আমান আবদুহু
দুইহাজার তেরো সালের আগের বছরগুলোতে শাহবাগি ব্লগাররা বাংলা কমিউনিটি ব্লগগুলোতে ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন দিক এবং প্রতীক বিষয়ে সীমাহীনভাবে বর্ণবাদী, কুৎসিত এবং মানহানিকর যা ইচ্ছা তাই মন্তব্য এবং লেখালেখি করে যাচ্ছিলো। তেরো সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ‘আমার দেশ’ পত্রিকায় সেসব লেখার স্ক্রিনশট প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশের মানুষ প্রথমবারের মতো জানতে পারে, অনলাইনে কি হয়। নির্জলা বাস্তবতা জনসাধারণের সামনে পরিস্কারভাবে প্রকাশিত হয়ে যায়। সেই প্রতিবেদনের রিপল ইফেক্ট বাংলাদেশ আজও অনুভব করছে। স্টেট-স্পন্সর্ড তথাকথিত শাহবাগ মুভমেন্ট ওরফে বেলুন-মোমবাত্তি সহকারে জংলী খুনীদের উৎসব-আন্দোলন একদম চুরমার হয়ে যাওয়া, শাপলার গণহত্যা, ফ্যাসিবাদের ক্ষমতা সংহত করণে শাহবাগিদের দিকে ঝুঁকে যাওয়া এমন বড় বড় ঘটনাই কেবলমাত্র নয়, বরং এবং এমন কি চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের শেকড় ভালোভাবে খুড়তে পারলে ঐ প্রতিবেদনের দূরবর্তী প্রভাব খুঁজে পাওয়া যাবে। সুতরাং সত্যকে পরিস্কারভাবে প্রকাশের সেই ঐতিহাসিক ঘটনার প্রভাব বাংলাদেশের নিকট ভবিষ্যতেও ঘটমান থাকবে, নিশ্চিতভাবে বলে দেয়া যায়।
কিন্তু শাহবাগিদের চেহারা খুলে দেওয়া সেই প্রতিবেদন বাংলাদেশের মিডিয়া জগতের লোকজনের কাছে প্রচন্ড দুর্বিষহ এবং অসহ্য বেদনাময় এক স্মৃতির নাম। বাংলাদেশের অমানুষ সাংবাদিক ও অমানুষ সাংবাদিকতার প্রফেসররা সে ঘটনার উল্লেখে আজও কাতরে উঠেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ও অমানুষ বুদ্ধিজীবীরা বিগত এগারো বছর ধরে যখনই সুযোগ পেয়েছে তখনই তারা এথিকাল পারসপেক্টিভ, রেসপনসিবল জার্নাালিজম ইত্যাদি নানা তত্ত্ব হাঁকিয়ে গেছে। তারা যে বেসিক জিনিসটা স্বীকার করে না, তা হলো এইসব তত্ত্ব অমানুষদের মুখে মানায় না। যেহেতু তারা বাংলা অমানুষ, যেহেতু তারা জানে গলাবাজি করতে করতে ত্রিশ লাখের ইতিহাস প্রতিষ্ঠা করা যায়, সুতরাং তারা অবলীলায় এই নির্লজ্জ্ব অমানুষবৃত্তি করে গেছে। ভবিষ্যতেও করে যাবে, এটাও নিশ্চিতভাবে বলে দেয়া যায়।
অথচ বাস্তবতা হলো, সমস্ত এথিকাল পারসপেকটিভস, প্রফেশনাল বিহেভিয়ার অফ জর্নাালিজম এবং রেসপনসিবলিটি টুয়ার্ডস সোসাইটি এন্ড জাস্টিস, সব দিক থেকেই আমার দেশ বাংলাদেশের সমস্ত পত্রিকাকে পেছনে ফেলে দিয়ে হিমালয়ের উচ্চতায় উঠে গেছে ঐ একটা প্রতিবেদন দিয়ে। কারণ দায়িত্বশীলতার সাথে অপরাধের প্রমাণকে প্রকাশ করা হলো ন্যায়বিচারের জন্য অন্যতম বড় একটা সহায়ক কাজ। আমার দেশ যা প্রকাশ করেছিলো, তা প্রকাশ না করলে এসব অপরাধের কোন শাস্তিই হতো না। ইন ফ্যাক্ট, ইনডিভিজুয়ালি কোন শাস্তি এখনো বাংলাদেশে হয়নাই। কিন্তু এই অপরাধীগুলোর সবচেয়ে বড় শক্তি এবং সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক আওয়ামী লীগ কিছুটা হলেও ফলাফল ভোগ করেছে।
তাহলে বাঙু অমানুষরা কেন এইসব ভুয়া যুক্তি দেয়? কারণ তারা মানুষের ধর্মবিশ্বাসের স্বাধীনতাকে কোন অধিকার মনে করে না। এইসব পোগতিশীলরা আসলে এতোটাই জংলী, অন্য মানুষের ডিগনিটি এবং রাইটস টু ফেইথকে বলি দিতে তারা কোন দ্বিধাবোধ করে না। নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য বাংলাদেশের সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীরা এতোটাই অন্ধ ও প্রতিহিংসাপরায়ণ।
শাহবাগি ব্লগাররা ছিলো ক্ষমতার বন্ধু। ক্ষমতার সহায়ক শক্তি। একই সাথে তারা ছিলো ক্রিমিনাল। এ দুইটা বিষয়কে মনে রাখলে, শাহবাগিদের মুখোশ উন্মোচনে আমার দেশের সেই প্রতিবেদনকে অন্ততপক্ষে তিনটা ঘটনার সাথে তুলনা করা যায়।
প্রথমটা হলো উনিশ একাত্তর সালে ওয়াশিংটন পোস্ট এবং নিউ ইয়র্ক টাইমস ভিয়েতনাম যুদ্ধ নিয়ে আমেরিকান সরকারের শয়তানির প্রমাণ প্রকাশ করেছিলো। ঐখানে এথিকাল ডিলেমা ছিলো জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার। অন্যদিকে বিষয় ছিলো জনগণের জানার অধিকার। পেন্টাগন পেপারস নামে বিখ্যাত এই প্রতিবেদগুলোকে আমেরিকার সুপ্রিম কোর্ট ফার্স্ট এমেন্ডমেন্টের কারণে বহাল রাখে।
কয়েক বছর পরেই ওয়াশিংটন পোস্ট আমেরিকান সরকারের রাজনৈতিক বিভিন্ন অপরাধের প্রমাণ প্রকাশ করে। ওয়াটারগেট কেলেংকারী নামে পরিচিতি এই প্রতিবেদগুলোর কারণে প্রেসিডেন্ট নিক্সন পদত্যাগ করে।
সম্প্রতি দুই হাজার চার সালে নিউ ইয়র্কার এবং সিবিএস নিউজ আবু গরীব কারাগারে আমেরিকান সৈন্যদের নির্যাতনের বর্বর ছবি প্রকাশ করে।
জানোয়ার সাংবাদিক সব দেশেই আছে। তবে বাংলাদেশের মতো নব্বই ভাগ না আর কি। সুতরাং প্রতিটা ঘটনাতেই সে সব দেশের নিজ নিজ গোলামগুলো এথিকাল ডিলেমা নিয়ে প্রচুর জ্ঞান কপচিয়েছে। কিন্তু সময়ের কষ্টিপাথরে টিকে গেছে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার শক্তি। পাবলিক ইন্টারেস্টের পক্ষে দাঁড়ানোর নৈতিক অধিকার।
বাংলাদেশ যেহেতু জানোয়ার প্রবণ দেশ, এই জঙ্গলে সমস্বরে চিৎকারের আওয়াজে মনে হতেই পারে ঢাবি সাংবাদিকার অমুক লেকচারার বা তমুক সাংবাদিকটা মনে হয় ঠিক কথা বলতেছে। কিন্তু এইসব শোরগোল যখন থেমে যাবে, ভবিষ্যতে সময়ের সেই কষ্টিপাথরে যাচাই হওয়ার পর মানুষ ঠিকই দেখতে পাবে একদিন এই দেশে নোংরা দালালী গোলামী সাংবাদিকতার সর্বগ্রাসী প্রবল বন্যার মাঝেও আমার দেশ নামে একটা পত্রিকা মানুষের বিশ্বাসের অধিকার, ধর্মপালনের অধিকার, ডিগনিটির অধিকারকে অধিকার হিসেবে বিবেচনা করে প্রবল শক্তিশালী ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে দায়িত্বশীল ভূমিকা নিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো। এটাই সাংবাদিকতা। যারা আবুল তাবুল অসৎ তত্ত্ব কপচায়, তাদেরটা হলো গোলামীর ধান্দাবাজি।