রফি হক
১.
“…এমনও তো হয় কোনোদিন / পৃথিবী বান্ধবহীন /
তুমি যাও রেলব্রীজে একা—- ধূসর সন্ধ্যায় নামে,
ছায়ানদীটিও স্থিরকায়া / বিজনে নিজের সঙ্গে দেখা।…”
.
যখন এ লেখা লিখছি, তখন আবু জাফর স্যার বড় একা হয়ে শুয়ে আছেন চিরনিদ্রায়। তিনি বান্ধবহীন আজ। অনেক স্মৃতি ছিল আমার আবু জাফর স্যারকে নিয়ে। পাস্ট টেন্সে বলছি—‘স্মৃতি ছিল’। কারণ, স্যারের সঙ্গে আমার চল্লিশ বছর আর দেখাই হয়নি। আমি ঊনিশ শ বিরাশি সালে ঢাকা আর্ট কলেজে ভর্তি হলে, ঢাকা চলে আসি অনেকটা পাকাপাকিভাবে। ফলে কিছুদিন যোগাযোগ ছিল। কিন্তু আগের মতো আর ছিল না।
❦
আমি যে আবু জাফর স্যারকে চিনতাম—তা একেবারেই ভিন্ন মেজাজের আবু জাফর স্যার। সবে বিয়ে করেছেন ফরিদা পারভীন আপাকে। ফরিদা আপা তখন পাদ-প্রদীপের আলোতে আসতে শুরু করেছেন। তিনি তখন বিখ্যাত আবু জাফরের লেখা ও সুর দেয়া গানের জন্য—
.
“এই পদ্মা এই মেঘনা / এই যমুনা সুরমা নদী তটে,
এই পদ্মা এই মেঘনা/ এই যমুনা সুরমা নদী তটে…”
কিম্বা
“…নিন্দার কাঁটা যদি না বিঁধিল গাঁয়ে / প্রেমের কী স্বাদ আছে বলো,
আঁধার না থাকে যদি কী হবে আলোর / প্রেমের কি স্বাদ আছে বলো…”
কিম্বা
“…তোমরা ভুলেই গেছো মল্লিকাদির নাম
সে এখন ঘোমটা পড়া কাজল বধু—
দূরের কোন গাঁয়…
পথের মাঝে পথ হারালে আর কি পাওয়া যায়…”
❦
এসব গান আমাদেরকে কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে যেত, অবিশ্বাস্য। স্যার আর ফরিদা আপা মঞ্চে গাই্ছেন…আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনছি। কিংবা সুনসান দুপুরে রেডিওতে যখন অনুরোধের আসরে ফরিদা আপার কণ্ঠে শুনতাম বিশেষ করে ওই গানটি, মল্লিকা দির গান—বিশেষ করে ওই দুটি লাইন, বুকটা হু হু করে উঠতো। আমাদের বয়স তখন ষোলো সতেরো। যেন, আমারও কোনো মল্লিকা দি কোথাও আছে—
“…দুপুর বেলা মল্লিকাদির আটচালাতে গিয়ে
পুতুল খেলার ছল করেছি হৃদয় দিয়ে নিয়ে…”
আহা, । মনটা কেমন শূন্য শূন্য লাগত ওই বয়সে। সে কথা ভাবলে মনে বর্ষা নামে।… পথের মাঝে পথ হারালে আর কি পাওয়া যায়…??? সত্যিই…
❦
.গ্রীষ্মে, বৈশাখের এক তীব্র দাবদাহের দুপুরে কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের নতুন ভবনের পশ্চিমপ্রান্তের শেষদিকের একটি ক্লাস রুমে আমাদের ক্লাস নিচ্ছেন আবু জাফর স্যার। বাংলা সাহিত্যের ক্লাস।
.
আবু জাফর স্যার রুমে এলেন প্রায় গলদঘর্ম হয়ে। তখন কুষ্টিয়া সরকারী কলেজের ওই অংশটি এক তলা। তখনও নির্মাণাধীন। ভবনটি প্রায় মাঠের মধ্যেই বলা যায়। চারদিক ফাঁকা। বাইরে হাওয়া বইলে ক্লাসরুমেও অনুভূত হয়। সে-সময়ে ক্লাসরুমে আমাদের সময়ে বৈদ্যুতিক পাখা ছিল না। আমরাও গরম অনুভব করছি। স্যার এসেই বললেন : ‘ভয়ানক গরম’, শুধ্রে নিয়ে নিজেই বললেন, ‘প্রচন্ড গরম’। এখানে “প্রচন্ড” শব্দটি হবে। আমাদের সহপাঠীদের মধ্যে কেউ একজন বলল, “স্যার, দুর্ধর্ষ গরম।“ ক্লাসের মধ্যে বেশ একটা হেলদোল বয়ে গেল। ক্লাস আর এগুলো না, স্যার চলে গেলেন!
.
আমি চল্লিশ বিয়াল্লিশ বছর আগের কথা বলছি। আমার স্কুল জীবন আরও আট বছর যদি যোগ করি তাহলে, প্রায় পঞ্চাশ বছর। আমি অত্যন্ত সাধারণ এবং দরিদ্র পরিবারে বেড়ে উঠেছি। বাড়ি ছিল টিনের ছাপড়ার। মাথার ওপর টিন ছিল আধা হাত ওপরে। আমি জানি প্রচন্ড গরমের রকমফের।
❦
আবু জাফর স্যার কুষ্টিয়াতে আমার প্রতিবেশী ছিলেন। আমার চোখে ভাসে আবু জাফর এবং ফরিদা আপার সেই সংসারটি। ঘর ভর্তি আনন্দ। ঘরভর্তি হারমিনিয়ামের বাজনা আর গান। আমার সহপাঠী বন্ধু মামুন আর আমি প্রায় প্রায়ই যেতাম। মামুন ছিল কুষ্টিয়ার তৎকালীন ডিসি আব্দুল মান্নান ভূঁইয়ার ছেলে। আমি যেতাম আমার নতুন কোনো লেখা কাঁচা কবিতা নিয়ে। স্যার আমাকে সবুজ কালি দিয়ে কিছু কিছু শব্দ লেখায় সংশোধন করে দিতেন। সংযোজনও করতেন। আমরা যেতামও ভর দুপুরে।
.
একবার স্যার মামুন ও আমাকে দাওয়াত দিলেন, বললেন, ফরিদা এই প্রথম রাষ্ট্রীয় সফরে জার্মানীতে গিয়েছিল। সে দেশে ফিরেছে। খুব সুন্দর চিনে মাটির ক্রোকারিজ এনেছে। তোমারা তাতে প্রথম খাবে। মোহনীয় দাওয়াত। আমি আর মামুন গেছি। একটু দেরিতে। মফস্বলে দুপুরের খাওয়া একটা থেকে দেড়টার মধ্যেই হয়ে যায়। স্যার, আপার সঙ্গে অনেক কথা হলো। সামান্য গানের কথাও হলো। কলকাতার ললিতকলা একাদেমি আবু জাফর স্যার এবং ফরিদা পারভীন আপাকে নিয়ে একটি গানের অনুষ্ঠান করেছিল । সেই অনুষ্ঠানটি শুধু ছিল আবু জাফর স্যারের লেখা ও সুরের গান নিয়ে বিশেষ অনুষ্ঠান—আপা ও স্যার তার কথা বললেন। কলকাতার আনন্দবাজার ও সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায় তার রিভিউ বেরিয়েছি তা দেখালেন, পড়লেন।…ভালো লাগছিল। নতুন বিয়ের, নতুন সংসারের একটা গন্ধ থাকে কিন্তু। আমরা, মামুন ও আমি সেই গন্ধ উপভোগ করছিলাম—
.
এরপর আমি আর মামুন মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছি, মামুন বললো, স্যার বোধহয় আমাদের দুপুরের দাওয়াতের কথা ভুলে গিয়েছেন। আমিও মাথা নাড়লাম। মামুন বলল, আমি আসছি, তুই থাক, আমি গাড়ি নিয়ে যাবো আর আসব। স্যারকেও তাই বলল, এখুনি আসছি। মামুন রথখোলায় গিয়ে দই আর মিষ্টি নিয়ে এলো।…স্যার বললেন, কী কান্ড ফরিদা, আমি ওদের আজ দাওয়াত দিয়েছিলাম দুপুরে খাওয়ার—তুমি জার্মানি থেকে যে ক্রোকারিজগুলো এনেছো, ওদেরকে দেখাবো বলে।… ফারিদা আপা তাড়াতাড়ি মোরগ পোলাও রাঁধলেন আমাদের মানা সত্ত্বেও। আলাদা একটি মাংসও রাঁধলেন। কী অসামান্য রান্না !! অত বড়ো একজন শিল্পীর হাতের রান্না ভুলবার নয়।
.
গত চল্লিশ বছর ফরিদা আপার সঙ্গে পরে অসংখ্যবার দেখা হয়েছে ঢাকাতে। এমনকি ঢাকার বাইরে ও দেশের বাইরেও। কিন্তু কখনওই আর আবু জাফর স্যারের কথা বলিনি তাঁকে। তিনি বলেন নি আমাকে। কী যে সুন্দর ছিল সেই সংসারটা । আহা !! আমার খুব মনে পড়ে।
.
আজ এই অগ্রহায়ণের শুক্রবারে তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন।
ঈশ্বরের কাছে আমার প্রার্থনা রইল, তাঁকে জান্নাতে প্রবেশের জন্য দরখাস্ত রাখলাম।
বিদায় আমাদের প্রিয় আবু জাফর স্যার। বিদায় প্রিয় গীতিকার, সুরকার।
বাংলাদেশ আপনাকে মনে রাখবে।
.
- র ফি হ ক
- Artist, Printmaker, Writer, Editor
- শুক্রবার, ২১ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১
- ৬ ডিসেম্বর ২০২৪
- .
Photo : Milton Khodakar