তমিজ উদ্দীন লোদী
হেলুসিনেশন
দূর রাস্তায় ছায়ার মতো চলেছো তুমি । নষ্ট হয়ে গেছে জিপিএস রিসিভার । নিভে গেছে স্কিন ।
হাতড়ে চলেছো নক্ষত্র দেখে । যেন পৌরানিক নাবিক ।
ঘন হয়ে উঠেছে আকাশ । পাকিয়ে উঠেছে কুয়াশা। তুমি হাফ অন্ধ আর অনুমাননির্ভর । তুমি পালাচ্ছ ।
যেন পেছনে ছুটছে শিকারি কিলার ওয়েইল আর হাঙরের দল ।
কোনো প্রতিফলন নেই আলোর । ধূসর কুয়াশার মেঘ ক্রমশ অন্তরাল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ।
বাতাস থম ধরে আছে । শব্দ নেই । চারপাশে কবরের মতো নিস্তব্ধতা ।
তুমি ছুটতে চাইছো কিন্তু পারছ না । উষ্ণতা চাইছো কিন্তু হিম ছাড়া আর কিছুই অনুভব করছো না ।
শুধু অনুভব করছো ধারালো কাঁচ দিয়ে কাটা হচ্ছে তোমার মুখ ।
ক্রমশ আটকে যাচ্ছো একটি বৃত্তে । যা থেকে তুমি কিছুতেই বেরোতে পারছ না ।
বিষণ্ণতা পেরিয়ে , নিঃস্পৃহতা পেরিয়ে
——————————————
একটি জগদ্দল পাথর গলে গলে পড়ছে
পূর্ণিমার রাত এসে ধুয়ে দিচ্ছে অমাবস্যার কালো
একদল যুবক শিস দিতে দিতে চলে যাচ্ছে রাস্তার ওপারে ।
কানে এসে লাগছে জলপ্রপাতের শব্দ
উচ্ছ্বসিত মানুষ দৌড়াচ্ছে ভয় ও নিজের ছায়াকে অতিক্রম করে
বিস্ময়ের আয়নায় তারা দেখলো
একটি অন্যরকম সূর্য উঠে আসছে লালাভ আভা ছড়িয়ে ।
বিষণ্ণতা পেরিয়ে , নিঃস্পৃহতা পেরিয়ে
ঝাঁপ দিয়ে আনন্দ এলো লোকালয়ে
আমাদের ভীতি ও ত্রাসের অপনোদনে আমরা হয়ে উঠলাম
একেকজন হারকিউলিস , একেকজন স্পার্টাকাস।
শীত এসে গেলো নীরবে
——————————
শীতের আগেই ভেবেছিলাম দেখা হবে
অথচ কুয়াশার আস্তরণ ভেদ করে সূর্য উঠল না তখনো
শীত এসে গেলো নীরবে
পাতা ঝরতে ঝরতে শাখাগুলো কালচে হলো
ধুলো উড়ল মিহি পাউডারের মতো
তোমার মসৃণ ত্বক রুক্ষ হলো
শাদা রঙের আলপনার মতো বরফের কুচি ছড়িয়ে থাকল
পর্বতের চূড়ায় ও খাঁজে খাঁজে
নিরিবিলি নদীর বিষণ্ণতার মতো বিষণ্ণতা ছুঁয়ে থাকল তোমাকে
শৈত্যপ্রবাহের ভেতরে প্রবিষ্ট হওয়া গেল শুধু
কোনভাবেই শীতের আগে আর দেখা হলো না আমাদের ।
মানুষ হাঁটছে বটে
কে যেন কি একটা টাঙিয়ে দিয়েছে
বলছে , এপাশটা আমার , ওপাশটা তোমার
খুব পরিচিত মুখ বলছে চিনি না তোমাকে !
বাগানের মাথার উপর উঁকি দিচ্ছে চাঁদ
ও বলছে , সে দেখছে তাই দেখবো না চাঁদ
চাঁদের কি দোষ , মানুষই পিশাচ
ছায়াগুলো নড়ে ওঠে এপাশে ওপাশে
মানুষেরই ছায়া
নাকি অবয়বহীন কবন্ধ মানুষ!
মানুষ হাঁটছে বটে ,হৃদপিণ্ড খুলে নেয়া
পাথুরে মানুষ ।
উন্মাদ ঘোষণার আগে তিনি রোমান্টিক ছিলেন
উন্মাদ ঘোষণার আগে তিনি রোমান্টিক ছিলেন
উন্মাদ হবার পর তিনি অনেকটাই রাজনীতিক
তিনি সকালে একটি বলছেন তো বিকেলে আরেকটি
এর আগে তিনি প্লেটো এবং এরিস্টটল চর্চা করলেও
এখন তিনি চাণক্য এবং ম্যকিয়াভেলির নিবিষ্ট পাঠক
উন্মাদ ঘোষণার আগে তিনি প্রকৃতি ঘনিষ্ট ছিলেন
এখন তিনি প্রকৃতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আছেন ।
দৃশ্য , দৃশ্যান্তর
——————-
বয়স্ক লোকটি বসে আছেন পার্কে , বেঞ্চে
পাতা ঝরা দেখছেন
লাল খয়েরি
পড়ন্তবেলায় নিজেরই প্রতিচ্ছবির মতো ।
পাশে বয়ে যাচ্ছে নদী ,ক্ষীণতোয়া
পাথরের স্লাভের উপর টলটলে জল
বইছে সংগীতের শব্দের মতন
নদীও ছুটছে সাগর কি মহাসাগরের পানে ।
যেন এক মায়ার হরিণ
——————————-
নিজেকে জানার জন্য ডুব দিতে থাকি
তবু হায় নিজেকে জানি না
সক্রেটিস বলেছিলেন ‘ নিজেকে জানো’
জানাটা যে এতোটাই কঠিন কে জানতো আগে !
দৌড়াচ্ছি অলীক ব্রতে
কি যেন ধরার জন্য , আদৌ কি ধরা দেয় কিছু ?
যেন এক মায়ার হরিণ , লেজ নেড়ে যায় শুধু ।
চিরকালই কিছু লোক
————————
চিরকালই কিছু লোক উলটোপথে যায়
তারা একচক্ষু, হ্যাঞ্চব্যাক , কুঁজো হয়ে হাঁটে
খুব উদ্দেশ্যমূলক ট্যারাচোখে ইতিউতি দেখে
তারা ঘোলাপানিতে মাছ শিকারে যায়
তারা রক্ত দেখে একচোখে
তারা মৃত্যু দেখে একচোখে
তারা সাম্প্রদায়িকা দেখে , তাও একচোখে ।
তারা গুহাজীবি সরীসৃপ চরিত্রে কেবলই লাফায় ।
বৃত্তা বদ্ধ মানুষেরা
———————
তিনি শিল্পী , তিনি নশ্বরতার কথা জানেন
জানেন সময়ের প্রবহমান স্রোত
জানেন খড়কুটোর মতো হারিয়ে যায় মানুষ কুটো
ছাঁচবন্দী মানুষ তবু খোঁজে প্রাকৃতিক সত্য
অর্ধসমাপ্ত কবিতার মতো আটকে থাকে
শব্দরাজি , রোমান্টিকতা , নন্দনতত্ত্ব কিংবা দর্শন
বৃত্তাবদ্ধ অসহায় মানুষেরা খোঁজে দৈব অনুগ্রহ ।
শাদা ছড়ি হাতে হেঁটে যায় আলোর সন্ধানে
——————————————————
অন্ধ সে , হোমারের মতো
লিখে যাচ্ছে ব্রেইল পদ্ধতিতে
মানুষের উত্থানের গল্প
অন্ধ চিত্রশিল্পী জন ব্রামব্লিটের মতো
স্পর্শ আর ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের দ্বারা এঁকে যাচ্ছে চিত্র তার
মূর্ত , বিমূর্ত
কোনো কোনো বাহ্যত দৃষ্টিমানের চেয়েও
তারা অন্তর্ভেদী , দেখে গভীর গোপন
চক্ষুষ্মানের চেয়েও চক্ষুষ্মান তারা
শাদা ছড়ি হাতে হেঁটে যায় আলোর সন্ধানে