ইমরুল হাসান
ক.
যে কোন ন্যারেটিভ চালু আছে বইলাই সেইটা ভুল না, কিন্তু সেই ন্যারেটিভগুলারে সবসময় আমাদের যাচাই কইরা দেখা দরকার।
১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বরের ঘটনা’টা যেইরকম, বলা হয়, পাকিস্তানি আর্মি’রা বাংলাদেশের সমাজে পরিচিত পেশাজীবী ও ইম্পর্টেন্ট মানুশ-জনরে খুন করছিল। তো, এই মানুশেরা খুন হইছেন — ফ্যাক্ট হিসাবে এইটা নিয়া কোশ্চেন করার বা সন্দেহ করার তো কিছু নাই। এইটা ঘটছে, খুন করা হইছে উনাদেরকে।
কিন্তু কেন খুন করা হইছে? বলা হয়, বাংলাদেশ যাতে একটা দেশ হিসাবে চিন্তা-ভাবনার দিক দিয়া দাঁড়াইতে না পারে এই কারণে যারা পাকিস্তানের পক্ষের লোকজন তারা এই খুনগুলা করাইছেন। এইটা যতোটা না ফ্যাক্ট তার চাইতে অনেকবেশি একটা ন্যারেটিভ। এই ন্যারেটিভ’টারে বিচার কইরা দেখা দরকার আমাদের।
এই ন্যারেটিভ’টারে ঠিক বইলা দাবি করার পয়েন্ট’টা হইতেছে, যারা উনাদেরকে ডাইকা নিছিল, তারা ছিল “আল-বদর” নামে একটা দলের লোক। কিন্তু এইটা সবক্ষেত্রে ফ্যাক্ট হিসাবে ঘটছে কিনা — সেইটা পাবলিক ডকুমেন্ট হিসাবে আমাদের সামনে এতোটা নাই। সবগুলা খুনেরই কিছু কাহিনি আছে, কিন্তু ফ্যাক্ট হিসাবে ডকুমেন্টেড জিনিস কি আছে, সেইগুলা হাইলাইটেড না তেমন। অই সব খুনের কাহিনিগুলা যাচাই করা দরকার আমাদের।
৫০ বছর বড় একটা টাইম। একটা জেনারেশন পার হইছি আমরা। কান্দা-কাটি করতে পারবো না আমরা — তা না, কিন্তু খুনগুলার এনকোয়ারি করা দরকার এখন, ফ্যাক্টগুলা ফেইড হয়া যাওয়ার আগেই।
এইখানে এটলিস্ট দুইটা জিনিস কন্সিডার করা দরকার আমাদের। এক হইলো, বাংলাদেশে চিন্তা-ভাবনা করা লোকজনরে গায়েব কইরা দিলে পাকিস্তান রাষ্ট্ররে যারা ধইরা রাখতে চাইছিলেন তাদের লাভের চাইতে রিভেঞ্জ নেয়ার ঘটনা’টা এইখানে বড়। মানে, বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের খুন করলে তো আর যুদ্ধে জিতা যাবে না; কিন্তু উনাদেরকে মারলে কারা এই পজিশনগুলাতে আসবে? মানে, উনাদের না-থাকার বেনিফিশিয়ারি কারা?
এইখানে এইজ-গ্রুপ’টা খেয়াল করা দরকার। টোটাল কতো জনরে খুন করা হইছিল? এর মধ্যে ৪০/৫০ বছরের বেশি মানুশ কয়জন? যদি সংখ্যাটা বেশি হয় তাইলে ইয়াং লোকজনদের অই ভ্যাকুয়ামগুলার বেনিফিট পাওয়ার কথা। মানে, এই কারণেই খুনগুলা করা হইছে — এইরকম স্ট্রেইট অনুমান করলে সেইটাও ভুলই হবে, কিন্তু কন্সিডারেশনে নিতে পারাটা তো দরকার।…
সেকেন্ড পয়েন্ট’টা হইতেছে, জহির রায়হানের গুম-হওয়াটা আরেকটা সিগনফিকেন্ট ঘটনা। (এইটাই একমাত্র ঘটনা?) পাকিস্তানি মিলিটারি সারেন্ডার করার পরেও উনি গুম হইলেন কাদের হাতে, আর কি কারণে? গুজব তো এইটা যে, উনি কলকাতার কুর্কীতিগুলা নাকি জানতেন, ফুটেজও ছিল কিছু উনার কাছে।… মানে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পরে বাংলাদেশে একটা ইন্টেলেকচুয়ালিটির জায়গা তো তৈরি হইছে এবং এই ভ্যাকুয়াম অই ফর্মেশনে হেল্পই করার কথা। কি কি ঘটনা ঘটছে আসলে তখন, অই জায়গাগুলাতে। অই বিচার’টা কেউ করেন নাই পুরাপুরি। [আহমদ ছফা একটা বই লেখছিলেন “বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস” নামে ১৯৭২ সালে, কিন্তু যতদূর মনে পড়ে অইটা একটা এগনয়ি’র (agnoy) ঘটনাই ছিল।]
কিন্তু অই বিচার’টা করার, এনকোয়ারিগুলা করার, ওভারঅল অই হিস্ট্রি’টার দিকে আমাদের তাকানোর সময় হইছে এখন।
২০২১
খ.
১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর একটা টার্গেটেড কিলিং হইছিল বাংলাদেশে, হাজার খানেক টিচার’রে খুন করা হইছিল, যাদের বেশিরভাগই মেবি ছিলেন স্কুল কলেজের টিচার, যদিও অন্য অনেক কিছুর মতো এই লিস্টও এভেইলেবল না পাবলিকলি…. কিনতু প্রতি বছর ১৫-২০ জনের ছবি ও ৫-৭ জনের নাম নেয়া হয়, যারা ভার্সিটির টিচার; এর ভিতর দিয়া ভার্সিটির টিচার মানে বুদ্ধিজিবি এই ‘সত্য’ এস্টাবলিশ করা হইছে আসলে বাংলাদেশে
- ১৪ ই ডিসেম্বরের টার্গেট-কিলিং —
১৯৭১ সালের ১৪ ই ডিসেম্বর কতজন “বুদ্ধিজীবী” খুন করা হইছিল বা কারা “বুদ্ধিজীবী” ছিলেন — এই লিস্ট এবং ধারণা এখনো স্পষ্টভাবে কোথাও পাওয়া যায় না। মুক্তিযুদ্ধ নিয়া অন্য সব আলাপের মতো এইটাও মোটামুটি হালকার উপরে ঝাপসাই। আলাপগুলাতে ফ্যাক্টের চাইতে ইমোশন দিয়া কাজ সারার টেনডেন্সিই মেইন।
বাংলাপিডিয়াতে একটা নাম্বার আছে (১১১১), যার ৯০% হইতেছেন টিচার। উইকিপিডিয়াতে নাম্বারটা হাজারের একটু কম। ১৯৭২ সালে মেবি ১০৭০ জনের একটা লিস্ট করা হইছিল। মানে, ১০০০-এর আশে-পাশেই একটা নাম্বার হিস্ট্রিক্যালি মেনশন কইরা আসা হইতেছে। কিন্তু কোন কমপ্লিট লিস্টই পাবলিকলি এভেইলেবল না।
তবে সিলেক্টিভ কিছু নাম মোটামুটি অনেক জায়গাতেই পাইবেন। কিছু ছবিও, যে উনারা ছিলেন বুদ্ধিজীবী, অই সময়ের। ঘুরায়া-ফিরায়া ২০-৩০ জনের ছবি এবং নামই আসে এইসব ছবিতে। (কিছু ভুলও থাকে। যেমন, জহির রায়হান ১৪ই ডিসেম্বর মারা যান নাই, কিন্তু একটা লিস্টে উনার নাম পাইছি, এইরকম।) আর সবচে বেশি আসে ভার্সিটির টিচারদের নাম।
মানে, “বুদ্ধিজীবী হত্যার” সিলেক্টিভ লিস্টটা বা ছবিগুলা যেইটা করে, ভার্সিটির টিচারদেরকে “বুদ্ধিজীবী” বানায়। প্রফেশন হিসাবে, এইটা (বুদ্ধিজীবী হওয়াটা) এর (ভার্সিটির টিচার হওয়ার) একটা বাই-ডিফল্ট ফিচার যে হয়া উঠছে বাংলাদেশে, এইটা হইতেছে অই লিস্টের একটা রেজাল্ট। এর লগে সাংবাদিকও আছেন। এইরকম “বুদ্ধিজীবী” হওয়া বা না-হওয়াটা প্রফেশনের একটা ঘটনা কইরা তোলাটা বাংলাদেশে “বুদ্ধিজীবী দিবস”-র একটা নেগেটিভ ঘটনা।
এর লগে রিলেটেড ঘটনা হইতেছে, যারা মারা গেছেন, তাদেরকে তো আমরা আর ফিরা পাবো না, তো তাদের প্রতি ট্রিবিউট জানানোর সবচে ভালো উপায় তো হইতেছে, তাদের চিন্তা-ভাবনা, কাজ-কামগুলার আর্কাইভ করা। কিন্তু এরও কোন টোটাল পিকচার পাইবেন না।
মানে, কোন ইন্টেলেকচুয়াল লসের জায়গাটারে তো আপনি অইভাবে হিসাব-কিতাবের মধ্যে আনতে পারবেন না, কোয়ান্টিফিকেশনের চেষ্টা করাটা ভুলই হবে। কিন্তু যা কিছু ছিল, সেইটার কম্পাইলেশন তো কখনোই খারাপ জিনিস না। অই জায়গা থিকা দেখতে পারাটা বেটার।
২.
তো, বাজারে যেই আলাপ-আলোচনা আছে সেইখান থিকা আমার ধারণা হইতেছে যে, ১৯৭১ সালের ১৪ ই ডিসেম্বর সারা দেশে অনেক টিচারদেরকে খুন করা হইছিল। সাথে, সমাজে যারা পাবলিক-ফিগার হিসাবে পরিচিত ছিলেন, তাদেরকেও টার্গেট করা হইছিল। (অই সময়ের, কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের যদি একটা লিস্ট করেন যে, কারা কারা ডমিনেন্ট করতেন একেকটা ফিল্ডে, তাদের মধ্যে কতো জন অইদিন মারা গেছিলেন – তাইলে ঘটনাটা আরো ক্লিয়ার হইতে পারবে।)
টার্গেট-কিলিং ছিল সেইটা। একটা সিভিল-ওয়ারেও টার্গেট-কিলিং জঘন্য একটা ঘটনা। (এইটা থিকা ‘শিক্ষা’ নিয়া বাকশালের ‘দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের’ অনলাইন যোদ্ধারা দেখবেন এইরকম ব্যক্তি/আইডি টার্গেট করে।)
কিন্তু যেই টার্মের ভিতর দিয়া, ন্যারেটিভের ভিতর দিয়া আমরা ঘটনাটারে দেখতেছি সেইটা দিনে দিনে আরো প্রব্লেমেটিক হয়া উঠার কথা।
হিস্ট্রি-রিডিংয়ে ইমোশন-কল্পনা থাকতে পারবে না — তা না, কিন্তু ফ্যাক্টগুলারে পাশে সরায়া রাইখা, বাতিল কইরা সেইটা হইতে পারে না আর কি!
২০২২