spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদসাক্ষাৎকারসাক্ষাৎকার : মুহম্মদ আবদুল বাতেন

গ্রহণে : সাজ্জাদ বিপ্লব

সাক্ষাৎকার : মুহম্মদ আবদুল বাতেন

সাক্ষাৎকার : বাংলা রিভিউ

১. বাংলা রিভিউ : জীবন কি? আপনার বর্তমান জীবন, অবস্থান– যা হতে চেয়েছিলেন বা যা হয়েছেন–এসব নিয়ে কোন আক্ষেপ, অনুশোচনা বা গর্ব হয়?
মুহম্মদ আবদুল বাতেন: ধন্যবাদ আপনাকে। আপনার প্রশ্নটি আমাকে ভাবনায় ফেলে দিলো। এর একটা জবাব বায়োলজিক্যাল,সবাই সেটা জানেন। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত একটা জীবন, কিন্তু জীবন মানে আরো এতো কিছু যে তা ব্যাখ্যা করে শেষ হবেনা। প্রত্যেকেই নিজের নিজের উপলব্ধি থেকে এর ব্যাখ্যা দেবেন। ধর্ম,বিজ্ঞান ও দার্শনিকভাবে জীবনকে নানা অন্তদৃষ্টি থেকে বিচার করা যায়। প্রাণী মাত্রই জীবন আছে, কিন্তু মানুষের জীবন সম্পূর্ণ আলাদা,কারন মানুষের কনশাসনেস। জীবন কি এই প্রশ্ন পৃথিবীর আর কোন প্রাণী কখনো তুলতে পারেনা। আমাদের জানামতে এই মহাবিশ্বে মানুষ ছাড়া কেউ নেই, যে তার নিজের জীবন সম্পর্কে প্রশ্ন তুলতে পারে। এই জীবন অনন্ত এক সিঁড়ির অংশ, কোথা থেকে এসেছি, কোথায় আছি এবং কোথায় যাবো এই প্রশ্নের মধ্যে জীবন এক রহস্যময় জটিল আখ্যান। প্রাণধারণই জীবন নয়। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যে জীবন, এটা আমার অস্তিত্বের একটি বিশেষ পর্বমাত্র। এই পর্বের আগে অন্য কোনরুপে,অন্য কোন জগতে ছিলাম,মৃত্যু পরে অন্য কোন জগতে ফিরে যাবো। জগতের সব কিছু অ্যাটমিক কাঠামো দিয়ে তৈরি,প্রাণের মৃত্যু মানে দেহের বিলুপ্তি, কিন্তু বস্তু ও শক্তিরূপে আমি অবিনাশী। এটাই পরকাল,পরজগত। সত্যকে জানার চেষ্টা, প্রকৃতির রহস্য বোঝা এবং নিজেকে জানার চেষ্টার মাধ্যমে অনন্তজীবনকে অুনধাবনের মাধ্যমে মানুষ তার জীবনের মূল্য বুঝতে পারে,জীবন তার জন্যই অর্থবহ হয়ে ওঠে।
আমি কি হতে চাই, সেটা চূড়ান্ত নয়, আল্লাহ আমাকে কোথায় নিয়ে যাবেন,কোন গন্তব্যে পৌঁছাবেন সেই তিনি নির্ধারণ করেন। আমি বিশ্ব-প্রকৃতির রহস্যের অনুসন্ধিৎসা নিয়ে বেড়ে উঠেছি। যা আমাকে প্রকৃতির আকর্ষণ বাড়িয়ে দিয়েছে, কবিতা ভাষা ছাড়া সেই রূপময়তা প্রকাশের মাধ্যম নেই। তাই কবিতা দিয়েই জীবন শুরু, স্কুল জীবন থেকে আমি সাহিত্যের দিকে ধাবিত হয়েছি। আমি পাঠ্য বইয়ের বাইরের পাঠের জগতে বিচরণ করেছি। পাঠ্য বই পেছনে থাকতো। আমি কবি হয়ে ওঠার পথে হেঁটেছি, বিজ্ঞান ও দর্শনে সমান আগ্রহী হয়ে উঠেছি। পেশা হিসেবে অধ্যাপনার চিন্তা করেছি।সেই সুযোগও হয়েছিল, শেষ পর্যন্ত সাংবাদিকতায় থেকে গেলাম। আমার কোন,আক্ষেপ নেই,সমাজ ও মানুষের জন্য কিছু করতে না পারার অনুশোচনা আছে,কিন্তু গর্ব করার কিছু,এই মহাবিশ্বে আমি কিছুই না। এই জগত যিনি সৃষ্টি করেছেন, গর্ব বা ঐশ্বর্য কেবল তারই। ভালো লাগে এই ভেবে যে আমি সুস্থ আছি,প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে আছি,অধিক প্রত্যশা থেকে মুক্ত আছি, মানসিকভাবে প্রশান্তির মধ্যে আছি। এখনো পড়াশোনার মধ্যে থাকার সুযোগ পাচ্ছি। লেখার মধ্যে আছি।বস্তু,মানুষ ও এই মহাবিশ্ব নিয়ে চিন্তা ও কল্পনার মধ্যে ডুবে থাকতে পারছি। জীবন সম্পর্কে দস্তয়েভস্কি’র একটা বক্তব্য আছে,সেটা হলো : “মানুষের অস্তিত্বের রহস্য শুধু বেঁচে থাকার মধ্যে নয়, বেঁচে থাকার জন্য কিছু খুঁজে পাওয়ার মধ্যে।”
২. বাংলা রিভিউ: আপনার শৈশব-কৈশোর কোথায় কেটেছে? কীভাবে কেটেছে? কোন অব্যক্ত কথা বা স্মৃতি কি মনে পরে? তাড়িত করে?
মুহম্মদ আবদুল বাতেন : আমার জন্ম বরিশালের এক প্রত্যন্ত গ্রামে।তখন সেখানে সড়ক,বিদ্যুৎ সুবিধা কিছুই ছিলো না। প্রকৃতপক্ষেই এটি ধান,নদী,খালের ভূমি। বর্তমানের সাথে সেই গ্রামের মিল নেই। বরিশাল শহর থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার পুবে আমার গ্রামের নাম পতাং। গ্রামের নামটি একটু ভিন্ন,এই নামের উৎপত্তি পর্তুগিজ ভাষা থেকে,এই অঞ্চলে১৪-১৫ শতকে পর্তুগিজ বণিকদের বিচরণ ছিল। এই গ্রাম সম্পর্কে আলোচনা দীর্ঘতর হবে।আমি সেদিকে যাবোনা।এই গ্রাম আমার তীর্থভূমি,জন্ম,শৈশব কৈশোর এখানেই কেটেছে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের পড়াশোনা এখানেই।ওই এলাকার মধ্যে এই গ্রামটি সমৃদ্ধ ছিল।পতাং প্রাইমারি ও হাইস্কুল ছিল এর প্রাণকেন্দ্র। সেই স্মৃতিতে ফিরলো সেটা সমাপ্তি টানা সহজ হবেনা। স্মৃতিতে তার বিচিত্র রূপ-রস আমাকে এখনো আচ্ছন্ন করে রাখে। এখনো গ্রাম আমাকে টানে।সেখানে ফেরার ইচ্ছে জাগে। অনেক স্মৃতি স্কুল জীবন,শিক্ষক, সহপাঠী, গ্রামের মানুষ,আত্মীয়স্বজন,প্রতিবেশী, কৃষিজীবী সমাজের জীবনধারা,কৃষক,মজুর,জেলে মাঝি,ওজা,কবিরাজ,নাপিত,বয়াতি,যাত্রা ও জারি ও পালাগান নানা বৈচিত্র্যময় এক জীবনধারা। এ নিয়ে আমার জীবন কথা লেখার পরিকল্পনা আছে। সেখানেই স্মৃতির রোমন্থন তুলে ধরার ইচ্ছে আছে।
৩. বাংলা রিভিউ: সাহিত্যে এলেন কেন? কীভাবে এলেন? অর্থাৎ শুরুটা কীভাবে? কোথায়?
মুহম্মদ আবদুল বাতেন : আমাদের বাড়িতে ধারাবাহিক পড়াশোনার পরিবেশ ছিল। বাবা মা আমাদের ভাই বোনদের পড়াশোনাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতেন। পড়ার টেবিল কখনো খালি থাকতো না। পরিবার স্বচ্ছল ছিল। আমাদের মাঠে কাজ করতে হতো না। বড় ভাই গ্রামে পড়াশোনা করা প্রথমদিকের একজন ছিলেন,পরে আমারাও সেই পথে হেঁটেছি। বাড়িতে বইপত্র ছিল,পাঠ্য বইয়ের বাইরের বইয়ের দিকেও আকর্ষণ তৈরি হয়েছিল। স্কুল জীবনেই বই কেনা শুরু করেছি। বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র, তারাশঙ্করের উপন্যাস পড়েছি,রবীন্দ্রনাথ,নজরুল মধুসূদন দত্তের লেখার সাথে পরিচয় ঘটে,মীর মোশাররফ হোসেনের বিষাদ সিন্ধু,কালীদাসের মেঘদূত (রাজশেখর বসুর অনুবাদ), যাত্রার বই পড়েছি। এখনো সেই বইগুলো সংগ্রহে আছে,বইয়ে আমার পাঠের চিহ্ন রয়েছে,সময় তারিখ লেখা আছে। এগুলো স্মৃতি হয়ে আছে। শৈশবটা শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্তের মতো বাউণ্ডুলে হয়ে উঠেছিল। রাতে যাত্রা দেখতাম,গানের আসরে ছুটতাম,মাছ ধরতাম, বড়শি ফেলতাম,ঘুড়ি উড়াতাম। তখন স্কুলের বার্ষিক নাটক হতো।গ্রামে সার্কাসের দল,যাত্রার দল আসতো। বেদে নৌকার বহর আসতো। এরমধ্যেই সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময় একটা নাটক লিখে ফেললাম,শুরু হলো লেখার খাতা। ওই নাটক পড়ে থাকলো পেছেনে। লেখার খাতাটা এখনো আছে। সেই চলার পথ একদিন কবিতার কাছে নিয়ে এলো। স্কুল জীবনেই কবিতা লিখলাম। কিন্তু তা আমি নিজেই আড়াল করলাম। ইন্টারমিডিয়েট থেকে লেখাটাই অনিবার্য হয়ে উঠলো, আজো তা চলছে, ক্রমাগত পরিবর্তিত হচ্ছে।
৪. বাংলা রিভিউ: বাংলা ভাষার তথা বাংলাদেশের প্রধান কবিবৃন্দ যেমন : ফররুখ আহমদ, আহসান হাবীব, সৈয়দ আলী আহসান, আবুল হোসেন, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, ফজল শাহাবুদ্দীন, শহীদ কাদরী, আবদুল মান্নান সৈয়দ, আবিদ আজাদ প্রমুখ– তাদের সাহিত্যকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করেন? আর কার-কার সঙ্গে আপনার সখ্যতা বা বন্ধুত্ব বা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে উঠেছিলো বা আছে? তাদের সম্পর্কে আপনার অভিজ্ঞতা বা তাদের সাহিত্য নিয়ে আপনার মতামত জানতে চাই।
মুহম্মদ আবদুল বাতেন: আপনি যাদের নাম উল্লেখ করেছেন প্রত্যেকেই বাংলা ভাষার কালাতিক্রম কবি। বড় কবি। ফররুখ আহমদের সাথে দেখা হওয়ার সুযোগ ছিল না। মৃত্যুকালে আমি কিশোরমাত্র। শহীদ কাদরী প্রবাসে থাকায় সাক্ষাতের সুযোগ ছিলোনা। আর সকলের সঙ্গেই যোগাযোগ হয়েছে। কারো কারো সাথে দীর্ঘ সময় কেটেছে। নানা মাত্রিক কাজে যুক্ত ছিলাম। সবার সাথেই বিপুল স্মৃতি। কবি আবদুল মান্নান সৈয়দের সাথে নিত্যদিনের যোগাযোগ ছিল। আহসান হাবীবের সাক্ষাতের সুযোগ হয়নি,তিনি যে দিন মারা যান,তখনও আমি গ্রামে,রেডিওতে তার মৃত্যু সংবাদ শুনেছি। তার ‘রাত্রিশেষ’ ও ‘দুই হাতে দুই আদিম পাথর’ কবিতার বই দুটি তখনই পড়া ছিল, এটা একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম,আধুনিক কবিদের লেখার দিকে ফেরার সময়। সৈয়দ আলী আহসান, আবুল হোসেন, শামসুর রাহমান,আল মাহমুদ, ফজল শাহাবুদ্দীন তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও যোগাযোগ ছিলো, এ নিয়ে লিখতে গেলে বৃহৎ পরিসরে লিখতে হবে। আবিদ আজাদের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক ছিল, জুনিয়র বিশ্বস্ত বন্ধু ছিলাম। আপনি যাদের নাম উল্লেখ করেছেন তাদের বাইরেও আরো অনেক কবি লেখকের সঙ্গে স্মৃতি রয়েছে। সেই দীর্ঘ আলোচনা এই পরিসরে সম্ভব নয়।
৫. বাংলা রিভিউ:আপনি একাধারে একজন কবি ও সাহিত্য বিশ্লেষক–অর্থাৎ বহুমাত্রিক। আপনার অভিজ্ঞতা ও বিচরণ ক্ষেত্র ব্যাপক ও বর্ণিল। বিচিত্র। এই সামগ্রিক সত্তাকে কিভাবে দেখেন? কিভাবে উপভোগ করেন?
মুহম্মদ আবদুল বাতেন: বহুমাত্রিকতার মধ্য দিয়ে আমরা ক্রমাগত সত্যে পৌঁছাতে চাই। সাহিত্য, দর্শন,বিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব সবকিছুর মধ্য দিয়ে আমরা একটা সত্যই জানতে চাই আমি কে,জগত কি,জীবন ও মহাবিশ্বের মধ্যে সম্পর্ক ও সংযোগ কোথায় সেই অনুসন্ধিৎসা আমাকে তাড়িত করে। কবিতা কল্পনা ও ধারণায় এগিয়ে থাকে, তাই এই মাধ্যমের সাথে জগত জীবনের অবচেতন যোগাযোগ ঘটে। সব কিছুর যে তত্ত্ব ‘থিউরি অব এভরিথিং’ সেই ধারণার দিকে স্পিরিচ্যুয়াল আকর্ষণ আমাকে আচ্ছন্ন করে। সব কিছুর উৎস এক এবং অভিন্ন, এই ভবিষ্যৎ দুনিয়ার চিন্তাধারার দিক থেকে আমি ফিউচারিস্ট। এ নিয়ে আমার একটা বই আছে ‘বায়োসেন্ট্রজম নিজের ভেতরে নিভৃত বিহঙ্গ’। এর মূল কথা জগতের সব কিছুই আন্তঃসম্পর্কযুক্ত। আমরা পৃথিবীতে বাস করি, কিন্তু পৃথিবীই শেষ কথা নয়। আমরা এখন কোয়ান্টাম কসমোলজির জ্ঞান কান্ডে ঢুকে পড়েছি,সময় দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে, বোধ, কল্পনার জগত প্রসারিত হচ্ছে, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সচেতনতা আমাদের চিন্তা ও কল্পনা এগিয়ে থাকে আমার লেখায় তার ছায়া পড়ে। দুনিয়া সম্পর্কে ধারণা প্রসারিত না হলে আমার লেখার গুরুত্ব তাৎক্ষণিকতায় ফুরিয়ে যাবে। এক দশক পরে সেই লেখাও হারিয়ে যায়। আমরা নিজেদের এই সময়েই তার নজির দেখছি। আমি নিজেকে মহাবিশ্বের অংশ ভাবি,দেশ-কালের মধ্যে থেকেও অন্তহীন সময়ের পরিসরে মহাসৃষ্টির মধ্যে নিজেকে কল্পনা করি। আমি,মুগ্ধ, প্রশান্ত,অবিচলিত। দর্শন,বিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব,কসমোলজি সব কিছু মধ্য দিয়ে মানবজগতের অস্তিত্ব অনুভব করার চেষ্টা করি। আমি সামান্য,অতিক্ষুদ্র কিন্তু মহাবিশ্বেরই অংশ। দম্ভ,অহংকার ও অমরত্বের স্থুল আকাঙ্ক্ষা আমার নেই। আমরা সবাই একই উপাদানে গঠিত,সবার একই পরিণতি।একদিন পৃথিবী ছিলোনা,এই সূর্যও ছিলোনা,আবার এসব কিছুই থাকবে না। কিন্তু আমাদের যাবতীয় সত্ত্বা এই মহাবিশ্বের অংশ হয়ে থাকবে। সেই জগত সম্পর্কে আমাদের কোন ধারণা নেই। আমার কোন ভাষা নেই,একটি কথাই বলতে পারি,সেটি হলো আলহামদুলিল্লাহ, সকল প্রশংসা আল্লাহর। ভাষাহীন জগত থেকে এসেছি, আবার সেখানেই ফিরে যাবো।
৬. বাংলা রিভিউ: আদি বাংলা তথা চর্যাপদ থেকে আজ অবধি বাংলা সাহিত্য কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে–আপনার বর্ণনা ও বিশ্লেষণে?
মুহম্মদ আবদুল বাতেন: আপনার এই প্রশ্নের বিষয়ে বলতে গেলে বড় আলোচনায় যেতে হবে। এ নিয়ে আমার একটা লেখা আছে,বইয়েও আছে। ভাষা,সাহিত্য কখনো এক জায়গায় থাকে না,ক্রমাগত বিবর্ধিত,পরিবর্তিত ও রূপান্তরিত হয়। পৃথিবীর সব ভাষা সাহিত্যের ক্ষেত্রেই তা সত্য। কারণ বদলে যায়,আপাত স্থান একই মনে হলেও বাস্তবে তা নয়। পৃথিবী আজ যে স্থান অতিক্রম করলো, সেখানে আর কখনো ফিরে আসবে না। সময়ের সম্পর্ক গতির সাথে। সব কিছুই সচল,গতিশীল তাই আমরা সময়ের অস্তিত্ব অনুভব করি। চর্যাপদ থেকে আজকের সময়ের ব্যবধান কমবেশি হাজার বছর,কিন্তু পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব লাখ লাখ বছরের।এক হাজার বছর সেই হিসেবে একটা দিনের সমানও নয়। চর্যাপদ থেকে ভাষা ও সাহিত্য রূপান্তরিত হতে হতে আজ আমরা এখানে পৌঁছেছি। এই বিবর্তনের মধ্যেও যোগসূত্র আছে,ভাষার জিনিয়ালোজিক্যাল অরিজিন একটা চেতনাগত সংযোগ বজায় রেখেছে। কিন্তু চর্যাপদ আর আজকের সাহিত্য এক নয়,আমরা তা সবাই জানি। একশ বছর পরে আমাদের আজকের ভাষা ও সাহিত্য অতীত হয়ে যাবে। পৃথিবীর ভাষার প্রসারণ ঘটেছে এখন সংকোচনের দিকে যাচ্ছে। কবি লেখকদের এই ধারণাটা থাকা দরকার।বিষয়টা এখানে ব্যাখ্যা করার সুযোগ নেই। আগামী দুই দশকে ভাষার বিরাট পরিবর্তন হবে। গণিতও ভাষা, তথ্য-প্রযুক্তি তো ভাষা সংক্ষেপের বাহন হয়ে উঠেছে। ভাষার বাহুল্য কমে আসবে। কবিতার আগামী দিনের ভাষা আরো সংহত এবং সাংকেতিক হয়ে উঠবে।
৭. বাংলা রিভিউ: সাম্প্রতিক বাংলাদেশে, শিল্প-সাহিত্যচর্চায় কোন-কোন চ্যালেঞ্জ বা সুবিধা-অসুবিধা আছে বলে আপনার মনে হয়? কীভাবে এগুলি মোকাবিলা করেন?
মুহম্মদ আবদুল বাতেন: বড় সমস্যা সাহিত্যের মধ্যে লেখকের নিষ্ঠা ও মনোনিবেশের সংকট। কবি লেখকের জীবনব্যাপী সাধনার স্পৃহা লুপ্ত হয়েছে। লেখাকে সৌখিন ও পরিচিত একটা উপায় হিসেবে নেয়া হচ্ছে। ফেসবুকে লিখেই লেখক কবি পরিচয়ে প্রচারণায় আত্মতুষ্টি এখন আত্মঘাতী হয়ে উঠছে। লেখায় শিল্পকুশলতা ও গভীরতা কমে গেছে। প্রপাগান্ডা,পুরস্কারের মোহ,দলবাজি এসব লেখালেখির বিষয়টা সাহিত্যের বাইরে ঠেলে দিচ্ছে। নানা সংগঠন,লিটলম্যাগ,অনলাইন গোষ্ঠী কেন্দ্রিক আত্মপ্রচারের মাধ্যম হয়ে উঠেছে। তথ্য প্রযুক্তির সুবিধা আমাদের বইয়ের সাথে সরাসরি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। তাই সাহিত্য এখন ভাসমান, গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে। নতুন প্রযুক্তির সুবিধার কারনে এটা একটা ক্রান্তিকাল। খুব কম সময়ে সাহিত্য বদলে যাচ্ছে, বৈশ্বিক জ্ঞান ও সময়ের ভাষা নিয়ে সামনে নতুন সাহিত্য আসবে,হয়তো আমরা তা দেখার সময় পাবোনা। ফিউচারিস্ট ভাবনাগুলো বুঝতে পারলে আমরা কিছুটা এগিয়ে থাকার সুযোগ পাবো।
৮. বাংলা রিভিউ: আপনার প্রথম প্রকাশিত বই কোন টি? কবে প্রকাশিত হয়েছিলো? প্রথম বই প্রকাশের অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি কেমন ছিলো?
মুহম্মদ আবদুল বাতেন: আমার প্রথম বই প্রকাশিত হয়,১৯৯৬ সালে। বাংলা একাডেমি তরুণ লেখক প্রকল্পের অধীনে বইটি প্রকাশ করেছে। বইটির নাম ‘অশ্বারোহী মেঘ’। বইটির প্রচ্ছদ করেছিলেন শিল্পী কাইয়ূম চৌধুরী। এর আগে আমার একটা বই প্রকাশের প্রক্রিয়ার মধ্যে ছিল,বইটির কাভার ছাপা হয়েছিল,বইয়ের প্লেটগুলো প্রেসে গেছিলো। মাস দুয়েক আমি অন্য কারণে ঢাকার বাইরে ছিলাম,প্রকাশককে ছাপা বন্ধ রাখতে বলেছিলাম। আমার বইটির নাম ছিল ‘যতিহীন যাতনাহীন’।আমরা প্রিয় শিক্ষক কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ বইটির বিষয় জানতেন। তিনি বললেন,’বইটির নাম ‘যতিহীন যাতনাময়’ হতে পারে। বয়স যতো বাড়বে ততোই যাতনাটা টের পাবে। আসলেও তাই। স্যার বাংলাবাজার থেকে আমাকে নিয়ে রিকসায় করে পুরান ঢাকা ঘুরিয়ে আলাউদ্দিন রোডের এক খাবার হোটেলে গেলেন। রিকসায় এবং পরে বিরানি খেতে খেতে স্যার গ্যায়টে থেকে রবীন্দ্রনাথ, আবু সয়ীদ আইয়ুব,ফরাসি প্রতীকবাদী সাহিত্য নিয়ে কথা বললেন,আমি প্রশ্ন করে তাকে উজ্জীবিত করলাম। আর মনে মনে ‘যতিহীন যাতনাহীন’ বইটির প্রতি উৎসাহ হারিয়ে ফেললাম। এটা আমার জন্য কঠিন সিদ্ধান্ত ছিল। বাইন্ডিং খানায় খবর নিয়ে জানলাম কাভার নষ্ট হয়ে গেছে,কাভারের স্তুপে তাদের টিনের ছিদ্র দিয়ে বৃষ্টির পানি পড়ে নষ্ট হয়েছে। ভাবলাম প্রকৃতির ইচ্ছে অনুযায়ী কাজ হচ্ছে। পরে বাংলা একাডেমির পান্ডুলিপি করার সময় স্যার বললেন তোমার আগের পান্ডুলিপি আমাকে দাও। কবিতার খাতাটি স্যারকে দিলাম,তিনি প্রশংসা করলেন এবং অনেকগুলো কবিতা বাছাই করে বললেন এগুলো বাংলা একাডেমির পান্ডুলিপিতে দাও। তাই করলাম। কবি রফিক আজাদ আমার পান্ডুলিপি যাচাই করে প্রশংসা করলেন। রফিক আজাদ অন্যদের কাছেও বইটি প্রশংসা করেছেন। ওনার অপার স্নেহ লাভ করেছি। কবি নুরুল হুদার প্রতিও কৃতজ্ঞতা জানাই,তার পরামর্শ নির্দেশনায় আমার অলসতার ঘোর কেটে গেছে। ‘অশ্বারোহী মেঘ’ আমার প্রথম কবিতার বই হিসেবে জন্ম নিলো। বইটি উৎসর্গ করলাম প্রিয় শিক্ষক,আমার শিল্পগুরু কবি,গবেষক আবদুল মান্নান সৈয়দকে। প্রথম বই প্রথম সন্তানের মতো। বইটি প্রশংসিত হয়েছে, কবি বন্ধু, লেখক ও পরিচিতদের কাছেও বইটির প্রশংসা পেয়েছি। দেখা হলে তারা আমার নাম না বলে, বলতো ‘এই যে অশ্বারোহী মেঘ কেমন আছেন।’ বইটির রিভিউ দৈনিকে ছাপা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা লিখেছেন,কবি,বরেণ্য শিক্ষাবিদ,প্রফেসর সৈয়দ আলী আশরাফ। তাঁর সান্নিধ্যে আমি রুহানিয়াত জগতের শিক্ষা পেয়েছি।
৯. বাংলা রিভিউ: সাহিত্যে আপনি কার উত্তরাধিকার বহন করেন?
মুহম্মদ আবদুল বাতেন: সাহিত্য কোন একক উত্তরাধিকারের বিষয় নয়। প্রথমত আমিই আমার এবং সমগ্রের উত্তরাধিকার বহন করছি। আমি খুব সামাজিক এবং মিশুক নই। একা চলার মানুষ। দল ও গোত্রের আনুগত্যও আমার স্বভাবের সাথে মিলে না। মজলিসে সবার পেছনে বসি। লেখার বাইরে আমি কথা খরচ করতে অভ্যস্ত নই। নিরব মনে বিস্ময় ও মুগ্ধতা নিয়ে মানবজাতির উত্তরাধিকার বহন করছি। আমি এই মহাবিশ্বের স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। এই মহাসৃষ্টির মধ্যে মানুষকেই তিনি জানা ও বোঝার আংশিক ক্ষমতা দিয়েছেন এবং পৃথিবী ও মহাবিশ্বকে সজ্জিত করেছেন,যার একটা না হলে অন্যটা চলে না। সূর্য না থাকলে পৃথিবী থাকেনা, মিল্কওয়ে গ্যালাক্সি না থাকলে সূর্য থাকে না,এভাবেই এই জগত সিমেট্রি গড়ে তুলেছে।
১০. বাংলা রিভিউ: এ যাবৎ সর্ব মোট আপনার কতটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে? এর মধ্যে কোনটি বা কোন-কোন কাজকে বা কোন বইকে আপনি আপনার উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি বলে মনে করেন?
মুহম্মদ আবদুল বাতেন: আমার ১৭টি বই বের হয়েছে। এরমধ্যে ১২টি কবিতার,বাকিগুলো গদ্য– এতে সাহিত্য, শিল্পতত্ত্ব,দর্শন,বিজ্ঞান– কোয়ান্টাম কসমোলজি নিয়ে আলোচনা আছে। আমি কবিতাকেই চিন্তা ও কল্পনার মূল জায়গায় রেখেছি।
১১. বাংলা রিভিউ: সম্প্রতি প্রকাশিত আপনার নতুন বই সম্পর্কে বলুন।
মুহম্মদ আবদুল বাতেন: সর্বশেষ প্রকাশিত হয়েছে কবিতার বই। এটির নাম ‘গুম ঘুমের কহর কাল’। বইটি বিগত আওয়ামী সরকারের শেষ দিকে বের হয়েছে। এখানে গুম ও খুনের ঘটনা নিয়ে কবিতা রয়েছে। বইটির বিপদজনক দিক বিবেচনা করে বইটি তেমন প্রচার করা হয়নি। অনেকে আমাকে এব্যাপারে সতর্ক করেছেন।
১২. বাংলা রিভিউ: আপনি নিজেকে কোন দশকের কবি-লেখক বলেন? কেন?
মুহম্মদ আবদুল বাতেন: কবির জন্য কোন দশকের সীমা নির্ধারিত নেই। সাহিত্যের পরিসরে আত্মপ্রকাশের নির্দেশক হিসেবে আমি নব্বই দশকের। হঠাৎ করে এটা হয়না। একটি চলমান প্রস্তুতির মধ্যেই এই আগমন ঘটে। আমি সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছি। সময়ের সাথে সবকিছু বদলাচ্ছে, আমি এই পরিবর্তনের সহগামী। আমি এই সময়ের যে দুনিয়া দেখছি,আমি তার সহযাত্রী। আমি নিজেকে ফিউচারিস্ট মনে করি,আজ আমি বেঁচে আছি,আগামীকাল নাও থাকতে পারি।জীবনের এই অনিশ্চয়তা ও পরিণতি আমাকে ভাবায়। বিংশ শতাব্দীর সেরা দার্শনিক লুতভিগ ভিটগেস্টাইন তার বিখ্যাত রচনা ট্যাকটেটাস লজিকো ফিলোসোফিকাস এ বলেছেন, আজ সূর্য উঠেছে,আগামীকাল সূর্য উঠবে কিনা তা আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারিনা। আমাদের অভিজ্ঞতা এবং ধারণা জন্মেছে যে,আগামীকাল অনুরূপ সূর্য উঠবে। কিন্তু নাও উঠতে পারে,কারণ আমাদের হাতে এর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। মহাবিশ্বের যে কোন সিমেট্রি লংঘন হলে সবকিছু প্রলয়ের মধ্যে পতিত হতে পারে। প্রায় পাঁচ শত কোটি বছর আগে এই সূর্য ছিলোনা,এই সৌরজগত ছিলোনা,পৃথিবী ছিলোনা।আমরাও ছিলামনা। আরো পাঁচশো কোটি বছরে সূর্যের আয়ু ফুরিয়ে আসবে। লাল তারকায় পরিণত হবে,পৃথিবীও থাকবে না। এটা বিজ্ঞানের হিসাব। আমাদের নিকটবর্তী কোন তারকার সুপারনোভা বিস্ফোরণ হলে আমাদের সৌরজগতের বিপর্যয় ঘটতে পারে। আজকের বিজ্ঞান ও দর্শন এসব ভাবনা হাজির করছে। আজ ও আগামীদিনের কবি,লেখকদের জন্য এই ভাবনা ও দৃষ্টিকোন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। কবির চিন্তায় ভবিষ্যৎ কল্পনা অনুপস্থিত থাকলে তিনি আগামী প্রজন্মের কাছে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে থাকবেন। কবির বিচার কোন নির্দিষ্ট দশক দিয়ে হবে না। সেটা যারা করেন,কবি হিসেবে তাদের আয়ু ততটুকুই। আমি আজ ও আগামীদিনের ভাবনার সঙ্গে থাকার চেষ্টা করি। বায়োলজিকয়ালি গতকালের আমি আর আজকের আমি এক নই, আমি আগামীকালের অভিমুখের যাত্রি। আমি আমার লেখা ও চিন্তাকে এই চলমান সময়ে প্রতিস্থাপনের চেষ্টা করি।
১৩. বাংলা রিভিউ: আপনার সমকাল নিয়ে বলুন।
মুহম্মদ আবদুল বাতেন: আগের প্রশ্নের জবাবে এ বিষয় আলোচিত হয়েছে। আমার সমকাল নিয়ে সাহিত্যের আলাপ দীর্ঘতর হবে। এখন সময় দ্রুত বদলে যাচ্ছে, আগে যা একশ বছরে ঘটতো এখন তা দশ বছরে ঘটছে। সময়ের এই দ্রুততা আরো বাড়বে। মোবাইল, ইন্টারনেট, তথ্যপ্রযুক্তির কথা চিন্তা করুন। বিনা তারে ১১ হাজার কিলোমিটার দূরে আপনার সাথে আমি মুহূর্তের মধ্যে যুক্ত হচ্ছি। এই বিষয়গুলো আমাদের সাহিত্য চিন্তায় আসা উচিত। আমরা যেহেতু এসব নিয়ে ভাবিনা,তাই আমরা পুরানো লেখা ও চিন্তার পুনরাবৃত্তি করছি। এসব বিষয় নিয়ে আলাদা আলোচনার দরকার।আজ এ পর্যন্তই।
১৪. বাংলা রিভিউ: আপনি কবিতায় মিথ, ধর্ম ও ধর্মীয় অনুষঙ্গ ব্যবহার করা বিষয়ে কি ভাবেন? বিশেষত ইসলামিক মিথ, ইতিহাস, ঐতিহ্য ইত্যাদি ব্যবহার করা বিষয়ে।
মুহম্মদ আবদুল বাতেন: এসবের ব্যবহার থাকবে,লজিক্যাল ভিত্তি থাকবে। আরোপিত ব্যবহার বর্জনীয়। কিভাবে এসব হাজির করবেন তার ওপর নির্ভর করে এর অপরিহার্যতা। ধর্ম জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত,চিরন্তন এবং বহমান ভাবনার জগত। ইসলামিক বিষয়, ইতিহাস, ঐতিহ্য থাকবে,তবে চিন্তার নতুনমাত্রা নিয়ে আসতে হবে। বিশ্বরহস্য ও আধ্যাত্মিক ভাবনা একই সাথে আসবে। বিশ্বকে আমরা এখন গ্লোবাল ভিলেজ বলি,আসলে এখন শুধু এই পৃথিবী নয়,মহাবিশ্বের ভাবনাই এখন আমাদের চালিত করছে। এবিষয় যদিও খুব কম কবি লেখকই অনুধাবন করেন। বিজ্ঞান,দর্শন,ধর্মতত্ত্ব একটা ইউনিভার্সাল আর্গুমেন্টের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আমি মনে করি সাহিত্যও এর পাশাপাশি চলছে।বর্তমান বিশ্ব সাহিত্যের গতিপ্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করলে এ বিষয়টি স্পষ্ট হবে। সেই আলোচনা এই পরিসরে করা যাবেনা।
১৫. বাংলা রিভিউ: আধুনিকতা ও উত্তর আধুনিকতা বলতে আপনি কি বোঝেন? বাংলাদেশের কবিতার পরিপ্রেক্ষিতে এই বিষয়ে আপনার মতামত জানতে চাই।
মুহম্মদ আবদুল বাতেন: সংক্ষিপ্তভাবে এই প্রশ্নের জবাব দেয়া কঠিন। পশ্চিমের অনুকরণে আমাদের এখানে আধুনিকতার ঢেউ এসে পড়েছে। সময় প্রেক্ষপট সব কিছু বদলে দেয়। এই শিফটিং সময়ের সাথে চলমান। আধুনিকতা ও উত্তরাধুনিকতার প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা ছাড়া এর ফারাক স্পষ্ট হবে না। এটি চিন্তার পরিবর্তন, শিল্প সাহিত্য এই পরিবর্তন ধারণ করে। আধুনিকতা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বোধ এবং মানবিক অবক্ষয়ে পতিত হওয়ায় ইউরোপেই উত্তরাধুনিকতার ধারণার উদ্ভব হয়েছে। উত্তরাধুনিকতা অন্তর্ভুক্তিমূলক, মানুষের অধিকার ও মূল্যবোধে ফেরার চেষ্টা। এখন উত্তরাধুনিকতার পরে আসছে বায়োসেন্ট্রিম।কিন্তু আমাদের সাহিত্য তা থেকে পঞ্চাশ বছর পিছিয়ে আছে।এটা ধারণ করার জন্য যে পর্যবেক্ষণ ও প্রস্তুতি সেটা আমাদের সাহিত্য চিন্তায় বিরল। বায়োসেন্ট্রিজম নিয়ে আমার একটা বই আছে। সেখানে এ নিয়ে আলোচনা আছে। এর সার কথা হলো সবকিছুর উৎস এক ও অভিন্ন। মানুষ থেকে মহাবিশ্ব সব একই সূত্রে গাঁথা।
১৬. বাংলা রিভিউ: আপনার লেখালেখিতে দেশি-বিদেশি কবি/ সাহিত্যিকদের কারো কোন প্রভাব কি আছে?
মুহম্মদ আবদুল বাতেন: সুনির্দিষ্টভাবে বলা কঠিন। তবে বিশ্বসাহিত্যের সামন্য পাঠের সামগ্রিক প্রভাব আমাকে গতিশীল করেছে। সাহিত্যের পাশাপাশি দর্শন ও বিজ্ঞান আমাকে সমান প্রভাবিত করেছে। আমার মূল ভাবনার জায়গাটা মানুষ,প্রকৃতি ও মহাবিশ্ব।
১৭. বাংলা রিভিউ: কোথায় আছেন? কি করছেন? পারিবারিক পরিচিতি জানতে চাই।
মুহম্মদ আবদুল বাতেন: আমি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা’য় ডেপুটি চিফ নিউজ এডিটর হিসবে কাজ করছি। আমার স্ত্রী কবি,সাংবাদিক ফাতিমা তামান্না। আমর এক মেয়ে রিফা মাইয়াম,ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী।
১৮. বাংলা রিভিউ: আপনি কখনো কি কোন পত্রিকা বা লিটল ম্যাগাজিন অথবা সংকলন সম্পাদনা করেছেন? বিস্তারিত বলুন।
মুহম্মদ আবদুল বাতেন: ১৯৮৮ সাল থেকে এসব কাজে জড়িত। ‘সংকল্প’ ও ‘নতুন সফর’ নামে দুটি সংকলন প্রকাশের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। ‘হৈচৈ’ নামে শিশুদের জন্য একটি পত্রিকায় কাজ করেছি। একটি মাসিক পত্রিকার সহকারী সম্পাদক ছিলাম। এরপর একাধিক দৈনিক পত্রিকার নিয়মিত সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছি। বর্তমানে ‘বাসস’এ কাজ করছি।
১৯. বাংলা রিভিউ: লিটল ম্যাগাজিন এর সংজ্ঞা কি? এ নিয়ে আপনার ভাবনা বলুন।
উদ্ভাবনী চিন্তার কাগজ। নতুন লেখা ও নিরীক্ষার কাগজ। আমাদের দেশে লিটল ম্যাগাজিন হিসেবে যা প্রকাশিত হয়,এগুলো সংকলন, বিভিন্ন গোষ্ঠীর আত্মপ্রচারের মুখপাত্র। এতে লিটল ম্যাগাজিনের চরিত্র বিরল। এসব সংকলন প্রকাশের পেছনে গোষ্ঠী স্বার্থ এবং বাণিজ্যটাই আসল। এতে নতুন চিন্তা ও শিল্পভাবনার উপাদান খুব একটা থাকেনা। এমনকি বৈশ্বিক পরিবর্তনের কোন চিহ্ন থাকেনা। বিশাল আকারে প্রকাশিত এই সংকলনের পেছনে সাহিত্য নয়,বাণিজ্যই মুখ্য।
লিটল ম্যাগাজিনগুলোর লেখায় অন্তত ‘সাধারণ গ্রহণযোগ্যতার থেকে দশ বছর এগিয়ে থাকা উচিত।’ এজরা পাউন্ড বলেছেন, ম্যাগাজিন পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে ইচ্ছুক, যা মূলধারার পাঠকদের কাছ গ্রহনযোগ্য নয়।
২০. বাংলা রিভিউ: অনলাইন ম্যাগাজিন বা ওয়েব ম্যাগাজিন চর্চাকে আপনি কোন দৃষ্টিতে দেখেন?
মুহম্মদ আবদুল বাতেন: ইতিবাচক দেখছি। তবে এগুলোর শিল্পগত মান সংরক্ষিত নয়। চিন্তা ও শিল্পের অভিনবত্বের প্রতিনিধিত্ব করেনা। এটি নতুন প্রচার মাধ্যম। তবে এই মাধ্যমটি ব্যবহার করেও নিজস্ব চিন্তা দর্শন তুলে ধরা যায়।
২১. বাংলা রিভিউ: ‘বাংলা রিভিউ’ পড়েন? কেমন লাগে বা কেমন দেখতে চান–আগামীতে?
মুহম্মদ আবদুল বাতেন: পড়ি। যখন ফেসবুকে দেখি। ‘বাংলা রিভিউর’ মধ্যে চিন্তার ঐক্য পাওয়া যায়। কবি লেখকদের মূল্যায়নের একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে।
২২. বাংলা রিভিউ: ভবিষ্যতে কেমন পৃথিবী কল্পনা করেন?
মুহম্মদ আবদুল বাতেন: আমার আপনার চাওয়া পৃথিবী । কিন্তু এটা আমাদের চাওয়া দিয়ে হবেনা। এটা হবে প্রকৃতির নিয়মে।

………
গ্রহণে : সাজ্জাদ বিপ্লব
ডিসেম্বর ১৪, ২০২৪

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
- Advertisment -

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

তনজিম আতিক on কবিতাগুচ্ছ
নয়ন আহমেদ on না
খান কাওসার কবির on লুৎফর রহমান রিটন নামা
নয়ন আহমেদ on কবিতাগুচ্ছ
সাজ্জাদ সাঈফ on বাছাই কবিতা
নয়ন আহমেদ on বাছাই কবিতা