spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যকবি নাসিমা সুলতানা

লিখেছেন : রফি হক

কবি নাসিমা সুলতানা


রফি হক

আপনাদের নাসিমা সুলতানাকে মনে আছে ?
কবি নাসিমা সুলতানার কথা?
.

একদিন ভুল করে বাড়ি খুঁজে পাবো না, চলে যাবো অন্য পথে
একদিন ভুল করে এক অচেনা ভদ্রলোককে ডেকে বলবো—
অনেকদিন পর তুই নিরঞ্জন ! ভাল আছিস তো ?
আয় বসি কোন চায়ের দোকানে’ ।

একদিন ভুল করে ঘোরতর স্বপ্নের মধ্যে জানলা খুলে রেখে
শুয়ে থাকবো, ঘুমাবো না
একদিন ভুল করে ঈশ্বরকে মনে রাখবো না
একদিন ভুল করে তোমাকে বলবো— ‘এই তো কাছেই থাকি
একদিন আসুন না’ ।
.

কিংবা ‘ভালোবাসা’ নামের কবিতাটি যা আমাদের প্রথম তারুণ্যের মুগ্ধ করা কবিতা ! মনে পড়ে কারু ?
.

ভালোবাসা ছিল এইখানে
ঘাসের ভেতরে যেন রৌদ্রখচিত নীলা
এই গাছে… বিমুগ্ধ ডালপালা… সবুজ ক্লোরোফিল
নাবালিকা চাঁদ আর অমল পাইনে—ভালোবাসা ছিল
এই খানে হাত রাখো ভালোবাসা হবে ।
…… ….
ভালোবাসা এইভাবে হয়,
বকুল ফুলের মতো দুঃখের ঘ্রাণে ভরে যায় বুক
ভালোবাসা হতে হতে চোখের পাতায় পড়ে কলাপাতা রোদ্দুর
ভালোবাসা হতে হতে রক্তকরবী গাছে বিমূর্ত জ্যোৎস্না
ভালোবাসা হতে হতে ব্রিজের ওপর এক আলোকিত ট্রেন
.

নাসিমা সুলতানা বিশ শতকের সত্তর দশকের কবি। আমার সহকর্মী ছিলেন। বন্ধু ছিলেন। আমার প্রিয় কবি ছিলেন। আর ছিলেন আমার প্রিয় ‘নাসিমা আপা’। আরো কিছু ছিলেন— আমার অগ্রজ, বন্ধু আহসানুল হাকিম টুটুল ভাইয়ের স্ত্রী। নাসিমা আপার জন্মস্থান : কুষ্টিয়া, ১৫ জানুয়ারি। আমার জন্মস্থান : কুষ্টিয়া । ওনার বাড়ি : কুষ্টিয়ার আমলাপাড়া। আমার বাড়ি : কুষ্টিয়ার কোর্টপাড়া। আমরা একই শহরের মানুষ !
.

আশির দশকের মধ্যভাগে আমি একটি দৈনিক পত্রিকার শিল্প-সম্পাদক হিসেবে কাজ করি— তখন সে পত্রিকার সহকারী সম্পাদক হিসেবে যুক্ত ছিলেন নাসিমা আপা । শান্তিনগরের মোড় থেকে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের দিকে যে রাস্তাটি গেছে তার মুখেই হাতের বামদিকে একটি পুরনো দিনের তিনতলা বাড়ি। এই বাড়িটিই আমাদের অফিস। এর তিন তলায় বিশাল ছাদ সহ মাত্র দুটি কামরা। সেখানে একটি কামরায় বসতেন তিন জৈষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, তাঁরা হলেন : কবি মাহবুব হাসান, বর্ষীয়ান সাংবাদিক নজরুল হক, এবং ফাইজুস সালেহীন। আরেকটি কামরায় নাসিমা সুলতানা এবং আমি। নাসিমা সুলতানা এবং আমি পাশাপাশি বসতাম। আমরা খুব গল্প করতাম । হাসাহাসি করতাম। আমাদের সঙ্গে কিছু পরে এসে যোগ দেন আরেক সহকারী সম্পাদক—শাহানা হুদা রঞ্জনা। আর রঞ্জনা হলো– কথা আর গল্পের ফোয়ারা, একাই এক’শ। রঞ্জনার মতো হাসতে আমি আজও কাউকে দেখিনি ! আমাদের রুমটাতে যেন তারুণ্যের ঢেউ খেলে যেতো ! সপ্তাহে একদিন আসতেন মুসা ভাবী, সেতারা মুসা । প্রখ্যাত সাংবাদিক এ বি এম মুসা সাহেবের স্ত্রী । মুসা ভাবীও দারুণ উজ্জ্বল থাকতেন। আমরা হৈ-হুল্লোড় করে অফিস করতাম। আমি অফিসে আসতাম আর্ট কলেজের ক্লাস শেষ করে, মধ্যাহ্নে। তখন আমি আর্ট কলেজে, সেকেন্ড কি থার্ড ইয়ার !
আহা ! সেই সব দিন !!
.

তখনও নাসিমা আপার বিয়ে হয়নি। বিষম লাজুক একটি ছেলে শেষ বিকেলে আসেন নাসিমা আপার সঙ্গে দেখা করতে। তারা কিছুক্ষণ নিচু স্বরে কথা বলেন। নাসিমা আপার লেখালেখির কাজ শেষ পর্যন্ত ছেলেটি অপেক্ষা করেন। কাজ শেষ হলে একসঙ্গে বেরিয়ে যান অফিস থেকে। এই লাজুক ছেলেটিই আহসানুল হাকিম টুটুল। তবে টুটুল ভাই যতক্ষণ নাসিমা আপার সমুখে বসে থাকতেন— লেখায় মগ্ন নাসিমা আপার দিকে টারে টারে তাকিয়ে থাকতেন। কী যে ভালো লাগত, ঐ বয়সে ওদের দুজনকে !
.

‘এমন করে তাকালে কেন তুমি ?
আমি কাউকে না-বলে কোনও দুঃখের কাছে না-গিয়ে
দ্বিপ্রহরে খুলে দিলাম দরজা
দুঃখ আমাকে ভীষণ দুঃখ দিয়ে গেলো
দুঃখ আমাকে বলে গেলো দুঃখ দুঃখ
এমন করে তাকালে কেন তুমি ?
….. …… ……
আমি তো যেতেই চাই…এ খেলা আমার নয়
আমি ঠিক যাবো উজ্জ্বল পরীর মতো নেচে নেচে
অর্জুন গাছের ছায়ায়—-যেখানে
পবিত্র মানুষের চোখে জ্বলে ওঠে নীলকান্ত ভালোবাসা
… ……
আমি তো চলে যেতেই চাই কাউকে না-জানিয়ে
অনিবার্য পতনের ঘাসবন ভেঙে—‘
.

সত্যিই, কাউকে না জানিয়ে নাসিমা সুলতানা চলে গেলেন একদিন । মাত্র চল্লিশ বছরে… ১৭ নভেম্বর ১৯৯৭ তে । ঠিক উজ্জ্বল পরীর মতো নেচে নেচে চলে গেলেন ।… একজন উজ্জ্বল কবি পৃথিবীকে বিদায় জানালেন । আপনাদের মনে আছে কারু ?
#
.
…………
রফি হক
আর্টিস্ট, প্রিন্টমেকার, রাইটার, এডিটর
১৬ জানুয়ারি

পুনশ্চ : [নাসিমা সুলতানা আপা ও টুটুল ভাইয়ের জন্মদিন : ১৫ জানুয়ারি, একই দিনে । গতকাল ছিলো তাঁদের জন্মদিন। নাসিমা আপার চলে যাওয়ার কষ্ট টুটুল ভাই জীবনের শেষদিন পর্যন্ত বয়ে গেছেন ।]

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

আমিনুল ইসলাম on কবিতাগুচ্ছ
শিকদার মুহাম্মদ কিব্রিয়াহ on কবিতাগুচ্ছ
নয়ন আহমেদ on কবিতাগুচ্ছ
নয়ন আহমেদ on মা দিবসের কবিতা
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম on শিপা, আমি তোমার বয়ফ্রেন্ড হতে পারিনি