spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদতরজমামাহমুদ দারবিশের কবিতা

অনুবাদ : মুহম্মদ মতিউল্লাহ্

মাহমুদ দারবিশের কবিতা


অনুবাদ : মুহম্মদ মতিউল্লাহ্

১.
শরৎঋতুকে ভালোবাসার অধিকার আমাদের আছে
…………………..

শরৎঋতুকে ভালোবাসার অধিকার আমাদেরও আছে
এবং প্রশ্ন তোলার, নতুন শরতের জন্য একটুও কি আমাদের জায়গা নেই
আমরা কয়লার মতো শুয়ে যেতে পারি?
শরৎ সোনালি পাতা ঝরার দিকে এগিয়ে যায়… আমরা যদি ডুমুরের পাতাও হতাম,
এমনকি পরিত্যক্ত লতাগুল্মের পাতা —
মরশুম পরিবর্তনের উৎসবে যেতে পারতাম।
আমরা যদি শিকড়ের দেশকে বিদায় না বলতাম এবং ছুরির ডগার সামনে পিতৃপুরুষের পালিয়ে যাওয়ায় প্রশ্ন তুলতাম
কবিতা এবং ঈশ্বর আমাদের করুণা কর!
সুন্দরী রমনী নিয়ে রাত্রি যাপনের অধিকার আমাদেরও আছে।
কিন্তু সময় এত সংক্ষিপ্ত,
কম্পাসের কাঁটা উত্তরে যেতে না যেতেই
দুজন অপরিচিতের সংলাপের রাত্রি
ছোট হয়ে আসে।
শরৎকাল।
আমাদের অধিকার আছে শরতের সুগন্ধ নেওয়ার,
রাত্রিস্বপ্নে বিভোর হওয়ার।
কিন্তু স্বপ্নচারীর মতোই খোয়াব অসুখে আছে।
শরৎ… শরৎ…
গিলোটিনে কি নবজাতকের জন্ম হতে পারে?
আমাদের পছন্দ মতো মৃত্যুর অধিকার থাক।
উন্মুক্ত প্রিয় ভূমি সবুজ গমের শিষে ছেয়ে যাক।
অনুবাদ: মুহম্মদ মতিউল্লাহ্

২.
যেখান থেকে আমি এসেছি
………………………….

আমি যেখান থেকে এসেছি সেখানে আমার অনেক স্মৃতি আছে, মর-মানুষের যেমন থাকে:
আমার মা আছে
অনেক জানালা ঘেরা একটি বাড়ি
আমার ভাইবন্ধু এবং একটি হিমশীতল জেলখানা;
আমার আছে সমুদ্রচিল বেষ্টিত ঢেউ
আমার নিজস্ব দেখার পৃথিবী,নিবিড় ঘাসের ফলক
শব্দের নিস্তব্ধতা ছোঁয়া চাঁদ, মরমি পাখি
এবং সঞ্জীবিত জলপাই গাছ।
আমি ছুরির ডগায় হেঁটেছি এদেশে
সজীব শরীরের ভারাক্রান্তি চিনে চিনে
আমি এসেছি ওখান থেকে।
আমি অনূদিত আকাশকে রেখেছি মায়ের কাছে
আকাশ যখন কান্নাকাটি করে
আমার কান্না রেখে দিই ঘরেফেরা সেই মেঘেদের কাছে।
সমস্ত ভাষা আমি অর্জন করেছি রক্তাক্ত মাটিতে
যাতে আমি আইন ভাঙতে পারি..
আমি সমস্ত শব্দাবলি শিখে এবং তাকে ছিন্নভিন্ন করে
একটি মাত্র শব্দ জেনেছি, ‘জন্মভূমি’।

৩.
প্যালেস্টাইন
………………

এ দেশ আমাদের দিয়েছে বেঁচে থাকার সমূহ সামর্থ্য
এপ্রিলের রক্তিম দিন ভোরবেলার রুটির সুগন্ধ
বয়স্ক মহিলার যাবতীয় তিরস্কার
এসকাইলাসের কবিতা,
প্রেমের থরথর প্রথম প্রহর,
পাথরের গায়ে জমে থাকা শ্যাওলা
প্রয়োজনের সুরে সুরে মায়েদের ছোটাছুটি
এবং আক্রমণকারী শক্তির ভয়ার্ত স্মৃতি।
এদেশ বাঁচতে শিখিয়েছে আমাদের
সেপ্টেম্বরের কাঁচাসবুজ ঝরে পড়া দিন
চল্লিশোর্ধ মহিলার খুবানি উৎসব,
একঝাঁক পতঙ্গের মত মেঘ,
আমার বিলুপ্ত অস্তিত্বের বুক পেতে দেওয়া
করতালি হাসি
এবং সৃজনশীল গানেগানে স্বৈরাচারীর ভয়।
এদেশ আমাদের দিয়েছে বাঁচার সমূহ সামর্থ্য
প্রিয় নারী— সমস্ত সূচনা-শেষের মাতৃমুখ
তুমি ছিলে প্রিয় প্যালেস্টাইন
তুমি আছো প্রিয় প্যালেস্টাইন
প্রিয় নারী— প্রিয় নারী মা আমার
আমার বেঁচে থাকার যাবতীয় অধিকার।

৪.
একটি মানুষ এবং হরিণশিশু একসঙ্গে বাগানে খেলা করে
…………………….

একটি মানুষ এবং একটি হরিণ শিশু একসঙ্গে বাগানে খেলা করে…
আমি আমার বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করলাম, কোথা থেকে এলো এই শিশু?
সে বলল, ‘স্বর্গ থেকে—মনে হয় প্রফেট জন আমার একাকিত্বের কাছে ফিরে এসেছে। আমি তার সান্নিধ্যে ধন্য। তার পরিচর্যা করার জন্য মা নেই, সুতরাং আমি তার মা হলাম, আমি তাকে সুগন্ধী মধুর সঙ্গে ছাগের দুধ খাওয়ায়। এবং তাকে ওক বনে প্রেমিকা মেঘের মতো নিয়ে যায়।’
আমি বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করি, সে তোমার মুখর বাড়িতে অভ্যস্ত হতে পেরেছে? গৃহস্থালির সঙ্গে?
আমার বন্ধু জানায়, ‘সে অসুস্থ অবস্থায় আমার বিছানাতেই শুয়ে আছে, আমিও অসুস্থ হয়ে…
ও নিঃসহায় শিশু, আমিই ওর বাবা, আমিই মা।
ওঠ এবং উঠে আমাকে শান্তি দাও।’
এক মাস পর আমি আমার বন্ধুর গ্রামের বাড়ি গেলাম। দেখি, তার কথার সঙ্গে কান্না জড়িয়ে আসছে। নিরাবেগ সলোমন যেন প্রথম কেঁদে উঠে আমাকে থরথর গলায় বলল, ‘হরিণ-হরিণীর এই শিশু আমার কোলেই মারা গেছে। সে গৃহজীবনে অভ্যস্ত হতে পারেনি। কিন্তু তার মৃত্যু তোমার আমার মত সাধারণ মৃত্যু নয়।’ সে সাদা হরিণের সমাধির কাছে গেল এবং হাত দিয়ে বালি জড়ো করে কাঁদতে কাঁদতে সে বলে চলে,’জাগো বৎস, তাহলে তোমার বাবা তোমার বিছানায় ঘুমাবে—
আমি জানি একমাত্র সেখানেই শান্তি।’
সে হরিণ শিশুর সমাধিতে ঘুমিয়ে পড়ল।
ওখানে আমার ছোট্ট এক টুকরো স্মৃতি রেখে গেলাম—
একটি মানুষ এবং একটি হরিণশিশু একসঙ্গে বাগানে ঘুমিয়ে আছে।

৫.
কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চেয়োনা
………………..

কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চেয়ো না— আমি সংগোপনে বললাম আমার অন্য আমিকে :
তোমার সমস্ত স্মৃতি জাগরুক—
বিড়ালের তন্দ্রা জড়িত দুপুরের অবসাদ,
মোরগের ঝুঁটি
জ্ঞানী মানুষের সুগন্ধী
মায়ের হাতের কফি
গদি-বিছানা-বালিশ
ঘরের লোহার দরজা
সক্রেটিসের চারপাশে মাছির গুঞ্জন
প্লেটোর মাথার উপরে বজ্রগর্ভ মেঘ
দিওয়ান আল হামাসা১ সংবেদী কবিতার বই
বাবার ফটোগ্রাফি
মুয়জাম আল বুলদান২
শেক্সপিয়র
তোমার তিন ভাই বোন
তোমার শৈশবের বন্ধুরা …
‘এই কি সে?’
সাক্ষীরা একমত হতে পারল না:
‘হয়তো’
‘হতে পারে’
তাহলে কে সে? আমি জিজ্ঞাসা করি
কোন উত্তর আসে না।
ফিসফিস করে অন্য আমিকে বলি
‘তুমিই কি সে? সেই কি আমি?’
সে অন্যদিকে চেয়ে থাকে।
সাক্ষীরা নিশ্চিত হতে এবার মায়ের দিকে তাকায়
মা তখন নিজেই নিরুপম সুরে গেয়ে ওঠেন:
আমি তাকে জন্ম দিয়েছি
কিন্তু এই প্রবহমান বাতাস তাকে প্রতিপালন করেছে।
আমি আমার অন্য আমিকে বললাম:
‘মা ছাড়া কারো কাছে কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চেয়ো না।’
………………………..

১. নবম শতাব্দীতে আবু তাম্মাম সংকলিত আরবি কবিতার সংকলন
২. ঐতিহাসিক এবং ভূগোলবিদ ইয়াকুত ইবনে আবদুল্লা-র লেখা ইতিহাস ভূগোল বিষয়ক গ্রন্থ; যেখানে প্রতিটি স্থানের ঐতিহাসিক প্রাকৃতিক এবং জাতিতাত্ত্বিক বিবরণ পাওয়া যায়।

৬.
দেশের কবিতা
………………….

একটি অবহেলিত গ্রামের বিবর্ণ সন্ধ্যা
আধবোজা ঘুমন্ত দুই চোখ
মনে করতে পারি তিরিশটি বছর
পাঁচটি যুদ্ধ
আমি সাক্ষী, সময় আমাকে গোপন রেখেছে।
গমের মসৃন দানা— ফসলের স্বাদ
গায়ক গুনগুন করে গান গাইছে
আগুন আর আগন্তুক নিয়ে—
সন্ধ্যা নিবিড় সেই সন্ধ্যা…
গায়ক গায়ছিল তার গান।
ওরা জিজ্ঞাসা করে
কেন গান গাইছো তুমি?
সে তাদের জানায় সে গান গায় বলে
তাকে ওরা আটক করেছে।
ওরা তার বুকের ভেতরটা খুঁজে চলে:
ওরা তার বুকের ভেতর খোঁজে
সেখানে দেখতে পায় একটি হৃদয়
এবং তারা যখন হৃদয়ের সন্ধান করে
তারা সেখানে দেখতে পায় মানুষের মুখ।
এবং তারা যখন ওর কণ্ঠস্বর খোঁজে
দেখতে পায় শুধুই শোক।
যখন তারা শোক খুঁজতে যায়
তারা শোকের ভেতর দেখে একটি কারাগার
যখন তারা খুঁজতে যায় কারাগার
দেখে,আসলে নিজেরা সবাই তারা শৃংখলিত।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on কবিতার স্ফুলিঙ্গ, স্ফুলিঙ্গের কবিতা