তাজ ইসলাম
চারদলীয় জোট আর চৌদ্দদলীয় জোটের আমলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্পষ্ট দুইটা বলয় ছিল। বাম বলয় ও ডান বলয়। আওয়ামীলীগও তখনকার বাম বলয়ের গোত্র ভুক্ত ছিল। বিএনপি ছিল ডান বলয় ভুক্ত। আওয়ামীলীগ ও বিএনপি সৃষ্টি লগ্ন থেকেই তারা ডান ও বাম হিসেবেই পরিচিত। আওয়ামীলীগ আওয়ামী মুসলিম লীগের পেট থেকে আওয়ামীলীগ হল। নিজেদের ইসলাম থেকে পৃথক করে সেকুলার হতে গেল। সেকুলার হতে হতে বামদের সহযোগী হয়ে পরিচিত হল। নিজেরা ধর্ম কর্ম করলেও দল হিসেবে ইসলাম বিমুখই রইল।সর্বশেষ নিজেদের বিজয় নিশ্চিত করল বাম ইনু,মেনন,দিলীপ বড়ুয়াদের সাথে নিয়ে। বাংলাদেশে বাম বললে ইনু, মেনন,রব,দিলীপ বড়ুয়া,মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমদের রাজনীতিকেই বুঝে। আওয়ামীলীগ তাদের মতো বাম দল না হলেও বলয় বললে আওয়ামীলীগ বাম বলয়েই উপযুক্ত হিসেবে স্পষ্ট হয়। বিএনপি ডান দল।
লীগ এক সময় বাম বলয়ের ত্রাতা হিসেবে কাজ করে। ক্ষমতা থেকে দূরে থেকেও বিএনপি তার নিজের বলয়ের নেতৃত্বের আসনে থেকে যায়।
২০০৮ এর পর আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় এসে নতুন রূপে আবির্ভূত হতে থাকে।বলয় থেকে বিচ্যুত হয়।ক্রমশঃ পরিচিতি পেতে থাকে স্বৈরাচার ও ফ্যাসিস্ট হিসেবে। ক্ষমতার স্বাদ পাওয়া বামেরাও হয় কক্ষচ্যুত। বামের এই অংশটি হয় পঁচা গলা বাম।
পঁচা গলা বামের বাইরে বামের আরেকটি অংশ থেকে যায় রাজনীতিতে।
ডান বামের হিসেবে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তির হিসাব,ভোটের মাঠে বাম দলগুলো এমনিতেও এক ব্যক্তি এক দল,অফিস ও কমিটি সর্বস্ব দল হিসেবেই বেঁচে আছে। আমরা কথা বলছি বামের সাথে বামের তুলনা দিয়ে। বামের যে অংশ ক্ষমতার কাছাকাছি ছিল আর যে অংশ ক্ষমতা থেকে দূরে ছিল তারা একটা থেকে আরেকটা উত্তম হয়ে আছে।প্রথম অংশটি রাজনীতির ঝুড়ি থেকে একেবারেই ফেলা দেয়া অংশ। নীতি, আদর্শ, গ্রহণ যোগ্যতায় তারা এখন পরিত্যক্ত। আওয়ামীলীগের মতোই তারা বাংলাদেশের রাজনীতিতে জনবিচ্ছিন্ন। জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত।
বামের দ্বিতীয় অংশ বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন সরব। ওরা চতুর ও কৌশলী। তারা বাম রাজনীতির সাথে যুক্ত,বাম আদর্শ লালন করেন কিন্তু রাজনীতির মাঠে বাহ্যত উহ্য রাখেন নিজের পরিচয়। সুশীল,বুদ্ধিজীবী,পেশাজীবী হিসেবে পরিচিত হতে চান। আওয়ামী শাসনের বেশিরভাগ সময় তারা আপোষ করে চলেছেন। কথা বলেছেন বাইমমাছ তরিকায়। তাদের কেউ কেউ বিএনপি ঘেঁষা হয়েও সময় অতিক্রম করেছেন। বিপ্লব পরবর্তী সময়ে তারাই অধিক লাভবান। সংখ্যায় তারা কম হলেও বুদ্ধিবৃত্তিক চালে ৫ আগস্টের বিজয়ের পর তাদের প্রভাব চোখে পড়ার মতো। আন্দোলনের ফসলে তাদের ডালা সুশোভিত। সংখ্যায় অল্প হলেও সংখ্যাধিক্যদের উপর ছড়ি ঘুরাচ্ছেন বস্তুত বামেরা।
আওয়ামী শূন্যতার পর সমগ্র ডান বলয়ের উপর প্রভাব বিস্তার করে চলেছে বাম রাজনীতিবিদেরা। বামেদের সাথে ডানের পক্ষ বুদ্ধিবৃত্তিক পিছিয়ে গেছে। প্রশাসনে প্রভাব সাবেক আওয়ামী সরকারের রেখে যাওয়া আওয়ামী ভাববাদীদের।অন্তর্বর্তী সরকারের নিয়োগ, রাজনৈতিক কৌশল, সরকারের আনুকল্যে বামেরা ধীরপায়ে নিজেদের অভিষ্ঠ লক্ষে পৌছে যাচ্ছে।
ক্ষমতার মসনদে বসতে তারা ব্যর্থ হলেও ক্ষমতাবানদের সাহচর্যে সুযোগ আদাশ করে নিতে তারা বরাবরই পটু।
৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে প্রাপ্ত সুযোগ সুবিধায় আগামীর বাংলাদেশে উজ্জীবিত থাকবে অনেক দিন।
বাম বলয় থেকে বাম দলগুলো এখন নিজস্ব পথে চলছে।আওয়ামীলীগ ও ক্ষমতার সহযাত্রীরা এখন আছে কক্ষচ্যুত। বাদবাকি বাম রাজনীতির চিন্তার ধারকরা বাম রাজনীতির চালক। জাতীয় পার্টির কোন ডান বাম নাই। ক্ষমতা ও কক্ষমতার কাছাকাছি থাকাই তাদের নীতি।
ডান বলয়ও এখন অঘোষিত বিভক্ত। ৫ আগস্টের পর বিএনপি চলছে একক গতিতে। রাজনৈতিক চিন্তায় বাংলাদেশের গণমানুষের বিশাল অংশ আওয়ামীলীগ বিএনপিতে বিভক্ত। এই বিভক্তি কোন বিশ্বাস, ধর্ম,আদর্শ কেন্দ্রীক না। কেবল দল বা রাজনীতি প্রীতি থেকেই সমর্থন।
ডান বলয়ের বিএনপি ও অন্যান্য দলগুলোর মাঝে একটা দাগ টেনে আলাদা করা যায়। সেই দাগের এক পাশে থাকতে পারে বিশ্বাস, আদর্শ, ধর্ম সম্পৃক্ত রাজনৈতিক দলগুলো। জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনসহ অন্যসব দল এইখানে থাকবে। ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখে অন্যসব দল।
ফ্যাসিস্ট আওয়ামীলীগ,বিএনপি,বাম রাজনৈতিক দলসমুহ ধর্মভিত্তিক দলগুলোর প্রতি বৈরী মনোভাব সব সময়ই আছে।ক্ষমতার রাজনীতির স্বার্থে তাদের সাথে জোট করে,আন্দোলন করে। আবার ক্ষমতার দিকে অগ্রযাত্রায় তাদের প্রতিবন্ধকতাও তৈরী করে। বামেরাতো সবসময়ই প্রকাশ্য বিরোধিতা করেই যায়। ৫ আগস্ট ২০২৪ এর পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামীলীগ পতিত দল। তাদের সামনে এখন বিরোধী পক্ষ হিসেবে আছে একাধীক পক্ষ।
আওয়ামীলীগের এখন অন্যতম প্রতিপক্ষ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতা।তাদের প্রতিপক্ষ অন্তর্বর্তী সরকার।আওয়ামীলীগের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি ও জামায়াত। এতসব প্রতিপক্ষের সাথে লড়াই করা তাদের শক্তি ও সামর্থের বাইরে। তারা পূর্বের তাস নিয়েই খেলছে।তারা নানাভাবে বিরোধীতা করছে জামায়াতের। সফল হলে অন্য দলের বিরুদ্ধে কথা বলবে। জামায়াতে ইসলামীকে লড়তে হচ্ছে শত্রু পক্ষ ও মিত্রপক্ষের বিরোধীদের সাথে। বলতে পারি জামায়াতের ক্ষনতার শত্রু আওয়ামীলীগ,ক্ষমতার প্রতিপক্ষ বিএনপি আর আদর্শিক শত্রু সমস্ত বামগ্রুপ। এতসব প্রতিকুলতার মাঝেও অন্য যেকোন সময়ের তুলনায় অনুকুল পরিবেশ এখন জামায়াতের। তারা ব্যপক শোডাউন করে যাচ্ছে। এখন শক্তি প্রদর্শনের সময়। উপযুক্ত পথেই হাঁটছে।তবে এর একটি বিরূপ প্রতিক্রিয়ায়ও আছে। তারা আগের মতো
তাদের ভাষায় (হেকমত) কৌশলী রাজনীতিতে নাই।তারা এখন শক্তি প্রদর্শনের পথে হাঁটছে। এর ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব আছে। যদি তারা ফের কোন প্রতিকূল পরিবেশে পড়ে তখন বর্তমানের কাজের পরিনতি ভোগ করতে হবে। ভবিষ্যৎ ভেবে কেউ বর্তমানের কাজের গতি থামিয়ে রাখে না।তবে হিসাব মাথায় রাখা বুদ্ধিমানের কাজ। ৫ আগস্টের পর রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে দুটো পথ উন্মুক্ত হয়েছে।মুক্ত রাজনীতি করা ও ক্ষমতার কাছাকাছি যাওয়া।জামায়াত প্রথমটা ভোগ করতে পারলেও দ্বিতীয়টা থেকে বঞ্চিত। ক্ষমতার সুবিধা নিতে দৃশ্যত তারা ব্যর্থ।এক্ষেত্রে এগিয়ে আছে বাম শক্তি।
এই মূহুর্তে রাজনীতিতে জামায়াতের সহযোগী নাই।সবাই প্রতিপক্ষ। ইসলামী আন্দোলন এখনও রাজনীতির শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে পারেনি।তারা এখনও সহযোগী হিসেবেই আছে। বিগত পনের বছর ছিল আওয়ামীলীগের সহযোগী। জাতীয় পার্টি ছিল দোসর। জুলাই বিপ্লবে জাতীয় পার্টি আওয়ামীলীগের পাপের সহযাত্রী ছিল।ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন অবশ্য শেষ পর্যন্ত আওয়ামীলীগের সহযোগী থাকেনি।আন্দোলনে একাত্ম হন অন্যসব আন্দোলনরত দলসমুহের সাথে।
জামায়াত দীর্ঘ সময় রাজনীতি করছে। তারা কেন যেন এখনো গণমানুষের দলে পরিণত হতে পারেনি।জামায়াত এখনো আছে তাদের নেতাকর্মী সমর্থকদের দল হয়ে। এখন তাদের সামনে অসীম সম্ভাবনা জনগণের দল হওয়ার।প্রচুর সুযোগ।এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে গণমানুষের দল হতে পারলে জামায়াত বাংলাদেশের অপ্রতিরোধ্য দলে পরিণত হবে। এবং ইসলাম পন্থীরা যদি ঐক্যবদ্ধ হতে পারে তাহলে বাংলাদেশের রাজনীতি অন্য এক মেরুকরণে পৌছবে। আর যদি পিছিয়ে পড়ে তাহলে সমগ্র ইসলামপন্থীরা পৌছে যাবে খাদের কিনারে। তারা বিপদে পড়লে কেউ এগিয়ে আসবে না। এতে ইসলামপন্থী ও ডান বলয় অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। ৫ আগস্টের পরের রাজনীতি, তার পরের হিসাব নিকাশ যত সহজ মনে হয় তত সহজ নয়। হিসাব কষে সামনে এগুতে হবে। সময় সুযোগ কাজে লাগাতে ব্যর্থ হলেই নিক্ষিপ্ত হবে অন্ধকারের অতলে। এই হিসাব মনে প্রাণে করতে হবে ইসলামপন্থীদের।