ফিরোজ আহমেদ
‘রাজনৈতিক বন্দোবস্ত’ অপেক্ষাকৃত নতুন বাজারচলতি কথা। বিয়ষটা কী? আমি সহজে যা বুঝি তা হলো, রাজনীতির মাঠে থাকা দলগুলো নিজেদের দলীয় অস্তিত্বের স্বার্থে নিজেদের মধ্যে যেসব অলিখিত বোঝাপড়া বা সম্মতিতে স্থির থাকে সেগুলোই তাদের ‘বন্দোবস্ত’, যেখানে আইন, ন্যায্যতা, এমনকি জনগণের কল্যাণের প্রশ্নটাও গৌণ। রাজনৈতিক বন্দোবস্ত অনড় বা অবিকল্প কোনো বিষয় না। ন্যায্যতা ও জনগণের কল্যাণের প্রশ্নে এগুলো বদলানো যায়।
:::
উদাহরণ ১: আওয়ামীলীগ নিষিদ্ধের প্রশ্নে বিএনপি-র অবস্থান একটা রাজনৈতিক বন্দোবস্ত। লীগ নিষিদ্ধ করা যাবে কি যাবে না– সেটা নিয়ে আইনি বিতর্কের একাট্টা কোনো উত্তর নেই। সেটি নিয়ে বিতর্ক কিন্তু যথাস্থানেই আছে। পৃথিবীর ইতিহাসে অতীতে যে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হয়নি তা-ও নয়। পতিত লীগ নিষিদ্ধে সম্ভাবনাময় বড় দলের ভূমিকা থাকা উচিত কি উচিত না— সেটাও বিতর্কের বিষয়। একটা দল আন্তর্জাতিক মাফিয়াচক্রের সদস্য হয়ে উঠেছিল, সেই দল নিষিদ্ধ করা জনগণের নিরাপত্তার স্বার্থে দরকার কিনা সেটাও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এইসব প্রশ্নের কোনো মীমাংসা না করেই সম্ভাবনাময় দল হিসেবে রাজনীতির মাঠে টিকে থাকার স্বার্থ বিবেচনা করে লীগ নিষিদ্ধের বিপক্ষে থাকা বা তাতে নিজের ভূমিকা অস্বীকার করার যে ব্যাপার—এটা বর্তমানের রাজনৈতিক বন্দোবস্তের একটা উদাহরণ।
বিএনপির ধারণা হলো কোনো দলকে নিষিদ্ধ করার নিয়ম চালু করলে ভাবিষ্যতে তাদেরকেও নিষিদ্ধ করার অজুহাত খোঁজা হতে পারে। এই যে বিএনপি ভবিষ্যতে নিষিদ্ধ হওয়ার ভয়ে লীগ নিষিদ্ধ করতে সম্মতি দিবে না এটা একান্তই দল হিসেবে বিএনপি-র টিকে থাকার প্রশ্ন, অস্তিত্বের প্রশ্ন। এই অস্তিত্বের প্রশ্নে সে আইন, উদাহরণ, ন্যায্যতা, জনগণের কল্যাণ কোনোকিছুকেই গণ্য করবে না। সে এই সুবিধাটুকু লীগকে দিবে যাতে সেরকম বেকায়দা পরিস্থিতিতে সেও লীগ বা অন্যান্য বিরোধী দল থেকে এই সুবিধাটা পায়। অথচ বিএনপি কেন ভবিষ্যতে কোনোদিন স্বৈরাচার হয়ে উঠবে তার কোনো যুক্তি নেই।
এভাবে আইন-কানুন, উদাহরণ, ন্যায্যতা, জনকল্যাণ ইত্যাদি প্রশ্নের মীমাংসা না করেই শুধুমাত্র রাজনীতির মাঠে টিকে থাকার স্বার্থে অন্য দলগুলোর সাথে যে অলিখিত সমঝোতা, বোঝাপড়া বা সম্মতিতে স্থির থাকার ব্যাপার- এটাই বর্তমান রাজনৈতিক বন্দোবস্তের একটা উদাহরণ। কাজেই রাজনৈতিক বন্দোবস্ত হলো মেটা লেভেলের রাজনীতি। রাজনীতির উপরের স্তরের রাজনীতি। রাজনীতির খেলার মাঠের পাটাতন। এরকম আরও উদাহরণ আছে।
::
উদাহরণ ২: ভারত প্রশ্নে বন্দোবস্ত। ভারতের মনোভাব হলো অনগাত হাজার বছর ধরে সে এদেশে দাদাগিরি করেই যাবে, অবৈধ সুবিধা নিয়েই যাবে, প্রয়োজনে সিকিমের মতো করে দখল করবে। আওয়ামীলীগের রাজনীতিই ছিল এই ভারতীয় হেজিমোনিকে জায়গা করে দিয়ে তৈলমর্দন করে ক্ষমতায় থাকা, লুটপাটের খাজনা বুঝিয়ে দিয়ে নিজের জমিদারি চালিয়ে যাওয়া। এই হেজিমোনিকে এদেশে এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে এবং বাস্তবে তা ইতিমধ্যে এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, বিএনপি-ও এই প্রশ্নে চ্যালেঞ্জ নিতে পারে না। ভারত প্রশ্নে রাজনৈতিক বন্দোবস্ত এমন দাঁড়িয়েছে যে, ক্ষমতায় থাকতে হলে ভারত-তোষণ করতেই হবে— কম আর বেশি। ভারত-তোষণ কম করার সুযোগ নেই, বেশির থেকে বেশি করলেই কেবল অস্তিত্ব টিকবে অন্যথায় নয়।
দলীয় অস্তিত্বের স্বার্থে এই ভারতীয় হেজিমোনিকে উচ্চে তুলে ধরার ঘটনার মাঝে বিএনপি-কে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এই বন্দোবস্তে বিএনপি একরকম বাধ্য। আওয়ামীলীগ যা দিয়েছে তার থেকে বেশি না দিলে নিজের রাজনীতি টিকবে না—এই যে ধারণাটির ব্যাপারে বড় দলগুলোর মাঝে অলিখিত সম্মতি উৎপাদিত হয়েছে—এটা এদেশে বিদ্যমান এক ধরনের রাজনৈতিক বন্দোবস্ত। এই মুহূর্তে হাসিনা যেহেতু তার ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করতে ভারতকে ইতিমধ্যে সব দিয়ে দিয়েছে (তার বক্তব্য অনুযায়ী) তাই এই বন্দোবস্তের অধীনে ক্ষমতায় যেতে ইচ্ছুক দলগুলোকে হাসিনার চেয়েও বেশিকিছু ভারতকে দিতে হবে। কিন্তু হাসিনার চেয়ে কে আর বেশি দিতে পারবে? ফলে ভারত আর কাউকেই চায় না, হাসিনাকেই চায়।
এটা একটা বাস্তবতা হয়ে উঠেছে ঐ ধরনের বন্দোবস্তের কারণেই। ক্ষমতায় যেতে ইচ্ছুক দলগুলোর কেউ দৃশ্যত ভারতীয় হেজিমোনির বিরুদ্ধে গিয়ে তার নিজের রাজনীতি দাঁড় করানোর চ্যালেঞ্জ নিতে চায় না। সেই পথকে তার কাছে ভীষণ দুরুহ আর ঝুঁকিপূর্ণ মনে হয়। ফলে সে বা তারা বিদ্যমান বন্দোবস্তের মাঝেই থাকতে চায়। অথচ ভারতেকে দেওয়ার মতো বস্তুগত জিনিস আর বলতে গেল অবশিষ্ট নেই। ভারতকে খুশি করার একমাত্র উপায় এখন অবশিষ্ট আছে এদেশে মুসলিম কোপানো। তাই বোধ হয় এখনই শোনা যাচ্ছে, ক্ষমতায় যেতে ইচ্ছুক দলের পাতিনেতার বক্তৃতার সময় মাইকে জোহরের আজান বন্ধ রাখা। একজন প্রয়াত শহীদ নেতার নাম জপলে নাকি বেহেস্ত কনফার্ম- এইসব কথাবার্তা দিয়ে ইসলাম আর মুসলিম সংস্কৃতিকে অপমানিত করা। এগুলো এই ২ নং বন্দোবস্তের ফলাফল।
::
উদাহরণ ৩: ৭১ প্রশ্নে বন্দোবস্ত। বড় দলগুলোর একটি এই বাংলাদেশ সৃষ্টির আগমুহূর্তের ঘটনাবলীর বিকৃত ইতিহাস ‘চেতনা’-র বোতলে ভরে বিক্রি করে। আরেকটি দল গৌরবময় যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশ নামের ভূখন্ডকে গৌরবান্বিত করে সেই গৌরবময় দেশের নাগরিক হিসেবে সবাইকে একজোট হয়ে মিলেমিশে থাকতে বলে।
৭১-এ এই ভূখন্ডের জন্ম না হলে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের রাজনীতি দাঁড়ায় না, আবার ঐ একই ৭১-এর চেতনা বিক্রি না হলে পতিত ফ্যাসিস্ট দলটির রাজনীতিও ভিত্তি পায় না। তাই ৭১ প্রশ্নে দুই বড় দলেরই নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া আছে। এই বোঝাপড়া কোনো জনকল্যাণবাদী বা ন্যায্যতার প্রশ্নভিত্তিক বোঝাপড়া না। এটা শুধুই উভয়ের রাজনৈতিক অস্তিত্বের প্রশ্নের ভিত্তিতে বোঝাপড়া। অথচ ৭১-এর বয়ানের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট দলটি ভারতীয় হেজিমোনিকে প্রসরিত করেছে। আর আরেকটি দল সেই হেজিমোনিকে এড়াইতে পারে নাই।
অথচ দেশগর্বীদের কথা ছিল ৭১-এ অর্জিত ভূ-খণ্ডের গৌরবকে উচ্চে তুলে ধরে রাজনীতি করার; ভিনদেশের মুখে ছাই দিয়ে এই বাংলাদেশের হেজিমোনিকে উচ্চে তুলে ধরার; জাতীয়তাবাদের মূল স্পিরিটই এটা। অথচ তারাও সহজ এবং চ্যালেঞ্জহীন রাজনীতি করার স্বার্থে, দল হিসেবে টিকে থাকার স্বার্থে ভিনদেশি হেজিমোনি এড়াতেই পারে নাই। বরং যেন আপোষে সেটির মাঝে গিয়ে স্থান করে নিয়েছে। দুই বড় দলের রাজনৈতিক অভিমুখ ভিন্ন; ৭১-এর অর্জনের ব্যাপারে দুই দলের ফোকাসও ভিন্ন। একজনের ফোকাস ‘চেতনা’ আরেকজনের ফোকাস ‘দেশ’। কিন্তু আবার তাদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে ৭১ বিষয়ে তাদের মাঝে অলিখিত বোঝাপড়া বা বন্দোবস্ত বহাল আছে।
:::::
জুলাইয়ের পরে দেখা যাচ্ছে এদেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক বন্দোবস্তের সবগুলোই জনমানুষের জন্য ক্ষতিকর। কোনোটাই জন্যকল্যাণ, ন্যায্যতা, সভ্যতার পক্ষে নয়। শুধুই রাজনৈতিক দলগুলোর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার বন্দোবস্ত। এই বন্দোবস্তগুলো ভেঙ্গে নতুন বন্দোবস্ত দরকার।
এদেশে রাজনৈতিক বন্দোবস্ত আর ‘বন্দোবস্ত’ হিসেবে নাই, বরং দীর্ঘদিন এই বন্দোবস্ত টিকে থাকার কারণে তা ‘রাজনৈতিক সংস্কৃতি’ হয়ে উঠেছে। একই রাজনৈতিক বন্দোবস্ত দীর্ঘদিন টিকে থাকলে সময়ে প্রেক্ষিতে তা ‘রাজনৈতিক সংস্কৃতি’ হয়ে ওঠে। ফলে মানুষের কল্যাণের লক্ষ্য নিয়ে নতুন কোনো দল আবির্ভাব হওয়ার পথও বন্ধ হয়ে যায়। দেশ, জনগণ, দল সকলের বর্তমান ও ভবিষ্যত সেই দুষ্ট রাজনৈতিক সংস্কৃতির মাঝে আটকে পড়ে। জনতা, রাজনৈতিক দল সবাই মিলে দুর্বল, আত্ম-প্রতারক, দুর্নীতিগ্রস্ত, আত্ম-হন্তারক হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের প্রতিবেশি দেশটি চায় এদেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক বন্দোবস্তটি আরও বেশিদিন টিকে থাকুক এবং সময়ের পরিক্রমায় তা এদেশের ‘রাজনৈতিক সংস্কৃতি’ হয়ে উঠুক যাতে ভবিষ্যতে আর কোনদিন এদেশে কোনো সুষ্ঠু রাজনীতির ধারা না গড়ে ওঠে। কব্জা করতে সহজ হয়। সুখের বিষয় হলো জুলাই এদেশের মানুষের জন্য হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো বিপুল সম্ভাবনা নিয়ে হাজির হয়েছে। নতুন বন্দোবস্তের পথ খুলে দিয়েছে।