রেজা তানভীর
রোববার মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের রাজু ভাস্কর্য সংলগ্ন মেট্রোরেলের পিলারে ফ্যাসিস্ট হাসিনার ক্ষতবিক্ষত গ্রাফিতি মোছে ফেলার চেষ্টা করেছে সিটি কর্পোরেশনের কর্মীরা। তারা ক্ষতবিক্ষত গ্রাফিতির মুখের অংশটি মোছে ফেলেছিল। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের বাঁধার মুখে পড়ে তারা পুরো গ্রাফিতিটি মোছতে পারেনি। হাসিনার এই গ্রাফিতিটি হাসিনার আমলেই আঁকা হয়েছিল। পাঁচই আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতন হলে জনতা গ্রাফিতিটির উপর জুতা নিক্ষেপ ও রং ছুড়ে গ্রাফিতিটিকে ক্ষতবিক্ষত করে তুলে। ক্ষতবিক্ষত গ্রাফিতি জনগণের কাছে ঘৃণার একটি বস্তু হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছিলো। জনগণ যখন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেত তখন এই ফ্যাসিস্ট হাসিনার ক্ষতবিক্ষত গ্রাফিতিটি তাঁদের মনে করিয়ে দিত ফ্যাসিস্টের প্রতি তাঁদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। যেটি ঘৃণাস্তম্ভ হিসেবে জনগণের কাছে বিবেচিত হয়ে আসছিলো।
কিন্তু মধ্যরাতে সিটি কর্পোরেশনের গ্রাফিতিটি মোছার উদ্যোগ নিয়ে জনগণের নিকট প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কেন এই ফ্যাসিস্ট হাসিনার ক্ষত বিক্ষত ছবি মোছে ফেলে জনগণের নিকট থেকে ফ্যাসিস্ট প্রতিচ্ছবি সরিয়ে ফেলার চেষ্টা? কোন ষড়যন্ত্র কী চলছে?
রোববার দিনভর ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নেটিজেনদের এই গ্রাফিতি মোছে ফেলার চেষ্টার প্রতিবাদ করা হয়। নেটিজেনদের প্রতিবাদ থেকে বুঝা গেল, জনগণ এখনো ফ্যাসিস্ট হাসিনার হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রতিবাদে জাগ্রত। যখনই জুলাই হত্যাকাণ্ডের স্মৃতিচিহ্ন মোছে ফেলার চেষ্টা করা হবে জনগণ তখনই জ্বলে উঠবে।
অবশ্য শিক্ষার্থীরা মধ্যরাতে বাঁধা না দিলে পুরো গ্রাফিতিই মোছে ফেলত। পরে শিক্ষার্থীরা হাসিনার একটি ব্যঙ্গ ছবি অংকন করে।
তবে, নেটিজেনরা হাসিনার ব্যঙ্গ ছবি আঁকার প্রতিও সন্তুষ্ট ছিলেন না। তারা মনে করছেন, হাসিনার ক্ষতবিক্ষত ছবিটিতেই মানুষের আসল ঘৃণা প্রকাশ পায়। নেটিজেনরা শেখ হাসিনার প্রতিকৃতি আবার তৈরী করে তাতে জুতা নিক্ষেপের কর্মসূচীর দাবিও তুলেন।
গ্রাফিতি মোছার ব্যাপারে অনেকেই প্রক্টরের দিকে আঙুল তুলেছেন।
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, “বিষয়টা পুরোপুরি ভুল বুঝানো হয়েছে। আমাদের ক্যাম্পাসে যখন বিভিন্ন দল বা সংগঠন বা শিক্ষার্থীরা রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে প্রোগ্রাম করে সেগুলোর ছবি ও বিস্তারিত সংগ্রহ করে এনএসআই উর্ধ্বতন পর্যায়ে পাঠায়। সেখানে এই দাবিগুলোর মধ্যে দেখা যায় যে, ঢাবিতে এখনো শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনার ছবি রয়ে গেছে। কিন্তু এগুলো যে প্রতিবাদের স্মৃতি হিসেবে এখানে রয়ে গেছে তা বুঝা যায়নি। সেজন্য এগুলো মুছতে বলা হয়েছিল। শিক্ষার্থীরা এখন যেভাবে চাইবে সেভাবেই গ্রাফিতি থাকবে। আমরা এ দুটো মেট্রো পিলারকে ফ্যাসিবাদ ঘৃণা স্তম্ভ ঘোষণা করে দিব।”
তবে এরপরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এক বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, “২৯ শে ডিসেম্বর রাজু ভাস্কর্য মেট্রোরেলের দুটি পিলারে থাকা শেখ মুজিব ও স্বৈরাচার হাসিনার ঘৃণাসূচক গ্রাফিতি মোছতে গেলে শিক্ষার্থীদের মবের সামনে ভুলবশত অতিরিক্ত পরিচালক জনাব শাহজাহানের নাম বলে বলে ফেলি। প্রকৃতপক্ষে এনএসআইয়ের কারো সাথে এ বিষয়ে কারো কোনো কথা হয়নি। এ ঘটনায় আন্তরিকভাবে দু:খ প্রকাশ করছি।”
প্রক্টরের এ বক্তব্য শুনে মনে হলো, যেখানে শিক্ষার্থীরা মনে করে গ্রাফিতিটি মোছা অন্যায় সেখানে একজন প্রক্টরের কাছে কেন মনে হলো গ্রাফিতিটা মোছা যেতে পারে? প্রক্টরের কী কাণ্ডজ্ঞান নেই?
একটা সমাজে গ্রাফিতির গুরুত্ব অনেক। গ্রাফিতিতে সমাজের প্রতিবাদের চিহ্ন ফুটে উঠে। শেখ হাসিনার ক্ষতবিক্ষত গ্রাফিতিতে উঠে এসেছিল ফ্যাসিস্টের প্রতি মানুষের ঘৃণার বহি:প্রকাশ। হাসিনার ক্ষতবিক্ষত গ্রাফিতি মোছার চেষ্টায় জনগণের যে প্রতিবাদ দেখা গেলো সে প্রতিবাদ সব সময় জারি থাকুক। তাহলে ফ্যাসিস্ট এদেশে কখনো নরমালাইজ হতে পারবে না।
জনগণের কাছে ফ্যাসিস্টের পরিচয় জাগরিত রাখতে না পারলে ফ্যাসিস্ট আবার ফিরে আসতে পারে। কারণ, জনগণ খুব দ্রুতই পূর্বের ঘটনা ভুলে যায়। সচেতন জনগণকে তাই ফ্যাসিস্টের প্রতি ঘৃণা জারি রাখা জরুরী। এই কাজটা করতে হবে সমাজের অগ্রসর অংশকেই। তাদের পথ হারানো যাবে না।
এর আগে আমরা দেখেছি, জুলাইয়ের অনেক গ্রাফিতি কিছু ব্যক্তি বা সংগঠন বিভিন্ন সময় মোছে অন্য কিছু আঁকার চেষ্টা করেছে। তাঁদের উদ্দেশ্য জনগণের স্মৃতি থেকে জুলাই গণহত্যাকে মোছে ফেলা। তবে, ইতিহাস মোছা যায় না, যখনই ইতিহাস মোছে ফেলার চেষ্টা করা হবে তখনই জনগণ প্রতিবাদ করবে।
৩০ ডিসেম্বর, ২০২৪