ইসলাম তরিক
‘শুয়ারে বাচ্চা, আন্দোলন মারাস! পেটে ভাত জোটে না, অথচ সরকার পতনের আন্দোলন করিস? বল, আর আন্দোলন করবি?’
শফিউদ্দিনের বুকের ওপর বুটের চাপ দিয়ে কথাগুলো বলতে থাকে কনস্টেবল হারুন। শফিউদ্দিন ৪৫ বছরের একজন প্রৌঢ়ব্যক্তি। পেশায় রিক্সা চালক। বুটের আঘাতে বুকের হাড়গুলো যেন ভেঙে যাচ্ছে। কিন্তু শফিউদ্দিন দমাবার পাত্র নয়। সে কাতর কণ্ঠে প্রতিবাদী সুরে বলল, ‘আমাকে মেরে লাভ নাই স্যার। দেশের কেউ আর হাসিনাকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না। আমাকে হত্যা করলেও অনেক শফিউদ্দিনের জন্ম হবে।’
‘এই শুয়ারের বাচ্চা! চুপ কর! যতবড় মুখ নয়, ততবড় কথা! প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ চাস?’ বলেই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কনস্টেবল মুনসুর শফিউদ্দিনের অণ্ডকোষে লাথি মারল।
শফিউদ্দিন ‘অ… মা…’ চিৎকার দিয়ে নিস্তেজ হয়ে পড়ল। শফিউদ্দিনের গুপ্তাঙ্গ থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরছে। কনস্টেবল মুনসুর মুচকি হেসে গোফ পাকাতে লাগল। মুনসুরের সঙ্গে যোগ দেয় কনস্টেবল হারুন। দুজনেই হাসতে হাসতে ওসির রুমে প্রবেশ করে। ওসি জাহাঙ্গীর তাদেরকে দেখে বললেন, ‘শফিউদ্দিনের কাছে কোনো তথ্য পাওয়া গেল?’
কনস্টেবল হারুন বলল, ‘না স্যার। শালার মনে হয় গণ্ডারের চামড়া! এত পিটান পিটালাম, তবুও কিচ্ছু বের করতে পারলাম না।’
— তাহলে কোর্টে চালান করেন।
— ক্যামনে চালান করব স্যার? মুনসুর অরে যে মাইর দিয়েছে, অণ্ডকোষ ফেটে এখন রক্ত ঝরছে। বাঁচবে বলে মনে হয় না।
— বলেন কী? তাহলে রাতে রাস্তায় অরে ফেলে দিয়ে আসেন। সাবধান! কেউ যেন টের না পায়।
হারুন ও মুনসুর ওসির রুম থেকে বের হলো। ওসি জাহাঙ্গীরকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে। কয়েকদিন থেকে অসংখ্য আন্দোলনকারীকে ধরা হয়েছে, কিন্তু কেউই পুলিশের ভয়ে ভীত নয়। সবাই যেন তিতুমীর! সবার মুখেই সরকার পতনের কথা। বুকে গুলি করেও লাভ হচ্ছে না। যাকে গুলি করা হচ্ছে, সে-ই শুধু লুটিয়ে পড়ছে। বাকিগুলো বুক চেতিয়ে বীরের মতো দাঁড়িয়ে থাকছে। আন্দোলনের স্লোগানগুলোও কী সাংঘাতিক!
‘বুকের ভেতর অনেক ঝড়
বুক পেতেছি গুলি কর!’
১৯৫২, ১৯৭১ সালেও মনে হয় এমন ভয়ানক স্লোগান আন্দোলনকারীদের মুখে শোনা যায়নি। এমন ভয়াবহ অবস্থা তিনি চাকরি জীবনে কখনো দেখেননি। চাকরির বয়সও তো কম হলো না। প্রায় ২৮ বৎসর। আগে মানুষ পুলিশ দেখে ভয় পেতো, পালিয়ে যেত। কিন্তু ইদানিং পুলিশকে ভয় পাওয়া তো দূরের কথা, পুলিশের গুলিকেও ভয় করছে না জনগণ। ওসি জাহাঙ্গীরের ভাবনা হঠাৎ অন্যদিকে মোড় নিলো। তিনি ভাবতে লাগলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথা। হাসিনার পতন ছাড়া কি আন্দোলনকারীরা থামবে না? সত্যিই কি হাসিনার পতন হবে? হাসিনার পতন হলে আমাদের কী হবে? চাকরিটা থাকবে তো? থাকলেও অবস্থা কী দাঁড়াবে? বিরোধী দলের সঙ্গে তো বড্ড অন্যায় করা হয়েছে ১৬ বৎসর ধরে। তারা কী আমাদের আস্ত রাখবে? নাহ্ আর ভাবতে পারছেন না তিনি। কীসের এক ফালতু কোটা আন্দোলনের বিপক্ষে যে সরকার কথা বলতে গেল! তাদের দাবিগুলো মেনে নিলে তো আজ সরকার পতনের আন্দোলন হতো না। আমাদের ওপরও এতো চাপ আসত না।
০২.
রাস্তার পাশে একটি ডোবা। ডোবার দূষিত পানিতে জন্মেছে অসংখ্য আগাছা। আগাছার ওপর পড়ে আছে শফিউদ্দিন। জ্ঞান ফিরেছে তার। গভীর রাত। আশেপাশে জনশব্দ নেই। মাঝে মধ্যে কিছু গাড়ির শব্দ কানে ভেসে আসছে। বুক ও গুপ্তাঙ্গের ব্যথায় কাতরাচ্ছে শফিউদ্দিন। নিঃশ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে তার। বুকের হাড়ে তীব্র ব্যথা। বুকের সবগুলো হাড়ই মনে হয় ভেঙ্গে গেছে। শফিউদ্দিন চিৎকার দিয়ে তার অবস্থান জানান দিতে চাচ্ছে। কিন্তু শরীরে শক্তি নেই। কণ্ঠ থেকে আওয়াজ বেরুচ্ছে না। ডোবার পানিতে শরীর হিম হয়ে গেছে। কানের কাছে বিশাল আকৃতির মশাগুলো ভনভন করে গান গাচ্ছে। মশাকে সে সহ্য করতে পারে না। খুব ভয় পায় মশাকে। মশারি ছাড়া সে ঘুমাতে পারে না। মশার শব্দে মাঝরাতে তার ঘুম ভেঙ্গে গেলে, লাইট জ্বেলে আগে মশা মারে, তারপর ঘুমানোর চেষ্টা করে। কিন্তু আজ মশা নিয়ে তার কোনো ভাবনা নেই। মশা তাড়ানোরও কোনো ইচ্ছা নেই। সে ডোবার আগাছাগুলো ধরার চেষ্টা করছে। কিন্তু হাতে শক্তি পাচ্ছে না। বুক দিয়ে ঠেলে উঠতে চাইল, কিন্তু পারছে না। বুকেও প্রচণ্ড ব্যথা। পা দিয়ে আস্তে আস্তে ঠেলা দিয়ে অনেক কষ্টে ডোবার পাড়ে উঠে এলো সে। প্রচণ্ড ক্ষুধা পেয়েছে। ক্ষুধা ও ঠান্ডায় শরীর কাঁপছে। চাঁদের আবছা আলোয় অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে রাস্তার গাছগুলো। শফিউদ্দিন চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। দৃষ্টি আকাশের দিকে। আকাশে অসংখ্য তারা জ্বলজ্বল করছে। মাঝে মাঝে কিছু মেঘখণ্ড চাঁদের আলোকে ঢেকে দিচ্ছে। শফিউদ্দিন নির্বাক হয়ে দেখছে দৃশ্যগুলো। তার মনে হচ্ছে, ছোট ছোট মেঘখণ্ডের মতো দীর্ঘদিনের নির্যাতিত মানুষগুলোই ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করবে। সে বিড়বিড় করে বলে, ‘ইয়া রব! তুমি নিশ্চয় অন্ধ নও। তুমি কি দেখতে পাচ্ছো না, ফ্যাসিস্ট হাসিনার নির্যাতন? তুমি কি শুনতে পাচ্ছো না মজলুমের বুকফাটা আর্তনাদ?’
শফিউদ্দিনের স্নায়ু ধীরে ধীরে আরও দুর্বল হচ্ছে। চোখ দুটো বুজে আসছে। চোখ বন্ধ করেও সে তার ছেলেকে দেখতে পাচ্ছে। রক্তাক্ত শরীর, তবুও কী মায়াবী চাহুনি তার! দানবরা তাকে গুলি করে হত্যা করেছে, তবুও কত প্রাণবন্ত তার হাসিটা। টিভিতে যেদিন নিজের ছেলেকে আন্দোলন করতে দেখেছিল, সেদিনই বুকটা কেঁপে উঠেছিল অজানা এক ভয়ে। তার ছেলে মিছিলের সামনে দাঁড়িয়ে স্লোগান দিয়েছিল–
‘লাশের ভেতর জীবন দে
নইলে গদি ছাইড়া দে।’
ছেলের দেওয়া স্লোগানটা এখনও তার কানে ভাসে। কতশত লাশ! এই লাশের ওপরই টিকে আছে ক্ষমতা। আহ্ ক্ষমতা! হাজার লোকের বুক শূন্য করে নিজের গদি টেকানো! কী নির্দয়! কী নির্মম ক্ষমতার লোভ!
শফিউদ্দিনের ছেলের নাম ওসমান। খুব মেধাবী সে। ওসমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে চতুর্থ বর্ষে পড়ত। শুরুতে কোটা আন্দলনের সমর্থক ছিল সে। কিন্তু কোটা আন্দোলনকে ঘিরে দেশে যখন ফ্যাসিস্ট সরকার অরাজকতা সৃষ্টি করেছিল, তখন সে আর চুপ থাকেনি। নেমে ছিল রাজপথে। ওসমান খুব নিরীহ প্রকৃতির। কিন্তু পুলিশ যখন ছাত্রদের বুকে সরাসরি গুলি চালাচ্ছিল, তখন সে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারেনি। নিরীহ ছাত্রদের হত্যার দৃশ্য দেখে সত্যি সত্যিই তার রক্তে আগুন লেগেছিল। হাজার হাজার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সেও শামিল হয়েছিল বিপ্লবের মিছিলে।
শফিউদ্দিন রিক্সা চালক হলেও ছেলে-মেয়ের পড়াশোনার কোনো ব্যঘাত ঘটায়নি। সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়েছে। ছেলে ওসমানকে নিয়ে শফিউদ্দিনের অনেক স্বপ্ন ছিল। তিলতিল করে জমানো দীর্ঘদিনের স্বপ্নগুলো একটি বুলেটেই নিঃশেষ করে দিয়েছে ফ্যাসিস্ট সরকার।
০৩.
শফিউদ্দিনের কানে ভেসে এলো কান্নার আওয়াজ। ধীরে ধীরে চোখ খুলল সে। বুঝতে পারল, সে এখন হসপিটালে। শিয়োরে বসে আছে স্ত্রী রহিমা। মুখে আঁচল গুজিয়ে কাঁদছে। শফিউদ্দিনকে চোখ খুলতে দেখে রহিমা আহাজারি করে কাঁদতে লাগল, ‘তুমি কেন গেলে আন্দোলন করতে? এতবার নিষেধ করলাম, তবু তুমি শুনলে না…..। এই আন্দোলনে আমার ছেলেকে হারিয়েছি। তুমিও যদি হারিয়ে যাও, তাহলে আমরা মা-মেয়ে বাঁচব কেমন করে….?’
শফিউদ্দিন রহিমার পিঠে হাত বোলানোর চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। তার দুই হাতেই স্যালাইনের নল ফোঁড়ানো। সে চোখের ইশারায় রহিমাকে শান্ত হতে বলল। রহিমা তবুও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। রহিমার সঙ্গে যোগ দিলো সতেরো বছরের মেয়ে ফাতেমা। ফাতেমা শফিউদ্দিনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, বাবা আমিও আন্দোলনে যোগ দিয়েছি। মেয়ে বলে ঘরে বসে নেই। আমাদের কলেজের অনেক মেয়েই আজ মিছিল করেছে। সবার মুখে একটাই স্লোগান–
‘দাকি এক দফা এক
শেখ হাসিনার পদত্যাগ।’
মেয়ের কথা শুনে শফিউদ্দিন খুশি হলো। ছেলে হারানো ব্যথাও কিছুটা হালকা হলো। তার ছেলের মতো যারা নিজের কলিজার টুকরোকে হারিয়েছে, তারা এসব আন্দোলন দেখে নিজের মনকে শান্তনা দেবে। শফিউদ্দিন ছেলের শোকে পাথর হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কয়েকদিন পর বুকে পাথরচাপা দিয়ে সে নিজেই ছাত্রদের সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দিয়েছে। সে মরবে তাতে সমস্যা নেই, তবুও এই ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন চায় সে। এই সরকার পতন হলে বুকের মানিক হারানো লোকগুলো অন্তত শান্তিতে দুফোঁটা অশ্রু ফেলতে পারবে। শুধু শফিউদ্দিনই নয়, শতশত রিক্সাচালক সরকার পতনের মিছিলে যোগ দিয়েছিল। শফিউদ্দিনের স্পষ্ট মনে আছে, সে যখন রিক্সার ওপর ওঠে স্লোগান দিচ্ছিল–
‘আমার ছেলে কবরে,
খুনি কেন বাইরে?’
ঠিক তখনই পা-চাটা পুলিশ তাকে কৌশলে থানায় নিয়ে গিয়েছিল। শফিউদ্দিনের মন চাচ্ছে শিক্ষার্থীদের মতো এই হাসপালের বেডে শুয়েই স্লোগান দিই-
‘তোর কোটা তুই নে
আমার ছেলে ফিরিয়ে দে।’
শফিউদ্দিন ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম একজন যোদ্ধা। ছেলের মৃত্যুর পর সে সবসময় রাজপথে থেকেছে। না, বেশি ইনকামের জন্য নয়। আহত যোদ্ধাদের সেবা-শুশ্রূষার জন্য। পুলিশ ও ছাত্রলীগের আঘাতে যেসব শিক্ষার্থী আহত হতো, তাদেরকে শফিউদ্দিন বিনা পয়সায় হাসপাতালে নিয়ে যেত। অভাবের সংসার তবুও ছাত্রদের জন্য বড্ড মায়া হতো তার। দিন শেষে যখন সে খালি হাতে বাড়ি ফিরত, তখন স্ত্রী রহিমা জিজ্ঞাসা করত, ‘আজ কতটাকা ভাড়া মারছো ওসমানের বাবা?’
শফিউদ্দিন স্ত্রীর মুখের দিকে লাজুকভাবে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলত, ‘আজ ভাড়া মারিনি রহিমা। আজ আমার বুকের মানিকরে নিয়া গোটা ঢাকা শহর ঘুরছি।’
রহিমাও খুব ধৈর্যশীল ও বুদ্ধিমতি মহিলা। স্বামীর বেদনাটা সে বোঝে। স্বামীর বলা ইশারার কথাগুলোও সে বোঝে। অভাবের সংসার, তবুও সে শান্ত থাকত। শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলত, ‘আচ্ছা, ভালো কাজ করেছো। এখন চোখ-মুখ ধুয়ে এসো। মুখে কিছু দিয়ে শুয়ে পড়ো।’
০৪.
‘রোগীর অবস্থা আশঙ্কাজনক! আপনারা আল্লাহকে ডাকুন। তিনিই একমাত্র রক্ষাকারী।’
আর কিছু বললেন না ডা. শাহীন। দ্রুত অন্যরোগীর দিকে ছুটলেন। ডা. শাহীন সুন্দর মনের মানুষ। তার ব্যবহারে সবাই মুগ্ধ। আন্দোলনে যারা আহত হয়েছেন, তাদের প্রতি ডা. শাহীন খুব আন্তরিক। ডা. শাহীনের কথা শুনে স্বশব্দে কেঁদে উঠল রহিমা। বুক চাপড়ে আহাজারি শুরু করল সে। কী বলে নিজেকে শান্তনা দেবে সেটাও খুঁজে পাচ্ছে না। এ দুঃসময়ে মেয়েটাও কাছে নেই। আন্দোলন নিয়েই পড়ে আছে। নিজের মনকে প্রশ্ন করে রহিমা, কী পোড়া কপাল তার! এমন কপাল নিয়ে কেউ কী পৃথিবীতে আসে? ধীরে ধীরে বেড়ে যাচ্ছে রহিমার আহাজারী! সবাই তাকিয়ে আছে রহিমার দিকে। লোকলজ্জায় মুখে কাপড়গুঁজে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে রহিমা। কিন্তু কাজ হচ্ছে না। কালবৈশাখী ঝড়ের মতো বুকের ভেতর থেকে তীব্র ব্যথাগুলো এলোমেলোভাবে ছুটে আসছে।
বিকাল তিনটার দিকে হাসপাতালে ছুটে এলো মেয়ে ফাতেমা। তার চোখেমুখে খুশির ঝিলিক। সে শফিউদ্দিনকে জড়িয়ে ধরে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘বাবা, বাবা, তুমি কী আমার কথা শুনতে পাচ্ছো? রাক্ষসী হাসিনা ভারতে পালিয়েছে বাবা। আমার ভাইয়ের খুনি আর গদিতে নেই। বাবা, তুমি কী আমার কথা শুনতে পাচ্ছো? ফ্যাসিস্ট হাসিনা বাংলাদেশে নেই বাবা। আমার ভাইয়ের রক্ত বৃথা যায়নি। তার মতো তরুণদের রক্তের বিনিময়ে দেশের লক্ষ-কোটি জনতা আজকে স্বাধীন বাবা। অন্যায় দেখে এখন কেউ আর মুখে তালা মেরে থাকবে না। জোর করে কাউকে আর জেলে রাখা যাবে না। বিনাদোষে কেউ আর শাস্তি পাবে না বাবা। বাবা, তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছো?’
মেয়ের মুখে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পালানোর কথা শুনে মুমূর্ষু শফিউদ্দিন নড়েচড়ে উঠল। মনে মনে রবের শুকরিয়া আদায় করল। খুশিতে শরীরের সমস্ত রোম জেগে উঠল শফিউদ্দিনের। সারাশরীরে বইয়ে গেল খুশির পরশ। আল্লাহু আকবার বলে চিৎকার দিতে ইচ্ছে করছে তার। কিন্তু পারছেন না। তবুও থেমে নেই শফিউদ্দিন। বারবার চেষ্টা করছেন। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করে সফল হলো শফিউদ্দিন। সে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে বিছানা থেকে ওঠার চেষ্টা করল। বিছানা থেকে মাথাটা একটু ওপরে তুলে বলল, ‘আল্লাহু আকবার!’
আল্লাহু আকবার বলেই ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়ল শফিউদ্দিন। তার তাকবির শুনে আশেপাশের লোকজন ছুটে এলো। কয়েকদিন থেকে কথা নেই শফিউদ্দিনের মুখে। আজ হঠাৎ করে তার মুখে তাকবির শুনে সবাই অবাক। শফিউদ্দিনের মুখে তাকবির শুনে খুশি হলো রহিমা ও ফাতেমা। কিন্তু বিছানায় পড়ে যাওয়াতে তারা চিন্তিত। রহিমা স্বামীর মুখের কাছে গিয়ে বলল, ‘তুমি কি সুস্থ আছো?’
কথা নেই শফিউদ্দিনের মুখে। মেয়ে ফাতেমা বাবার হাত ধরে ঝাঁকি দিয়ে বলল, ‘বাবা তোমার কী সমস্যা হচ্ছে?’ তবুও সাড়া নেই শফিউদ্দিনের। নড়াচড়াও নেই। সবাই কৌতূহলী হয়ে তাকিয়ে আছে শফিউদ্দিনের দিকে। শফিউদ্দিনের তাকবির শুনে ছুটে এসেছেন ডা. শাহীন। শফিউদ্দিনের মুখে এতো জোরে তাকবির শুনে তিনি আশ্চর্য হয়েছেন। জীবন যায়যায় অবস্থায় একজন রোগী কীভাবে এত জোরে তাকবির দিতে পারে? কিছুতেই হিসাব মিলাতে পারছেন না ডা. শাহীন। তিনি এসেই শফিউদ্দিনের হাতের পালস দেখলেন। বিপদ সংকেত! কিন্তু বিশ্বাস হচ্ছে না তাঁর। এইতো একমিনিট আগেই সে তাকবির দিয়েছে। তিনি শফিউদ্দিনের বুকে স্টেথোস্কোপ লাগালেন। নাহ্, কোনো শব্দ নেই। ঝাপসা হয়ে এলো তাঁর চোখ। চোখ মুছতে মুছতে তিনি বললেন, ‘হি ইজ নো মোর!’