spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদসাম্প্রতিকরাজনীতিতে পলায়ন ও পলায়নের রাজনীতি

লিখেছেন : আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

রাজনীতিতে পলায়ন ও পলায়নের রাজনীতি

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

বাইবেলে বলা হয়েছে, “বন্ধুদের জন্য যে তার জীবন বিলিয়ে দেয়, তার চেয়ে বড় ভালবাসার মানুষ আর হয় না।” সময়ের শুরু থেকে প্রায় প্রতিটি সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে আপনজনদের রক্ষার জন্য কারও নিজের জীবন উৎসর্গ করাকে সাহস এবং নিঃস্বার্থতার চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। কিন্তু দু:খজনকভাবে বাংলাদেশের ৫৪ বছরের ইতিহাসে এমন ঘটেছে যে, একই পরিবারের দুই ক্ষমতাধর ব্যক্তি, যাদের অঙ্গুলি হেলনে একসময় দেশের মানুষ উঠতে-বসতো, তারা উভয়েই দেশবাসীকে বিপদের সকল ঝুঁকির মধ্যে ফেলে নিজেদের জীবন রক্ষার জন্য দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। এই দুজন শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার কন্যা শেখ হাসিনা। পৃথিবীতে যেসব দেশ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে স্বাধীনতা লাভ করেছে, সেসব দেশের স্বাধীনতা অর্জনে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এবং ধাপে ধাপে চূড়ান্ত লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়ার দৃষ্টান্তই অধিক।

আলোচনার ক্ষেত্র প্রস্তুত করার জন্য দখলদার শাসকগোষ্ঠী বা ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলনের ইতিহাস ভারতীয় উপমহাদেশসহ কমবেশি সব দেশের আছে। কিন্তু সমগ্র দেশবাসীর শক্তি ও সমর্থনে পুষ্ট হওয়ার দাবিদারদের দেশ থেকে আলোচনা ও যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে পলায়নের ইতিহাস খুব বেশি নেই। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর (পরবর্তীতে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সিদ্দিক সালিক), যিনি ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে লে: জেনারেল টিক্কা খান ও লে: জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজির তথ্য অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, তিনি তার গ্রন্থ ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ এ ১৯৭১ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেফতার সম্পর্কে লিখেছেন, Mujib readily emerged offering his arrest. He seemed to be waiting for it. (মুজিব সাথে সাথে বের হয়ে এসে তাকে গ্রেফতার করতে বলেন। মনে হয়, তিনি গ্রেফতার হওয়ার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন।) শেখ মুজিবের স্বেচ্ছা গ্রেফতার বরণ, তথা পলায়নের কাহিনি তার সহকর্মীদের বিভিন্ন বিবরণীতেও উঠে এসেছে।

শেখ মুজিব পালিয়েছিলেন ক্ষমতা গ্রহণের আগে। তার কন্যা শেখ হাসিনা পালিয়েছেন ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত তিনটি নির্বাচনের প্রতিটিতে ৮০ শতাংশের অধিক ভোটে ঐতিহাসিক বিজয় (?) লাভ করে প্রধানমন্ত্রী হিনেবে টানা সাড়ে ১৫ বছর ধরে দোর্দণ্ড প্রতাপে দেশ শাসন এবং সকল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিবীর্যকরণের পর। তবে শেখ হাসিনা যে দম্ভে, কণ্ঠের যে টোনে, যে ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন ও বডি-ল্যাঙ্গুয়েজে ‘আমার দেশ,’ ‘আমার বাবার দেশ,’ ‘শেখ হাসিনা পালায় না,’ ‘শেখের বেটি পালায় না,’ ইত্যাদি বলতেন, তাতে তার পলায়নে তার দলীয় নেতাকর্মী ও সমর্থক, পাইক-বরকন্দাজ এবং তার সরকারের আমলে প্রশাসনের সকল পর্যায়ে দলীয় বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্তরা নিদারুণ হতাশ হয়েছেন।

শেখ মুজিব যে পালিয়ে গিয়েছিলেন অথবা স্বেচ্ছা-গ্রেফতার বরণ করেছিলেন, তা তার নিজের স্বীকারোক্তিতেও সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারি ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট শেখ মুজিবের যে সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন, তখন তিনি ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে প্রদত্ত ভাষণে ‘স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র’ ঘোষণা না করার কারণ জানতে চাইলে মুজিব বলেন, “আমি বিশেষ করে ওই দিনে তা করতে চাইনি। কারণ, আমি তখন তাদেরকে একথা বলতে দেওয়ার সুযোগ দিতে চাইনি যে মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে।”

ফ্রস্ট যখন জানতে চান যে, তিনি পাকিস্তানিদের হাতে গ্রেফতার না হয়ে কলকাতায় চলে গেলেন না কেন, তখন শেখ মুজিব উত্তরে বলেন, “আমি যদি ইচ্ছা করতাম, তাহলে যেকোনো জায়গায় যেতে পারতাম। কিন্তু কীভাবে আমার পক্ষে আমার জনগণকে ছেড়ে যাওয়া সম্ভব? আমি জাতির নেতা। আমি লড়াই করে মৃত্যুবরণ করতে পারি।”

শেখ মুজিব পাকিস্তানের কারাগারে যে বাস্তবে বন্দি ছিলেন না, তা প্রমাণিত হয়, সেখানে অবস্থানকালে পাইপে ধুমপানের জন্য পাকিস্তানি আপ্যায়নকারীদের দ্বারা তার প্রিয় ব্র্র্যান্ডের তামাক সরবরাহের স্বীকারোক্তিতে। এই তামাকের নাম ‘এডিন মোর’স। তিনি ফ্রস্টকে বলেছেন: “আমি এই তামাক দিয়ে প্রায় ১৪ বছর যাবত ধুমপান করছি। এমনকি কারাগারেও। আমি তাদের বলেছি যে, আমাকে অবশ্যই এই তামাক সরবরাহ করতে হবে। এবং তারা মেহেরবানি করে আমাকে এটিও সরবরাহ করেছে।”

প্রায় কাছাকাছি সময়ে ইতালির খ্যাতিমান সাংবাদিক ওরিয়ানা ফালাচি শেখ মুজিবের যে সাক্ষাৎকার নেন, তাতেও তিনি যে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানে বন্দিজীবন কাটাননি তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। কারাগারে তিনি কি করেছেন, ফালাচির প্রশ্নের উত্তরে শেখ মুজিব বলেন, “আমি অনেক চিন্তা করেছি। পড়াশোনা করেছি। আমি বই এবং অন্যান্য জিনিস পড়েছি।” ফালাচি জানতে চান, “এটা কি করে সম্ভব হলো যে, শেষ পর্যন্ত ওরা আপনাকে ফাঁসিতে ঝোলালো না?” শেখ মুজিব উত্তর দেন, “জেলার আমাকে সেল থেকে পালাতে সহায়তা করেছেন এবং তার বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছেন।” একজন হাই প্রোফাইল রাজবন্দি, যিনি রাষ্ট্রদ্রোহিতার দায়ে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত, যার নিজের বক্তব্য অনুযায়ী তাকে ‘ফাঁসি দেওয়ার পরই কবরস্থ করার জন্য কারাপ্রকোষ্ঠের পাশেই কবর খনন করা হয়েছে,’

জেলার তাকে অবলীলায় জেলখানা থেকে বের করে নিয়ে তার বাড়িতে আশ্রয় দিলেন! তাছাড়া ইতিহাসে এমন দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়াও কঠিন হবে যে, কোনো বন্দিকে ফাঁসিতে ঝোলানোর পর তার মরদেহ কারাগারে উক্ত বন্দির কারাপ্রকোষ্ঠের সামনেই কবরস্থ বা দাহ করা হয়েছে অথবা বন্দি যে ধর্মবিশ্বাসের অনুসারী ছিলেন, সেই ধর্মের রীতি অনুযায়ী কারাপ্রকোষ্টের সামনে অন্তেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে এই মিথ্যা, অসার কাহিনিকেই ইতিহাসে পরিণত করা হয়েছিল।

১৯৭১ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত শেখ মুজিব যা ছিলেন, ১৯৭২ এর পর আর তা ছিলেন না। গণতন্ত্রী শেখ মুজিব একটি স্বাধীন দেশের ক্ষমতার অধীশ্বর হয়ে এক এক করে ছুঁড়ে ফেলতে থাকেন তার রাজনৈতিক জীবনের ১৯৭১ এর মার্চ পর্ব পর্যন্ত পরিহিত গণতন্ত্রের মুখোশ, জপমালা ও নামাবলী। মুজিবের কর্তৃত্ববাদী নেতৃত্ব দেশের সার্বিক পরিস্থিতিকে সর্বণাশা পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে শুরু করে। তিনি স্বৈরশাসক হয়ে উঠেন। শেখ মুজিবের এক সমালোচক বলেছেন যে, ‘তিনি তুরস্কের কামাল আতাতুর্কের মতো হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তার লক্ষ্যগুলো প্রশংসনীয় ছিল, কিন্তু তিনি যেভাবে তার লক্ষ্য বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছিলেন, তা ছিল ঘৃণ্য। তিনি যদি স্বৈরাচারী না হতেন, তাহলে বাংলাদেশ এখন অনেক সমৃদ্ধ দেশ হতে পারতো। কিন্তু বাংলাদেশ তা হতে পারেনি। কেন পারেনি?

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস-ভিত্তিক একটি উপন্যাস ‘দ্য ব্ল্যাক কোট’ এ শেখ মুজিবের চরিত্র চিত্রণ করা হয়েছে চমৎকারভাবে। কানাডা প্রবাসী বাংলাদেশি নিয়ামত ইমাম এ উপন্যাসের লেখক। বাংলাদেশে গত চুয়ান্ন বছরে ইতিহাস বলতে যা লেখা হয়েছে, সেগুলোর সঙ্গে তুলনা করতে গেলে নিয়ামত ইমামের ‘দ্য ব্ল্যাক কোট’কে কেবল একটি ফিকশন বা কল্পকাহিনি মনে হবে না, বরং বাংলাদেশের প্রকৃত রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার প্রতিফলন বুঝা যাবে। উপন্যাসে শেখ মুজিবের অধীনে বাংলাদেশের এক অন্ধকার ও বিভীষিকাময় অবস্থার চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, যেখানে শেখ মুজিব এক সর্বগ্রাসী শাসক, যিনি শুধু সত্যকেই বিকৃত করেননি, বরং তার নিপীড়নকে বাধাহীন করতে রাজনৈতিক বিরোধিতাকে কঠোর হাতে দমন করেছিলেন। তার দৃষ্টিতে শেখ মুজিব একজন ‘দানব’ এবং দেশবাসীর জন্য ‘অভিশাপ’। জাতির ওপর চেপে বসা অভিশাপের অবসান ঘটেছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। এটা সত্য যে, তার পুরো পরিবারকে হত্যা করা ভয়াবহ এবং নজীরবিহীন হিংস্রতা, কিন্তু শেখ মুজিব যে ক্ষমতা থেকে উৎখাত হওয়ার যোগ্য ছিলেন, তাতে কোন সন্দেহ নেই।

বাংলাদেশের বিশিষ্ট পদার্থবিদ ও সমাজকর্মী আবু রায়হান তার গবেষনা গ্রন্থ ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান : হিরো অর ভিলেইন’ গ্রন্থে বাঙালি জাতীয়তাবদের বিকাশ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তার অবদানের স্বীকৃতি দেওয়া সত্বেও প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন যে, ‘তিনি কি ইতিহাসের একজন নায়ক, অথবা খলনায়ক, না কি কেবল তার অবদানের সঙ্গে জড়িত সকল জটিলতা ও দ্বন্দ্বের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন মানুষ?’ রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তার কর্তৃত্ববাদী নেতৃত্ব, অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ ও দুর্নীতি মোকাবিলায় ব্যর্থতা এবং স্বজনপ্রীতিকে প্রশ্রয় দেওয়ার মতো বিষয়গুলো তার জীবনের করুণ পরিণতি ডেকে এনেছিল। তার হত্যাকাণ্ড কেবল একটি রাজনৈতিক যুগের সমাপ্তি ছিল না, বরং নবগঠিত জাতির মধ্যে বিভাজন গভীর করেছিল, যা অনাগত বহু যুগ পর্যন্ত দেশের সামগ্রিক বিকাশকে পেছনে টেনে রাখবে। তার কন্যা শেখ হাসিনার ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার প্রবণতাও এ বিভাজনের ধারাবিাহিকতার অংশ ছিল।

শেখ হাসিনা তার পিতার মত দ্বৈত চরিত্র নিয়ে ক্ষমতায় আসেনি। তার কাছে গণতন্ত্র ছিল কর্তৃত্ববাদ প্রতিষ্ঠার উপায় বা হাতিয়ার। শেখ মুজিব সাংবিধানিকভাবে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে কবরস্থ করে একদলীয় স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠা করেন। শেখ হাসিনা সাংবিধানিকভাবে বহুদলের অস্তিত্ব বজায় রেখে কার্যত একদলীয় শাসন কায়েম করেন। শেখ মুজিব জনগণকে ক্ষেপিয়ে তোলার কাজে যতটা পারঙ্গম ছিলেন, তার প্রমাণ যদি রাজনৈতিক কুশলতার রাখতে পারতেন, তাহলে সম্ভবত তাকে অপঘাতে মরতে হতো না। কুশলতার প্রথম লক্ষ্য ছিল সপরিবারে তার পিতার হত্যাকারীদের বিচার করা এবং ১৯৯৬ সালে প্রথমবার নির্বাচিত হয়েই তিনি তার লক্ষ্য পূরণ করেন।

শেখ হাসিনা রাজনৈতিক কুশলতা প্রদর্শনে তার পিতাকে ছাড়িয়ে গিযেছিলেন তা বললে বাড়িয়ে বলা হবে না। ২০০৯ সালের শেখ হাসিনা দ্বিতীয় দফা ক্ষমতায় আসার পর তার বেশ কজন দলীয় সহকর্মী বলতে শুরু করেছিলেন যে, ‘আওয়ামী লীগের রাজনীতি মূলত বাকশালের রাজনীতি।’ কিন্তু জনমনে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে আওয়ামী নেতৃত্ব বাকশাল নিয়ে আর তেমন উচ্চবাচ্য করেনি। কিন্তু শেখ হাসিনা দেশে একদলীয় শাসনই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি বিরোধী দলগুলোকে কেবল রাজনীতির মাঠ ও নির্বাচন থেকেই দূরে রাখেননি, নানা অপকৌশলে বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদে কার্যত ‘নিবীর্য’ বা ‘হীনবীর্য’ করে ফেলেছিলেন। তার সাড়ে ১৫ বছরের শাসনে কোনো বিরোধী রাজনৈতিক দলের পক্ষে বিনাবাধায় একটি মিছিল বা সমাবেশ করা সম্ভব হয়নি। হত্যা, গুম ও মামলার শিকারে পরিণত হওয়ার ভয়ে বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের অধিকাংশই ‘শীতনিদ্রা’য় চলে গিয়েছিলেন। যারা সাহস দেখানোর চেষ্টা করেছেন, তাদের আশ্রয় হয়েছে কারাগারে।

শেখ হাসিনা কি জানতেন না যে, তার অপশাসনের পরিণতি কি হতে পারে? অবশ্যই জানতেন। তবু তিনি কঠোর হাতে দেশ শাসন করেছেন তার প্রতিশোধস্পৃহা চরিতার্থ করতে ও দেশের সম্পদ অবাধে লুণ্ঠন করতে। ক্ষমতা তাকে এত দাম্ভিক করে তুলেছিল যে তিনি তার পিয়নের ৪০০ কোটি টাকার মালিকে পরিণত হওয়া এবং উক্ত পিয়নের হেলিকপ্টারে ভ্রমণের ঘটনাকেও সহাস্যবদনে সাংবাদিক সম্মেলনে প্রকাশ করতে দ্বিধা করেননি। পিয়নের পক্ষেই যদি এত সম্পদের মালিক হওয়া অসম্ভব না হয়, অন্যান্য পদাধিকারীরা যে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে থেকে পরবর্তী কটি জেনারেশনের ছড়িয়ে-ছিটিয়ে খাওয়ার মতো বিত্ত কামাই করেছেন, তা সহজে অনুমেয়। কিন্তু কেউই তাকে সসম্মানে তাকে তার পদে বহাল রাখতে ঢাল হয়ে দাঁড়ায়নি। শেখ হাসিনার পলায়নের সঙ্গে সঙ্গে যেন বাতাসে মিলিয়ে গেছে একটি পুরো মন্ত্রীসভা, প্রত্যেকেই হয়তো ভেবেছে, “জান হ্যায় তো জাহান হ্যায়” – যতদিন জীবন আছে, ততদিন পৃথিবী আছে। অবশ্য আওয়ামী লীগের এই পলায়ন চর্চা বেশ প্রাচীন। ১৯৭৫ সালের আগস্টেও তারা তাদের নেতার মৃতদেহ সিঁড়িতে ফেলে প্রাণভয়ে উর্ধ্বশ্বাসে দিগবিদিক পালিয়েছিল।

শেখ হাসিনা যদি বার বার দেশ থেকে না পালানোর বাণী উচ্চারণ না করতেন, তবুও কথা ছিল। খালেদা জিয়া তো ২০০৮ এর নির্বাচনে পরাজিত হয়ে পালাননি। ২০১১ সাল পর্যন্ত তিনি তো যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে সফরে গিয়েও দেশে ফিরে গেছেন। স্বৈরশাসক এরশাদও তার পতন অবশ্যম্ভাবী দেখেও দেশ ছেড়ে পালাননি। তারা দু’জনই তাদের বিরুদ্ধে সরকারের দায়ের করা সত্যমিথ্যা (?) মামলায় কারাগারে কাটিয়েছেন। সেক্ষেত্রে শেখ হাসিনা ও তার অনুগামীদের কি এমন ভয় যে, তাদের দেশ থেকে পালানো ছাড়া গত্যন্তর থাকে না! শেখ হাসিনার সরকারের নিয়োগ করা বায়তুল মোকাররম মসজিদের ইমাম, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকেও কেন পালাতে হয়? বুলেটের সামনে বুক পেতে দেওয়ার হুঙ্কার কোথায় যায়?

কবি জন কিটস তাঁর ‘ওড টু এ নাইটিংগেল’ কবিতায় বলেছেন, “দাম্ভিকতা মানুষকে আত্মগর্বে অন্ধ করে ফেলে, বিষন্নতার ঠেলে দেয়। তার মাঝ থেকে হারিয়ে যায় নম্রতা, শালীনতা ও ভব্যতার সকল গুণ। তিনি যা বলেন, তা পরিণত হয় অহংকারের প্রলাপে। অনিয়ন্ত্রিত অহঙ্কার তাকে শ্রেষ্ঠত্বের বিপজ্জনক অনুভূতিতে জাপটে ধরে এবং বেলুনের মতো স্ফীত হতে থাকে।” শেখ হাসিনার অহংকারের পরিণতি ছিল বাংলাদেশের ধ্বংস। তিনি তাকে মোকাবিলা করতে সক্ষম এমন কোনো প্রতিপক্ষ দেখেননি। দৃশ্যমান সকল প্রতিপক্ষকে নির্মূল করে তিনি তার চারপাশে গড়ে তুলেছিলেন সীমাহীন দম্ভের বলয়। অতীতের অহংকারী অনেক শাসকের মতো তিনিও ভাবতে অক্ষম ছিলেন যে একদিন তাকে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। দু:শাসনের অনিবার্য পরিণতি পরাজয় ও পলায়ন এবং অদৃষ্ট মন্দ হলে জনরোষে মৃত্যু।

কবি ইকবাল বলেছেন:
“ইয়ে কবর, ইয়ে কাফন ইয়ে জানাজে রসমে শরিয়ত থি ইকবাল,
মর তো ইনসান তবহি জাতা হ্যায় জব উসসে কোঈ ইয়াদ করনেওয়ালা না হো।”

(ইকবাল, এই যে কবর, কাফন, জানাজা–সবই তো শরিয়তের নিয়ম,
মানুষ তো তখনই মরে যায়, যখন তাকে স্মরণ করার কেউ থাকে না।)

পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অস্তিত্ব এখন শুধু প্রাণভয়ে নিজ দেশ থেকে পলায়নের কাহিনির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on কবিতার স্ফুলিঙ্গ, স্ফুলিঙ্গের কবিতা