আবু নাসের সিফাত
দু:শাসনে সবার উদ্যম ভেঙে পড়ছে। প্রত্যেকটা প্রতিরোধ ব্যর্থ হচ্ছে। স্বৈরশাসনের তখন চরম বাড়বাড়ন্ত। অনেকেই হতাশায় ভেঙে পড়েছেন। তখন ফেসবুকে চোখে পড়লো মুসা আল হাফিজের একটা উক্তি , ‘ আপনি দুর্বল বলে লড়াই করছেন না, ব্যাপারটা তা নয়, বরং ব্যাপার হলো আপনি লড়াই করছেন না, তাই আপনি দুর্বল। ‘ বার্তাটা আমরা নিলাম। তাকে আরো পাঠ করতে লাগলাম। দেখা গেলো, তিনি বিভিন্ন পরিস্থিতিতে ছোট ছোট নির্দেশনা ও চিন্তাভাষ্য দিয়ে আমাদের পথ দেখাচ্ছেন । যেমন (ক) তুমি যদি নিজের পরিচয় নিজের মতো করে না লিখো, তাহলে অন্য কেউ তার মতো করে তোমার পরিচয় লিখবে। (খ) ছাগল ঘাস খাচ্ছে, এতে ছাগলের দায় নেই। কিন্তু দু:শাসন বিরতিহীনভাবে জনতাকে পিষ্ট করছে, এতে জনতার দায় আছে। (গ) ‘ রাস্তায় দেখা হলো তার সাথে। সে বললো,ভালো থাকুন। আমি বললাম,তুমি যেখানে আছো,সেখানে আমরা ভালো থাকি কী করে?’
এই সব উক্তির মধ্যে আমরা ডুবে যেতে থাকলাম। প্রতিটি ঘটনা ও ইস্যুকে মুসা আল হাফিজ কীভাবে দেখান, তার প্রতি আমাদের নজর থাকতো।
সিলেটে বন্যা চলছিলো। মঙ্গলবার (২১ জুন) পৌনে ১০টার দিকে হেলিকপ্টারে করে সিলেটে যান তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।তিনি হেলিকপ্টার থেকে বন্যাদুর্গত এলাকার ছবি তুলছেন, সেই ছবিও ভাইরাল হলো। মুসা আল হাফিজ তখন লিখলেন একটি ছোট্ট কথা– মানুষের বন্যা, সাপের পিকনিক।
ইতোমধ্যে মুসা আল হাফিজের বিভিন্ন গ্রন্থের মধ্যে আমাদের ডুবসাঁতার চলছে। ঐতিহ্য থেকে বেরিয়েছে নক্ষত্রচূর্ণ (ঐতিহ্য সংস্করণ) এতে বইটির দারুণ রকমের পরিচিতি লিখেছেন নাঈম ভাই। পরিচিতি পড়েই চমকে উঠেছিলাম। কারণ নাঈম ভাইয়ের কথাই ছিলো আমাদের কথা। তিনি লিখেন– সংক্ষিপ্ত, আকর্ষণীয়, স্মরণীয় এবং প্রায়ই মুগ্ধতা জাগানো উক্তি মুসা আল হাফিজের প্রবচন সমূহের একটি বিশেষ দিক। এসব উক্তি প্রজ্ঞাস্নিগ্ধ, সমালোচনাধর্মী আবার কখনো শ্লেষ ও ব্যঙ্গাত্মক বিবৃতি। এসব বিবৃতিতে কিছু কথা লেখক বলেন। এই কিছু কথার ভেতর নিহিত থাকে অনেক কথা। যাকে খুঁজে নিতে হয় পাঠককে।
আসলেই তাই। তিনি কিছু বলতেন, বাকিটা আমরা ব্যাখ্যা বুঝে নেবার চেষ্টা করতাম। এই ধারায় অবশেষে আমরা প্রবেশ করলাম বিপ্লবের পর্বে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সুবাদে ‘আন্দোলনটি কোটা ইস্যুর চেয়েও গভীর’– এই শিরোনামে একটি কলাম দৃষ্টিগোচর হয়। কলামটি ১৮ জুলাইয়ে প্রকাশিত হয়েছে Insaf24.com নামক একটি অনলাইন জার্নালে। যখন দেখলাম কলামটি লিখেছেন আমার দার্শনিক মুসা আল হাফিজ, তখন দ্বিগুণ আগ্রহ আর উৎসাহের সমন্বয় ঘটিয়ে লিংকে প্রবেশ করে পড়ে ফেললাম পুরো কলাম। পড়ার পর মনে হলো, লড়াইয়ের থিম সং পেয়ে গেছি। এর চরিত্র কী হবে আর আন্দোলনকে কোন দিকে নিয়ে যাওয়া উচিত, সেই বার্তাও পেয়েছি। আমাদের বন্ধুরা লেখাটির দ্বারা প্রচণ্ডভাবে প্রভাবিত হয়। যুক্তি বাস্তবতার নিরিখে অন্তর্চক্ষু দিয়ে লেখা অনবদ্য কলাম ছিলো সেটি।
১৮ জুলাই প্রকাশিত সেই কলামে অঙ্কন করা ছিলো জুলাই অভ্যুত্থানের পুরো রোডম্যাপ; সোজা কথায় বলতে গেলে ভবিষ্যদ্বাণী। তার বাক্য প্রয়োগে বেজে উঠেছিল তরুণ সমাজের মাধ্যমে আশু দ্বিতীয় স্বাধীনতার দামামা।কোটা আন্দোলকারী শিক্ষার্থীদের সম্পর্কে তিনি লিখেছিলেন “…এবার তারা ক্ষমতার ইগো, একরৈখিক দম্ভ এবং জনগণের জীবনের মূল্যহীনতার বাস্তব চিত্রকে দিগম্বর করলো আরেকবার। এর পাশাপাশি যে কোনো অধিকার প্রয়াসের বিপরীতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নাম করে চাপানউতোর খেলার ধারাবাহিকতাকেও বড়-সড় ধাক্কা দিলো। অধিকার চাওয়া বনাম মুক্তিযুদ্ধের চেতনার যে বাইনারিকে প্রাতিষ্ঠানিক চরিত্র দেওয়া হয়েছে এখানে। শিক্ষার্থীদের উচ্চারণের প্রতি অবজ্ঞা, শ্লেষ, বিদ্রুপ ও প্রত্যাখ্যান মন্দ্রিত হয়েছে। তারা জানে, তাদের পরিচয়কে রাজাকারির সাথে সম্পৃক্ত করার আদৌ কোন অর্থ নেই, সুযোগ নেই। তারা কোনো রাজাকারির উত্তরাধিকারও বহন করছে না। তারা উত্তরাধিকার বহন করছে আরেক স্বাধীনতার। বৃহত্তর মুক্তিকে। ১৯৭১ সালের হাতছাড়া স্বাধীনতাকে তারা নিজেদের অধিকারে আনতে চায়। প্রয়োজনে আরেকবার স্বাধীনতা অর্জনের অভিপ্রায়ে তারা জাগ্রত, জলন্ত।”
ভাবা যায়? তিনি তখনই আরেকটি স্বাধীনতার আওয়াজ তুলেছিলেন। সেজন্য যে বয়ানকে উল্টে দেওয়া দরকার, তাও করেছিলেন। এতে তিনি শিক্ষার্থীদের সুরে সুরারোপ করছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের মতো সার্বজনীন চেতনাকে একটি দল ও একটি পরিবার নিজেদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি মনে করতো। তারা মূলত বাজারের হকারের মতো ঘুরে ঘুরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ট্যাবলেট বিক্রি করতো। সেই ট্যাবলেট খেয়ে তৈলমর্দনে অভ্যস্ত কিছু দেশীয় বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ও তথাকথিত সুশীলশ্রেণি। যারা ফ্যাসিবাদকে লালন করতো মননে ও কাজে। মুসা আল হাফিজের লেখা কলামে তিনি এ নিয়ে দ্রোহ ও প্রতিবাদ উচ্চারণ করেছেন তেমন অস্তিত্বের সঙ্কটাপন্ন মুহুর্তেও।
তিনি লিখেছেন, “ মুক্তিযুদ্ধকে একটি দল ও পরিবার নিজেদের অপকর্মের ঢাল বানিয়েছে এর উপর কায়েম করেছে অপরাধমূলক মনোপলি। এর উপর ভর করে মানুষকে ভাবছে প্রজা। ফলে এই প্রজন্ম এই সময়ে, নাগরিকের অধিকার সুযোগের সমতা, রাষ্ট্রের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের সুরক্ষা এবং রাষ্ট্রের মালিকানা তার প্রকৃত মালিক জনতার কাছে ফিরিয়ে দেবার প্রশ্নে প্রতিবাদী ও লড়াকু।”
সুকান্ত ভট্টাচার্য তার ‘ছাড়পত্র’ কাব্যগ্রন্থে ‘আঠারো বছর বয়স’ নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন; সেখানে কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য মূলত আঠারো বছর বয়সের জয়গান করেছেন। আঠারো বছর বয়স তথা তারুণ্য যদি দেশের চালিকাশক্তি হয় তাহলে ইতিবাচক স্রোতের দিকে ধাবিত হবে গোটা দেশ-জাতি। সুকান্ত লিখেছেন—
“এ-বয়স যেনো ভীরু কাপুরুষ নয়
পথ চলতে এবয়স যায় না থেমে
এবয়সে তাই নেই কোন সংশয়
এদেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে”
মুসা আল হাফিজের সেই লেখনীতে আমি যেন সুকান্তের কবিতার সেই পুনঃউচ্চারণই অবলোকন করলাম।কেননা তিনি লিখেছিলেন– “শিক্ষার্থীরা তাজা, প্রত্যয়ী ও কাব্যিক সাহসে নিজেদের ভাষা ও তত্ত্ব বয়ন করেছে। প্রেক্ষাপটের বাস্তবতায় তারা আমাদের ঋণী করেছে বড় অর্থে। তাদের সাহস ও আত্ববিশ্বাস আমাদের পাতাঝরা জীর্ণতার কানে আরেকবার বসন্তের সম্ভাবনার গান ছড়িয়ে দিলো।”
সকল বিরোধী রাজনৈতিক দলের সক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করে এদেশের ছাত্রসমাজ যখন দ্রোহের শব্দ উচ্চারণ শুরু করলো তখন যেন নববসন্ত আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছিলো বাংলাদেশের ভাগ্যাকাশে। তাই কৃতজ্ঞতা স্বীকার ও তাদের প্রজন্মের জীর্ণতাকেও তুলে ধরেছেন মুসা আল হাফিজ।
ফ্যাসিবাদের হাতে তৈরী সমসাময়িক নির্মম বাস্তবতাকেও তিনি শব্দের মধ্যে অঙ্কণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।তার ভাষায়– “রাষ্ট্র হয়ে উঠেছে বিশেষের, সবকিছুর উপরে বিশেষ হয়ে আছে সবকিছু। রাষ্ট্র মানে দল, আরো বিশেষ অর্থে এলাকা ও পরিবার, আরো সুনির্দিষ্ট বিচারে ব্যক্তি। সমস্ত কিছুই এক চক্রে বিন্যস্ত। তারাই একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক, শাসক ও সর্বেসর্বা। সবকিছুর মালিক-মুখতার। জনগণকে এই মালিকানায় নিজেদের স্বত্ব পরিহার করে খুশি থাকতে হবে। ধন্য ধন্য করতে হবে। আমরা চেয়েছি জোরে নিশ্বাস নিতে। বিপরীতে লালচক্ষুর তীব্রতা নাভিশ্বাসকে করে দিয়েছে আমাদের নির্ধারিত নিশ্বাস। আমরা চেয়েছি বলতে যে, আমরা আছি। কিন্তু বিপরীতে ক্ষমতার থাপ্পড় আমাদের বলাকে করেছে নিঃশব্দ। তারপর আমরা আছি বটে, কিন্তু নাই হয়ে আছি। নৈশব্দে আছি। নিজেদের থাকার অর্থকে অস্বীকার করে আছি।”
ফ্যাসিবাদি দুঃশাসনের বিপরীতে দেশের প্রথমশ্রেণির বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন নির্বাক, নিঃশব্দ। শুধু নির্বাক নিঃশব্দ থাকলে কোন সমস্যা ছিলো না। অর্থের গোলামী ও তৈলমর্দনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা তাদের করে তুলেছিল উন্মাদ। বিবেক, বুদ্ধি, মানবিক দায় সবকিছুই যেন তারা ফ্যাসিবাদি দুঃশাসনের কাছে বর্গা দিয়েছিলেন। তাদের চিন্তা ও বিবেকের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে ছিল না। কোনো কোনো বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক তো সরাসরি কলম যুদ্ধে নেমে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করতেন এই ফ্যাসিবাদি দুঃশাসনকে।
তথাকথিত বুদ্ধিজীবী ও সুশীলদের নিরবতাকে ভেঙ্গে ছাত্রসমাজ যে নতুন দিগন্তের উন্মোচন করলো তা-ও উল্লেখ করেছেন মুসা আল হাফিজ তার কলামে– “শিক্ষার্থীরা তোমরা নিরবতা নৈশব্দ ভাঙলে। জঘন্য বিপদ জানার পরেও তোমরা জাগরণকে সালাম জানালে। তোমাদের উচ্চারণে গভীর আবেগ আর ভালোবাসা। তোমাদের চোখে-মুখে রক্তের চাঞ্চল্য। সত্যিকার ভালোবাসার সাথে তোমরা তারুণ্যের মিলন ঘটালে। এর মধ্যে উত্তেজনার চেয়ে বেশি সুস্থির দৃঢ়তা, প্রগলভতার চেয়ে বেশি আত্মবিশ্বাস। তোমাদের দাবি পরিকল্পনা, নির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট সুর তোমাদের আন্দোলনের বিষয়ের পাশাপাশি তোমাদেরকে নিয়ে এসেছে আমাদের আগ্রহ ও প্রত্যাশার লাল বিন্দুতে। আজ বলতে পারছি না, শেষ শিখাটি নিভে যায় নি। আমাদের নতুন জেনারেশন মেরুদণ্ড প্রদর্শন করতে জানে। ”
গত ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদি দুঃশাসনে ক্ষমতাসীনদের একটি প্রবণতা সকলেই লক্ষ্য করেছেন, তা হলো তৃতীয় পক্ষের নাম করে দেশের যেকোন অস্থিতিশীল পরিস্থিতির দায়ভার চাপানো হতো বিরোধীদলগুলোর উপর। এভাবে বিরোধী দল ও মতগুলোকে গত ১৬ বছর কোণঠাঁসা করে রাখা হয়েছিল। যা কখনোই সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক চর্চার পথকে সুগম করে না। এই আন্দোলনেও এমন পায়তারা করেছিল ফ্যাসিবাদী শক্তি। এই তৃতীয় পক্ষের থিওরিটাকে মুসা আল হাফিজ উড়িয়ে দিয়েছেন তার কলামে–“ …সাধারণ শিক্ষার্থী ও সরকার যদি দুই পক্ষ হে তাহলে দৃশ্যমান তৃতীয় পক্ষ এখানে কে? নিশ্চয়ই ছাত্রলীগ। বাদবাকি বিএনপি, জামায়াতের দিকে ইশারা করা হচ্ছে, তা ক্ষমাতসীনদের মুখস্ত চর্চা এবং ষড়যন্ত্রতত্ত্বের ধারাবাহিক ভাষণ। বিগত ষোল বছর ধরে প্রতিদিন প্রতিরাত ক্ষমতাচক্রের জবানে বিএনপি-জামায়াতকে দায়ি করার যে অনবরত অনুশীলন প্রথায় পরিণত হয়েছে, এটা তারই ধারাবাহিক। বিএনপি-জামায়াত কোনো নিষিদ্ধ রাজনৈতিক সংগঠন নয়। তারা দেশের চলমান রাজনৈতিক ইস্যুতে মতামত দেবে, অবস্থান নেবে এমনকি সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করবে, এটা রাজনৈতিক স্বাভাবিকতা। সারা দুনিয়ার বিরোধী দলগুলো এমনটি করে। কিন্তু এখানকার মিডিয়া সরকারি বয়ানকেই শেষ কথা হিসেবে রাষ্ট্র করতে চায়। তাদের উচিত প্রমাণ চাওয়া। বিরোধী দলের অংশগ্রহণ সমস্যা নয়, এটা তাদের অধিকার। কিন্তু তাদের অপরাধমূলক অংশগ্রহণ থাকলে এর প্রমাণ কি? সরকারের কুটিল খেলা অতীতে হয়তো কাজ করেছে, কিন্তু সবসময় করবে?”
একটি প্রজাতান্ত্রিক দেশের মালিক সেদেশের জনগণ। জনগণের সুবিধা-অসুবিধা, চাওয়া-পাওয়াকে, আগ্রহ-বিতৃষ্ণা ইত্যাদিকে প্রাধান্য দিয়েই একটি সভ্য রাষ্ট্র পরিচালিত হয়। কিন্তু গত ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনে আমরা দেখেছি, রাষ্ট্রকে একটি দল, একটি পরিবার ও এক ব্যক্তিমূখী করা হয়েছে। এতে দেশের আঠারো কোটি মানুষের সকল আশা আকাক্সক্ষাকে নিমিষেই কবর দেওয়া হয়েছে। পুরো দেশটা জিম্মি ছিলো একজন ব্যক্তি, দল ও পরিবারের কাছে। এ-দেশ ছিলো যেন সাংবিধানিক সরকারের চাঁদরে মোড়ানো একটি অঘোষিত স্বৈরতন্ত্র। এই স্বৈরতন্ত্রের বলি হয়ে নির্বাক হয়েছে দেশের আঠারো কোটি মানুষ। কেউ যেন ছিলো না এই নিরবতা ভাঙার।
এর মধ্যে শিক্ষার্থীদের রুখে দাঁড়ানোকে মুসা আল হাফিজ ভিন্ন মহিমায় আবিষ্কার করেন। তাদেরকে নিছক কোটা আন্দোলনের বদলে কোন গুরুত্বপূর্ণ জায়গা সমূহে নজর দিতে হবে, তারও স্পষ্ট বয়ান দেন তিনি। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সম্ভাব্য চরিত্র ও পরিণতি সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, “রাজনীতির এই কুটিল খেলা শিক্ষার্থীদের আপাপবিদ্ধ সাহস ও প্রত্যয়কে মলিন করতে পারে নি। তারা প্রমাণ করেতে চাইছে, রাষ্ট্রের মালিক কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা কায়েমী শ্রেণি নয়। রাষ্ট্রের জনগণ।… দুর্বৃত্তায়িত ক্ষমতাচক্র পেশি ও প্রতারণার উপর সওয়ার হয়ে আমাদের জীবনের উপর গড়েছে উপনিবেশ। সেই উপনিবেশের বরকন্দাজ হয়ে আছেন প্রশাসনকর্তাদের অনেকেই। তারা জনতার প্রভু হতে চাইছেন। কিন্তু তাদেরকে আপন জায়গা চিনে নিতে হবে। সেই অনুযায়ী চরিত্র ধারণ করতে হবে। দেশ ও জনতার উপর চাপিয়ে দেওয়া উপনিবেশ কোনো জনমতের ধার ধারে না। জনতার সমর্থনের ধার ধারে না। নির্বাচিত হবারও কোনো প্রয়োজন নেই। সংবিধান হচ্ছে তার স্বার্থশিকারের ইচ্ছাপত্র। সংসদকে তারা বানিয়েছে দলীয় ক্লাব। এই পরাধীন, পরাজিত ও পিষ্ট বাস্তবতাকে উন্নয়নের গল্প আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নাম করে খাওয়াতে চাচ্ছে আমাদের। আমরা খাইনি। জনগণ খায়নি। জনগণ উন্নয়নের সেই গল্পকে ফাঁক করে দেবে, যা রচিত হচ্ছে তাদের প্রাণ, সম্মান ও অন্যান্য অধিকারের নিনিময়ে জনগণ সেই দেবতাকে পায়ের তলে গুড়িয়ে দেবে, আমাদের কাছে যার বাধ্যতামূলক পূজা চেয়েছেন। জনগণ অন্ধ নয়, যদিও আপনারা মনে করেন তাদের চোখ নেই। তারা সেই দৃশ্যও দেখছে, যা আপনারা লুকাবার সবরকমের চেষ্টা করেছেন। তাদের চোখে আপনারা কাপড়হীন রাজা। এখন বালকরা বলবে-রাজা তোর কাপড় কই?”
মুসা আল হাফিজের কলামে স্পষ্টই শোনা গেছে ফ্যাসিবাদের পতনের করুণ কান্না ও দুঃসহ পরিণতি। সেই সাথে তিনি অগ্রিম চিত্রায়ন করেছেন একদফার চিত্র। যা অকল্পনীয়। কারণ তখনও স্বৈরাচার পূর্ণমাত্রায় শক্তিশালী এবং তার বাহিনী খুব নিষ্ঠুরতার সাথেই লড়ে যাচ্ছে রাজপথে। বস্তুত চার আগষ্ট অবধি কেউ জানতেন না আন্দোলনের ফলাফল কী হতে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় ১৮ জুলাই মুসা আল হাফিজ যেন দেখতে পাচ্ছিলেন পরিস্থিতি। আসলে তিনি পরিস্থিতিকে সেদিকেই নিয়ে যেতে চাচ্ছিলেন, যার নাম এক দফা। খুব ঝুঁকিপূর্ণ এক সময়ে বসে মুসা আল হাফিজ অগ্রিম রচনা করলেন একদফার চিত্র। তার ভাষায় “… গুলি ও নির্মমতা দিয়ে আন্দোলনকে যে গভীরতা দেওয়া হয়েছে, তাতে আন্দোলনটি এসব মর্মকে বহন তো করছেই, সাথে সাথে বহন করছে ওয়ান/ইলিভেনের পর থেকে এ অবধি চলা গোটা অসুস্থতাকে বিদায় করার প্রসঙ্গও। অনির্বাচিত ক্ষমতার ন্যায্যতার জরুরি কিন্তু কম উচ্চারিত সওয়াল অচিরেই উঠবে। তখন কোটা আন্দোলনের তুরণ মিছিলগুলো একদফার এমন লাভা উদগীরণ করবে, যার সাথে সরকারের পরিচয় ঘটে নি আগে। কারণ স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি স্বৈরতন্ত্র এবার তার আসল প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হয়েছে এবং সেই প্রতিপক্ষের নাম জনতা। ছাত্ররা জনতার সেই জনতার অগ্রসর ও সচেতন অংশ। ইতিহাসের নিয়মেই তারা আমোঘ গন্তব্যের দিকে আমাদের আকাঙ্ক্ষাকে চালিত করেছে।”
বিগত ১৬ বছরে স্বৈরাচারের কার্যকলাপে তারা জনতার বিপক্ষে বরাবরই তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। জনতার ক্ষোভ, রোষ পুঞ্জীভূত হয়েছে একসাথে বিস্ফোরিত হয়েছে। ইতিহাসের ভেতর থেকে উঠে আসা চিন্তক এই সময়ে ইতিহাসের মোড়বদলকে বুঝতে পারেন। মুসা আল হাফিজ সেই জায়গা থেকে দেখতে পাচ্ছিলেন ফ্যাসিবাদী সরকার পালাচ্ছে। তাকে বাঁচাতে পারছে না সশস্ত্র বাহিনী। তিনি মন্তব্য করেছিলেন, “সরকারের অবস্থান ইতিহাসের বিপরীতে, প্রাকৃতিক সত্যের বিপরীতে। এখন পরামর্শ দিলেও সে শুনবে না। কারণ চাটুকারিতা ছাড়া আর কোনো কিছু শোনার মন ও কান থেকে সে বঞ্চিত। …হত্যাকে সমাধান মনে করছেন কিন্তু এটা একটা সমস্যা। গণমতকে অবজ্ঞা করাকে শক্তি মনে করছেন কিন্তু এটা দুর্বলতা। পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনীর নির্মমতাকে নিরাপত্তা মনে করছেন। তাদের নির্মমতা জনগণকে দমাতে পারবে না। তাদের পাহারা আপনাদের বাঁচাতেও পারবে না। বরং ভাবুন এই পাহারা সরে গেলে কোথায় পালাবেন?”
জুলাই বিপ্লবের বিপরীতে স্বৈরাচারের প্রত্যেকটি ভুল চালের অগ্রিম ঘোষণা দিয়ে রেখেছিলেন মুসা আল হাফিজ। “বস্তুত সরকার ভুল অঙ্ক কষছে। ক্ষমতাকে দম্ভ দিয়ে নিরাপদ করতে চাইছে। কিন্তু পাপ বোধ হয় চূড়ান্ত পরিণতির শেষ মঞ্চে। নিয়তির সাইরেন বোধ হয় বেজে গেছে। এই আন্দোলনকে সেই পরিণতির উপলক্ষ বানানোর জন্য যত ধরনের বোকামি করা লাগে, সরকার তা করবে। এতে হয়তো অজস্র প্রাণ আমরা হারাবো। কিন্তু প্রাণ দিতে দিতে প্রাণের মূল্য প্রতিষ্ঠার লড়াই থেকে মানুষ কখনো পিছু হটে না। এজন্যই সে অনন্য, অপরাজেয়। এই আন্দোলনটি ছোট স্ফুলিঙ্গ থেকে বড় দাবানলের দিকে যাচ্ছে। ভয় নেই। মাভৈ। সবার এগিয়ে আসা দরকার। সব পেশায়, সব অঞ্চলের, সব চিন্তার, সব ধারার, সব ধর্মের, বিশেষত তাওহিদবাদীদের।”
আমি শুধু চিন্তা করি, ১৮ জুলাই তখনও বাকস্বাধীনতা মুক্তি পায়নি। তখনও স্বৈরাচার বাকস্বাধীনতা হরণ করে আনন্দ উল্লাসে মত্ত। দাবি-দাওয়া আদায়ের সংগ্রামে যারাই নেতৃত্ব দিয়েছে বা উত্থাপন করেছে তারা তখনও স্বৈরাচারের আয়নাঘরে বা তার পোষা বাহিনীর হেফাজতের নামে জীবন সংকটে। সেই মুহুর্তে বসে এমন ঘরানার চরমপত্র লেখার প্রেরণা মুসা আল হাফিজ কোথা থেকে পেলেন?
এমন চরমপত্রের অবধারিত ফলাফল ছিলো আয়নাঘর, ডজনকে ডজন মিথ্যা মামলার বোঝা আর স্বৈরাচারের রক্তচক্ষু। কিভাবে মুসা আল হাফিজ স্বৈরাচারের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে এসব কথা নির্দ্বিধায়, নিঃসঙ্কোচে লিখে গেছেন? আমার খুবই জানতে ইচ্ছে হয়! হয়ত ইতিহাসের সাথে নিবিড় সখ্যতার কারণে তিনি সবকিছু এত সহজেই আঁচ করতে পেরেছিলেন। মুসা আল হাফিজ ইতিহাসে বসবাস করেন , তাই হয়তো সে সময়ের ভবিষ্যত যা পরবর্তীতে ইতিহাস হতে যাচ্ছে; সে-ই মুসা আল হাফিজের কানে কানে এসে বলে গিয়েছিল। তাই হয়তো স্বৈরাচারের রক্তচক্ষু, আয়নাঘর, মিথ্যা মামলা, পুলিশি নির্যাতন এসব ভয়কে জয় করে মুসা আল হাফিজ লিখে গেছেন বীরদর্পে। সৃষ্টিকর্তা মুসা আল হাফিজের বুদ্ধিমত্তা ও প্রজ্ঞাকে এই জাতির জন্য কল্যাণে ব্যয় করুন। তার মস্তিষ্ককে নিত্য নতুন চিন্তা চাষের জন্য উর্বর করুন।
…………
আবু নাসের সিফাত
সহকারী সম্পাদক, কর্ষণ
বিবিএ (অধ্যয়নরত), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়