spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যসাম্প্রতিক বাংলা কবিতা

ধারাবাহিক রচনা রচনাকাল : ডিসেম্বর ২০১৬ লিখেছেন : সাজ্জাদ বিপ্লব

সাম্প্রতিক বাংলা কবিতা



প্রাক কথন : এক
…..

সমগ্র বাংলাদেশের মতো বাংলাদেশের কবিতাও আজ অভিভাবকহীন, দিকভ্রান্ত। যে যেভাবে পারছে নিজেদের প্রচার-প্রপাগাণ্ডা চালাচ্ছে। নিজেকে জাহির করছে। এতে সত্য-মিথ্যার বালাই বা সোহাগ যেমন বা যতটুকু নেই, তেমনি নেই নিজেকে নির্লজ্জ ও উলঙ্গ উপস্থাপনের অসুস্থতা ছাড়া অন্য কিছু।

আমরা সংস্কার বশে বা রীতিনীতি শিখে বা দেখে এতোকাল জেনে এসেছি যে, নিজের কথা নিজে বলা লজ্জার ব্যাপার। বলতে নেই। আমি কি বা কেমন, সেটি অন্যে বলবে, এটি স্বাভাবিক এবং শোভনীয়। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, নিজেই নিজেকে সার্টিফাই করছে আমি, আমার কালের শ্রেষ্ঠ লেখক বা কবি। আর নির্লজ্জ্যের মতো তার বা তাদের কিছু তাবেদার বা অনুসারীও জুটে যাচ্ছে। যারা গলা মেলাচ্ছে, একই সুরে। একই তালে।

এটি কি ধ্বংস বা অধ:পতনের লক্ষণ?

আমার অনুমান এবং আশংকা মিথ্যে প্রমাণিত হলে সুখি হবো। হবো ঢের আনন্দিত এবং খুশি।

…..

প্রাক কথন : দুই
……

কারা ভালো লিখছে, এ সময়ে? অনেকেই। বিচ্ছিন্নভাবে এই চিত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে সর্বত্র। জোড়া দিলেই দাঁড়িয়ে যাবে, আশাব্যঞ্জক সোনালি চিত্র। রূপময়। বহু বর্ণে বিভাসিত।

একটি স্রোতোবাহী নদী যেমন সাবলীল ভঙ্গীমায় প্রবাহিত, তেমনি বাংলা কবিতা বা বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কবিতাও অগ্রসরমান।

শুধু বাংলাদেশে বসে নয়, সারা পৃথিবী জুড়েই ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য বাংলা ভাষাভাষী লিখে চলেছেন, বাংলা কবিতা। সমৃদ্ধ করে চলেছেন আমাদের কবিতার ভাণ্ডার।

মৃত বা জীবিত কবিদের মধ্যে বিশেষ করে, বাংলাদেশে,(যেহেতু আলোচনার মূল প্রতিপাদ্য বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কবি ও কবিতা, তাই এখানে ভারতভুক্ত পশ্চিম বঙ্গের কবিদের উল্লেখ থাকছে না।) কবিদের মধ্যে সর্বদা স্মরণে রাখছি : ফররুখ আহমদ, আহসান হাবীব, সৈয়দ আলী আহসান, আবুল হোসেন, সিকান্দার আবু জাফর, আশরাফ সিদ্দিকী, আতাউর রহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, সাইয়ীদ আতীকুল্লাহ, বোরহান উদ্দীন খান জাহাঙ্গীর, আবদুস সাত্তার, আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দীন, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, ফজল শাহাবুদ্দীন, সৈয়দ শামসুল হক, দিলওয়ার, আজীজুল হক, ওমর আলী, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, শামসুর রাহমান, আবু জাফর ওবায়দুলাহ, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী, আবদুল মান্নান সৈয়দ, রফিক আজাদ, রুবী রহমান, মোহাম্মদ রফিক, সিকদার আমিনুল হক, নির্মলেন্দু গুণ, আবুল হাসান, আফজাল চৌধুরী, আবু কায়সার, ফারুক সিদ্দিকী, কাজী রব, সুরাইয়া খানম, মুহম্মদ নূরুল হুদা, মোফাজ্জল করিম, মাহবুব তালুকদার, হায়াৎ সাইফ, ইমরান নূর, মহাদেব সাহা, মাহবুব সাদিক, আবিদ আজাদ, আবিদ আনোয়ার, শিহাব সরকার, আবু করিম, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, আলতাফ হোসেন, শামীম আজাদ, খোন্দকার আশরাফ হোসেন, সরকার মাসুদ, রিফাত চৌধুরী, মুকুল চৌধুরী, হাসান আলীম, এজাজ ইউসুফী, হাফিজ রশিদ খান, নাসিমা সুলতানা, সরকার আমিন, সায়ীদ আবুবকর,কামরুজ্জামান কামু প্রমুখ।

ফেসবুক একটি বিকল্প মিডিয়া। কোন লেখক কখন, কোথায়, কি, লিখছেন, ফেসবুকের স্ট্যাটাসের কল্যাণে তা দ্রুত পৌঁছে যাচ্ছে, বিশ্বময়। সঙ্গে-সঙ্গে জানা যাচ্ছে, পাঠ-প্রতিক্রিয়া। এ-ই বা কম কি! খারাপ কি!

এই লেখাটিও যদি ধরে নেই কোন একজন বা দুইজন বা ততোধিক লেখক-কবি’র স্ট্যাটাস এর পাঠ-প্রতিক্রিয়ার প্রতিক্রিয়ায় তৈরী। তাতেও লাভ ছাড়া ক্ষতির কোন কারণ আছে বলে আমার মনে হয় না।

অনেকদিন ধরে বাংলা কবিতার একজন সামান্য মনোযোগী পাঠক হিসেবে আমার অবজারভেশন বা অবলোকন-ও বলা যায় লেখাটি।

নিজের মনে যে চিন্তা বা কবিতাজগৎ কেন্দ্রিক যে ভাবনা বলয় তৈরী হয়েছে, তার যৎসামান্য বহি:প্রকাশ, এটি। অন্যেরা এ লেখা থেকে কতটুকু বা কীভাবে উপকৃত হবেন, বা কে, কীভাবে গ্রহণ করবেন, জানি না। তবে নিজের মনে যে প্রশান্তি আসবে, এটি-ই আমার জন্য, এই মুহূর্তে জরুরী।

আমি যেহেতু বাংলাদেশ থেকে শারীরিক ভাবে অনেক দূরে, দীর্ঘদিন থেকে ( প্রায় ১ দশক) বিচ্ছিন্ন, প্রবাস যাপন করছি। যুক্তিসংগত ও বাস্তব কারণেই আমার সাম্প্রতিক পঠন-পাঠনে ঊণতা থাকবে, এটি স্বাভাবিক, নিজে মেনে নিচ্ছি এবং আমার সম্মানিত পাঠক-বন্ধুদের বিনীতভাবে স্মরণে নিতে অনুরোধ করছি। এ ছাড়াও প্রবাসজীবনে নানাবিধ সমস্যা ও প্রতিকূলতা তো আছেই!

আমি গত কয়েক বছর যাবৎ ফেসবুক মারফৎ যত ফ্রেন্ড এড করেছি বা যাদেরকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠিয়েছি, এদের অধিকাংশ, কবি-সাহিত্যিক-সংস্কৃতিসেবী। নয়তো কোন না কোন ভাবে এ সবের সঙ্গে জড়িত।

নিজে যেহেতু যৎ সামান্য কবিতাচর্চা করি। তাই কবিদের কবিতাও পাঠ করার চেষ্টা করি, মন দিয়ে। এইআলোচনার অধিকাংশ আমার দেখা, না দেখা, অচেনা, চেনা সেইসকল ফেসবুক বন্ধুদের নিয়ে। সকলের জন্য।


…..
প্রাক কথন : তিন
……

এই লেখা যেহেতু ফেসবুক থেকে আহরিত, সংগৃহীত, ফেসবুক বন্ধুদের কবিতা নিয়ে। তাই এর ধারাবাহিকতা অনেক সময় বিঘ্নিত হবে, অর্থাৎ দশক বা বয়স অনুযায়ী সিনিয়রিটি-জুনিয়রিটি বজায় নাও থাকতে পারে, সেটিও সকলকে মেনে নেওয়ার অগ্রিম বিনীত অনুরোধ জানাই।

তরুণ-অতি তরুণ থেকে শুরু করতে চাই। মানে তরুণ বন্ধু বা বান্ধবী দিয়ে আরম্ভ করে ক্রমান্বয়ে যাবো বয়োজ্যেষ্ঠদের কবিতায়।

এবার আমার পর্যবেক্ষণ উল্লেখ করা যাক।

দশক ওয়ারী (অর্থাৎ কবিদের প্রচলিত উত্থান কাল বা পরিচিতি অথবা বিকাশ ও ব্যাপ্তির জন্য আমরা দশকের উল্লেখ করে থাকি) আলোচনায় বাংলাদেশের সক্রিয় কবিদের মধ্যে যারা ফেসবুকে সচল, এদের মধ্যে যারা আমার ফ্রেন্ড লিস্টে আছেন, এবং আমার পছন্দের কবিদের তালিকায় আছেন, আমার দৃষ্টিতে ভালো লিখছেন বা লেখেন, এরা হলেন (যতদূর মনে এলো, এর বাইরেও অনেকে আছেন, বা থাকতে পারেন, তাদের অনুল্লেখ, অনিচ্ছাকৃত ) : ফরহাদ মজহার, ওমর শামস, মুহম্মদ নূরুল হুদা, সাযযাদ কাদির, মাহবুব হাসান, মিনার মনসুর, মনজু রহমান, আবু হাসান শাহরিয়ার, সালেম সুলেরী, আবদুল হাই শিকদার, মঈন চৌধুরী, শামসেত তাবরেজী, কাজল শাহনেওয়াজ, মোশাররফ হোসেন খান, বুলবুল সরওয়ার, মজিদ মাহমুদ, মাসুদ খান, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ (প্রমিথিউস বাউন্ড), খসরু পারভেজ, তমিজ উদদীন লোদী, আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ, ফেরদৌস নাহার, ব্রাত্য রাইসু, ইশারফ হোসেন, মুহিবুর রহিম, মুহম্মদ আবদুল বাতেন, শান্তা মারিয়া, ফাতিমা তামান্না, শাকিল রিয়াজ, শোয়াইব জিবরান, মজনু শাহ, আহমেদ স্বপন মাহমুদ, কাজী জহিরুল ইসলাম, টোকন ঠাকুর, নয়ন আহমেদ, মাঈন উদ্দীন জাহেদ, শিমুল আজাদ, শাহেদ সাদ উল্লাহ, মুজিব ইরম, শিবলী মোকতাদীর, ফজলুল হক তুহিন, মিজানুর রহমান বেলাল, সাঈফ ইবনে রফিক, সালমান রাইয়ান, শাহীন খন্দকার, ভায়লা সালিনা লিজা, রওশন আরা মুক্তা, ইসমত শিল্পী, কালপুরুষ, ইমতিয়াজ মাহমুদ,রেজাউল করিম রনি, রিকেল, সাইয়েদ জামিল, রাসেল রায়হান, চঞ্চল মাহমুদ, জব্বার আল নাঈম, শামশাম তাজিল, শিমুল সালাহউদ্দীন, তানিম কবির, অনামিকা তাবাসসুম, হাবীবাহ নাসরীন প্রমুখ উল্লেখযোগ্য এবং সক্রিয়।

আমার বিবেচনায় এরাই সাম্প্রতিক বাংলা কবিতাকে বিভিন্ন স্রোতে ও ধারায় এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। 

…….

কালপুরুষ
..….

আলোচনা যেহেতু (এবং মূলত) ফেসবুক কেন্দ্রিক লেখক ও তার লেখা নিয়ে, সেহেতু, আমার দৃষ্টিতে সবার আগে আমি, কালপুরুষ, এর নাম উল্লেখ করতে চাই। কালপুরুষ -এর স্ট্যাটাস -এ আমি যেটুকু কবিতা পড়েছি, এ যাবৎ,  তা পাঠে আমার মনে হয়েছে, বাংলাদেশের এ সময়ের শক্তিমান তরুণদের মধ্যে সে অগ্রগণ্য উল্লেখিত একজন।

এখনকার তরুণদের অনেকেই  ভালো লেখেন। এবং লিখছেন। এটি গড়পড়তা উচ্চারণ নয়। পাঠোত্তর বিশ্বাস থেকেই আমার এ প্রতীতির জন্ম। 

তবে, ধারাবাহিক ভাবে যে ক’জন ভালো লিখছেন, তাদের মধ্যে সেরা হিসেবে আমি যার নাম উল্লেখ করেছি, সেই ‘কালপুরুষ’ এর বিচ্ছিন্ন কয়েকটি কবিতা আমার কথার সমর্থনে উল্লেখ করছি, এখানে (আপনারা তার সাম্প্রতিক প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ “রোহিণীর জন্য একটি রাষ্ট্র ” পড়ে দেখতে পারেন। অথবা ভিজিট করতে পারেন, তার টাইমলাইন। ):

১.
পৃথিবীর সমস্ত নিয়ে ইতিহাস লিখে যাবো
সেই উদ্দেশ্য ছিলো না
তবু “দর্শন” লিখলেই মাথা নত কোরে ভাবতে শুরু করে
সকল দার্শনিক
আমার মহত্ব

“ধর্ম” লিখলেই মাথা নত কোরে
আমাকে থামাবার প্রার্থনায় বসে কূপমণ্ডূক যাজক

মহাকালের সকল অতীত আমি রেখেছি লিখে
মহাকালের ভবিষ্যৎ লেখা পাণ্ডুলিপিটি ফেলেছি হারিয়ে

আবিষ্কার করতে না পেরে মাথা নত কোরে আছেন মহান বিজ্ঞানীরা

( আংশিক )

কালপুরুষ ।। কালপুরুষ



২.
শান্তির অর্থ হলো

যার বন্দুক আছে
যার নেই
তার মাথায় আপেল রেখে স্থির দাঁড় করিয়ে প্র্যাকটিস করানো
(কারণ যুদ্ধ আসণ্ণ এটা যেন কেউ ভুলে না যায়)
কারা মরবে কারা মারবে
কারা ফসলের জমিগুলো দখল কোরে ঘাসের চারা রোপন করবে
কারা মার্ক্স কারা ফ্রয়েড
কারা রক্ত দিয়ে রাজকুয়ো ভর্তি কোরবে
কারা সেই জল বেঁচে জীবিকা নির্বাহ কোরবে
কারা ধর্ষণ শেষে মেয়েকে ধর্ম শিক্ষা দিতে নিয়ে যাবে লুকিয়ে
কারা একটি রুটিকে তিন ভাগ কোরে চারজন শরণার্থীকে খেতে দিয়ে
জাতিসংঘে ভাষণ দিতে যাবার প্রস্তাবে ঘোড়াকে গাধা ভেবে পেটে চড়ে বসে পরস্ত্রী’র স্নানের জলের দিকে লক্ষ্য রেখে নাউজুবিল্লাহসহ
নবনির্মিত গীর্জার দিকে তাকিয়ে স্বস্তি পাবে
কারা নো ম্যানস ল্যাণ্ডে হাওয়ার চাষ কোরবে
কারা সংবিধান রচনা কোরতে গিয়ে মানচিত্রের উপর হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়বে
কারা সরকারী পুলিশ কারা বেসরকারী খুনি
কারা জমি মাপতে গিয়ে ভাঙা কবরে পড়ে মরে যাবে
কারা শুলে চড়ার অভিনয়ে দক্ষ জোকারটিকে ইহুদীর মাংশ খেতে দেবে
কারা চিতা কারা কবর
কারা বিবিসি কারা খবর
কারা ব্রোথেলের মাইকে স্বাধীনতা-ঘোষণা পাঠ শেষে পুনরায় শুরু কোরবে
কারা মাঠে কারা হাসপাতালে
কারা গুলিতে কারা ফাঁসিতে
কারা সন্ধ্যায় কারা সূর্যাস্তে
কারা পুঁজিবাদ কারা ধীরে কারা আস্তে
কারা অস্ত্র কারা ক্রেতা
কারা আপেলটিকে সঠিক মাথাটিতে বসাবার দায়িত্ব পালন করবে

ক্রমানুসারে লিখে লাল চিহ্ন দিয়ে রাখা

রাজনীতি ।। কালপুরুষ


৩.
আমার সেদিনের কথা স্পষ্ট মনে আছে
গোধূলির ডান পাশে আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম
সিগারেটগুলো একটু একটু কোরে খেয়ে নিচ্ছিলো আমাকে

স্পষ্ট মনে আছে আমার সেদিনের কথা
ভায়োলিনের হাত ধরে এসেছিল সে
সূর্যাস্তের দক্ষিণ পাশে বসেছিল সে

সেদিনের কথা স্পষ্ট মনে আছে আমার
ভালোবাসার কথা আমি তাকে বলিনি
সেও আমাকে বলেনি আমার জন্য দুঃখ তার

আমরা তবু দু’জনের দিকে চেয়ে
আমরা তবু দু’জনের দিকে চেয়ে
ধীরে, পৃথিবীর দিকে চলে গিয়েছিলাম

ধীরে, পৃথিবীর দিকে ।। কালপুরুষ



…..

সালমান রাইয়ান
……

ঝকঝকে স্মার্ট কবিতা লেখেন, কবি সালমান রাইয়ান। কোন দৈনিক পত্রিকার পাতায় তার কোন কবিতা কোনদিন পড়েছি, বলে মনে পড়ে না। সম্ভবত লিটলম্যাগাজিনে লিখেই (ইদানীং ফেসবুকে) এই কবি তৃপ্ত। কোন ঢাকঢোল নেই, কোন প্রচার-প্রপাগাণ্ডা তো নয়-ই। নীরবে, নিভৃতে বাংলা কবিতার শস্য ভাঁড়ার সমৃদ্ধ করে যাচ্ছেন, সালমান রাইয়ান। কিন্তু বোকা ছেলে, বোঝে না, এ যুগ দাবী আদায়ের যুগ। আধিকার প্রতিষ্ঠিত করা অথবা প্রাপ্যতা ছিনিয়ে নেয়ার যুগ। হে কবি, হে সন্ত, তোমার আশেপাশে তাকাও না কেন? দেখো না, কত মিডিয়াবাজ, প্রচারপটু কবি সম্প্রদায় কি করে আদায় করে নিচ্ছে, তাদের প্রাপ্যের অধিক।
তুমি কি জানো না, সে কালেও কবি জীবনানন্দ দাশের পক্ষে কলম ধরতে হয়েছিলো একজন বুদ্ধদেব বসুকে। একালে, জেনে রাখো, হে তরুণ, হে মেধাবী, প্রচারণা এবং ইতিহাস নিজেকেই তৈরী করতে হয়। চুপচাপ থাকার কাল, এটি নয় (কোনকাল-ই কি ছিলো?)। ইতিহাস এবং অতীত বলে, যুদ্ধ করেই টিকতে হয়। বিজয়ীদের গলাতেই পরে বরমাল্য। পরাজিতের গলায় ফাঁস। আমরা তোমার গলায় বিজয়মাল্য পড়াতে চাই। তোমাকে অভিবাদন, হে কবি…

একদম সাম্প্রতিক লেখা সালমান রাইয়ান এর কয়েকটি কবিতা:

১.
ওখানে মাটি ছিল না কিন্তু তোমার নামের বীজ হাজারবার বপন করেছে  সে
কিন্তু কখনই তা ঠোট অতিক্রম করেনি।

তার চিন্তার রেখায় কতশত বার তোমাকে বিন্দু বিন্দু করে ভেঙে দেখেছে
অথচ একবারও স্পর্শ করেনি ।  

তোমার ছোট্ট নদের উজানে তার কত না রঙ্গিন মাছ সাতার কেটে গেছে 
অথচ ঘুণাক্ষরেও টের পাওনি ।

এটাই পৃথিবী যেখানে বাস্তবতাই পৃথিবীর একটিমাত্র আয়না 
এমনকি তুমিও জানো না কি তার অস্তিত্ব !

২.

স্মৃতির ঘ্রান

হঠাৎ এই ঘ্রানটার সাথে ধাক্কা খেলে
জমাট অন্তরটা একটু একটু করে বাতাস হয়ে গেল, অথচ
ডানে না ছিল কোন ফুলের প্রস্ফুটন
বামে না ছিল বসন্ত
আহ কি স্নিগ্ধের অর্হন, প্রশান্তি গিলে খাওয়া চর্তুরপাশ     
যেন জোছনায় কাঁঠালচাপা গাছটি ফুলবতী হচ্ছে সত্যের তৃষ্ণায়
যে দূর গায় গান  
ঘুম ঘুম কানে ভাসে তারই ম্লান। 

তারপর আত্মার ফিসফিস শুনলে
বলছে-
নিশ্চয়ই একজন যে তোমার দুঃখ জানে
হেঁটে যাচ্ছে স্মৃতির রাস্তা ধরে।

৩.
এই মাত্র খনিজ ভালবাসার গোপন খনি থেকে
উঠে এসেছে এক শ্রমিক
বলেছে
সেখানে নাকি মানবিক বোমা পোতা আছে   
বিস্ফোরিত হবার অপেক্ষায়
যে নিথর নগরী চোখ খুলবে
বিকট শব্দে
তার শরীর ছেপে বনভূমির মতো জেগে উঠতে পারে সবুজ কুমার।
তাই শুনে মধ্য রাতের এক জোড়া তরুন তরুণী
বন্ধ করে দিয়েছে খুঁজতে থাকা
বিছানার দানব। 
যখন জেনে যায় ওটা তাদের ভেতরেই আরোগ্য নিচ্ছে। 
অথবা তৈরি হচ্ছে।

..…


এই কবি’র কোন গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে, কি-না, আমার অজানা। অচিরেই তার গ্রন্থ প্রকাশ জরুরী।

….…



খসরু পারভেজ
……

নব্বই দশকের ঠিক কোন সময়টা, তা ঠিক মনে নেই। কিন্তু এ কথা মনে আছে যে, কোন এক রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিনে একটি প্যাকেট পেয়েছিলাম, সাগরদাঁড়ি, যশোর থেকে বগুড়ায়। এক বাক্স যেন আনন্দের জোয়ার।

কবি খসরু পারভেজ-এর একগুচ্ছ কবিতার বই। তার মধ্যে একটি ছিলো : “ধর্ষণ মঙ্গল কাব্য”। নামেই বোঝা যাচ্ছে, প্রতিবাদ। সে সময়ে তার ঐ বইগুলি পড়ে আমি বুঝেছিলাম, এই কবি, শক্তিমান। পরে তার সঙ্গে আমার সখ্যতা ও চাক্ষুস আলাপ এবং ঘনিষ্ঠতা। যা আজো বিদ্যমান।

তিনি আমার পত্রিকা, “স্বল্পদৈর্ঘ্য”তে নিয়মিত লিখে আমাদের উৎসাহ যুগিয়েছেন। আমাদের সমৃদ্ধ করেছেন। এ সুযোগে বলে নেয়া যায়, সাগরদাঁড়িতে তার বাসায় আমার এক রাতের আতিত্থ্য এবং আড্ডা আমার এই ছোট্ট জীবনে, অনন্য সংযোজন বলে আমি মনে করি। তার মাইকেল চর্চার কথা আজ সুবিদিত। তিনি কিছুকাল পূর্বে এর স্বীকৃতি স্বরূপ পুরস্কৃত হয়েছেন। তাকে এ জন্য অভিনন্দন জানাই।

তিনি একাধারে একজন, কবি-গবেষক-সংগঠক। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে তার কবি সত্তা আমার কাছে মূল্যবান। আমরা, বিশেষ করে আমি, চাইবো তিনি যেন, কাব্যচর্চায় আরো বেশি সময় দেন।

আমার প্রিয় ও পছন্দের তালিকায় কেন কবি খসরু পারভেজ আছেন, আসুন, একটু পরখ করে দেখি।

তার অতি সম্প্রতি লেখা কয়েকটি কবিতা তুলে দিচ্ছি:


ক।
ভালো কবিতা কালো কবিতা
————————
যখন একটি ভালো কবিতা পড়ি
                                               তখন আমার খুব কষ্ট হয়
কেননা সারাটা জীবন ধরে
                 একটি ভালো কবিতা আমি লিখতে পারিনি
বিষণ্ণতার ঘোর আমাকে ডুবিয়ে রাখে সারাবেলা-সারারাত
অথচ একটি ভালো কবিতা পড়ার পর
                                   মন ভালো থাকবার কথা ছিল

পৃথিবীর পথে পথে দুরন্ত ফেরিওয়ালার মত খুঁজে ফিরি তাকে
ডেকে ডেকে ফিরে আসি পয়সাবিহীন -পসরাবিহীন
কোথায় লুকিয়ে থাকে সে কোন গ্রহলোক-বিপুল ব্রহ্মাণ্ডে
কোনো গৃহিণীর পাতিহাঁস হারানোর মত উৎকণ্ঠা নিয়ে
আমি শূন্য হাতে ফিরে আসি ঝরাপাতার বনে

যখন একটি ভালো কবিতা পড়ি
                                          তখন আমার খুব কান্না পায়
একটি ভালো কবিতা আমি তুলে দিতে পারিনি মাধবীর হাতে
একটি ভালো কবিতা আমি রেখে যেতে পারিনি
                                                আমার সন্তানদের জন্য
অনিবার্য মিছিলের জন্য
অগ্নিঝরা রাজপথের জন্য আমার কোনো কবিতা নেই
মানুষের জন্য প্রকৃতপক্ষে আমি কোনো কবিতা লিখতে পারিনি
একটি ভালো কবিতা না লিখতে পারার এই অক্ষমতাকে
                                         কেউ কখনো ক্ষমা করবে কি

একটি ভালো লিখবো বলে
প্রতিদিন আমি লিখে ফেলি অসংখ্য কালো কবিতা
অক্ষম পঙক্তিমালায় ভরে রাখি আমার ভোরের খাতা
আমি ব্যর্থতার কলমে কিছু মন্দ কবিতা লিখে ফেলি

আমার কালো কবিতাগুলো পড়ে ওরা হাততালি দেয়
আমার মন্দ কবিতাগুলো পড়ে ওরা খুশিতে নাচতে থাকে
তাহলে ভালো এবং মন্দের ভেতর
                               আজ আর কোনো পার্থক্যই নেই !
——————————————————————
খসরু পারভেজ  # ২২অক্টোবর ২০১৬, দুপুর ; যশোর


খ।
সোনামেয়েপাখিমেয়ে
———————————————-
[ আমার আত্মজা ফারিহা শিরিণ প্রমার জন্মদিনে ]

১.
তুমি আসবে আমি জানতাম সোনামেয়ে
হেমন্তের শিশিরের ভেঁজা টিপ পরে পৃথিবীর পথে
তুমি আসবেই আমি জানতাম প্রিয়মেয়ে  ।

২.
আলোর ওড়না জড়িয়ে এসেছিলে তুমি
কী অমোঘ আনন্দে ভরে উঠেছিল আমার উঠোন
বিষাদ-নগরে আমি ছড়িয়ে দিয়েছিলাম মুঠোমুঠো খুশি
আমার আকাশে তখন অজস্র আলোর বেলুন
ঈশ্বরের দরজায় আমি ছুঁড়ে দিয়েছিলাম আমার  অহঙ্কার
ফুলঝুরি শরতের তুমুল জ্যোৎস্না বুকে নিয়ে এসেছিলে  তুমি ।

৩.
আমার জীবনে কখনো মেঘলাদুপুর ঘনবৃষ্টি
যে বৃষ্টিতে তুমিও ভিজে গেছো বারবার
ধুলোর শহরে সবুজের ঘ্রাণ খুঁজি – এমনই  অপদার্থ আমি
ভুলকে ফুলের মতো বুকে জড়িয়ে নিই – এমনই প্রেমান্ধ আমি !

৪.
অনেক দুঃখের দিন হেসে ওঠে রৌদ্রগৃহে
ভোরের খাতায় প্রিয় কবিতাগুচ্ছের মতো
                              সুখের শিশিরে ধোয়া ঘাসফুল তুমি
তোমাকে দিলাম জীবনের সব শুদ্ধসংগীত
অজস্র আনন্দ-এস্রাজ ভালোবাসা-প্রিয়গান   ।

৫.
ভালো  থেকো  সোনামেয়ে
ভালো  থেকো  প্রিয়মেয়ে   ।

—————————————————————-
প্রমার জন্মদিন,২০ অক্টোবর ২০১৬, যশোর

গ।
আজ আমার একমাত্র পুত্র খন্দকার ফারহান ফয়সাল দীপ্ত’র জন্মদিন । তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে আমার উপহার  :

ভালোবাসা পর্ব
————————–
[ আমার আত্মজ দীপ্তকে ]

১.
অর্ধেক জীবন দিয়েছি সর্বনাশের হাতে
বাকিটা তোমার জন্য তুলে রাখি
                                                    পরাণ-পকেটে
এক জীবনে কত বজ্রপাত
এক জীবনে কত বৃষ্টিঝড়
বৃষ্টিভেঁজা জীবনের কান্নাঝরা দিন আমার জন্য থাক

তোমাকে দিলাম
ভালোবাসার রৌদ্র ভরা অসীম আকাশ
তোমাকে দিলাম
নবান্নের গন্ধ ঝরা  পদ্যগ্রাম  ।

২.
পথে পথে ছড়ানো কষ্টের কাঁকর
জানি রক্ত ঝরবেই
শ্বাপদ অরণ্য পেছনে ফেলে তোমাকে পৌঁছাতেই হবে
পথের ধুলোর মত কষ্টগুলো ছুঁড়ে ফেলে
আলোর মশাল হাতে
তোমাকে পৌঁছাতেই হবে মানুষের মহাস্থান গড়ে 

জীবন মানেই তো মৃত্যুর আরেক নাম
তবুয়ো মৃত্যুকে পিছনে ফেলে
তোমাকে পৌঁছাতেই হবে জীবনের আরশি নগরে ।

৩.
তরতাজা দুঃখগুলোকে ছুঁড়ে ফেলে দেব আজ
চুমুতে চুমুতে ভরে দেব তোমার চিবুক
আজ আমার হেমন্ত উৎসব
আজ আমার আলোর উৎসব  ।

৪.
ভাটার আগুনের মত
গনগনে দুঃখগুলো নিভে যাবে একদিন

ভালো থেকো প্রিয় !
—————————————————–
২৪ অক্টোবর২০১৬, সাগরদাঁড়ী ,যশোর।

…..

কবিতা যে জীবনের কথা বলে অথবা জীবন-ই  যে কবিতায় কথা বলে, কবি খসরু পারভেজের কবিতা আমাদের বারবার সে কথা মনে করিয়ে দেয়।

শক্তিমান এই উজ্জ্বল কবিকে সহস্র সালাম।



…….

রওশন আরা মুক্তা
……

আত্ম অহঙ্কার বা গর্ব প্রকাশের জন্য নয়, সাহিত্যে সিরিয়াসনেস বোঝানোর জন্য উল্লেখ করা যেতে পারে যে, আমি প্রায় ১ দশক পূর্বে (২০০৮) যখন দেশ ছাড়ি, তখন যাদের নাম শুনিনি বা যাদের লেখা কবিতা পড়িনি (আমার সীমাবদ্ধতা স্বীকার করেই বলছি) অবশ্য তখন এমন ইন্টারনেট বা ফেসবুক ছিলো না, কিন্তু আমার পড়া ও সংগ্রহের আগ্রহ ছিলো প্রচুর ( এখনো আছে। এখনো পড়ি, প্রতিদিন, নিয়মিত, লিখিও)। তখন যাদের হয়তো কেবল বিকাশ ঘটছে, লিটলম্যাগাজিন বা দৈনিক পত্রিকা কেন্দ্রিক, সেইসব অতিতরুণ বা তরুণ লেখকদের, তাদের লেখা বা কবিতার সঙ্গে এখন পরিচয় ঘটে যাচ্ছে, দ্রুত, ফেসবুকের কারণে। এমনকি যাদের লেখার সঙ্গে পরিচয় ছিলো, বই পাঠের বা পত্রিকা পাঠের মাধ্যমে, তাদের সঙ্গে আজ সাইবার যোগাযোগ, বা মতবিনিময় হচ্ছে, মুহুর্তে। প্রযুক্তির নানা নেগেটিভ সাইড ইফেক্ট থাকার পরও এ পজিটিভ এচিভমেন্ট কে অস্বীকার করা যায় না।

মানুষের জীবন-যাপন যেমন পরিবর্তিত হয়েছে, পাল্টেছে। তেমনি পাল্টেছে, তাদের প্রকাশভঙ্গী ও আচার-আচরণ। চিন্তাভাবনা, অনেককিছু। এই পরিবর্তন মানে প্রগতি। এগিয়ে যাওয়া। আমরা চাই বা না চাই, ভালো-মন্দ দু’টো মিলিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। আমাদের আশেপাশে অবক্ষয়, হতাশা, কালো কুচক্রের পাশেই দাঁড়িয়ে থাকছে, আবছা আলো, সময়ের অপেক্ষায়। সুযোগ এলেই বেরিয়ে পড়বে আলোর বন্যা। বহুকুল ছাপিয়ে।

প্রতিদিনের ঘটে যাওয়া কত ঘটনা, কত সাধারণ বিষয় ও কথাবার্তা, কবিতায় আসতে পারে তা দেখা যায়, কবি রওশন আরা মুক্তার কবিতায় :

১.
সিএনজি চালকের সাথে

পড়ালেখাটা করলে আমি অফিসার হইতাম
উচা-লম্বা আছি, আমার তো চেহারা ভালা

এমন সময় নামলো আকাশ থেকে বিষ্টিবাদলা
পর্দা টানাতে টানাতে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করি
কেন করলেন না তাহলে পড়ালেখা?

কী করতাম ভাই, অভাব ছিল চরম
শুনে আমি চুপ হয়ে যাই
গায়ে বিষ্টিবাদলা লাগাই
কিছুক্ষণ পর আস্তে করে
দিয়াশলাই আছে কীনা শুধাই

২.
কুড়াপক্ষী

প্রিয়ম সেদিন কুড়া পাখির গল্প বলেছিল
মেঘলা আকাশের নীচে
যেতে যেতে
কুড়া পাখির অভিমানের কথা, প্রিয়ম বলছিল
এ পাখির অযত্ন হলে, পাখি
নিজেই খুলে নেয় নিজের পালক
ঠোঁট দিয়ে
নখ দিয়ে
আঁচড়ে-খামচে
পাখি তুলে তুলে ফ্যালে মায়ার পালক

এরপর সে মরে যায়
কুড়াপক্ষি শুধু বাঁচে ভালোবাসায়
তাই সে মরে যায়
নিথর দেহ পড়ে থাকে খাঁচায়
কুড়া পাখি মারা যায়

এ গল্প শুনে আমার রিদয় স্টপ করেছিল
কয়েকটা বিট। এমন মায়ার কুড়াপাখি
এসেছিল কেন তবে দুনিয়ায়
অভিমানে কেন সে মরে যায়
এ পৃথিবী জানে না ভালোবাসতে
লোভের দুনিয়ায় কেন এসেছিলি কুড়া পাখি
মরে যেতে আর কাঁদতে?

৩.
মেঘনা

ঠিক যেন সেই রাত ফিরে এল আবার
অন্ধকার কিন্তু ঠিক যেন আঁধার না
গায়ে কাঁপন কিন্তু ঠিক যেন শীত না
আমারই ভিতরে আরেক আমি

আমার আরেক আমি’র ভিতরে আমি
অন্ধকারে ভেসে আছি, বলতে চাচ্ছি না

নানা রস আর লাভায় মুখোশ খুলে পড়ছে সূর্যের
পৃথিবী যখন অন্ধকারে ডুবে থাকবে
স্যাঁতস্যাঁতে সেই অন্ধকারে মা বলার আগেই
দেখতে পাবো আবার সেই আলো
যেন কতকাল পরে ফিরে এলাম কালো গুহা ছেড়ে

পৃথিবী এত কালো এত কালো যে
সুর্য অবসর গ্রহণ করার আগেই সে ফিরে আসবে আমারই কাছে

আমি পৃথিবীর কাছে যাব না।

এবার আবার আমি,
আমি ভেসে যাচ্ছি বানের পানিতে
সাথে আমার অন্য আমি

তার ভিতরে আমি অন্য এক আমি
ভেসে যাচ্ছি ঠাণ্ডা সাদা সাদা সব পানিতে
আমি সাঁতরে চলি, আরেক অন্য আমি ধরে আছি অন্য আমিকে

পানিতে ডুবে গেছে সকল কাঁটাতারের বেড়া
কাপড়গুলো গুছাতে হবে এই ভেবে ঘর খুঁজছি
বানের পানিতে ভেসে ভেসে আমরা দুই অন্য আমি সাঁতরে চলছি

যেন আর কিছুদূর এগোলেই পেয়ে যাব ঘর
আর কিছু অগোছালো কাপড়

তীব্র শুদ্ধতা বলতে কিছু নেই
প্রকৃত মাতৃত্ব বলেও না
এর বাইরে যেতে পারে নি যেসব মেঘ
তাদের নাম হয়ে উঠছে মেঘনা

দিন যাচ্ছে আর মেঘনা চাপা পড়ে যাচ্ছে কিছু কংক্রিটে
ইচ্ছামতো প্রকৃতির নিয়মের বাইরে গিয়ে নদী শাসন হয় পৃথিবীতে
তাই তার গতিপথ কোথায় হওয়ার কথা ছিল তা কেউ জানে না

২৯/১০/১৪
…..

এই কবির সাম্প্রতিক প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ এলদোরাদো। আপনারা পড়ে দেখতে পারেন।


……

শাহেদ সাদ উল্লাহ
…..

মাঝে-মাঝে চট্টগ্রাম থেকে বা ঢাকা থেকে অথবা অন্য কোন জেলা থেকে প্রকাশিত স্বল্পপ্রচারিত কোন লিটলম্যাগাজিন বা সাহিত্যপত্রিকায় হঠাৎ দেখা যেতো তার কবিতা। তখনও তার কবিতা এতোটা মনোযোগ দাবী করেনি। এরপর আর কোন খোঁজ নেই। লাপাত্তা। মানে, আমাদের পরিচিত সাহিত্য পরিমণ্ডলে তার অনেকদিন যাবৎ দেখা নেই।

এরপর কর্ণফুলীতে অনেক পানি গড়িয়েছে, শুকনা এবং মরা করতোয়াও থাকেনি স্থির। ধুঁকে-ধুঁকে তার মতো সে অব্যাহত রেখেছে তার পথ চলা। আমিও পাড়ি দিলাম আটলান্টিক ওশান, আটে (২০০৮)।

সকলের মতো আমারো নতুন জীবন, নতুন পরিবেশ। কিন্তু মারা যায়নি সাহিত্য চিন্তা ও সাহিত্যিক সত্তা। দেখা মিললো একে-একে অনেকের। অনেক পরিচিত মুখ হল ঝাপসা। অনেক অপরিচিত হল আপন ও অন্তরঙ্গ। যোগাযোগ পুণস্থাপিত হল, অবশ্যই, প্রযুক্তির কল্যাণে। দূরত্ব আর দূরে রাখতে পারলো না আমাদের।

ফেসবুকের সুবাদে আবার পড়ার সুযোগ ঘটলো, নিউইয়র্ক এর হট্টগোলের বাইরে থাকা আমাদের সমকালীন কবিবন্ধু শাহেদ সাদ উল্লাহ্‌’র কবিতা।

আগের কবিতার চেয়ে অনেক অগ্রসর তার এখনকার কবিতা। যদি অগ্রসর এবং নতুনত্ব না থাকতো, তাহলে, আমারো হয়তো প্রয়োজন পরতো না, তার কবিতা নিয়ে কথা বলার। তার কথা উচ্চারণ করার।

ইদানীং তার লেখা কবিতায় তিনি আমাদের কেমন এবং কীভাবে আশান্বিত করছেন, আসুন, এক ঝলক দেখে নেয়া যাক, তার কয়েকটি কবিতা:



১.
কোনো এক জাহাজের গল্প # শাহেদ সাদউল্লাহ

এই ঘোর সন্ধ্যায় নিস্তব্ধতায় বুদ হয়ে আছে পরিত্যক্ত একটি জাহাজ;
মাটির ভেতরে ডুবে গেছে তার নোঙর।
সূর্যের ছায়া এসে পড়েছে তার ডেকে।
সে ছায়া যেন পলাতক ছায়া।
রাত এলে চলে যায়।

কোথায় সে ছায়া যায়?
সমুদ্র হয়তো জানে। তবুও সে বলেনি কোনো দিন।

নির্লিপ্ত আকাশের নিচে মাঝে-মাঝে অলস দুপুর ন্যুজ হয়ে  আলতু ছুঁয়ে দিয়ে জাহাজের জানালাগুলো–সেও ফিরে আসে।

জাহাজ জানে ফিরে আসা মানে, কোনো দিন ফিরে না-যাওয়া।
জাহাজের মন ভারি হয়ে ওঠে মানুষের মতো।
মানুষের মতো তার চোখে ভেসে ওঠে অতীত। চকখড়ি দিয়ে লেখা কোনো নাম।

কিন্তু প্রশ্ন, কেন সে এখানে, এই নির্জন,
জনমানবহীন পারে?
সমুদ্র হয়ত জানে, বলেনি কোনো দিন।

এভাবে না-বলা-কথা রয়ে যায় কোথাও,
কারো হৃদয়ের গভীরে।
আমি শুধু দেখি, জাহাজের জং-ধরা-জানলায় মাঝে-মাঝে
কিছু বৃষ্টির ফোঁটা গড়িয়ে পড়ে
সমুদ্রে চলে যায়।

২.

পৃথিবী # শাহেদ সাদ উল্লাহ

লাফাতে-লাফাতে পৃথিবী এসে পড়ছিল আমার উঠোনে।
একটি টোকাই কুড়িয়ে নিয়ে গেল তার বস্তিতে।
মানুষ অপেক্ষায় ছিল একটি সোনালি ডিমের।
কিন্তু বস্তির মানুষগুলো অবাক হয়ে বলল, এই তবে পৃথিবী!
তারা দেখতে পেল পৃথিবীজুড়ে অসংখ্য রেখা–বিভক্তিরেখা।
আফ্রিকা থেকে এশিয়া, এশিয়া থেকে ইউরোপ…

সবাই ঊর্ধ্বমুখি হয়ে তাকাল আকাশের দিকে।
স্পষ্ট দেখতে পেল সেখানে কোনো রেখা টানা নেই।
একটি দোয়েল পাখি উড়ে-উড়ে যাচ্ছিল আমেরিকার দিকে।

সবাই দোষারোপ করলো ছেলেটিকে।
ছেলেটি পরদিন লজ্জায় রেখে এলো পৃথিবীকে সেই উঠোনেই।

এখন তারা পৃথিবীবিহীন।
কিন্তু তাদের আদৌ কোনো পৃথিবী ছিল ? 
তবুও ত্রস্ত বেড়ালের মতো বস্তিতে সে রাতে কেউ ঘুমাতে পারল না ,
শুধু মেয়ে মানুষ খিল-খিল করে হেসেছিল।
তারা দেখেছিল তাদের বস্তিটি দক্ষিণ এশিয়ানামক বিভক্তিরেখার ভেতরেই !
কেউ ঘুমাতে পারে না ঘোড়ার শব্দে!
ছেলেটি পন করেছে,
সে আর কখনো পৃথিবী কুড়িয়ে নেবে না।

৩.
স্মৃতি # শাহেদ সাদ উল্লাহ

বরফে ঢাকা এই শহরটির একটি স্কেচ এঁকে
চলে যাব অন্য কোথাও।
একটি স্মৃতি নিয়ে যাব সাথে।
আমার ঘরের দরজায় ঝুলে থাকা তালাটির মতো  নিস্তব্ধতা এক কোণে এসে কাঁদবে বৃষ্টি ঝরার মতো।

কেউ দেখবে? হয়ত না।
তবুও সন্ধ্যাগুলো উড়ে গিয়ে ঢেকে দেবে পায়ের ছাপ।

এইতো জীবন!
জীবন মানে একটি স্মৃতি।
স্মৃতি মানে একটি স্কেচ, তার ভেতরে অনেকগুলো রেখা।

ওই যে দূরে পাগুলো  দেখছেন,
ওগুলো  অনেক দূরে যেতে চায়নি।
জলের ভেতরে ডুবে-যাওয়া সূর্যের মতো
ওগুলো ডুবে গিয়েছিল। তারপর
সাঁতরাতে-সাঁতরাতে চলে গেছে অন্য পারে।
ছাই-ওড়া-সন্ধ্যাগুলো তাই বার-বার এসে পাগুলোকে ঢেকে দেয়।

এই শহরে
দুটি পা আর তার স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছে রাত!
এমন বিষণ্ণতায় ডুবে আছে রাত!
কেউ কি জানে? হয়তো না।

……
এমন চমৎকার-চমৎকার কবিতা যার হাতে খেলা করে, তার কি উচিত নয় শুধুমাত্র কবিতাকে ভালোবাসা?

…..

তসলিমা নাসরিন
……

তসলিমা নাসরিন, যদিও আমার ফ্রেন্ড লিস্টে নাই কিন্তু আমার পছন্দের কবিতার তালিকায় আছে, তার কবিতা।

এখানে একটি বিষয় খুব পষ্ট করে বলে নেওয়া ভালো যে, আমি তসলিমা নাসরিন-এর চিন্তা-চেতনা ও মতাদর্শের ঘোর বিরোধী এবং বিনাশকামী। কেউ যেন ভেবে বসবেন না, আমি তার কবিতা পছন্দ করছি বলে, তাকেও পছন্দ করি।

আমার মাঝে-মাঝে মনে হয়, কতই না ভালো হতো যদি সে শুধু কবিতা নিয়েই থাকতো! কিন্তু প্রচার ও খ্যাতির নেশা যাকে পেয়ে বসে, তাকে কে ফেরাবে?

যাই হোক, খুব সাম্প্রতিকে, মানে, গতকালকে লেখা তার কবিতা, ভাস্যসহ, আমি তুলে দিচ্ছি।

এটি আশার কথা যে, কবিতা এখনো তাকে ছেড়ে যায়নি।
…..

“কয়েক বছর কবিতা লিখিনি। এবার সময় লেখার। কাল থেকে শুরু করবো। এক বই প্রেম।  কিন্তু ছাপাবে কে? এক সময় আনন্দ ছাপাতো।  আনন্দ এখন আমার ছায়া মাড়ায় না। আর কলকাতার প্রকাশকরা আনন্দ দূরে সরলে নিজেরাও দূরে সরে। এমন নিরীহ নিষিদ্ধ কবি কস্মিনকালেও দেখিনি। এমন ভীতু প্রকাশকের দলও জগতের অন্য কোথাও  দেখিনি।”

তসলিমা নাসরিন

১.
তোমার কপালের ভাঁজগুলোকেও আমি লক্ষ করেছি আমি ভালোবাসি,
ভালোবাসি কারণ ওগুলো তোমার ভাঁজ,
তোমার গালের কাটা দাগটাকেও বাসি, যেহেতু দাগটা তোমার
আমার দিকে ছুঁড়ে দেওয়া তোমার বিরক্ত দৃষ্টিটাকেও ভালোবাসছি,
যেহেতু দৃষ্টিটা তোমারই।
তোমার বিতিকিচ্ছিরি টালমাটাল জীবনকেও পলকহীন দেখি,
তোমার বলেই দেখি।

তোমাকে দেখলেই আগুনের মত ছুটে যাই তোমার কাছে, তুমি বলেই,
হাত বাড়িয়ে দিই, তুমি বলেই তো,
হাত বাড়িয়ে রাখি, সে হাত তুমি কখনও স্পর্শ না করলেও রাখি,
সে তুমি বলেই তো।

১০.২৮.১৬

২.
প্রেম দিও, যত প্রেম সারাজীবনে সঞ্চয় করেছো তার সবটুকু,
কোথাও কিছু লুকিয়ে রেখো না।
আমার তো অল্পতে হয় না, আমার তো যেন তেন প্রেমে মন বসে না,
উতল সমুদ্রের মতো চাই, কোনওদিন না ফুরানো প্রেম চাই,
কলঙ্কী কিশোরীর মতো চাই,
কান্ডজ্ঞানহীনের মতো চাই।
পাগল বলবে তো আমাকে? বলো।

১০.২৮.১৬

৩.
যদি ভালোবাসো, ওই জুঁইফুলটি কেন জানে না যে ভালোবাসো!
ফুলটির দিকে এত যে চেয়ে রইলাম,
আমাকে একবারও তো বললো না যে ভালোবাসো!

আগে আমাকে পাখিরা বলুক, গাছেরা গাছের পাতারা ফুলেরা বলুক,
আকাশ বলুক, মেঘ বৃষ্টি বলুক, রোদ বলুক, চাঁদের আলো বলুক,
নক্ষত্ররা বলুক,
পাড়া পড়শি বলুক, হাট বাজারের লোক বলুক, পুকুরঘাট বলুক,
পুকুরের জল বলুক যে তুমি ভালোবাসো আমাকে!
শুনতে শুনতে যখন আর তিষ্ঠোতে না পারবো তখন তোমাকে ওই চৌরাস্তায়  তুলে একশ লোককে দেখিয়ে চুমু খাবো, যা হয় হবে।

জুঁইফুলটি যেদিন বলবে  তুমি আমাকে ভালোবাসো, সেদিনই কিন্তু তোমাকে বলবো তোমাকেও বাসি, তার আগে একটুও নয়।

১০.২৮.১৬

আরও পড়তে পারেন

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ