঘ ফুটে উঠবে পথে।”
(সৌন্দর্যবোধ)
ব্যক্তি যে নিজের মধ্যেও স্বতন্ত্র, সেই পৃথক নিজস্ব ভাবনা ও সত্তার ভেতর সৌন্দর্যকে খুঁজে বেড়ানোই হলো আধুনিকতা। আর এই আধুনিকতায় দেবতা থেকে যেন ব্যক্তির গুরুত্ব অনেক বেশি। প্রাচীন কিংবা মধ্যযুগের সাহিত্যে সৌন্দর্যের উপলব্ধির স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ ঘটলেও চিত্রকল্পের ভেতর ব্যক্তির অনুভূতির প্রকাশ এতোটা জোরালো ছিল না যতটা আধুনিক কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে। বলতে গেলে, উপলব্ধিকে নিজস্ব ভঙ্গিমায় প্রকাশ বা চিত্রকল্পের অনুভূতিই আধুনিক কবিতাকে আলাদা করেছে প্রাচীন বা মধ্যযুগীয় সাহিত্যের সীমারেখা থেকে। মাহবুব কবির, চঞ্চল আশরাফ, টোকন ঠাকুর, হেনরি স্বপন, রহমান হেনরী,শোয়াইব জিবরান, কামরুজ্জামান কামু, শাহিন মমতাজ-সহ নব্বইয়ের দশকের এমন অনেক কবি রয়েছেন, যাদের কবিতায় আধুনিকতার লক্ষণ স্পষ্ট। শুধু নব্বইয়ের দশক কেন চল্লিশের দশকের কবিতা থেকে সাম্প্রতিক কবিতায় আধুনিকতা স্পষ্ট।
উত্তরাধুনিকতা আন্দোলনটির শুরু হয়েছিল আধুনিক আন্দোলনের মধ্যে উপস্থিত হিংস্রতা আর শক্রতার বিপরীতে একটি প্রতিক্রিয়ার আন্দোলন হিসেবে।
আধুনিকতাবাদ ও আধুনিকতার নিগ্রহ থেকে মুক্তির পথ হিসেবে উত্তরাধুনিকতাকে একটি সদর্থক বিকাশ ও একটি ডিসকোর্স হিসেবে দেখা শুরু হয়। নানাজনের কাছে উত্তরাধুনিকতা নানাভাবে আসে। কেউ আধুনিকের সঙ্গে এর ধারাবাহিকতা দেখেন, কেউ বা জোর দেন এদের মধ্যকার বিচ্ছেদ বা বিচ্যুতির ওপর। লিওতার তার “দ্যা পােস্টমডার্ন কন্ডিশন” প্রবন্ধে দেখান যে, একজন উত্তর-আধুনিক আধুনিকের ঐক্য ও সংহতির অন্বেষণকে বাতিল করে যে বিচ্ছিন্নতা-দীর্ণতা অন্বেষণের কথা বলেন তারও উদ্দেশ্য হচ্ছে সংযােগ-সংহতি আর অন্বেষণকেই খুঁজে পাওয়া। তিনি আরাে দেখান যে, উত্তর-আধুনিক এসব মায়া-কুহক কিংবা ঐন্দ্রজাল থেকে মুক্ত। এই উত্তরাধুনিকতা সাম্প্রতিক কবিতার উপর ব্যাপক ফেলেছে। উত্তর-আধুনিক কবিতা প্রায়শই এমনভাবে লেখা হয় যা বেশ মুক্ত আকারে এবং চেতনা শৈলীর একটি স্রোতের মাধ্যমে চিন্তা বা জৈব কথা বলার প্রক্রিয়াকে প্রতিফলিত করার জন্য বোঝানো হয়। এ ক্ষেত্রে লক্ষ করা যাক অমিত রেজা চৌধুরীর একটি কবিতা:
“রাষ্ট্রকে আমার রাজা কিং লিয়ার মনে হয়
যে মূলত সীসাচিহ্নিত মানুষজনকে পছন্দ করে
তারা একেকজন যেন গলিত অলর্ক, নরকে মগ্ন ঘুঙুর
আর আমরা মাসপিপল করডেলিয়ার পুনর্জন্ম বয়ে চলেছি”
(গণপ্রজাতন্ত্র)
কিংবা মারজুক রাসেলের একটি কবিতা দেখা যাক:
“ভাত খাওয়ার জন্যই আগুন, কাগজ, ব্লেড খাওয়ার খেলা।
‘ভাত, চলো ছোবল খাই,
পেটের নগদ নীল নামাই।’
‘ওই নীল সিঁড়ি দিয়া নামবে না,
ওই নীল লিফট ছাড়া নামবে না!’
‘তাইলে চলো আমরাই লাফ দিয়া নামি…’
ধপাস!”
(প্যারাডাইম শিফট)
উত্তর-আধুনিক কবিতা প্রায়ই অর্থহীনতা বা বাস্তবতার অভাবের থিম নিয়ে কাজ করে এবং প্রায়শই একটি অস্তিত্বগত দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শন করে। উত্তর-আধুনিক কবিতায় শব্দের বিন্যাস এবং পছন্দও জটিল বা বোঝা কঠিন হতে পারে।বাংলাদেশের কবিতায় মাসুদার রহমান,অমিত রেজা চৌধুরী, মারজুক রাসেল, ফিরোজ শাহ-সহ অনেকেই উত্তরাধুনিক কবিতাচর্চা চালিয়ে যাচ্ছে।
১৬. আপনার লেখালেখিতে দেশি-বিদেশি কবি/ সাহিত্যিকদের কারো কোন প্রভাব কি আছে?
মাসুদুল হক:প্রভাব বিষয়টি আমার কাছে ছোঁয়াচের মতো।যখন রিলকের কবিতা পড়েছি, তাঁর প্রভাব আমার উপর পড়েছে।র্যাঁবো ফরাসি কবিতায় এক উজ্জ্বল নাম। তাঁর ‘নরকে এক ঋতু’ পড়ে অভিভূত হয়ে পড়ি।আমার উপর তাঁর প্রভাব পড়তে থাকে। এভাবে যখন ঘটতে থাকে, নিজেকে সামলে নিতে থাকি। তাঁর পরেও আমি অনুভব করি দীর্ঘ পাঠের কারণে আমার উপর টি. এস. এটিয়টের প্রভাব রয়েছে।আমোস তুতুলার The Palm-Wine Drinkard উপন্যাসটি যখন পড়ি তারপর থেকে তাঁর সহজ সরল গদ্যের কাঠামো আমাকে আকৃষ্ট করে। আমি অনুপ্রাণিত হই এই ধারায় উপন্যাসের বয়ানে। কিন্তু আজও পাড়িনি তাঁর মতো করে।তবে আমি প্রভাবিত। বাংলা ভাষার গল্প ঔপন্যাসিকদের মধ্যে অমিয়ভূষণ মজুমদার, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ,দেবেশ রায়, অভিজিৎ সেন, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হাসান আজিজুল হক দ্বারা আমি বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন ভাবে প্রভাবিত।
১৭. কোথায় আছেন? কি করছেন? পারিবারিক পরিচিতি জানতে চাই।
মাসুদুল হক: বর্তমানে আমি দিনাজপুরে আছি।একটা সরকারি কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্বে।তবে দর্শন বিষয়ে অধ্যাপনাই আমার কাজ। আমার স্ত্রীও শিক্ষকতা করেন। আমাদের দুই সন্তান।বড় ছেলে বিবাহিত,ইংরেজিতে অনার্স মাস্টার্স করে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছে। ছোট মেয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় মাস্টার্স করছে।
১৮. আপনি কখনো কি কোন পত্রিকা বা লিটল ম্যাগাজিন অথবা সংকলন সম্পাদনা করেছেন? বিস্তারিত বলুন।
মাসুদুল হক:আমার সম্পাদিত প্রথম কাব্যসংকলন “কবিতা” সিরিজ।১৯৮৮ সালে প্রকাশিত হয়। প্রকাশ করেছিল “কুমুদ সাহিত্য সংসদ”, জিন্দাবাহার, ঢাকা। ঐ সংকলনে শামসুর রাহমান,আল মাহমুদ,হায়াৎ মামুদ, নির্মলেন্দু গুণ,হেলাল হাফিজ, মোহাম্মদ রফিক, রফিক আজাদ,আল মুজাহিদী, ব’নজীর আহমেদ,সাবদার সিদ্দিকী-সহ আরো অনেক কবির কবিতা ছিল। এরপর লিটিল ম্যাগের কনসেপ্টে চলে আসি।সমকালীন কবিদের কাব্যচিন্তা ও কবিতায় নিজস্ব পরীক্ষা-নিরীক্ষার দিকে আমার ঝোঁক তৈরি হয়।সে সময় ‘কারুজ’ পত্রিকার সম্পাদক শিমুল মাহমুদ,কামালউদ্দিন কবির,কফিল আহমেদ,যারা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সতীর্থ, তাদের সহচার্যে আমার কাব্যভাবনার পরিবর্তনের পাশাপাশি শিল্প-সাহিত্যে কমিটমেন্টের বিষয়টি প্রগাঢ় হয়ে ওঠে। সেইসঙ্গে হায়াৎ মামুদ, মোহাম্মদ রফিক ও সেলিম আল দীনের সান্নিধ্য আমার চেতনা নির্মাণে প্রত্যক্ষ -পরোক্ষ প্রভাব ফেলে।তার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯২ সালে সময় আমি ও কামালউদ্দিন কবির যৌথভাবে সম্পাদনা করি “এই সময় এই স্রোত” নামক দীর্ঘ কবিতা সংকলন।যা শিমুল মাহমুদের কারুজ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। যেখানে অসীম কুমার দাস,বিষ্ণু বিশ্বাস, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ, শিমুল মাহমুদ,কবীর রানা, হাসিবুল হক, মাসুদুল হকের কবিতা ছিল।
১৯৯৮ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত শ্রাবণ প্রকাশনীর রবিন আহসান, কবি ও তথ্যচিত্র নির্মাতা পারভেজ চৌধুরী ও আমি– এই তিনজনের সম্পাদনা ও তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত হয় লিটল ম্যাগাজিন ” শ্রাবণের আড্ডা”। যেখানে আমরা নব্বইয় ও শূন্য দশকের কবিদের কবিতা প্রকাশ করতাম।আর সিনিয়রদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করতাম।সেইসময় শামসুর রাহমান,সেলিনা হোসেন,আসাদ চৌধুরীর দীর্ঘ সাক্ষাৎকার ছেপেছি। সেই সঙ্গে শ্রবণের আড্ডায় নতুন ভাবনার প্রবন্ধ,গল্প ও গ্রন্থ সমালোচনা প্রকাশ করতাম। এ পত্রিকার সঙ্গে পরোক্ষভাবে মুজিব মেহদি,মজনু শাহ, মাহবুব কবির, প্রশান্ত মৃধা, রবিউল করিম আরো অনেকে জড়িত ছিল।
২০০২ এর দিকে দিনাজপুর চলে এলে “প্রিন্ট মেকার্স” নামে একটি লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনা করি মোহাম্মদ আমজাদ আলী,জ্যাকি ইসলাম ও আমি।ওটি চারটি সংখ্যার পর আর বের হয়নি। শাহজাহান শাহ, শাহ্ মুবিন জিন্নাহ, মোহাম্মদ আমজাদ আলী ও আমার সম্পাদনায় ১৯৯৬ সালে “কবিতা নয় কালপ্রপাত” সাহিত্য সংকলন এবং দিনাজপুরে দশ মাইলে শ্রমজীবী নারী ইয়াসমিন পুলিশ দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করলে একটা বড় আন্দোলন তৈরি হয়েছিল।সেই আন্দোলনের প্রেক্ষিতে শাহ্ মুবিন জিন্নাহ, মোহাম্মদ আমজাদ আলী এবং আমার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় একটি সংকলন “মৃত্যুত্তীর্ণ: ইয়াসমিন”।
১৯. লিটল ম্যাগাজিন এর সংজ্ঞা কি? এ নিয়ে আপনার ভাবনা বলুন।
মাসুদুল হক: লিটিল ম্যাগাজিন বলতে আমি বুঝি শিল্পসাহিত্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞান বিষয়ে চলমান ধারাকে চ্যালেঞ্জ করে ব্যতিক্রমধর্মী চিন্তাধারা ও মতামত ব্যক্ত করার মুদ্রিত একটি কাগজকে। এ ম্যাগাজিন অনেকটা অনিয়মিত এবং অবাণিজ্যিক। লিটল ম্যাগাজিন প্রতিনিধিত্ব করে একটি ছোট সমমনা নব্য গোষ্ঠীর; যার চিন্তা-ভাবনা-দর্শন চলমান ধারা থেকে ভিন্ন এবং অভূতপূর্ব। একটা সময় এটা হারিয়ে যায়।ষাটের দশক থেকে বাংলাদেশে লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ পেলেও আশি ও নব্বইয়ের দশক বাংলাদেশের জন্য উত্তুঙ্গ। প্রিন্ট মিডিয়ার ব্যাপক প্রসারে শূন্য দশকে এসে লিটল ম্যাগাজিন এর চারিত্র হারায়।এরপর তথ্যপ্রযুক্তির প্রসার ও অনলাইন ম্যাগাজিনের আগমনে আমি মনে করি লিটল ম্যাগাজিনের আর প্রয়োজন নেই।মুদ্রিত সাহিত্য পত্রিকা হলেই চলবে।আর নতুন কথা,নতুন চিন্তা,রাগ-অভিমান, পরীক্ষা- নিরীক্ষা চালাবে ওয়েব ম্যাগাজিন।
২০. অনলাইন ম্যাগাজিন বা ওয়েব ম্যাগাজিন চর্চাকে আপনি কোন দৃষ্টিতে দেখেন?
মাসুদুল হক: আমি বললাম তো নতুন কথা,নতুন চিন্তা,রাগ-অভিমান, পরীক্ষা- নিরীক্ষা চালাবে ওয়েব ম্যাগাজিন।এটা তো ছাপার অক্ষরে দেশের মধ্যে কয়েকজনের মধ্যে থাকবে না;ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র বিশ্বে।ভাষা যেমন যে কোনো অবস্থাতেই কমিউনিকেশন ঘটায়,ওয়েব ম্যাগাজিনও তাই। সমস্ত বিশ্বে ছড়িয়ে পড়া বাঙালির সাহিত্য-সংস্কৃতির যোগাযোগের মাধ্যম ওয়েব ম্যাগাজিন।
২১. “বাংলা রিভিউ” পড়েন? কেমন লাগে বা কেমন দেখতে চান–আগামীতে?
মাসুদুল হক: আমি এখন কয়েকটি ওয়েব ম্যাগ পড়ি,এর মধ্যে “বাংলা রিভিউ” অন্যতম। এরমধ্যে একটা নিরীক্ষা প্রবণতা রয়েছে। আড়ালে থাকা লেখকদের তুলে ধরতে চায়। নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও বিন্যাসের আয়োজন রয়েছে। প্রচল কাঠামোর বাইরে মত প্রকাশের একটি স্বাধীন দিগন্ত তৈরি করতে চায়। আমি দেখতে চাই বাংলা রিভিউ সম্পাদিত হবে আমেরিকা থেকে,যেখানে সমগ্র বিশ্বের বাঙালি কবি- সাহিত্যিকগণ লিখবেন, বাংলায় থেকে না থেকেও বিশ্ব বাঙালির চিন্তা ধারণ ও প্রকাশের মাধ্যম হবে ” বাংলা রিভিউ”।
২২. ভবিষ্যতে কেমন পৃথিবী কল্পনা করেন?
মাসুদুল হক: আমার মনে হয় জিনতাত্ত্বিক গবেষণায় প্রভুত সাফল্য আসবে।তখন মানুষের কোনো অসুখ-বিসুখ থাকবে না। মানুষ তখন কয়ক শ’ বছর বাঁচবে।সে বাঁচার জন্য মানুষের অনেক ফসল, খাদ্য লাগবে।এতো খাদ্য কীভাবে আসবে? আমার মনে হয় এশিয়া আর আফ্রিকায় মানুষ থাকবে না।থাকবে শুধু রোবট।ওরা পাশ্চাত্য বিশ্বে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকা মানুষদের জন্য ফসল ফলাবে। প্রাণিসম্পদ পালন করবে।আর ঐ সময় বেঁচে থাকা পাশ্চাত্যের মানুষগুলো পৃথিবীতেই স্বর্গে বাস করবে। সবাই খেলাধুলা-বিজ্ঞান-শিল্প-সাহিত্য চর্চা করবে।