মজিদ মাহমুদ
গতকাল বাংলা একাডেমি ও প্রেসক্লাবে জানাজা শেষে মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে কবি হেলাল হাফিজকে দাফন করা হলো। হেলাল হাফিজ নামে একজন কবি ছিলেন– গতকালই তাঁর শারীরিক প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। কিন্তু গতকাল আর আজ যারা তাকে নিয়ে পোস্ট দিলেন, কথা বললেন, জানাজায় আসলেন– এখনো তাদের শারীরিক প্রয়োজন ফুরায়নি। শারীরিক প্রয়োজন মানে দেহের সীমাবদ্ধতা– জীবিত মানুষ মৃতদের নিয়ে যা কিছু করে তা মূলত তাদের নিজেদের প্রয়োজনে; মৃত ব্যক্তির তাতে কিছু এসে যায় না। যারা তাঁকে ফুল দিলেন, তাদের শ্রদ্ধা নিবেদন করলেন তা যে মেকি ছিল– তা মোটেও নয়, এটিই রীতি। কিন্তু যারা বললেন রাষ্ট্র তার সম্মান দিলো না যথাযথ, একাডেমি–প্রেসক্লাব তাঁর জন্য আরো করতে পারতো, হয়তো পারতো অথবা পারতো না, অথচ যারা এসব বললেন, চিৎকার করলেন– তাদের অনেকেরই গত বছরে কবি হেলাল হাফিজ সম্বন্ধে মূল্যায়ন ছিল অন্য রকম, তাদের অনেকেরই সামাজিক যোগাযোগে তাঁর প্রতি ছিল নিন্দা। সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের অনেকে বললেন, হেলাল হাফিজকে একুশে এবং স্বাধীনতা পুরস্কার না দেয়া জাতির জন্য লজ্জাকর। কিন্তু তারা কি জানেন, হেলাল হাফিজকে কারা পুরস্কার দিয়েছিল, এবং কেন দিয়েছিল– অন্যরা কেন দেয়নি!
হেলাল হাফিজ যেহেতু সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, সেহেতু পুরস্কার নামক বস্তুটি পাওয়ার সুযোগ তার জন্য খুব কম ছিল। হেলাল হাফিজ ষাটের দশকের একজন কবি, আওয়ামী স্বৈর-সরকারের আগেও তো অনেক পুরস্কার দেয়া-নেয়া করেছে– তারা কি হেলাল হাফিজকে পুরস্কার দিতে পারতেন না, তারা কি দিয়েছিলেন! আবিদ আজাদকে পুরস্কার দিতে পারতেন না! তখন যারা পুরস্কার গ্রহণ করছেন, পুরস্কারের জন্য বাংলা একাডেমি, সচিবালয় এবং ফেলো কবিদের বাড়ির মাটিতে স্যান্ডেল ক্ষয় করছেন– তারা কি তা জানতেন না– বাংলা সাহিত্যে ষাটের একজন হেলাল হাফিজ আছেন, সত্তরের একজন আবিদ আজাদ আছেন। কিন্তু তারা জানেন, পুরস্কার একটা রাজনৈতিক সুযোগ যা কেবল রাজনীতির সঙ্গে জড়িত কিংবা সমর্থকদেরই দেয়া হয়– হয়তো তারা এক্সিডেন্টালি লেখার সঙ্গে জড়িত। এটি নিতে পারা একটি ক্ষমতারও প্রকাশ– যেটি তারা ঘটাতে চান।
হেলাল হাফিজ পুরস্কার পেয়েছিলেন হাসিনা সরকারের আমলে, অথচ তিনি বিএনপি-পন্থী বলেই পরিচিত, হয়তো বাস্তবিকও তা-ই। তাহলে তিনি কিভাবে পুরস্কার পেলেন! আসলে তাঁর পুরস্কারও সাহিত্যের জন্য ছিল না, এটি একান্ত বন্ধুকৃত্য ছিল, যেভাবে মাহবুব তালুকদার পেয়েছিলেন- শামসুজ্জামান খানের সৌজন্যে। যেহেতু হেলাল হাফিজের বন্ধু বেবী মওদুদ– প্রেসক্লাবের সদস্য এবং শেখ হাসিনার সার্বক্ষণিক সঙ্গী হিসাবে স্বীকৃত, এমনকি কবি হেলাল হাফিজ নিজেও শেখ হাসিনার বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী। বেবী মওদুদ তার নিজ উদ্যোগে শেখ হাসিনাকে রাজি করিয়েছিলেন– আর এটি খুব স্বাভাবিক, বন্ধু সহপাঠী ভিন্ন দলমতের হওয়া সত্ত্বেও এই সৌজন্যাতাটুকু অনেকেই দেখায়– যা তার জন্য দেখানো হয়েছিল। তাঁর এই পুরস্কার পাওয়ার পরে আমি হেলাল ভাইয়ের সমালোচনা করে একটি ছোট লেখা লিখেছিলাম! এর কারণ অবশ্য পুরস্কার গ্রহণ নয়। হেলাল ভাই পুরস্কার পাওয়ার পরে শেখ হাসিনার প্রতি এতোটাই মুগ্ধতায় ভূগছিলেন– যা রীতিমতো আশ্চর্যের! পুরস্কার গ্রহণের সময় শেখ হাসিনা তাকে কি বলেছেন, তিনি উত্তরে কি বলেছেন, তিনি কি পোশাক পড়েছেন– তার জন্য টিশার্ট পাঠানো হয়েছে; অথচ তখন শেখ হাসিনা বিনাভোটে নির্বাচনের পায়তারা করছেন; তাই এসব তাঁর মুখে শুনতে আমার ভালো লাগেনি; কারণ তিনি নিজেই বলতেন তাঁর ৫৬টি কবিতা ৫৬ হাজার গ্রামে পৌঁছে গেছে। একজন মানুষের পক্ষে পুরস্কার পাওয়ার আনন্দ উদযাপন ও মুগ্ধতা হয়তো খুব স্বাভাবিক। অবশ্য তাঁর বঞ্চনা উত্তর প্রাপ্তিটুকুর প্রতি তাঁর কৃতজ্ঞতা অনস্বীকার্য নয়। কিন্তু আমি ভেবেছি একজন স্রষ্টা নিজেও তার উচ্চতা সব সময় বুঝতে পারেন না, কিংবা অন্য আর পাঁচজনের মতো শিশু হয়ে যান। হেলাল হাফিজ আসলে বাংলা একাডেমি পেয়েছেন তাঁর লেখার জন্য নয়, আওয়ামী-বিএনপি সমর্থক হওয়ার জন্যও নয়– তিনি পুরস্কার পেয়েছেন মূলত বন্ধুকৃত্য হিসাবে। কিন্তু আবিদ আজাদের সেই বন্ধু ভাগ্য হয়নি। তিনি হাসপাতালে মারা যাচ্ছেন– আর অন্যরা পুরস্কারের জন্য কবিতার বদলে কতটা ক্ষমতাসীন দলের লোক তা প্রমাণের জন্য সংস্কৃতিক মন্ত্রীকে মা, আল মাহমুদকে চাচা বলে বেড়াচ্ছেন। আর ঠিক আগের মতো এখনো এক শ্রেণির কবি-সাহিত্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো আশেপাশে মহড়া দিয়ে বেড়াচ্ছে– কে পুরস্কার নেবে, আর কাকে পুরস্কার দেবে।
গতকাল যারা শোডাউন করলেন– তারা গত পরশু কোথায় ছিলেন– তখন তো হেলাল হাফিজ বেঁচে ছিলেন, অর্থের সমস্যা ছিল, চিকিৎসার সমস্যা ছিল, কিন্তু তাদের কজনই বা তাঁর কাছে গিয়েছেন, সাধ্য মতো সহযোগিতার চেষ্টা করেছেন। আর যারা করেছেন তারা নীরবে নিভৃতে রয়ে গেছেন, তাদের কথা কেউ জানতেও পারছেন না। আর যারা জানান দিয়েছেন– তাদের জানান দেয়াই কাজ– এতে আখেরে তাদের ফায়দা আছে।
তবে আমার একটি কষ্ট রয়ে গেছে। হেলাল ভাই বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়ার পরে জাতীয় প্রেসক্লাব কর্তৃপক্ষ তাঁর একটি সাক্ষাৎকার ছাপতে চাইলেন– প্রেসক্লাবের বার্ষিক ম্যাগাজিনে। হেলাল ভাইকে এটি প্রেসক্লাবের তৎকালীন সেক্রেটারি জানালে তিনি বলেছিলেন– সাক্ষাৎকারটি যেন আমাকে দিয়ে নেয়ানো হয়। কিন্তু হেলাল ভাই শেষ পর্যন্ত সাক্ষাৎকারের ব্যাপারে আগ্রহ পেলেন না। আমাকে বললেন, তুমিও কিছুটা আড়ালে থাকতে ভালোবাসো, আমিও আড়ালে থাকতে ভালোবাসি, বাদ দাও। যাই হোক, সেদিন সাক্ষাৎকাটা নিয়ে নেয়াই ভালো ছিল, কিন্তু আমিও আসলে তাঁর মতো পিছলে যেতে চেয়েছিলাম। আমার উচিত হয়নি, কারণ হেলাল হাফিজ কি লিখেছেন, কতটা লিখেছেন, তার সাহিত্যিক মূল্য কি– তারচেয়ে বড়– তিনি একটি সময়ের নির্মাতা– কবিকালের নির্মাতা– তাঁর প্রয়াণের মধ্য দিয়ে সে কালের অবসান হলো।