…..
কাজী জহিরুল ইসলাম
…..
অনেকদিন থেকেই আমার পছন্দের তালিকায় আছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম ও তার কবিতা। বহুমাত্রিক লেখক এই কবি’র বিচরণ ক্ষেত্র একাধিক এবং বহুবর্ণিল ও বিচিত্র। তিনি একাধারে ভ্রমণকাহিনীকার, উপন্যাসিক, অনুবাদক, সম্পাদক, আলোচক, উপস্থাপক ইত্যাদি।
নিউইয়র্ক এর ব্যস্ততম জীবনে সাহিত্য জড়িয়ে আছে এই লেখকের সারা মন ও মননজুড়ে। সাহিত্যের জন্য যারা নিবেদিত হতে চান, অথবা যারা নিবেদিত, তাদের জন্য প্রেরণার উৎস হতে পারেন এই কবি। তবে, তার একজন সুহৃদ ও শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে আমার কামনা তিনি আরো একটু ধীরে অগ্রসর হলে, বা সাহিত্যে আরো গভীর অভিনিবেশ নিয়োগ করলেও তার ক্ষতি বা কমতি হবে না।
বর্তমান কালের কবিগণ যে, কবিতা ও গদ্যে সমান দক্ষ, এটি সুখকর। আনন্দের। ইতিমধ্যেই এই কবি’র গ্রন্থ সংখ্যা তিরিশ উত্তীর্ণ। সম্প্রতি বেরিয়েছে, কাব্যসমগ্র।
তার লেখা কয়েকটি সাম্প্রতিক কবিতা, পাঠকদের জন্য:
১.
স্কেচ
কয়েকটি ভয়ানক শব্দ খুব দ্রুত এঁকে ফেলি
লিখতে শুরু করি সময়, হাডসনের রূপালি ছোবল
রোজ সকালে টাইয়ের নটে একটি করে গল্প বেঁধে রাখি,
কোনো একদিন প্রজন্ম-সভায় ওদের পড়া যাবে।
একোরিয়ামে ক্ষতচিহ্নেরা সাঁতার কাটে রঙিন আলোর নিচে।
ব্যাকইয়ার্ডে টুপটাপ ঝরে পড়ছে শরৎ,
ওভেনে জল চড়িয়েছি শীত রান্না করবো বলে।
বাড়ির সামনে দিয়ে রোজ হেঁটে যায় দুঃস্বপ্নের এরোপ্লেন।
ম্যানহাটন, নিউ ইয়র্ক। ২৬ অক্টোবর ২০১৬।
২.
প্রতিবাদ লিখো
প্রতিবাদ লিখো হে কলম প্রিয়তমা
মুখোমুখি বসে প্রেমালাপ নয় আজ
সময়ের জাজ করবেনা জানি ক্ষমা
যদি না বাজাই কন্ঠে জোর-আওয়াজ।
মাংসের পিছ লুকিয়ে রেখেছে কাক
সারা পৃথিবী কি বন্ধ করেছে চোখ?
কেউতো গোপনে ঠিকই পেয়ে যায় ভাগ
সবখানে আছে মীরজাফরের লোক।
বাহাদুর শাহর কথা কি গিয়েছো ভুলে?
নিয়মের কী যে নির্মম বিভ্রাট
দেশদ্রোহিতার এক অজুহাত তুলে
শাস্তি কে পায়? ভারতের সম্রাট!
প্রতিবাদ লিখো হেকলম প্রিয়তমা
লিখে যাও তুমি ব্যাকরণহীন ভাষা
ভেবোনা কোথায় রয়েছে দাড়ি ও কমা
প্রতিবাদে হোক প্রতিটি পৃষ্ঠা ঠাসা।
ম্যানহাটন, নিউইয়র্ক। ২৪ অক্টোবর ২০১৬।
৩.
ষড়ঋতুর বোন
একটি নীল ফ্রক ভাসতে ভাসতে এসে ভিড়েছিল আমাদের ঘাটে, বর্ষায়
এর আগে আমাদের কোনো বোন ছিল না
শরতের উঠোন ঝরাপাতার নিয়ন্ত্রণে, ভেঙে পড়া দেয়ালের ফাঁকে অশুভ ঘাসের উঁকি
ঘাস কেন অশুভ মা?
নির্বংশ হবার ইঙ্গিত
একটা হু হু বাতাশ ওঠে বাঁশঝাড়ে। দুটো ডিম খসে পড়ে বকের বাসা থেকে।
উড়ে যায় ধবল বক কালো মেঘের ভেতরে।
একটি ওড়না, শুভ্র, উঠোনে ওড়ে খুব, খুব উত্তুরে বাতাশে,
এর আগে আমাদের কোনো বোন ছিল না।
মধুমঞ্জুরির ডালে বুলবুলির ঝুটি দেখে হেসে ওঠে বিকেল
আমরা লেপগুলো শুকিয়ে নিই শীত-রাত্রির জন্যে
শিমের সরু ডগাগুলো জড়াজড়ি করে লাফাতে থাকে কী ভীষণ, বাঁশের পলকা মাচায় উঠবে বলে-
ঝাড়ের যে মরা বাঁশটি মাঝখান থেকে ভেঙে পড়েছে
তার ওপর বসে একটি লাউয়া ঘুঘু তোলে করুন সুর
যা ধার নিয়ে এক অখ্যাত শিল্পী গাইতে শুরু করেন ‘কাল সাপে দংশে আমায়’
মেঠো-গোপাটে পা রেখে শিল্পী হেঁটে যান কোকিলের কাছে,
এভাবেই আমাদের বসন্ত আসে।
রেশমী চুড়ির রিনিক-ঝিনিক বাড়ির পেছনে, নাগেশ্বরের হলুদ পরাগ ছুঁয়েছে কোনো মায়াবী আঙুল,
আমাদের এখন একটি বোন আছে, বর্ষায় কুড়িয়ে পাওয়া।
কৃষচূড়ার ডালে বুলবুলি পাখি শুনিয়ে যায় প্রভাতফেরীর গান
আমরা হাঁটতে হাঁটতে পুকুরঘাটে যাই, কদম ফুল ছুঁড়ে নিশানা ঠিক করি রাজহাঁসের গ্রীবা
এরপর ঝড় ওঠে, আমাদের উঠোন ঢেকে যায় লাল লাল ফুলে,
এখন আমাদের আর কোনো বোন নেই।
ম্যানহাটন, নিউ ইয়র্ক। ১৮ অক্টোবর, ২০১৬
…..
এ কবি’র কবিতা পড়লে বোঝা যায়,শব্দ তার অনুগত। তিনি শব্দ নিয়ে সাবলীলভাবে খেলতে পারেন। শব্দকে তিনি শাসন করতে পারেন, ইচ্ছে মতো, স্বপ্নের সড়কে।
এখন শুধু দেখার পালা, তিনি কতদূর যান…
……
অনামিকা তাবাসসুম
…..
দেখতে-দেখতে একটি অবয়ব দাঁড়ায়া যায়, যেমন লেখতে-লেখতে একটি চেহারা বা ভাষ্য। কথা বা ভাষার গুণ এমন-ই। ভাষার শক্তিও মনে হয় এ রকম।
এ কালের কবি বা লেখকেরা কেউ-কেউ যাচ্ছেন জটিলতার দিকে। আবার কারো-কারো ঝোঁক বা প্রবণতা অথবা স্বতঃস্ফূর্ততা, সাবলীলতা, সিদ্ধতা, দক্ষতা, সহজতার দিকে।
এটি কেন হয়? সম্ভবত মানসতার প্রতিফলন এটি।
অনেকে সহজ বিষয় জটিল করে লিখছেন। আবার অন্যে, জটিল বিষয়কে উপস্থাপন করছেন, সহজতায়, প্রাঞ্জলতায়। দু’টি-ই সিদ্ধ। স্বীকৃত।
আবার কেউ-কেউ মায়াবী মাদকতায়!
যেমন, অনামিকা তাবাসসুম।
কবি অনামিকা তাবাসসুম এর কবিতা পড়লে আপনার মনে অজান্তেই মায়াবী দোলা লাগবে। মন ভরে যাবে, প্রশান্তিতে।
দেখে নিন, তার কয়েকটি কবিতা:
১.
জোছনা আবাস
গায়ে গতরে মেখে দুধেলসাদা মেঘের রঙ, নিঃশ্বাসে ঝরে চন্দ্ররোশনাই কাব্য কাব্য জল। রুপ দেখে তার চন্দ্রনাথ পাহাড় ও বাজারের সুগন্ধী লাগে তুচ্ছ থেকে অতিশয় তুচ্ছতর !
সে এক পড়শী নদী, বয়ে চলে রাত্রিদুপুর, বুকের মাঝে মোচড় দিয়ে, শব্দ করে ছলাৎ ছল !
আমি এক অন্ধ মাছ
ডানার ভেতরে পুষি অনাদিকালের ভ্রমণপ্রিয় ঢেউ
আমাকে টেনে নিলোনা কোন জোসনার ঘোরগ্রস্থ আবাস !
২.
রাতের রাস্তাগুলোর শরীরে অজস্র ভাঁজ। চাঁদপোড়া গন্ধ লেপ্টে গেছে চুলে চুলে। একটা হলুদ প্রজাপতি ছড়িয়ে দিচ্ছে বিমুগ্ধ উল্লাস।
আকাশটা যেনবা আজ ঝিকিমিকি নদী
আমাকে টগবগে সমুদ্র নয়, ডাকিছে ওই তোমার মায়াঘাস জন্মানো জংলা বুকের সন্মোহনী।
“এত আলো, এত রোদ, এত্ত এত্ত ফুলের কানাকানি
তুমি তো হতেই পারো বিভোর হাওয়া
আর আমি মেঘপরী। “
৩.
ওই যে আকাশটা ঘন কালচে, থইথই করছে নদীর জল, দুরের ঘাস ও ধানক্ষেত।
ওই যে রাস্তাটা এখনো আগলে রেখেছে কতিপয় উদ্দাম সবুজ।
এদিকে আমি আয়তনে বড় হতে থাকি। চোখের জানালায় মৌন বিকেলগুলো স্নেহে টুকটুক।
আমার ভেতরে বড় হতে থাকে শামুকভোর।
ছটফট করে কয়েকশত পাখি
অজস্র ফুলবনকে এবার আমি বৃন্দাবন নামে ডাকতেই পারি।
আমার বারান্দায় নেমে আসা মেঘগুলোর গায়ে তবু দুঃখ দুঃখ কুয়াশা।
সম্ভবত সেই কুয়াশার জন্য আশ্চর্য কিছু সোনালী মুহূর্ত আমি চাইতেই পারি।
হতে পারে সেটা তোমার ধনাত্বক চুম্বন। যার রক্তসঞ্চালনে থাকবেনা কোন নগর, আঙ্গুলে খলখল শব্দ করে হেসে উঠবেনা কোন ট্রিগার।
যে ঠোঁট আমন্ত্রণ জানাবেনা নরকের পুঁজি আর অর্থনীতিবিদ্যার নাগরিক পাঠ
সেই সব পুঁজিবাদের ঠোঁট নিয়ে যাক পতঙ্গবাহিনী। আমি একজোড়া মানবিক ঠোঁট এ জনপদে খুঁজে ফিরি।
সেই ঠোঁটের জন্য চিরটাকাল আমি প্রলুব্ধ হবো ! নিদ্রায় কাতর হলে জোর করে বলবো, কাকসন্ধ্যা নেমেছে ধরনীতলে। হরিণরোদ্র শিয়রে রেখে, এসো হে প্রিয়তর গগন আজ সেজেছে প্রণয় সাজে বিশ্বচরাচর উঠি্ছে যেন কিসের লাগি কাঁপি কাঁপি , এবার আমরা একসঙ্গে শায়িত আর নিদ্রিত হতেই পারি !
……
চিত্ররূপময়তায় পরিপূর্ণ অনামিকা তাবাসসুম এর কবিতা।
এই কবি’র সাম্প্রতিক কাব্যগ্রন্থ : “পৌরাণিক পাখি” ইতিমধ্যেই সুধী সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। নির্দ্বিধায় বলা যায়, এ কবি অনেকদূর যাবে।
…….
হাসনাত শোয়েব
..….
“জীবনানন্দ বাংলা কাব্যে সুররিয়ালিস্ট কবিতার প্রবর্তক বলা যেতে পারে”, বলেছেন দীপ্তি ত্রিপাঠি, ১৯৫৮ সালে।
আবার, জুলফিকার হায়দার ২০১৩ সালে তার এক রচনায় কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ এর কবিতার আলোচনা প্রসঙ্গে জানাচ্ছেন, “জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছের (১৯৬৭) মধ্য দিয়েই বাংলা কবিতায় পরাবাস্তবতার চর্চা শুরু”।
যাইহোক, সুররিয়ালিসম বলি আর পরাবাস্তবতা বলি, এ ধারার চর্চা বাংলা সাহিত্যে খুব একটা এগিয়েছে বা কেউ করেছেন বলে দেখা যায় না।
কেউ-কেউ বিচ্ছিন্নভাবে পরাবাস্তব বা সুররিয়ালিস্টিক কবিতা লেখার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু বেশী দূর যেতে পারেননি। সাহস ও শক্তিমত্তার অভাবে।
সেই দূরূহপথে পা বাড়িয়েছেন, এ প্রজন্মের কবি হাসনাত শোয়েব। লক্ষ্য করুন তার ” হলুদ ম্যাপল পাতারা” কবিতাটি!
এ যাবৎ তার যতটুকু কবিতা পড়েছি, তাতে তাকে সাবলীল বলে মনে হয়েছে। কিন্তু দুরূহ এ পথে তিনি কতদূর কীভাবে যাবেন, তা, তার কাব্যশক্তি ও সময় নির্ধারণ করে দিবে।
আমরা আপাতত তার কিছু কবিতা এঞ্জয় করি:
হাসনাত শোয়েব এর কবিতা :
ক্ষত – ৩
ঘাসের ভিতরে চ্যাপলিনকে লুকিয়ে রেখেছি বহুদিন। সেল্টা ভিগোর বিমান বন্দরে ভ্রমণকালীন বিরতিতে দেখা হয়ে যায় জীবনানন্দের সাথে। সেকি তুমুল আড্ডা! অথচ ঘাস এবং কুয়াশা ছাড়া জীবনানন্দের অন্যকোন শব্দের অর্থই চ্যাপলিন বুঝতে পারেনি। সে নিজে শুধু বলতে পেরেছিল উই লিভ ইন পোস্টমডার্ন টাইম। অতপর দীর্ঘ নীরবতা! নিঃসঙ্গ দেবদারুর গল্পটা জীবনানন্দ আর তুলতেই পারেনি। টেলিগ্রাফের তার বেয়ে নেমে আসা সন্ধ্যাটাই যখন পুরো সেল্টা ভিগো ছেয়ে যায় তখন দ্রুতগামী দুই বিপরীত ট্রামে দুজন উঠে পরে।
( ‘সূর্যাস্তগামী মাছ‘ থেকে)
২.
হলুদ ম্যাপল পাতারা
হলুদ ম্যাপল পাতারা আমাদের ভালোবাসা। বায়োলজির অধ্যাপকের কান থেকে ঝরে পড়ছে মাছের কেশর। ইতস্তত মাছ একা একা প্রাণ নিয়ে ছোটে। অতঃপর শুয়ে পড়ে মনোরম ম্যাপলের গায়ে। মাছের হৃদপিণ্ড ছিঁড়ে অধ্যাপক বের করে আনেন সোমবারের রোদ। উজ্জ্বল রোদে ম্যাপল পাতারা হাসে। বায়োলজির দুপুরে প্রেমিকার নাম মাছ। সে একা একা ছুটছে। সোমবারে ম্যাপল পাতারা আমাদের ভালোবাসা।
(প্রাগৈতিহাসিক স্টোর রুম থেকে)
৩.
বুলগেরিয়ার রাজধানীর নাম হয় সোফিয়া লরেন
বুলগেরিয়ার রাজধানীর নাম সোফিয়া জানার পর, আমার সোফিয়া লরেনের কথা মনে পড়ে। সোফিয়া লরেনের ডাক নাম টুথপিক। একদিন মাংস খাওয়ার পর দাঁত খিলান করার সময় মনে হয় সোফিয়া লরেনকে দিয়েই দাঁত খিলান করছি। এরপর থেকে প্রায় মাংস খেতাম সোফিয়া লরেনকে দিয়ে দাঁত খিলান করার লোভে। এভাবে পৃথিবীর বহু মাংসল প্রাণীকে হত্যা করা হলো।
তুমি বললা, এইসব আলাপন বড় মধুর। ঠিক যেমন, ‘নভেম্বর রেইন’ গানের মতো। নভেম্বর মাসে অখ্যাত রকস্টাররা যৌনতা বোধ করে। তারা একা একা নভেম্বর রেইন বাজিয়ে মাস্টারবেশন করে। আগুন সেদ্ধ করে পাতার বিড়ি বানায়। লালনের দোকানে ঘাসের চা বানিয়ে খায়। লালনের পুরো নাম লালন বাহাদুর। প্রতি বছর আঠার ডিসেম্বর সে আশুলিয়া গান করতে যায়। আমাদের ধারণা মতে সে সমকামী।
তুমি কেবলই অনুসিদ্ধান্ত দিতেছ! আমরা চাই ক্রিটিক্যাল আলোচনা। যেমন ধরো, জলবায়ু সম্মেলনের সাথে গৌতম বুদ্ধের সম্পর্ক কিংবা রকস্টার হওয়ার একশ একটা নিয়ম। আলোচনার শেষ পর্যায়ে থাকবে আন্তোনিও গ্রামসির রেড ফুটনোট। নিশ্চয় আমরা শীতকালে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে ভুট্টা খেতে ভালোবাসি।
না না। আকাশ অংশত গোলাপিও হতে পারে অথবা মেরুন। পৃথিবীর ডানায় থাকে অহংকারী পুরুষের ছায়া আর কুমারীদের বিবিধ কার্ভ। যদিও হেমন্তের শেষ তোমাদের দেশে বৃষ্টি হতে পারে। তবে অবশ্যই তোমরা থাকে বর্ষাকাল বলে ডাকতে পারবানা। তাহলে ছাতা ব্যবসায়ীরা বড়লোক এবং আইস্ক্রিম বিক্রেতারা ফতুর হয়ে যেতে পারে।
(ব্রায়ান এডামস ও মারমেইড বিষুৎবার‘ পাণ্ডুলিপি থেকে )
…..
এ কালের তরুণ কবিদের কবিতায় আখ্যান বা গল্প বলার ঢং বা স্টাইল লক্ষ করা যাচ্ছে। যা ইতিমধ্যে তাদেরকে জনপ্রিয় এবং পাঠকপ্রিয় করে তুলেছে।
হাসনাত শোয়েব এর কবিতাতেও গল্পবলার এই স্টাইল আছে। এবং সে তা ভালোমতোই রপ্ত করেছে বলে মনে হয়।
তার প্রকাশিতব্য কাব্যগ্রন্থ : “ব্রায়ান এডামস ও মারমেইড বিষ্যুৎবার” এর জন্য অগ্রিম শুভ কামনা রইলো।
……..
রেজাউল করিম রনি
……
এ প্রজন্মের সবচেয়ে সাহসী তরুণের নাম : রেজাউল করিম রনি। সাহসী এবং সৃষ্টিশীল। ভাবুক, বিশ্লেষক এবং কবি।
পুতুপুতু বা ন্যাকামো মার্কা উচ্চারণ বা শৌখিন সাহিত্য নয়, বলিষ্ঠ ও জীবনঘণিষ্ঠ উচ্চারণে ভরপুর তার লেখা : কবিতা ও গদ্য।
আমার, জানি না, কেন জানি, তাকে আমাদের কালের নজরুল ইসলাম বলে মনে হয়। নজরুল যদি বেঁচে থাকতেন, হয়তো আজো, এভাবে, রনি’র মতো তীব্র উচ্চারণে, ক্ষোভে, প্রতিবাদে ফেটে পরতেন।
সাম্প্রতিক বাংলাদেশের নষ্ট রাজনীতির অন্ধকার কিম্বা সাহিত্যিক ভণ্ডামী ও মেরুদণ্ডহীন সাহিত্যিকদের মুখে চপেটাঘাত মারতে আজ আমাদের দেশে শত-শত রেজাউল করিম রনি’র মতো লেখক-সাহিত্যিক-সাংবাদিক, সর্বোপরী, একজন মানুষ প্রয়োজন।
তার সাহসী কলমের জন্য, তাকে অভিনন্দন না জানিয়ে উপায় নেই।
লাল সালাম। হে বীর।
এবার তার কয়েকটি কবিতা পড়ে ফেলি:
১.
“সন্ত্রাসের দিনে নয় কোন বিরহী গান
শুধু শ্লোগান, শুধু শ্লোগান।
রক্তের খেলাই যদি নীতি হয়ে যায়, তবে প্রাণে প্রেমের তেজ নিয়া যেন ফিরে আসি
বকুল বনে বারুদের সুবাস ছড়িয়ে দিয়ে তোমাকে বলি, ভালোবাসি, ভালোবাসি।
সন্ত্রাসের দিনে নয় কোন বিরহী গান
শুধু শ্লোগান, শুধু শ্লোগান।
ভালোবেসে আকাশ ছুঁতে চাই না, আসো আমরাই আকাশ হয়ে দূরের কাশবনে মিশি
রিদয়ের সব বিষাদ কার্তিকের পাতলা কুয়াশায় ছড়িয়ে জানাই ভালোবাসি,ভালোবাসি।
সন্ত্রাসের দিনে নয় কোন বিরহী গান
শুধু শ্লোগান, শুধু শ্লোগান।”
( দ্র: “বিকল্প বাস্তবের প্রস্তাবণা” নামে একটা বড় কবিতার কয়েক লাইন। এর আগেও এর কিছু লাইন দেয়া হয়েছে। সামনে আরও দেওয়া হবে, এখন থেকে ফেসবুকে নাম্বার দিয়ে দিব। বাট পুরাটা মিলে একটাই কবিতা) ধন্যবাদ প্রিয় বন্ধুদের।
২.
নিজের দিকে ফিরে
শরীর ভরা জোয়ার নিয়া নদীর কাছে ফিরে দেখি–
আহত মৃদু ঢেউয়ের উপর দিয়ে প্রবাহমান বাতাসের সুরে
ভাসছে ভাষাতীত রিদয় তোলপাড় করা হাহাকার।
আমাদের মিথ্যার ভেতর আমরা যখন ক্ষয়ে যেতে থাকি–
পরম প্রেমময় কান্নার কাছে ফিরে খুন হতে চায় জিবন
পৃথিবীর সরলতার নিয়মে আজও হাসতেছে শিশুতোষ সকাল।
হারিয়ে অনেক কিছু বাস্তবের ভিড়ে
আমি নিজের দিকে দেখতে গিয়ে কেবল নিচের করুণ ঘাসের দিকে দেখি
ভাবি মিলায়ে যাবো ভয়হীন সহজ জিবনের লাজুক বাতাসের রিদয়ে
ক্ষমার ক্ষমতা ঘিরে আহত রিদয় নিয়ে যারা বেঁচে থাকার ভেতর এক মধুর কষ্ট আছে।
ফলে দুনিয়াতে কিছু কান্না ধরে রাখা গেলে দেখা যায় রিদয় জ্বলার রাতে জোছনায় ভাসা ঘাসের ডগার শিশির- আমাদের নিহত অনুভুতির চেয়ে আরও শীতল।
সব আশাবাদের বুলিতে আগুন লেগে জনতার জমায়েত ছত্রভঙ্গ হওয়ার পরে
বেওয়ারিশ জুতার মতো যদি পড়ে থাকি সম্ভবনাময় পথের বুকে
তবে বাস্তবের মিথ্যার ভেদ মুছে বুঝে নিও- প্রেম ও শরমের ভেতর আমি অবনত,
শ্রী চরণ যদি ছুয়ে যায় ঘাসের ডগার পানি-বিন্দু মনে রেখো–
আমার কান্নার কাল যৌবনের সমান বয়সী।
এই আহত প্রাণনে জেগে ওঠা গভীর প্রণয় নিয়া দূরে চলে যায় যদি জিবন
বাতাসে পাবে কি আগামীর স্বপ্নপোড়া ঘ্রাণ?
মানুষের আপন আপন তুচ্ছতার বাইরে নিজের দিকে তাকালে জাগে হাহাকার
এইসব বোবা বেদনার ভিতর নিজেরে দেখলে আপন আদলকে
শিশুর সুরত বলে চেনা যায়।
জীবনের জোয়ার আর মরণের মতো ভাটার ভয় নিয়ে তোমার কাছে ফিরে
হাহাকারকেই হাসি মনে হয় আর রিদয়ের ঘোরে
ফুলের দেমাগকে একটু আহত করে,
তোমার-আমার বিষাদ ভরা রিদয়ে
–চিরদিন খুঁজতে চাই কান্না ও হাসির গোপন সব ফোয়ারা।
১০/১০/১৬
৩.
যুদ্ধের জন্য কিছু মায়া
বকুল বনে হাইটা হাইটা ক্লান্ত জীবন অবশেষে পথে নেমে বারুদ গন্ধে চিনে নিচ্ছে
–এই সময়কে।
সব স্বপ্ন নিয়ে রিদয় পুড়ে গেলে
–বরফের দেশে বিচরণ করেও তুমি কি আর শান্তি পাবে?
লোভে প্রাণের প্রতিজ্ঞা মরার দিনে পুড়ে গেলে ফুলবাগান আগুনের চিকন ডগায় নাচে
–আগামীর স্বপ্ন।
মিথ্যারা সত্যের পোষাকে বিকট রিহার্সাল দেওয়া শুরু করলে অসহায় প্রেমিক দেখে
-ধর্ষকের নসিহতে নটী হয় রাজকুমারী।
ভাবনার ভিন্নতা ঘিরে স্বাস্থ্যবতী তর্কে অসুখ উদাম হয়ে স্বার্থ নষ্ট হয় শিয়ালপন্ডিতের
–মত ও পথের পার্থক্যের মাঝে এখন শুয়ে আছে লাশ।
মা ও মানুষের মধ্যে তফাত না জেনেও মানুষ মাকে ভালোবেসে মরে যেতে পারে
–তবুও জাতীয় চেতনার গর্ভ ভরে উঠছে নিটোল সন্ত্রাসে।
উন্নয়নের অভিশাপ আছে তবুও আলোর ভেতর এতো ছলনা নিয়ে তুমি খুশি হলে
-হায়েনার হাসিই প্রধান খবর হয় জনজীবনে।
ধ্বংসের দিনলিপি লেখার ভাগ্য নিয়া কে আর প্রিয়তমার মতো প্রিয় থাকতে চায়
–সত্য শত্রুকে পেলে যুদ্ধও নিজেকে নিজের কাছে নতুন করে চেনায়।
আমাদের প্রেম ভরা প্রাণ আহত হলে পারমানবিক জমানায়ও সাধনার সত্যকে পেতে
–সত্য যুদ্ধের জন্যও রিদয়ে কিছু মায়া থাকতে হয়।
ক্ষমতার আগুন খায় ফুলবতী জিবনের স্বাদ আর গোরস্তান হয় পৃথিবীর জীবন
–আজ প্রাণময়ী বারুদের সুবাসে পরম প্রেম তবে জাগুক।
৯/১০/১৬
…..
রেজাউল করিম রনি’র প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ : দাউ দাউ সুখ।
এ সুখ, ঘরে-ঘরে ছড়িয়ে পড়ুক।
…..
শামশাম তাজিল
……
এক সময় আমিও ছোট-ছোট কবিতা লিখতাম। এখনো লিখি। তবে কম। আসলে যখন যেভাবে আসে, সেভাবেই লিখিত হয়, নাজিল হয় কবিতা। এরপর, পরিবর্ধন, পরিমার্জন খুব একটা করি না, আমি। রেখে দেওয়ার চেষ্টা করি, অসম্পাদিত। অবিকল। আর কে কি করে আমি জানি না। জানার কথাও না। কারণ একেকজনের রুচি, চিন্তা ও স্টাইল, একেক রকম। কারো সঙ্গে কারো মেলে না। মিল নেই। দরকারও নেই। এটি-ই বৈচিত্র্য। এটি-ই সুন্দর। এমনটি-ই স্বাভাবিক।
ছোট কবিতা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে, আবেগের জোয়ারে কথাগুলি এসে গেলো।
এবার যার কবিতা প্রসঙ্গে এতো কথা, সেই কবি শামশাম তাজিল ও তার কবিতা নিয়ে কিছু বলা যাক।
শামশাম তাজিল এ সময়ের তরুণদের মধ্যে উজ্জ্বল প্রতিনিধি। তাকে “তরুণদের প্রতিনিধি” বলার কারণ এই যে, তার সমসাময়িক অন্যান্য তরুণ কবিদের প্রায় সব লক্ষণ তার কবিতায় বিদ্যমান।
এদের ভাষা ও প্রকাশভঙ্গী সহজ, কিন্তু বোধ ও ব্যাপ্তি গভীর। অনেক গভীর বিষয় ও চিন্তা, সহজ ভঙ্গীতে প্রকাশে এরা পারদর্শী।
এইসব তরুণদের আরেকটি জিনিস আমাকে প্রাণিত করে, তা হলো, সহমর্মিতা। একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা বোধ ও সন্মানপ্রদর্শন।
কবি আল মাহমুদ, আমাদের কবিতা, “নব্বইয়ের কবিতা : গোধূলীসন্ধির নৃত্য” আলোচনা করতে গিয়ে একদা বলেছিলেন, “কালের অক্ষর যারা রচনা করেন তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা থাকবেই। তবে গুপ্ত হত্যা বা নিম খুন না থাকুক এটাই আমাদের কাম্য।”
আমি এদের কার্যক্রমে এই আন্তরিক প্রতিযোগিতা পাই। নোঙরা আক্রমণ বা অযাচিত আক্রোশ এখন পর্যন্ত দেখিনি (কামনা করি কখনো যেন, দেখতে না হয়)।
এবার শামশাম তাজিল-এর কবিতা পড়া যাক :
১.
ব্যাকরণ
.
শোক আর সুখের পার্থক্য অল্পপ্রাণ আর মহাপ্রাণের।
এবং এই কথা সকলেরই জানা : শোকের চাইতে সুখে বাতাসের আধিক্য বেশিই থাকে।
_ বাকি সব জানেন মুনীর চৌধুরী
এক কালের শোক অন্য কালের উৎসব!
এতে উষ্মা প্রকাশের সুযোগ নাই
এও জানি, আমি যার পুত্র তার পিতা আমার ভাই।
২.
মূর্খতা
তোকে দেয়া প্রথম উপহার ছিল সর্প বিষয়ক একটা বই, কস্তুরি_
জানি ভয়ে উল্টেও দেখিস নি কোন পাতা,
দেখলে কুতূহলেও কিছু জিজ্ঞেস করতি।
কিন্তু ছোবল দিয়েছিস ঠিক। তাই তোর এমন নীরবতা?
মেঘ করে এলেও দিন ডাকে না, নামে না বিষ ফলে_
মুদ্রার রহস্য ছেড়ে তুই মেতেছিস কিসের কোলাহলে
জানা হল না!
৩.
পথ
রাস্তাটাকে পকেটে পুরে নেয়ার সঙ্গেই
পথচলার ক্লান্তি কেটে গেলেও বিপত্তি
ঘটে দুই জায়গায়
প্রথমত, এক বাচাল এসে কথা বলতো
কানের কাছে অবিরাম
যদিও কণ্ঠই শুনেছি কেবল
ওর কথোপকথনে জীবন হয়ে উঠেছিলো জেরবার, যে ভাষায় কথা বলতো তার বিন্দু-বিসর্গ জানা ছিলো না
_এই সান্ত্বনা নিয়েই দিন কাটছিলো
কিন্তু সকল জ্যোতিষশাস্ত্রকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ঘটলো আরেক বিপত্তি
ঘামের গন্ধ আর কলারের ময়লা পরিস্কার করার নিমিত্তে ছোট বোনটি শার্ট ধুতে গিয়ে দেখলো পকেট থেকে বের হয়ে যাচ্ছে অজস্র কবুতর, যাদের মুখে ছিলো তাজা রক্তের দাগ
সে ভয়ে শার্টটা পানিতে ফেলে আসলেও কবুতরগুলো ফিরে এসেছে ঘরে
এখন বোনই ওগুলোর দেখাশোনা করেছে
আর আমি নিজে পথ হারিয়ে পুকুরের জলে অন্বেষণ করে যাচ্ছি রাস্তা
বাবা স্পষ্ট বলে দিয়েছেন রাস্তা খোঁজে না পাওয়া পর্যন্ত আমার মৎস্যাহার নিষিদ্ধ,
সে নিয়ে যদিও আমি ভাবিত নই
ঘরের আর কেউ না জানলেও আমি জানি কবুতররূপী প্রাণীগুলো আসলে এক একটা রাক্ষস
কিন্তু সেই কথা কি করে আমি আমার বোনকে বুঝাই!
…..
তরুণ এই কবি’র সাম্প্রতিক কাব্যগ্রন্থ “আদম পাহাড় “। প্রকাশ করেছে দেশের খ্যাতনামা প্রকাশক রাজীব চৌধুরী, তার, চৈতন্য, থেকে। বইটির বহুল প্রচার কামনা করছি, কবি ও কবিতার ভবিষ্যতের স্বার্থে।
……
শাহীন খন্দকার
…..
আশি’র কবিতা প্রসঙ্গে, এক আলোচনায় (নব্বইয়ের কবিতা : গোধূলীসন্ধির নৃত্য), মহাকবি আল মাহমুদ প্রসঙ্গক্রমে বলেছিলেন : “কিন্তু স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে তারা কোথাও কিছু লিখেছিলেন, অন্তত: ‘ গণতন্ত্র মুক্তি পাক, স্বৈরাচার নিপাত যাক ‘ -এধরনের স্লোগানও লিখেছেন, তাদের বই থেকে এর কোন দৃষ্টান্ত পেশ করা যাবে না।”
এর পরবর্তীকালিন কবিতা ও কবিদের প্রসঙ্গেও এই অভিযোগ বা অনুযোগ কম-বেশী খাটে বা প্রযোজ্য। দু’একটি ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। সেটি বাদে।
তবে কি একালের কবিগণ রাজনীতি সচেতন নন? কিম্বা রাজনীতি বিমুখ? না-কি তাদের গায়ে গণ্ডারের মতো এমন কোন চামড়া সাঁটানো, যে তাদের আঁচ লাগে না! মুখ বা কলম বন্ধ? বন্ধ্যা? না কি তারা কোন এক বিশেষ দলের কাছে বিবেক বিক্রি করেছেন? অথবা বন্ধক রেখেছেন? না-কি ভীত-সন্ত্রস্ত?
কিন্তু কবি-সাহিত্যিক অর্থাৎ সচেতন অগ্রসর মানুষ, যারা, এরা তো জাতির বিবেক। এদের মুখ কথা বলবে। নিদেন পক্ষে কলম। নয়তো অন্তর জানাবে ঘৃণা। শেষ অস্ত্র তো এটি-ই।
সেখানে তো আর ফ্যাসিবাদী, স্বৈরিণী ৫৭ নাই? না-কি আছে? কে জানে!
প্রতিবাদ প্রসঙ্গে এতো কথার অবতারণা।
এর মধ্যেও যারা বিবেক বন্ধ বা বন্ধক না রেখে সাহসের সঙ্গে শিল্পীত উচ্চারণে কবিতায় প্রতিবাদ জারি রেখেছেন, কবি শাহীন খন্দকার তাদের মধ্যে অন্যতম সাহসী এবং শক্তিমান শুদ্ধস্বর।
এখানে উদ্ধৃত তার প্রথম কবিতা ‘রোড ম্যাপ” এ শুরুতে অগ্রজ কবি নয়ন আহমেদ এর প্রভাব লক্ষ্য করা গেলেও পরের দিকে তার নিজস্ব স্বতন্ত্র স্বর আমাদের চিনে নিতে অসুবিধা হয় না।
একালে যে ক’জন তরুণ কবি সম্ভাবনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন, কবি শাহীন খন্দকার তাদের প্রথম কাতারের একজন।
এখন তার শুধু প্রয়োজন আরো সচল হওয়া। নিরন্তর নিজেকে, নিজেদের, তুলে ধরা। হতে পারে তা লিটলম্যাগাজিন, কোন পত্র-পত্রিকা। আর, ফেসবুক তো আছেই। আর প্রয়োজন বই। যা নিজের অবস্থান তৈরীর জন্য জরুরী।
আমি চাইবো, এই কবি’র একটি বই দ্রুত বাজারে আসুক।
আসুন, এ বিরতিতে পড়ি তার কিছু কবিতা।
..…
শাহীন খন্দকার-এর কবিতা:
রোডম্যাপ
বধুর ওষ্ঠের মতো লোভ নিয়ে সূর্যাস্তে আছি
আমি জানি এভাবেই প্রতীক্ষা করতে হয়…
সভ্যতাকে সভ্য পোশাকে চিনবো বলে
বাজার থেকে কিনে আনি প্রথম সূর্যের মতো জামদানী সুতো
পাইজাম চালের মতো ফুরফুরে সুঁচে সেলাই চলুক…
একটা পোশাক তৈরি হবে মানবিক!
যার হাত হবে খোরাসানের… সেলাই চলুক।
গলা হবে গাজা কিংবা নাজাফের… সেলাই চলুক।
সিনা হবে রামাল্লার… সেলাই চলুক।
আমি এ পোশাক পড়েই হবো জাতিসংঘের মহাসচিব।
তারপর আমি হেটে যাবো সাবসাহারার দুই লক্ষ কুড়ি হাজার নরকঙ্কাল পায়ে মাড়িয়ে দেবদূতের মতো আমার হাতে থাকবে লোভনীয় রুটির গন্ধ। মেঘের দঙ্গল থাকবে চোখের মোড়কে। তারপর- আমি হেটে যাবো মায়ের মুখের মতো রূপকথা নিয়ে আল-আকসার মহাবিহ্বল প্রান্তরে। সেখানে প্রণয়ের গজল রোপন করে সিত্তুই আর কিরকুকের মহাহিংসা আমি মুখস্থ করতে থাকবো। আমি মুখস্থ করতে থাকবো আমার পিতার হিস্যার দলিল। সবুজ জরায়ুর আয়ুগুলো, বিপর্যস্ত রক্ত-মাংশের ভূমিগুলো আমি মুখস্থ করতে থাকবো। আমি মুখস্থ করতে থাকবো নিপীড়িত আগুনের বিদ্যা। তারপর …
একটা পোশাক তৈরি হবে আনবিক!
যার হাত হবে হোয়াইট হাউসের… সেলাই চলুক।
গলা হবে ব্রিটেনের… সেলাই চলুক।
সিনা হবে তেলআবিবের… সেলাই চলুক।
আমি সে পোশাক না পড়েই হবো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সৈনিক।
জেনে রেখো আজীবন বিক্ষুব্ধ কবিই একদিন ট্রিগার টেনে দেবে।
২.
সভ্যতা
চার.
আমার টিশার্টে একটি ছোট্ট ফুটো ছিল ।
অতি ব্যবহারে দিন দিন ফুটোটা বড় হচ্ছে ।
আর চুরি হয়ে যাচ্ছে কারিগরের যাবতীয় প্রজ্ঞা ।
আমি জানি টিশার্টটি এভাবেই একদিন ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়বে…
৩.
এই পতনে যারা যারা খুশি ছিল আগে তারাও জানতো বপনপদ্ধতি। মিছিল জানতো। শ্লোগান জানতো। পতাকা জানতো। তখন কীভাবে একটি দেহকে টুকরো টুকরো করে মানচিত্র বানানো হতো, সেটা তারা রপ্ত করেছিল। তাই তারা কখনোই মরতো না। শহীদ হতো।
কিন্তু একই রকমের দুর্ঘটনায় ইতোঃপূর্বে যারা যারা শহীদ হয়েছিল, ফিরে এসে তারা প্রতিবাদ করতে ভুলে গেছে।
যাকে যাকে বলতে শুনেছিলাম ‘ভাত দে হারামজাদা, নইলে মানচিত্র খাবো’ তারা আজ একচক্ষু মিডিয়ায় মানচিত্র বিক্রি করে ভাত খায়।
ভাত খা হারামজাদা, বিবেক বিক্রি করে খা।
…..
কবিতা তো জীবনের অপর নাম। জীবন-ই উচ্চারিত হয় প্রকৃত কবিতায়।
কবি শাহীন খন্দকার জীবনের জন্যই কবিতা লিখেন। লিখেন জীবন নিয়ে। জীবন থেকে। এ ধরণের কবি ও কবিতার মৃত্যু নেই।
মানবিকতার উচ্চারণে ভরপুর তার কবিতা। এমন কবিতা, কথা বলবে, যুগ-যুগ ধরে।
……
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ
…..
আমরা তখন বুঁদ হয়ে আছি কবিতায়, লিটলম্যাগাজিনে। ঢাকাসহ দেশের আনাচে-কানাচে থেকে কিছুদিন পরপর প্রকাশিত হচ্ছে, বিভিন্ন ধরনের লিটলম্যাগাজিন ও সাহিত্যপত্রিকা। চট্টগ্রাম, বগুড়া, বরিশাল, কুমিল্লা, ঠাঁকুরগাঁ, সারা দেশ থেকে। সে এক বর্ণালী জোয়ার।
ঢাকা থেকে কবি-অধ্যাপক খোন্দকার আশরাফ হোসেন-এর সম্পাদনায় প্রকাশিত “একবিংশ” ছিলো প্রথম সারির সেরকম একটি পত্রিকা। এই পত্রিকাতেই আমাদের কিঞ্চিত অগ্রজ কবিগণ লিখতেন। যাদের মধ্যে বায়তুল্লাহ কাদেরী, আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ, দাউদ আল হাফিজ প্রমুখ এর নাম মনে পড়ছে।
এখানেই সম্ভবত প্রথম পড়ি কবি আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ’র কবিতা।
বর্তমানে তিনি অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী। কবি খোন্দকার আশরাফ হোসেন, লোকান্তরিত। নেই তার “একবিংশ”ও। কিন্তু আছে সে সময়ের উজ্জ্বল নক্ষত্র কবিসকল। আর আছেন, আমার প্রিয় কবি আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ।
ইদানীং ফেসবুকের বদৌলতে তার চমৎকার সব কবিতা আমার মন ভরিয়ে দেয়।
আসুন, পড়া যাক, তার ভিন্ন স্বাদের কিছু মিস্টিক কবিতা:
১
গানের আসরে
ঘুর্ণ্যমান বায়ুপৃষ্ঠে তোমার কথা পাচ্ছি।
এতো সুর তারান্নুম- এতো জলবিছানো
সিম্ফনি সোনাটা
গ্রহ অণু-গ্রহ সমুদ্র করে তুলছে।
উড়ন্ত শরীর আমার- কোনো মাধ্যাকর্ষণই পাচ্ছি না
হালকা পালকের স্মৃতিগুচ্ছ জাগছে মাথার গুগোলে।
ভীড়ের মধ্যে তোমার ঠোঁট নড়ে
পুতুলখেলার মাইম… ঝি টিকা ঝি … ডিজে …রিডু
উড়ে আসছে পুচ্ছে লুকানো কার হারানো চাবি।
একটু একটু করে আলগা হচ্ছে বন্ধুর মুখ
বদ্ধ ভীড়ের হামলা। আরো কিছু ছায়া আরো কিছু
উড়ে চলা গাছ- পা ছড়িয়ে দিচ্ছে ম্যামথ ভূপৃষ্ঠের ওপর।
আমি তাদের কী নামে ডাকি- কী নাম দিই
এই বিহ্বল মায়া-স্রোতার!
২.
অস্ট্রেলিয়া ১
বাংলা বলে জীবনানন্দ আত্মহত্যা করে
আর বিনয় মজুমদার পাগল হয়ে যায়!
এই কথা ভেবে কবে— এই নিরাপদ দূরত্বে থাকি
কথায় কথায় ইংরেজি বলি— সাইকেল ছেড়ে গাড়িতে
হাইওয়ে পেট্রলে নামি।
আর মোশন নিতে নিতে ভাবি— দূরের
জাহাজগুলি শরীরে
কোন দেশের মায়াবীজ লাগায়!
সী-বীচে সন্ধ্যা আসে। লাল পালকের কাঁকড়াগুলি
তাকিয়ে থাকে— বৃটিশদের বংশধর জন আর জেনিফারের হারেমে।
জোয়ান গাভীর মতো মেয়েগুলির নাসপাতি কত মনোহর
পাগল বা আত্মহত্যার ঝুঁকি নেই বীচপাপোশে!
রবিবারে যার লম্বাছায়া— গাম ট্রির মাথায় উড়তে দেখা যায়
সে তো বন্ধু- সুব্রত। তার হাতে ঝুলে শান্ত কফির পেয়ালা।
খয়েরি শাদা এই নেশাভান্ড- ঘুম তাড়িয়ে নিয়ে যায়
বিকালের কোন ডাকাত রেস্তোরাঁয়!
আমরা কবিতা হারিয়েছি সোনালি চুলের ড্রাগনে।
২০১২
৩.
হে খোদা হে দয়াময়
তোমার অনেকগুলি নিয়ামতের মধ্যে খোদা
তুমি জানো আমি কবিতা লিখি
আমার ভাব জাগে দিনে রাতে
কাজে আর অবসরে ঘুমে নির্ঘুমে
এই বাঁশপাতা এই শিয়াকুল প্যাপিরাসে
কথার ময়ূর ফলাই
অক্ষরে অক্ষরে চাঁদের নৌকা চড়াই।
আবার দশটা পাঁচটা মানুষের মতো কাজ করি
কারণ আমার বালবাচ্চারা রুটি চায় দুধ চায়
তাদের বইখাতা কিনি ঔষধপত্র কিনি
মাঝে মাঝে সিনেমা আর মেলায় নিয়া যাই।
কিন্তু সমস্যা হইল খোদা
মাঝে মধ্যে আমি ধীরে ধীরে আর বাবা থাকি না
আমার পিঠে ঘাস ওঠে আমার আঙুল থেকে ফল ঝরে
সুলেমানি তরবারি বাঁশি হয়ে যায় আমার চোখে।
আমি আগুনের মধ্যে হাত রাখি- গোলাপ গোলাপ করি
আমি গন্ধ পাই আঙুর বাগানের- আমি ভাই সাজি
সোনার রেশমের অই আশ্চর্য খরগোশের।
তোমার অনেকগুলি নিয়ামতের মধ্যে খোদা
আমার এই ভাব এই কবিতাকে তুমি কীভাবে বিচার করবা?
আর তাকে কীভাবে সাজা দিবা?
আমার এইগুলি কি নামাজ নয়? এইগুলি কি এহতেকাফ নয়?
আমি কি তোমাকে ডাকি না ভোরে যখন কাক ডাকে বটগাছে
আমি কি থরো থরো কেঁপে উঠি না তোমার
বাণীর মর্মসুরে। আমি কি কেঁদে উঠিনা
যখন আমার ছোট্ট মেয়েটি তাসবিহ গুনে গুনে
তার বাবার হায়াত বাড়ানোর দোয়া করে!
তাহলে কীরকম দোযখ রাখবা আমার কবিতার জন্য?
…
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ, তার নিজের কবিতা প্রসঙ্গে বলেন:
সেই নব্বই দশক থেকেই, আমার কবিতা পড়ে অনেক পাঠক (এমন কি আমার সমসাময়িক কবিরাও) অভিযোগ করে আসছেন যে তারা আমার কবিতা ধরতে পারেন না। কারণ হিসাবে তারা বলেন আমার কবিতা কয়েক স্তরে সাজানো থাকে। মানে সরাসরি কোনো বক্তব্য থাকে না, যা বলার লুকিয়ে বলি। অজানা অচেনা, গহীন ইমেজেরি ব্যবহার করে কবিতাকে রহস্যে ঢেকে দিই। আর এক দল আছেন আমার কবিতাকে পরাবাস্তব কবিতা বলেন। বলেন আমার কবিতা বাস্তবতার বাইরে আর এক অধিবাস্তবতা দিয়ে লেখা। ফলত অতি দূরের। বারবার পড়া লাগে। তারা অবশ্য বলেন আমার কবিতা না বুঝতে পারলেও তাদের বেশ ভালো লাগে। এ ভালো লাগা বর্ণনা দেয়া যায় না। এটি ঠিক যে আমি আমার সমসাময়িক অনেকের মতো মিষ্টি, সরল, প্রেম ভালোবাসা, কষ্ট,বিষণ্নতা, ছন্দের তালে তালে দোলায়িত কবিতা লিখিনি। এমন না যে আমি ইচ্ছা করেই লিখিনি। এটি আমার কাব্যরুচি, কবিতার স্বভাব নয়।তাই লিখিনি। আমার কবিতা এভাবেই হাজির হয় আমার মতো সব কবিতা। এসব রহস্য, আলো-অন্ধকার, অধিবাস্তবতা, অচেনা অজানা ইমেজারি নিয়েই যারা আমার কবিতা ভালোবাসেন, আমার বই কিনেন তাদেরকে জানাই শুভেচ্ছা।
…..
তার কবিতা পড়ে নির্দ্বিধায় বলা যায় না-কি, তিনি আমাদের কালের একজন প্রধান কবিকণ্ঠ?
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ’র সাম্প্রতিক প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ সমূহ : ১. ক্রমশ আপেল পাতা বেয়ে ২. সিজদা ও অন্যান্য ইসরা।
প্রকাশক, বনেদী প্রকাশন : চৈতন্য।