spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যপাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত 'সিঁথি' কবিতার শৈল্পিক পোস্টমর্টেম

লিখেছেন : আবু তাহের সরফরাজ

পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত ‘সিঁথি’ কবিতার শৈল্পিক পোস্টমর্টেম

আবু তাহের সরফরাজ

পাঠ্যপুস্তক জাতি নির্মাণের কারখানা। কারখানার যান্ত্রিক ও ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি থাকলে উৎপাদিত পন্যেও ত্রুটি থাকবে। ফলে, পাঠ্যপুস্তকের ভেতর দিয়েই বোঝা যায়, ওই জাতির সভ্য হয়ে ওঠার জাতীয় চেতনা। এ কারণে পাঠ্যপুস্তক থাকা দরকার রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত। তেমনটি অবশ্য পৃথিবীর কোনো দেশেই দ্যাখা যায় না। সত্যজিৎ রায়ের ‘হিরক রাজার দেশে’র কাহিনিই এই সত্যের প্রমাণ। মনে হতেই পারে, হিরক রাজার দেশ সত্যজিতের কল্পনা। কিন্তু মজা হচ্ছে, বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রের বাস্তবতাই সত্যজিৎ চলচ্চিত্রে রূপদান করেছেন। ফলে দ্যাখা যায়, যখন যে রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রক্ষমতায় বসে তখন সেই দলটি আগের দলের পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন করে নতুন পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করে। কারণ, তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ তারা জাতীয় চেতনা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। এই আয়োজনে কিছু কিছু নিকৃষ্ট রচনা পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যাদের রচনা অন্তর্ভুক্ত হয় তারা ওই দলের লেজুড় সাহিত্যিক।
বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকার আওয়ামী লীগ সরকারের পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জন ও সংশোধন করছে। শীঘ্রই এসব দেশের স্কুল-শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে যাবে। কিন্তু আমাদের সন্তানদের হাতে কী জিনিস এই সরকার তুলে দিচ্ছে, সেদিকে চোখ দেয়ার গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চয়ই আমাদের আছে। সেই অধিকার চর্চায় সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রবল প্রতিবাদ উঠেছে একটি কবিতা অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে। দ্বিতীয় দশকের কবি হাসান রোবায়েতের কবিতাটির নাম ‘সিঁথি’। চলুন তবে, পড়ে নেয়া যাক কবিতাটি:

ভাই মরল রংপুরে সেই
রংপুরই তো বাংলাদেশ
নুসরাতেরা আগুন দিল
দোজখ যেন ছড়ায় কেশ।
কওমি তরুণ দাঁড়ায়া ছিল
কারবালারই ফোরাতে
শাহাদাতের আগুন দিয়া
খুনির আরশ পোড়াতে।

লাশের মিছিল, গণকবর
খুনির কাতান শাড়িতে
যাত্রাবাড়ি ডুইবা গেল
আজরাইলের ফাঁড়িতে।

চিরকালই স্বাধীনতা
আসে এমন রীতিতে
কত রক্ত লাইগা আছে
বাংলাদেশের সিঁথিতে।

ছড়াটি সুন্দর তো! জুলাই বিপ্লব নিয়া কত ভালো ভালো কথা রইছে। তাহলে সবাই প্রতিবাদ করছে কেন? করছে কারণ, পাঠ্যপুস্তকে কী যাচ্ছে না-যাচ্ছে, সেসব নিয়ে সাধারণ মানুষের কোনোই মাথাব্যথা নেই। সব সরকারের আমলেই তাদের লক্ষ্য থাকে, যেভাবেই হোক সন্তানকে এম.এ বি.এ পাশ করিয়ে চাকরিতে ঢুকিয়ে দিতে হবে। ফলে, প্রবল এই প্রতিবাদ উঠেছে দেশের কবিসমাজের কাছ থেকে। বিশেষ করে প্রতিবাদ উঠেছে তাদের কাছ থেকে যারা কবিতার কৃৎকৌশল, ছন্দ ও উপমা বিষয়ে বিশেষ জ্ঞানের অধিকারী। তাদের প্রতিবাদ হাসান রোবায়েতের বিরুদ্ধে নয়। তারা প্রশ্ন তুলেছেন ওই কবিতার শিল্পমান নিয়ে। শিল্প কী? শিল্প হচ্ছে নিরন্তর সৌন্দর্য। কবিতা নির্মাণে ছন্দ, উৎপ্রেক্ষা, ভাষাশৈলী, উপমা― এসব হচ্ছে অলঙ্কার। কবিতার সৌন্দর্যকে সাজিয়ে তোলার অনুষঙ্গ। সাধারণ মানুষের চোখে কবিতার সৌন্দর্য সেইভাবে ধরা পড়ে না, যতটা গভীরভাবে পড়ে কবিদের। তাই তো কবিদের প্রবল প্রতিবাদ ‘সিঁথি’র বিরুদ্ধে।
কবিতা আসলে লেখা যায় না। কবিতা হয়ে ওঠার বিষয়। কিভাবে হয়ে ওঠে একটি কবিতা? কবিতা নিজেই আসলে প্রকাশ ঘটে কবির মাধ্যমে। কবির অবস্থা তখন ঘোরগ্রস্থ। কবির বোধের গহীন অন্ধকারে আলোর মতো হঠাৎ জ্বলে ওঠে কোনো বিশেষ একটি বোধ। এরপর সেই বোধ স্ফুরিত হতে থাকে। নিজের প্রকাশ ঘটাতে চায়। এসময় বেগ তৈরি হয় কবির ভেতর। কী রকম ঘোরের ভেতর যেন চলে যান কবি। বোধকে ভাষায় নির্মাণ করতে হবে। ব্যাপারটা অনেকটা ফুলের সুবাসকে ভাষায় শরীর দেয়ার মতো। খুবই মুশকিলের কাজ। প্রাণান্ত প্রচেষ্টা। কিন্তু প্রকৃত কবির বেলায় কাজটি প্রাকৃতিকভাবেই সহজে ঘটে যায়। কবিতা খুবই স্বাভাবিক গতিতেই কবির ভেতর থেকে ভাষায় রূপ নিতে থাকে। কবি কেবল নিমিত্ত হয়ে লিখে যেতে থাকেন বোধের অনুরণন। কিন্তু আরেক শ্রেণির কবি আছেন, যাদের বোধে কবিতা সেভাবে স্ফুরিত হয় না। কিন্তু কবিতা যে তাকে লিখতেই হবে, না-হলে তিনি কবি হয়ে উঠবেন কিভাবে! ফলে, কবিতাকে বিনির্মাণ করতে চেষ্টা করতে থাকেন তারা। এতে হয় কি, শেষমেষ কবিতার মতো করে যা লিখিত হয় তা কবিতা হয়ে ওঠে না। হয়ে ওঠে কবিতার মতোই কিছু একটা। এই দুই শ্রেণির মাঝামাঝি আরেক শ্রেণির কবি আমাদের চোখে পড়ে। তাদের বোধের জগতে কবিতা স্ফুরণ তোলে। তারা টেরও পান সেই ঢেউ। কিন্তু বোধের প্রকাশ তারা ভাষায় রূপ দিতে পারেন না। তবে চেষ্টা করেন। বোধের অস্ফুট স্বর শুনতে চেষ্টা করেন কান পেতে। কিছু শুনতে পান, কিছু শুনতে পান না। ফলে, কিছুটা তাড়না আর কিছুটা নিজের চেষ্টা থেকে তারা বোধের মরমে লুকনো স্ফুরণকে লিখতে চেষ্টা করেন। পাশাপাশি এও সত্যি যে, কবিতা দূরবিশ্বের থেকে অস্ফুট স্বরে ভেসে আসা কিছু ইঙ্গিত। সেই ইঙ্গিতকে ভাষায় রূপদান করা সত্যিই দুরূহ। বলেছি যে, কোনো কোনো কবিতা প্রাকৃতিকভাবেই কবির মধ্যদিয়ে নির্মিত হয়ে যায়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এখানেও কিছুটা ধরা না-ধরার খেলা থাকে। কবি তো আর ত্রিকালদর্শী নয়, কবি শেষপর্যন্ত মানুষ। সবমিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, কবিতা তৈরি হয় কিছুটা আভাসে, আর কিছুটা আয়নায় দেখা স্বচ্ছ প্রতিবিম্বের মতো চিত্রময়তায়। কবির জীবনবোধের সাথে কবিতার ইঙ্গিত ও চিত্রময়তার গভীর যোগসূত্র রয়েছে। কেননা, কবির অন্তর্জগত হচ্ছে কবিতার রসায়নাগার। অদৃশ্যলোক থেকে যে ইঙ্গিত কবি পান, সেই ইঙ্গিত জারিত হয় কবির অন্তর্জগতে। এরপর সেখান থেকে বোধকে ভাষায় চিত্রিত করেন কবি, যাকে আমরা কবিতা বলে থাকি। এই কবিতা অনেক রকম। যত রকম মানুষ পৃথিবীতে বসবাস করছে, তত রকম। আর এ কারণেই কবিতার সুনির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা নেই। সংজ্ঞা না থাকলে কবিতার সৌন্দর্য রয়েছে। সেই সৌন্দর্য দেখে কাব্যরসিক ঠিকই প্রথম শ্রেণির কবিতা থেকে দ্বিতীয় শ্রেণির কবিতাকে চিহ্নিত করতে পারেন। সাধারণ মানুষ আবার সেটা পারে না। কারণ, কবিতার সৌন্দর্য-চেতনা তাদের নেই। আছে কবিতার মতো কিছু একটা পড়ে যাওয়ার আনন্দ। ফলে, সাধারণ পাঠকের কাছে ‘সিঁথি’র শব্দসম্ভার ভালো ভালো কথা হলেও কবিদের কাছে সেসব কথার কোনো সৌন্দর্য নেই। অসুন্দর একটি কবিতাকে তারা জাতীয় শিক্ষায় অন্তর্ভুক্ত করতে দিতে চান না। শিল্পের সৌন্দর্য থেকে ‘সিঁথি’কে একটু ভেঙেচুরে দ্যাখা যাক।

ভাই মরল রংপুরে সেই
রংপুরই তো বাংলাদেশ

যে রংপুরে ভাই মারা গেছে সেই রংপুর বাংলাদেশ। এখানে রংপুরের পর একটি কমার বিরতি দাবি করে। কিন্তু কবিতায় কমা নেই। এ অবস্থা বাক্যের মানে প্রকাশে জটিলতা তৈরি করে। কথা হচ্ছে, গণ-অভ্যুত্থান কি কেবল রংপুরেই হয়েছিল? তা তো নয়। তাহলে রংপুর গোটা বাংলাদেশ হতে যাবে কোন দুঃখে?

নুসরাতেরা আগুন দিল
দোজখ যেন ছড়ায় কেশ।

নুসরাত কে? ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে মারা যাওয়া কোনো শহিদ? এই নাম তো শুনিনি। তবে জানি যে, নুসরাত নামের ফেনীর এক মাদ্রাসাছাত্রকে হত্যা করা হয়েছিল বছর পাঁচেক আগে। দেশজুড়ে যে ঘটনা প্রবল সাড়া জাগিয়েছিল। যদি সেই নুসরাত আর কবিতায় উল্লিখিত নুসরাত একজনই হয়, তাহলে আন্দোলনের প্রেক্ষাপট বদলে যাবে। কবিতায় কথা হচ্ছে জুলাই বিপ্লব নিয়ে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যারা শহিদ হয়েছেন তাদের কারো কারো নাম কমবেশি পরিচিত। যেমন: আবু সাঈদ, মুগ্ধ। এই রকম পরিচিত নামের ভেতর নুসরাত নামটি অচেনা। তবে অপরিচিত কোনো শহিদের নাম নুসরাত থাকলেও থাকতে পারে। যার কথাই রোবায়েত কবিতায় উল্লেখ করেছেন। কিন্তু কবিতাটি যেহেতু বিশেষ একটি সময়ের প্রতিনিধিত্ব করছে সেহেতু অপরিচিত কোনো শহিদের নাম না দিয়ে পরিচিত কোনো শহিদের নাম দেয়া বেশি যৌক্তিক হতো।
নুসরাতেরা আগুন দিল। কিন্তু কোথায় আগুন দিল? এই বিষয়টি কিন্তু উহ্য। মনে রাখতে হবে, পাঠ্যপুস্তকে এই কবিতা পড়ছে ছোটরা। তারা উহ্য বিষয়ের চেয়ে যে কোনো বিষয় ছবির মতো করে মনের চোখ দিয়ে দেখতে চায়। ফলে তাদের জন্য চমৎকার চিত্রকল্প আঁকতে হয় শব্দের সুতোয় বেঁধে। নুসরাতেরা কোথায় আগুন দিল সেই বিষয় বোঝা না গেলেও শিক্ষার্থে জানানো হচ্ছে, ‘দোজখ যেন ছড়ায় কেশ’। বোঝা যাচ্ছে, নুসরাতেরা যে আগুন দিয়েছে সেই আগুন এতটাই ভয়াবহ যে দেখে মনে হয়, দোজখ যেন কেশ ছড়িয়ে দিয়েছে। আন্দোলনকারীদের অগ্নিপ্রতিবাদে দেশে দোজখ তৈরি হয়নি। দোজখ তৈরি হয়েছে স্বৈরাচারী শাসকের শোষণ-ত্রাসে। লুণ্ঠনে। গণহত্যায়। সেই দোজখের আগুন নিভিয়ে বেহেস্তের শান্তির সুবাতাস নিয়ে আসতেই জুলাই বিপ্লব। ফলে নুসরাতদের আগুনেই যে দোজখ তৈরি হলো, বিষয়টি জুলাই বিপ্লবের পরিপন্থী। আগুনের ভয়াবহতা বোঝাতে যে চিত্রকল্প, তা হাস্যকর। বোঝাই যাচ্ছে, অন্তমিল ঠিক রাখতে এই প্রয়াস। ফুঁটোর ভেতর তুলো গুজে দিয়ে ফুঁটো বন্ধ করার মতো ঘটনা। কিন্তু তুলোই কি সত্যিই ফুঁটো বন্ধ হয়? দোজখের কেশ চিত্রকল্পটি প্রতিচিত্র হিসেবে শিক্ষার্থীদের মানসপটে কী ছবি ফুটে উঠবে? দোজখের কেশ কি সত্যিই হয়? নাকি কবির কল্পনা? যদি কল্পনা হয় তাহলে অতি দুর্বল কল্পনা। দোজখের কেশই যখন শিক্ষার্থী বুঝতে পারছে না তখন দোজখের আগুন নিয়ে কেশের ছড়িয়ে পড়ার দৃশ্যপট শিক্ষার্থীর মাথার ওপর দিয়ে যাবে। এ ধরনের দুর্বল চিত্রকল্প কবিতার সৌন্দর্যকে অসুন্দর করে। কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতার একটি বাক্য হচ্ছে, ‘ভয়ে সপ্ত নরক হাবিয়া দোজখ নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া’। দোজখের যে ছবি এখানে আমরা দেখতে পাই সেই ছবি দোজখের ভয়াবহতা গভীরভাবে আমাদের উপলব্ধির ভেতর নিয়ে আসে। দোজখের চিত্রকল্প কবিতার সৌন্দর্যকে শৈল্পিক-সুষমায় রাঙিয়ে গেছে। এই রকম অনেক চিত্রকল্পই অনেক কবির কবিতায় রয়েছে। সেসব চিত্রকল্প অনন্য। মানুষের চিরন্তন জীবন-সূত্রে গ্রোথিত। আর তাই সেই সকল কবির কবিতা দিয়েই তৈরি হয় বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তক। সেইসব কীর্তিমান কবিদের পাশে হাসান রোবায়েত কি যথাযোগ্য? কীর্তিমান কবিরা আশা করেন, তাদের উত্তরসূরীদের থেকে যোগ্যরাই উঠে আসুক তাদের সারিতে। কেননা, পাঠ্যপুস্তকে কবিতা অন্তর্ভুক্তির মানেই ওই কবির জাতীয় সর্বজনীন স্বীকৃতি তৈরি হওয়া। হাসান রোবায়েতের কবিত্ব কি সত্যিই ওই পর্যায়ের?
আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে প্রথম দশকের একজন কবি বেশ পরিচিত হয়ে উঠলো। তার কবিতার একটি পঙক্তি ছড়িয়ে পড়লো দেশের আনাচে-কানাচে।

যতদূরে যাও পাখি, দেখা হবে ফের
স্বাধীন ঐ আকাশটা শেখ মুজিবের।

এই পঙক্তিও কাটাছেঁড়া করা যায়। এখানে সেটা জরুরি নয়। জরুরি হচ্ছে, আওয়ামপন্থী ওই কবির কবিতা কিন্তু সরকার পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করেনি। অথচ পাঠ্যপুস্তককে তারা আবর্জনা দিয়ে ভরে রেখেছিল। এরপরও দলীয় কবিদের অন্তর্ভুক্ত করেনি। কিন্তু অন্তবর্তীকালীন এক্ষেত্রে কোনো রাখঢাক রাখলো না।

কওমি তরুণ দাঁড়ায়া ছিল
কারবালারই ফোরাতে

মাদ্রাসার ছাত্রদেরকে বলা হচ্ছে কওমি তরুণ। কওমি মাদ্রাসার ছাত্রেরা জুলাই বিপ্লবে বড় একটি ভূমিকা নিয়েছিল। সেই ঘটনা আমরা জানি। কিন্তু তারা বাংলাদেশ ছেড়ে কারবালার ফোরাতে গিয়ে কেন দাঁড়িয়ে ছিল? নাকি রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকার মাদ্রাসা ছাত্রদের আন্দোলন বোঝাতে গিয়ে কবি কারবালার পটভূমি তৈরি করলেন! এই প্রশ্নের যৌক্তিক জবাব নেই। তবে আমরা ধরে নিতে পারি, কারবালার ঐতিহাসিক ঘটনার পটভূমিতে হাসান রোবায়েত বাংলাদেশর আন্দোলনের ছবি ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন। কিন্তু ‘দাঁড়ায়া’ কি প্রমিত শব্দ? প্রমিত ভাষা হচ্ছে জাতির মানভাষা। এই ভাষা সুনির্দিষ্ট। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলা ভাষার যোগাযোগ স্থাপিত হয় এই মানভাষা দিয়ে। আর, পাঠ্যপুস্তক সেই মানভাষার ধারক ও বাহক। নব্বইয়ের দশকের কবি ব্রাত্য রাইসুর কবিতার মাধ্যমে মূলত দাঁড়ায়া, লাইগা, ডুইবা, যাইগা― জাতীয় ভাষার কথ্যরূপ তৈরি হয়েছে। এরপর চলচ্চিত্র নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর মাধ্যমে ঢাকা-কেন্দ্রিক একটি শ্রেনির ভাষা হয়ে ওঠে ওই ঢঙের বুলিগুলো। মুখের ভাষার এ ধরনের নানা রকম-ফের বাংলা ভাষায় আরও আছে। সাম্প্রতিক তরুণ কবিরা এই ঢঙের নানা শব্দ কবিতায় ব্যবহার করছে। সেটা তাদের সাহিত্যপ্রকাশ। করতেই পারে। কিন্তু যখন পাঠ্যপুস্তকের জন্য কোনো কবিতা নির্বাচন করা হবে তখন নির্দিষ্ট রাখতে হবে মানভাষা, মানে প্রমিত ভাষা। প্রমিত ভাষাই শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মাধ্যম। কিন্তু ‘সিঁথি’ কবিতার ক্রিয়াপদের কিছু কিছু শব্দ প্রমিত নয়। ভাষার এক ধরনের মৌখিক ঢঙ। সেই ঢঙের কবিতা পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্তির একটি উদ্দেশ্য হতে পারে, বাংলা ভাষার প্রমিত রীতিকে ভেঙে ফেলার প্রথম প্রচেষ্টা। আমরা ধারণা করি, যারা এই ষড়যন্ত্র করছেন ইতিহাস তাদেরকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে।

শাহাদাতের আগুন দিয়া
খুনির আরশ পোড়াতে।

শহিদি মৃত্যুর আগুন দিয়ে খুনির আরশ পোড়াবে বলে কওমি তরুণ ফোরাতের তীরে দাঁড়িয়ে ছিল। একজন শহিদ হচ্ছে। এই খবর দ্রুত পৌঁছে যাচ্ছে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। ফলে, মানুষর ক্ষোভের আগুন আরও বেশি দাউদাউ জ্বলে উঠছে। এক্ষেত্রে শাহাদাতের আগুন চমৎকার একটি উপমা। কিন্তু সেই আগুন খুনির আরশ পোড়াতে গিয়েই ঝামেলা তৈরি করলো। আরশ আরবি শব্দ। এই শব্দের মানে সিংহাসন বা উঁচু স্থান। ইসলাম, ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মমতে, পরম প্রভুর অবস্থান স্থল। মুসলমানরা বলে আরশ। খ্রিস্টানদের কাছে থ্রোন অব গড বা ঈশ্বরের সিংহাসন এবং ইহুদিদের কাছে আরাবাত নামে পরিচিত। হাসান রোবায়েত আরবি শব্দের মূল অর্থ সিংহাসন ব্যবহার করেছেন তার কবিতায়। ফলে কবিতার অর্থ সংক্রান্ত জটিলতা তৈরি হয়েছে। আরশ মূলত আল্লাহর সিংহাসন। সেখানে হরেদরে যে কেউ বসতে পারে না। বিষয়টি মুসলিম ধর্ম-বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক।

লাশের মিছিল, গণকবর
খুনির কাতান শাড়িতে

খুনির কাতান শাড়িতে লাশের মিছিল ও গণকবর। এই চিত্রকল্প দিয়ে কী বোঝানো হচ্ছে? কাতান শাড়িতে লাশ ও কবর কী করছে? ঘটনার ছাপ ফেলে যাচ্ছে? যদি তা যায়ই তাহলে খুদে শিক্ষার্থীদের কাছে বিষয়টি আরও হৃদয়গ্রাহী চিত্রকল্পের ভেতর দিয়ে উপস্থাপন করা যেত। যেটা কীর্তিমান কবিরা করে গেছেন। সেই রকম শৈল্পিক-নৈপুণ্য না থাকলে কীর্তিমানদের সারিতে নিজেকে দাঁড় করানোর প্রয়াস ধৃষ্ঠতা।

যাত্রাবাড়ি ডুইবা গেল
আজরাইলের ফাঁড়িতে।

কারবালার উপমার পেছনে কি এই যাত্রাবাড়িই ছিল? থাকতে পারে। সেখানেই তো মাদ্রাসার ছাত্ররা তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। কিন্তু আজরাইলের ফাঁড়িতে যাত্রাবাড়ি ডুবে গেল কিভাবে? ফাঁড়ি মানে পুলিশের ছাট থানা বা ঘাঁটি। আজরাইল বলতে পুলিশকে বোঝানো হচ্ছে। যদিও আজরাইল বানানটি ভুল। হবে, আজরাঈল। কথা সেটা নয়। কথা হচ্ছে, যে কোনো কিছু তো পানিতে ডোবে। এই প্রথম আমরা শুনলাম ফাঁড়ি নাকি যাত্রাবাড়িকে ডুবিয়ে দিচ্ছে! ফাঁড়ি তো একটি কাঠামো। সেই কাঠামো কোনো স্থানকে ঢেকে দিতে পারে, কিন্তু ডোবাতে তো পারে না। হাস্যকর চিত্রকল্প নয় কি? অন্তমিলের দরকারে খুঁজে খুঁজে শব্দ এনে মিল করা হয়েছে। অন্তমিল স্বতঃস্ফূর্ত উপায়ে এখানে আসেনি। মানে, এই কবিতা স্বাভাবিক গতিতে হাসান রোবায়েতের ভেতর থেকে ভাষায় রূপ নেয়নি। বরং বিশেষ একটি উপলব্ধিকে ভাষায় রূপ দিয়ে কবিতা তৈরি করতে চেয়েছেন রোবায়েত। এই চেষ্টা প্রাথমিক পর্যায়ের একজন কবির প্রচেষ্টা। বয়সের দিক দিয়েও রোবায়েত সেই পর্যায়েই আছেন। অথচ জুলাই বিপ্লব নিয়ে কত্ত চমৎকার কবিতা সেই সময় লেখা হয়েছে। এখনো হচ্ছে। সেসব কবিতা বাদ দিয়ে নির্দিষ্ট করে ‘সিঁথি’ কবিতাটাই কেন পাঠ্য করতে হবে? এই জিজ্ঞাসা জাতির। কিন্তু বঙ্গদেশের রীতি হচ্ছে, প্রশ্ন আছে জবাব নেই।
‘ডুইবা’ শব্দটি পড়তে কেমন লাগছে হে পাঠক? যেন মনে হচ্ছে, দ্বিতীয় দশকের কোনো তরুণ কবি কর্তৃক সম্পাদিক ছোটকাগজে আরেক কোনো তরুণ কবির কবিতা পড়ছি। আরে ভাই, এটা তো ছোটকাগজ নয়। এটা পাঠ্যপুস্তক। এই সহজ ও প্রাঞ্জল বিষয়টি পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন কমিটি যে বোঝে না, এটা আমরা বিশ্বাস করি না। তবে কোনো এক অজ্ঞাত কারণে তারা না-বোঝার ভান করে আছেন।

চিরকালই স্বাধীনতা
আসে এমন রীতিতে

কথা কিন্তু সত্যি। স্বাধীনতার আসার পথ চিরকালই রক্তাক্ত। অনেক প্রাণের বিনিময়েই শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতা আসে। বাংলাদেশের নতুন এই স্বাধীনতাকে বিবাহিত হিন্দু রমণীর সিঁথির সিঁদুর হিসেবে চিত্রকল্প এঁকেছেন রোবায়েত। তিনি লিখছেন:

কত রক্ত লাইগা আছে
বাংলাদেশের সিঁথিতে।

সিঁথি মানে বাংলাদেশ এখানে হিন্দু রমণী। আর, স্বাধীনতার লড়াইয়ে শহিদদের রক্ত এখানে সিঁদুর। বাংলাদেশকে বিশেষ একটি ধর্মের ভূখণ্ড বানিয়ে ফেললেন রোবায়েত। কেননা, হিন্দু ধর্মের রমণী ছাড়া আর কোনো ধর্মের বিবাহিত নারীরা সিঁদুর পরে না। অথচ এই রোবায়েতই এর আগে আন্দোলনের যোদ্ধা হিসেবে কওমি তরুণদের দাঁড় করিয়েছিলেন ফোরাত নদীর তীরে। এই কবিতায় হিন্দু জনগোষ্ঠিকে একাত্ম করতেই বোধহয় রোবায়েত এই পঙক্তি রচিয়াছেন। কিন্তু তার সেই চেষ্টা বড়ই দুর্বল। হয়তো তিনি নিজের অজ্ঞাতসারেই বাংলাদেশকে হিন্দুর ভূখণ্ড হিসেবে উপমা টেনেছেন। এটা হলেও ক্ষতি নেই। কারণ, তিনি বয়সে এখনো তরুণ। ভাষার প্রয়োগ, শৈলী, ছন্দের কারুকাজ ইত্যকার বিষয়ে এখনো প্রাজ্ঞ হয়ে ওঠেননি। তবে চেষ্টা অব্যহত থাকলে একদিন হয়তো তার কবিতাও পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্তির যোগ্য হবে। কিন্তু সেই প্রচেষ্টা এখনই কেন? জানতে পারলাম, কবিসমাজের তীব্র বিরোধিতার মুখে ‘সিঁথি’ কবিতার পুর্নলিখন চলছে। মানে, পাঠ্যপুস্তকে হাসান রোবায়েত নামটা থাকতেই হবে। বুঝলাম যে, হাসান রোবায়েতের খুঁটি বাঁশের নয়, পাথরের। এসব নিয়ে অবশ্য আমাদের খুব বেশি বিচলিত হবারও কিছু নেই। কারণ, জাতীয় নির্বাচনের পর কোনো একটি রাজনৈতিক দল সরকার গঠন করবে। এরপর তারা রাষ্ট্র-সংস্কারের অংশ হিসেবে পাঠ্যপুস্তকও সংস্কার করবে। তখন হয়তো বাদ পড়ে যাবে ‘সিঁথি’ কবিতাটি। তখন হয়তো আরেক অপক্ক কবির কবিতা অন্তর্ভুক্ত হবে পাঠ্যপুস্তকে। এই প্রক্রিয়া নিরন্তর। সকল রাষ্ট্রেই কম-বেশি চলিতেছে। আমরাও চলিয়াছি রাষ্ট্রের সহযাত্রী হয়ে।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ