spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যবাঙালির সামাজিক গঠনে সুফিদের প্রভাব

লিখেছেন : মুসা আল হাফিজ

বাঙালির সামাজিক গঠনে সুফিদের প্রভাব

মুসা আল হাফিজ

বাংলায় ইসলামের উদয়কালে ছোট ছোট গ্রামকে বলা হতো বাটক বা পাটক বা পাড়া। গ্রামের মধ্যেও কম গুরুত্বপূর্ণ বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে পার্থক্য ছিলো।

সাধারণত গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হতো এমন গ্রাম, যেখানে উচ্চবর্ণের বা শাসকশ্রেণীর লোকদের বসবাস। সমস্ত সুবিধা এই সব এলাকার দিকে কেন্দ্রীভূত থাকতো।

সুফিরা গ্রামজীবনে নতুন ধারণা বিস্তার করেন। যেখানে শিক্ষা-সংস্কৃতি, জীবনোপকরণ এবং ধর্ম-কর্ম বেশি বিকশিত, সেই গ্রাম অধিকতরো গুরুত্বপূর্ণ। তারা গ্রামজীবনে সুযোগ-সুবিধা সম্প্রসারণ করেন। যে গ্রামের অবস্থান জলাভূমি ও স্থলপথের ধারে , লোকালয় ও কৃষিজ ভূমি যেখানে সহজপ্রাপ্য ও প্রচুর, সেই সব গ্রামে সুফিদের মনোযোগ থাকলেও ব্রাত্য জনপদগুলোকে নিজেদের ঘাটি হিসেবে বেছে নেন বহু সুফি। ফলে সুবিধাবঞ্চিত গ্রাম ও সুবিধাপ্রাপ্ত গ্রামের ব্যবধান কমতে থাকে। নতুন কেন্দ্র গড়ে উঠে।

সুফিদের যোগসূত্র ছিলো ব্যবসা-বাণিজ্যের মানুষদের সাথে, শিল্পোৎপাদনের সম্ভাবনার সাথে এবং শাসনকার্য পরিচালনায় থাকা মানুষদের সাথে। আগে গ্রামকে তাঁদের কাছে নিরন্তর যেতে হতো। বহু সুফির গ্রামকেন্দ্রিকতার ফলে তাদেরকে এখন গ্রামে আসতে হতো । প্রায়ই। কারণ সুফিদের অবস্থান তার খানকা ও মাদরাসাকে শিক্ষা, সংস্কৃতি বা ধর্মকর্মের কেন্দ্রভূমি হিসেবে পরিচিতি দিতো।

বাংলার গ্রামীণ সমাজ বহুলাংশে অস্ট্রিক ভাষাভাষী আদিবাসীদের উত্তরাধিকার নিয়ে সুফিদের সাথে যুক্ত হয়। নাগরিক সভ্যতা দ্রাবিড় ভাষাভাষী মানুষের উত্তরাধিকার বহন করে ।

ইসলাম আসার আগে বাংলায় ধর্মকেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠে বহু নগর। ইসলামের প্রভাবেও ঘটে একই ব্যাপার। পুরনো শহরগুলো বিস্তৃত ও বিচিত্র বিকাশ লাভ করে।

দেওকোট, বিক্রমপুর, লাখনৌতি, পাণ্ডুয়া, সোনারগাঁ, চট্টগ্রাম ইত্যাদি নগরী আন্তর্জাতিক আবেদনে আত্মপ্রকাশ করে ।

শহরে থাকতেন রাজবংশ, প্রশাসক, , রাজকর্তা, সৈন্য, শিক্ষক, পুরোহিত, ব্যবসায়ী ইত্যাদি উচ্চসুবিধার মানুষ। থাকতেন কর্মকার, কাংসকার, শাঙ্খিক-শঙ্খাকার, মালাকার, তক্ষক-সূত্রধার, শেন্ডিক, তন্তুবায়-কুবিন্দক প্রভৃতি সম্প্রদায়ের লোক, থাকতেন স্বর্ণকার, সুবর্ণবণিক, গন্ধবণিক, অট্টালিকাকার, কোটক, অন্যান্য ছোট-বড় শিল্পী ও বণিকেরা, থাকতেন রজক, নাপিত, গোপ প্রভৃতির সমাজসেবক। থাকতেন ডোম, চন্ডাল, ভোলাবাহী, চর্মকার, কশাই ইত্যাদি। এরা নাগরিক মর্যাদার অধিকারী ছিলেন না।

নগরের সুবিধাবঞ্চিত এই মানুষগুলো ইসলামের কাছে পেতে থাকে মনের আশ্রয়। যার যার পেশার মূল্য ও মহিমা ইসলাম কখনো ক্ষুন্ন করে না। প্রত্যেক উপকারী পেশাকে করে মহিমান্বিত। কিন্তু বাংলায় তখন উচ্চপেশা ও নিম্নপেশার বিচারে মানুষের মূল্য ও অধিকার নিরূপিত হতো। আবার পেশা নিরূপিত হতো বর্ণের বিচারে। ইসলাম এই বাস্তবতাকে চ্যালেঞ্জ করে।

সেকালে নাগরিক ছিলেন মূলত শ্রেষ্ঠী, শিল্পী, বণিক, নগরবাসী রাজা ও মহারাজা সম্প্রদায়ের রাষ্ট্রপ্রধান এবং বিত্তবান ব্রাহ্মণরা । এরাই ছিলেন শহরের আসল হর্তাকর্তা । শহর ছিল তৎকালে সম্পদ বণ্টনের প্রধান কেন্দ্র।গ্রাম ছিলো কৃষি ও গৃহশিল্প সম্পদ উৎপাদনের উৎস, আর শহর মূলত ঐশ্বর্য ও ভোগ-বিলাশের কেন্দ্র।শহর ও গ্রামে ব্যবধান ছিলো উত্তম বনাম ইতরের। কিন্তু শহরের ভেতরেও ছিলো সেই উত্তম-ইতর। খুব অল্প সংখ্যক সুবিধাভোগী উত্তমের বর্গে, বাকিদের জীবন ছিলো মানবেতর। রামচরিত, পবনদূত কিংবা সদুক্তিকর্নামৃত এর নানা পঙক্তি এই বাস্তবতার ঘোষণা করে। সমসাময়িক লিপিগুলোতেও এর প্রমাণ বিস্তর। গ্রামগুলো সম্পদ সৃষ্টি করতো। ভোগ করতো শহরের বিশেষ শ্রেণী। গ্রামের জীবন ছিলো সুবিধাবঞ্চিত।

গ্রামের ভূমিজ চেহারা গঠন করতো ঊষরভূমি, মালভূমি, গর্ত, গোচারণভূমি, খাল-বিল, পুষ্করিণী, নদী, নদীর খাত ইত্যাদি । অধিবাসীরা ঘর বানাতো বন-জঙ্গল হতে আনা জ্বালানি কাঠ, বাঁশ, খুঁটি ইত্যাদি দিয়ে । খড়কে ব্যবহার করা হতো। মাটির ঘর আর খড়ের ছাউনি ছিলো প্রচুর। কৃষিকাজের জন্য প্রয়োজনীয় বাঁশ ও বেতের নানা প্রকার পাত্র, ঘরবাড়ি, নৌকা, মাটি নির্মিত হাঁড়িপাতিল, লোহার দা-কুড়াল, কোদাল, লাঙ্গলের ফলা, খন্তা ইত্যাদি নিত্য ব্যবহার্য কৃষি যন্ত্রাদির প্রয়োজন ছিল গ্রামে।

কার্পাস ফুল ও বিচি, তাঁত, তুলা, তুলাধুনো ইত্যাদি কার্যক্রম গ্রামেই বেশি ছিল । সুতাকাটা মেয়েদেরও কর্ম ছিল। তাঁরা কাপড় বুনত। কাঁসারি শিল্প ও হাতির দাঁতের শিল্প গ্রামে বেশ চালু ছিল। ইসলাম এই গ্রামজীবনের কোনো উপা্দানের সাথে অসহযোগিতা করেনি। বরং এর বহুমাত্রিক বিকাশ ও সহজিকরণের পথ প্রস্তাব করেছে। গ্রামে সম্ভাবনাময় বাঁশ ও বেতের শিল্প, কাষ্ঠশিল্প, মৃৎ শিল্প, কার্পাস ও অন্যান্য বস্ত্রশিল্প, লৌহ শিল্প ইত্যাদির কেন্দ্র গঠনে সুফিআস্তানাগুলো ভূমিকা রেখেছে।

গৃহনির্মাণশিল্পকে নতুন রুচি ও আভিজাত্য দিয়ে সুশোভিত করেছে। ফলে গ্রামের মুসলিম ঘরগুলো বাঁশের কঞ্চিতেও আঁকতো বিচিত্র আলপনা, যেখানে ব্যবহার করা হতো রং ও প্রকৃতিকে। প্রতিবেশী সমাজেও এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে।

বাগানের বিস্তার, বাড়ীতে বৃক্ষরোপনের গুরুত্ব, বাড়ীর সামনে বেড়া ও পর্দা, দরোজা-জানালায় পর্দার ব্যবহার, পাকা ঘরে খিলানের ব্যবহার ইত্যাদির প্রচলন ঘটে। বাথরুম ও হাম্মামের প্রচলন ছিলো গুরুত্বপূর্ণ দান। কৃষিজ যন্ত্রপাতি ও স্থানীয় উপকরণগুলোর অগ্রসর ব্যবহার ও উত্পাদনে ইসলামের প্রচারক — সুফিরা আনুকূল্য সর্বরাহ করেন।

আরও পড়তে পারেন

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on কবিতার স্ফুলিঙ্গ, স্ফুলিঙ্গের কবিতা