আবু তাহের তারেক
বাংলাদেশের সাহিত্যের নয়া ইতিহাস লেখা দরকার। সেই ইতিহাসে লালন হাসন রাধারমণদেরকে মূলধারার কবি হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার পাশাপাশি, মমিনসিংগের গীতিকা, পুথি সাহিত্য ইত্যাদিরে এইখানকার সাহিত্যের প্রধান রচনা হিসাবে তুইলা ধরা দরকার।
এছাড়া আধুনিক, মধ্যযুগীয় ও প্রাচীন নামক কান্ডজ্ঞানহীন যুগভাগকে উপড়ে ফেলা উচিত। কতটুকু বিকৃত মনোভাব ধারণ করলে পরে, কেউ ‘কলোনাইজেশনের যুগরে’ ‘আধুনিক’ যুগ বলতে পারে!
আমরারে শিখানি হয়, আধুনিক বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবি নাকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-জীবনানন্দ দাশ! এইখানে নজরুলরেও আমলে আনা হয় না। অথচ, নজরুল এদের দুইজনের চাইতে বড় কবি। তাছাড়া, এরা কেউওই ত, লালনের মতন বড় কবি নন। জীবনানন্দ দাশ কি রাধারমণের চাইতে বড় কবি! র.ঠা কি হাসন রাজা, বা আব্দুল করিমের চাইতে বড় কবি!
এই কথা শুইনা অনেকের মাথা গরম হইয়া যাইতে পারে। যাইবারই কথা। কলোনির আন্ডারে বড় হওয়া কিছু জমিদার আর কেরানি পকরিতির কবি-সাহিত্যিকরে ‘আধুনিক’ অভিধা দিয়া আমরার মাথার উপরে ছড়ি ঘুরানিই ত সহজ, স্বাভাবিক; তাই না!
আমাদের সাহিত্যে আধুনিকতার যুগবিভাজন এতই কদর্য, যে এই যুগ জসীম উদ্দীনরে কোথায় লুকাইবে, তা নিয়া রীতিমত হিমশিম খাইতে থাকে।
আমাদের দরকার, সাহিত্যের নয়া ইতিহাস রচনা।
২.
জীবনানন্দের কবিতার কথা আমি ভার্সিটিতে গিয়া শুনি। আর, উনার ভক্ত হইয়া যাই। এরপর, দীর্ঘ ভার্সিটির জীবন আমি জী.দা’র কবিতা পড়ি। আর শুনি, র.ঠা’র গান। এই দুইটা জিনিস পুরা ভার্সিটি লাইফ আমারে অধিকার কইরা রাখল। এরপরে, গ্রাজুয়েশনের পরে, একটা দীর্ঘ সময় কর্মহীন কাটল। তখন র.ঠা’রে ফালতু লাগল। আর, জী.দা’রে তিত্তা লাগল। আমার কর্মহীন, বিস্বাদ জীবন এইভাবে, র.ঠা আর জী.দা’রে আমার কাছ হইতে ছিনাইয়া লইয়া গেল।
এরপরে, আমার চাকরি জুটল এলাকার একটা প্রতিষ্ঠানে। শহর ছাইড়া, আমি আবার মায়ের কোলে চইলা গেলাম। গ্রামে থাকলাম। তখন, আমার শৈশবের স্মৃতিগুলা ফিইরা আসতে লাগল।
মা-চাচীরা ‘ধামাইল’ নামে এক প্রকারের গীত গাইতেন। এইটা মোটামুটি রিচুয়ালের মত আছিল। এইখানে তারা গান গাওয়ার পাশাপাশি, কমর দোলাইয়া নাচতেন। এছাড়া, ছোট কলসিতে পানি ভইরা, তাতে চাউল, গলার হার ইত্যাদি ভইরা, ভাগ্য পরীক্ষা করতেন। গানের শেষদিকে, ‘ভাইবে রাধা রমণ বলে’ এই কথাটা খুব কইতেন। কিন্তুক, এই কথার অর্থ যে ‘রাধা রমণ ভাইবা বলে’, তা বুঝতাম না।
যখন বুঝলাম, তখন আমি ভার্সিটির ফারেগ। চাকুরিরত। গ্রামে বাস করি। এরপরে, সিলেটের গ্রামের বিয়াগুলিতে রাধারমণের বিয়ার গীত গাইবার বেপারটা খুব গোচর করি।
তো, রাধারমণের মতই, আস্তে আস্তে করিম, হাসন, ক্বারী আমির উদ্দিনদেরকে আবিস্কার করি আমি।
কথা হইল, জী.দা’র প্রেমে পড়া মানুষের পক্ষে শক্ত কইরা বলা কঠিন যে, তার বেস্ট কবিতা কি কি। অথবা, উনার কুন কুন কবিতারে ইউনিক বলা যায়। আপনে যদি, রাধারমণের ইউনিক কবিতার আবেদনের লগে, জী.দা’র ইউনিক কবিতার আবেদনের বিচার করেন, তাইলে পরে রাধা রমণকেই বড় কবি হিসাবে আগাইয়া রাখবেন– এইরকমই আমার অনুমান।
একইভাবে, আমরা যারা র.ঠা’র গানের ভক্তি দিয়া বেশ প্রভাবিত, তারা র.ঠা’র চাইতে হাসন রাজারেই বেশী প্রিফার করবার কথা। হাসন যত সহজ ভাষায় এবং সোজাসুজি, অথচ গভীর বোধের জায়গা হইতে আল্লার কথা বলছেন, র.ঠা’য় স্রষ্ঠার কথা সেই গভীরতায় আসে না।
এই বেপারে একটা কথা মনে রাখা খুব দরকার। র.ঠা একজন ‘আধুনিকতাবাদী’ কবি। যার সামাজিক পরিচয় হইল ‘জমিদার’। হাসন রাজাও জমিদারই ছিলেন। র.ঠা’র পরিবারের মত, প্রজাপীড়নও করতেন বইলা শোনা যায়। তদুপরী, হাসন যখন গান লেখা শুরু করেন, তিনি একজন ফকিরে রূপান্তরিত হন। তার একটা ফকিরি জার্নি শুরু হয়। ফলে, ‘আমি যাইমু ও যাইমু আল্লারো সংগে’, বা ‘ধরো দিলারাম’ গানগুলার আকুতি অনেক বেশী ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ও আবেগময় রূপে পাঠমনে ধরা দেয়।
জী.দা বা র.ঠা’রে রাধারমণ আর হাসন রাজার লগেই যে মিলাইতে হইব, তা না। কলোনির আমলের দুইশ বছরের ইতিহাসে কলকাতার র.ঠা’রা যখন নোবেল পুরস্কার পাইতেছিল, তখন পূর্ব বাংলায় ভাবের একটা জোয়ারই তৈয়ার হইছিল, বলা যায়। লালন, হাসন, রাধারমণ, জালাল খাঁ ইত্যাদি মহৎ কবি, গীতিকারের হাট বসছিল এই অঞ্চলে।
জী.দা’রা আধুনিক মানুষের নি:সংগতা ও পশ্চিমা কাব্যিক স্টাইল কিছু ক্ষেত্রে সফলভাবে আমদানী করতে পারছিলেন, সইত্য। তারপরেও, সামগ্রিক বিবেচনায়, পূর্ব বাংলার গত দুইশ বছরের কবি সাহিত্যিকদেরকে যেইভাবে ইতিহাসের বাইরে ছাইচাপা দিয়া রাখা হইছে, তা বেদনার। এইগুলা সত্য সত্য স্টাডির ভিতরে আনলে, জী.দা’রা ম্রিয়মান হইবেন বটে!
সিলেটের ঐতিহ্যবাহী বিয়ার গীত, বা ধামাইল বাংলাদেশের জনপ্রিয় নৃত্যগীত হইতে পারত। সেই সূত্রে, রাধারমণ পুরা বাংলাদেশের সেলিব্রিটি কবিদের একজন হইতেন। এছাড়া, গত দুইশ-তিনশ বছর ধরে এই অঞ্চলে তৈয়ার হওয়া ভাব সম্পদের যে জোয়ার, তার খবর আমরা আরো আন্তরিকভাবে রাখতে পারতাম।
এই না পারার অন্যতম বড় কারণ, আমাদের কলোনিয়াল শিক্ষা ব্যবস্থা। আমি ইউনিতে যাওয়ার পরই না র.ঠা আর জী.দা’র ভক্ত হইলাম! এমনকি, অনেকে, নিউ মিডিয়ার কল্যাণে এদের নয়া নয়া মুরিদ হইতেছেন। আমাদের শিক্ষক-চিন্তকদের দশাও একই। তারা বাংলার রেনেসা বিষয়ে মুখস্ত বিদ্যা জাহির করতে ব্যস্ত।
পূর্ব বাংলার ভাবের জোয়ারের কথা কে বলবে তবে!
৩.
আধুনিকতা: জীবনানন্দ দাশ ও জসীম উদ্দীন
………..
জী.দার কবিতায় মানুষ নাই। বেপারটা খিয়াল করছেন? কিন্তুক কেন! বিপরীতে, জসীমের কবিতায় মানুষ, পকরিতির অন্যান্য উপাদানের মতই, সহজ-স্বাভাবিকরূপে আসে। আল মাহমুদের মত করে কইলে, জসীমের কবিতায় একটা রূহানিয়াত খিয়াল করা যায়। কলমিলতা, জসীমে, পারসনিফাইড হয়। অর্থাৎ, সে একটা অনুভূতি সম্পন্ন প্রাণীর রূপ ধারণ করে। তখন, কলমির লগে কথা বলা, আর দশজন মানুষের মত কথা বলার মতই, সহজ!
জী.দার পকরিতি-প্রেম কেমন? গড়ে, তা ইম্প্রেশনিস্টিক। নস্টালজিয়া আক্রান্ত। জী.দা এই পকরিতির ভিতর বাস করেন না। এইটারে উনি হয়ত, মিস করেন। (যদিও, জী.দা’র পকরিতি বিষয়ে সার্বিক কথা বলা রিস্কি। পকরিতি নিয়া উনার শক্তিশালী কিছু কাব্য, অন্তত, লাইন ত আছেই। আমাদের আলাপ, জী.দা’র রচনার গড় ধরণ নিয়া।)
আধুনিকতাবাদী চিন্তায় মানুষকে প্রকরিতি হইতে আলাদা করে ভাবার চল আছে। মানুষ হইল কর্তা। ন্যাচার তার অনুগত। ফলে, ন্যাচার নিয়া তার ভাবনা কর্তার জায়গা হইতে। জী.দা’র কবিতায় আধুনিকতাবাদী এই পার্স্পেক্টিভ খুইজা পাইবেন। এদিকে, জসীমে মানুষ আর পকরিতি একাকার। এইখানে প্রাণী মাত্রেই একে অন্যের মিত্র। একে অপরের উপর নির্ভরশীল।
এই কারণে, জসীমে মানুষের উপস্থিতি প্রবল। তার মানুষ চাষা, মজুর, যাদের ব্যক্তিপরিচয় খুব একটা জরুরী না। জী.দা পশ্চিমা ব্যক্তিবাদী বিষাদে আক্রান্ত কবি। এই ব্যক্তিরে, কলোনির ভিতরে খুজতে গেলে, মজুরদের কাছেই ত যাইতে হইবে। জী.দা ওদের কাছে যাইবেন কেমনে! তখন উনার কলোনিয়াল আধুনিকতা ভাইংগা পড়বে না! ঠিক এই কারণে, তার কবিতায় সান্ধ্য ভাষার আবির্ভাব ঘটে। সে কিছুটা ‘মিনমিনা’ বটে!
আমরা যদি ইউরোপীয় মডার্নিজমের প্রভাবশালী কবি, যেমন ফার্নান্দ পেসোয়ার কথা বিবেচনা করি, দেখব, তারে মডার্ন হইতে হয় নাই। সে মডার্নিজমের ভিতরেই বাস করে। ফলে, সে লিসবনের যে লিসান (জবান) আর যাপন তার কবিতায় রোপণ করে, তা প্রাণবন্ত। তার ভাষা সজীব। এছাড়া, সে এই যাপনরে নিয়া ঠাট্টা মশকরাও করে। জী.দা’য় মশকরা হয়ত বাইছা-খুইজা একটা দুইটা পাইয়াও যাইতে পারেন। কিন্তুক, আধুনিক হইবার, আধুনিক থাকবার যে প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা, তা অহরহ উনার মইদ্যে টের পাইবেন।
উদাহরণ বাড়াইলে, ইয়েটসের কথা আনা যায়। সে আধুনিক থাকার পাশাপাশি, এর ক্রিটিকও। এছাড়া, আধুনিকতার মুসিবতের কথাও তার কবিতায় বিখ্যাত। এদিকে, রবার্ট ফ্রস্টের কথা ভাবেন। একটা ‘মডার্ন টাইমের’ ভিতরে উনার কবিতা কুন হিসাবে ‘মডার্ন’?
এই জায়গায় প্রশ্ন আসবে, আমাদের মডার্ন আর পশ্চিমা মডার্নের। প্রত্যেক জাতির নিজস্ব একটা মডার্নিজম থাকে। এই মডার্নিজম মোটেও একরোখা কোন বেপার নয়। কিন্তুক, জী.দা যেই মডার্নিজমের চর্চা করছেন, তা করতে গিয়া, তিনি উপনিবেশিত মানুষের জবান, উপস্থিতি ইত্যাদিরে সেন্সর করছেন। ইউরোপীয় বিষন্নতা আমদানি করছেন। পকিরিতি আর মানুষের মইদ্যে দূরত্ব রচনা করছেন। ব্যক্তির কথা বলতে গিয়া, ‘তুমি’ আর ‘আমির’ বাকশে মোটাদাগে বন্দি হইছেন।
এইটারে জী.দার ‘মাইমেটিক ডিজায়ার’ রূপে পাঠ করতে পারবেন। খিয়াল করেন, পূর্ব বাংলার ছেলে জী.দা। তার রচনায় পূর্ব বাংলা সামান্য কিছু উপাদানই যোগ করে মাত্র। এর বেশী কিছু না। উনি পুব বাংলা হইতে, বেশ পরিণত বয়সে, পশ্চিমে হিজরত করেন। সেইখানে গিয়া, মোটের উপর পশ্চিমই হইয়া যান তিনি। পার্টিশনের পরে, দেশে ফিরার কথা ভাবেন না আর। এখানকার মানুষ নয়, বরঞ্চ, পকরিতিই তারে বেশী টানে! সেই টান, আবারো, ইয়াদের বেশে আসে। এইসব তথ্যকে, মাইমেটিক ডিজায়ারের ভাষ্যমত পাঠ করলে, জী.দা’র কলোনিয়াল মনোভাবের হদিশ পাইবেন। তিনি একটা উপনিবেশিত মন দিয়া, প্রভুর মত হইবার কুশিশ করতেছিলেন প্রাণপণে।
জী.দা’র এই আধুনিকতারে আমরা পশ্চিমা মডার্নিজম রূপে পাঠ করতে পারি। এই জায়গায়, জসীমের আধুনিক হওয়া বা সময়ের প্রেক্ষিতে নিজেরে হাজির করার কুশিশ, মূলত নিজের সারাউন্ডিংসরে ঘিইরাই। তাই বলি, তা কি সময়রে পার করার হিম্মত রাখে না! জসীমের পকিরিতির প্রতি দরদসম্পন্ন কাব্য এই সময়ে আরো বেশী গুরুত্ব দাবী রাখে বৈকী! অন্তত, ইকো ক্রিটিসিজমের দিক থেকে।
বর্তমান সময়ে ‘কার মডার্নিজম’ প্রশ্নটা সাহিত্যিক পরিমন্ডলে বেশ গুরুত্ব সহকারে আলোচিত হইতেছে। দেখা যাইতেছে, মডার্নিজমের একক কুনু রূপের হদিশ মিলতেছে না। পশ্চিম ইউরোপীয় আধুনিকতাবাদী মডেলের বাইরেও, আরো বহু বহু স্থরের আধুনিকতা চর্চিত হইতেছে, সারা দুনিয়ায়। আমাদের বিশ্বাস, জসীম উদ্দীন কলোনিয়াল ‘মাইমেটিক ডিজায়ার’ বিষয়ে ব্যপকভাবে সচেতন আছিলেন। তিনি নিজের জবান আর মানুষরে নিয়া, তার সাধ্যমত কাম করতে চাইছিলেন। জী.দা, আপাতদৃষ্টে, একজন উচ্ছাকাংখী মানুষ আছিলেন। তিনি শিল্পের খাতিরে নিজের মাতৃভূমি ত্যাগ করছিলেন। একটা পরিশীলীত ভাষারে নিজের ভাষারূপে গ্রহণ করছিলেন। একটা পশ্চিম ইউরোপীয় কাব্যিক স্ট্রাকচারে নিজের কাব্যকলা চর্চা করছিলেন।
এতে দুইজনের অর্জন অনেক। দুইজনই বাংলা ভাষার প্রভাবশালী কবি। অবশ্য, জী.দা’র বেপারে অনেক অনেক আলাপ হওয়ার পাশাপাশি, উনার পশ্চিমা আধুনিকতার অনুকারক থাকার বেপারটা খুব একটা আলাপে আসে না। ইউরোপীয় ধ্রুপদী আধুনিক রাইটারদের তুলনায়, আধুনিক কবি হিসাবে, জী.দা’র অর্জন কমই। উনার কবিতার তর্জমা হইলে পরে, ইউরোপ কখনোই উনারে ফার্নান্দ পেসোয়া, ডব্লিও বি ইয়েটস, বা রবার্ট ফ্রস্টের মতন সমান গুরুত্বপূর্ণ কবি হিসাবে নিবে না। সংগত কারণেই।
………
র.ঠা = রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
জী.দা = জীবনানন্দ দাশ
………