spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদসাম্প্রতিকজিয়াউর রহমান : একজন বাইচ্যান্স জেনারেল নামা

গ্রন্থনা : মীর সালমান শামিল

জিয়াউর রহমান : একজন বাইচ্যান্স জেনারেল নামা

মীর সালমান শামিল

এক।

…আমি আর দাউদ কামরায় বসে রইলাম। রাষ্ট্রপতি টেলিফোনে তথ্যমন্ত্রীকে চাইলেন। সংযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হোয়াট হ্যাভ ইউ ডান এ্যাবাউট মিঃ মূসা’ উত্তরে কী জানলেন আমি জানিনা, তবে মুখ খানি কঠোর করে কিছুক্ষণ শুনলেন, তারপর ‘আচ্ছা’ বলে টেলিফোন রেখে দিলেন। আমাকে বল্লেন, ‘একটু সমস্যা দেখা দিয়েছে, ঠিক করে দেব।’ আমাকে যাওয়ার অনুমতি দিলেন, দাউদকে থেকে যেতে বল্লেন।

সমস্যাটি কি পরে দাউদের মুখে শুনেছিলাম। সমাধানটি রাষ্ট্রপতি কীভাবে করেছিলেন তাও জেনেছি। আমার প্রেস ইনস্টিটিউটে নিয়োগের ব্যাপারে সামরিক ও বেসমরিক গোয়েন্দা সংস্থা থেকে আপত্তি এসেছিল। আমাকে বিদায় দিয়েই টেলিফোন করলেন ডিএফআই প্রধান জেনারেল মহব্বত জান চৌধুরীকে। জেনারেল চৌধুরী রাষ্ট্রপতিকে জানালেন, ‘মূসা সাহেব আওয়ামীপন্থী, সুতরাং তাঁকে সরকারি কোন পদে নিয়োগ দেয়া যাবেনা।’ রাষ্ট্রপতি গম্ভীর মুখে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘ তা আমি জানি। তিনি প্রেস ইনস্টিটিউটের ডিজি হওয়ার উপযুক্ত কিনা, সাংবাদিকদের শেখানোর বিদ্যা আছে কিনা, সেটা বলুন।’ তারপর নাকি বলেছেন, ‘তাকে রাষ্ট্রপতি ক্লিয়ারেন্স দেওয়ার পরে আপনাদের রিপোর্ট ইজ ইউজলেস’। এই কথাবার্তার বিষয়বস্তু পরবর্তীতে মহব্বত জান চৌধুরীর ছোটভাই সরওয়ার জান চৌধুরীও আমাকে জানিয়েছিলেন। দু’দিন পরে হুদা ভাইয়ের ফোন পেলাম, ‘মূসা, তুই কোথায়? এদিকে বঙ্গভবনের টেলিফোনে আমার প্রাণ অতিষ্ঠ।’ যথা সময়ে ডিজি পিআইবি পদে যোগ দিলাম।

অতঃপর জিয়া চরিত্রের কোন বিশেষ দিক নিয়ে বিশ্লেষণের প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। তবে আমার ব্যক্তিগত কাহিনীটি থেকে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের রাষ্ট্র পরিচালনায় যে প্রশাসনিক দক্ষতার কথা বলা হয় তার ভিত্তি সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যেতে পারে। অন্তত আমার ক্ষেত্রে বোঝা গেছে তাঁর প্রশাসনে দলীয়করণ, রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনায় ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ এবং রাজনৈতিক সংকীর্নতার কোন স্থান ছিল না। প্রশাসনিক বা নীতিটি অনুসরন না করার কারণেই পরবর্তীতে কেউ কেউ রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন॥”

— এ বি এম মূসা, জিয়ার দর্শন ও বাংলাদেশ(প্রবন্ধ সংগ্রহ), পৃ: ২৫

দুই।

…প্রেসিডেন্ট জিয়া সম্পর্কে মাওলানা ভাসানী কে প্রশ্ন করা হয়েছিল : হুজুর, আপনাকে তো সব সময়ই সরকার বিরোধী ভূমিকায় দেখা যায়, এমনকি যখন আপনার নিজের দল মন্ত্রী সভা গঠন করেছেন তখনও আপনি একই জনসভায় দাঁড়িয়ে আপনার পাশে বসা মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বক্তব্য দিয়েছেন, অথচ দেখা যায় আপনি জিয়াউর রহমানের প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতিশীল । জিয়াউর রহমানের প্রতি আপনার এই দুর্বলতার কারণ কি ?

মাওলানা ভাসানী জবাবে বলেছিলেন : দেখ তোমরা তো রাজনীতি দেখছো বহুদিন ধরে, আমার রাজনৈতিক জীবন ও অনেক দিনের। আমার এই দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে এদেশে এমন একটা লোক তো কখনো ও দেখলাম না যে ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছে নিজেকে দূর্নীতি আর স্বজনপ্রীতির ঊর্ধ্বে রাখতে পেরেছে । আমাকে একটা উদাহরণ দেখাও”।

— অধ্যাপক আবদুল গফুর (ভাষা সৈনিক), প্রবন্ধ

তিন।

…তিনি ছিলেন জনগণের হৃদয়ের মানুষ। তিনি ছিলেন কাজের মানুষ। সামরিক শৃঙ্খলাকে, সামরিক আবেগকে তিনি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে নিয়ে আসেন। তার দূরদৃষ্টিমূলক, রাষ্ট্রনায়কোচিত কর্মকাণ্ডের কারণে বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়কে প্রথম পা রাখে; বাংলাদেশ পৃথিবীর জাতিগুলোর মিলনমেলায় নিজের নাম উজ্জ্বলভাবে প্রস্ফুটিত করে। মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমান দেশগুলো, তাৎক্ষণিক প্রতিবেশী অমুসলমান দেশগুলো এবং বিশ্বের নেতৃত্ব প্রদানকারী পাশ্চাত্যের দেশগুলোর সাথে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন। ইরাক ও ইরানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। উভয় পক্ষের সাথে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ওই যুদ্ধ নিরসনের লক্ষ্যে যেই তিন সদস্যের তথা তিনজন রাষ্ট্রপ্রধানের কমিটি করা হয়েছিল, সেই কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। সর্বোপরি উদীয়মান সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি চীনের সাথে ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন জিয়াউর রহমান।

জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক বিরোধীরা তার সমালোচনা করতেই পারেন। কিন্তু বিশ্লেষকেরা বিনাদ্বিধায় বলবেন, জিয়াউর রহমান সমন্বয়ের রাজনীতি, সহনশীলতার রাজনীতি, সমঝোতার রাজনীতি ও বহুদলীয় রাজনৈতিক গণতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন। গবেষকেরা স্বীকার করেন, তিনি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে তৃণমূল মানুষের অংশগ্রহণে বিশ্বাস করতেন, কঠোর শৃঙ্খলায় বিশ্বাস করতেন এবং নিজেকে দুর্নীতির ঊর্ধে রাখায় বিশ্বাস করতেন। তিনি তরুণ ও মেধাবীদের রাজনীতিতে আগ্রহী করে তোলার প্রচেষ্টা নিয়েছিলেন। সব কিছু মিলিয়ে তিনি সেনাপতি থেকে রাষ্ট্রনায়ক হয়েছিলেন। তিনি বন্দুকের যোদ্ধা থেকে কোদালের কর্মী হয়ে দেশ গড়ার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করেছিলেন।

— মেজর জেনারেল অবঃ সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম (বীর প্রতীক) ৩০ মে ২০১৮, দৈনিক নয়া দিগন্ত

চার।

মওলানা ভাসানী বললেন, “আবদুল গফুর, আমি তোমার বাবার বয়সী। আমি আমার জীবনে তোমার চেয়ে বেশি সরকার ও বেশি নেতাদের দেখেছি। ব্রিটিশ আমলে দেখেছি, পাকিস্তান আমলে দেখেছি, বাংলাদেশ আমলেও দেখেছি। তুমি আমাকে একটা এক্সাম্পল দেখাও, কোন রাজনৈতিক নেতা কম-বেশি দুর্নীতি করে নাই বা দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয় নাই এবং কোন নেতা স্বজনপ্রীতি করে নাই।”
অধ্যাপক গফুর চুপ করে রইলেন।

মওলানা বললেন, “এখন পর্যন্ত জিয়াউর রহমানের ব্যক্তিগত দুর্নীতির কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় নাই। কোনোরকম স্বজনপ্রীতিও তার মধ্যে নাই। তাঁর আত্মীয়-স্বজনকে কেউ চেনে না। তাঁদেরকে সে কোনো সুযোগ-সুবিধা দেয় না। ইন্ডিয়ান সাব-কন্টিনেন্টে এ ধরণের শাসককে মানুষ পছন্দ করে। একজন সৎ শাসকের তো প্রশংসাই প্রাপ্য।”

— সৈয়দ আবুল মকসুদ, ভাসানী কাহিনী, আগামী প্রকাশনী, পৃ: ৪৭-৪৮

পাঁচ।

১৯৭৭ সালে কিং খালেদ বিন আব্দুল আজীজের আমন্ত্রণে সৌদি আরব যান জিয়াউর রহমান এবং উপহার হিসেবে সাথে নিয়ে যান দশ হাজার নিম গাছের চারা। বাদশাহকে উপহার দেয়ার সময় বলেন- “গরিব মানুষের দেশের গরিব রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে আপনার জন্য এই সামান্য উপহার।”

বাদশাহ্ বহু দেশ থেকে বহু মূল্যবান উপহার পেয়েছেন; কিন্তু এই অদ্ভুত উপহার আগে তিনি পাননি। এই গাছ উষর মরুতে ছায়া দেবে শুনে তিনি বলেন অবাক হয়ে যান এবং বলেন, আজ থেকে সৌদি আরব ও বাংলাদেশ পরস্পর অকৃতিম বন্ধু। তিনি বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য অর্থ সাহায্য দিতে চান। এ সময় জিয়াউর রহমান বলেন, আমাদের দেশের মানুষ গরিব, কিন্তু তারা পরিশ্রম করতে জানে। আপনার দেশের উন্নয়ন কাজের জন্য হাজার হাজার শ্রমিক দরকার। একটি নব্য স্বাধীন মুসলিম দেশের জন্য যদি আন্তরিকভাবে সাহায্য করতে চান, তবে আমার দেশের বেকার মানুষদের কাজ দিন। বাদশাহ তক্ষনাৎ রাজি হলেন। শুরু হল আরব বিশ্বে জনশক্তি রপ্তানি। তখন থেকে বাংলাদেশ থেকে লাখ লাখ মানুষ সৌদি আরব গিয়ে নিজেদের ভাগ্য বদল সহ স্বাবলম্বী হয়ে ফিরেছেন বাংলাদেশে

জিয়াউর রহমানের দেয়া সেই নিমের চারাগুলো আজ ছড়িয়ে পড়েছে সাড়া সৌদি জুড়ে। আরাফাতের ময়দানে সবুজ শীতল ছায়া দিয়ে চলেছে লক্ষ নিম গাছ। সউদি আরবের মানুষ প্রেসিডেন্ট জিয়াকে স্মরণ করে নিম গাছকে বলে “জিয়া সাজারাহ” বা জিয়া গাছ।

— দৈনিক সংগ্রাম, ১৬ আগস্ট ২০১৭

ছয়।

জিয়ার শাসনামলে বেতার ও টেলিভিশনে নামাজের সময় আজান প্রচার শুরু হয়। জিয়া ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ বলে বক্তৃতা আরম্ভ করতেন। বিভিন্ন ধর্মীয় দিবস উপলক্ষে, বিশেষ করে ঈদে মিলাদুন্নবী, শবে বরাত, শবে কদর এবং আশুরা পালন বেশ ঘটা করেই শুরু হয় এবং জিয়া এ উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে ‘বাণী’ দেওয়া চালু করেন। বিভিন্ন সেনানিবাসে কেরাত প্রতিযোগিতা চালু করা হয়।

পাকিস্তান আমলে দেশে একটি ইসলামিক একাডেমি’ ছিল। ১৯৭২ সালে এটা বন্ধ হয়ে যায়। রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ২৮ মার্চ ‘ইসলামিক ফাউন্ডেশন’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১১ জিয়াউর রহমান এই ফাউন্ডেশনকে আরও কার্যকর করেন। তিনি স্বতন্ত্র একটি ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয় তৈরি করেন। মাদ্রাসার সংখ্যা হঠাৎ করে বেড়ে যায়। ১৯৭৫ সালে দেশে ১,৮৩০টি মাদ্রাসায় ২,৯১,১৯১ জন ছাত্র পড়াশোনা করত। ১৯৭৮ সালে মাদ্রাসার সংখ্যা বেড়ে হয় ২,৩৮৬ এবং ছাত্রসংখ্যা হয় ৪,৪১, ২০০।

— মহিউদ্দিন আহমদ, বিএনপি: সময়-অসময়, পৃঃ ১৩৩

সাত।

…শুক্রবার ভোরে প্রেসিডেন্ট জিয়া নাস্তা খাচ্ছিলেন। আয়োজন সামান্য। চারটা লাল আটার রুটি। দুই পিস বেগুন ভাজি। একটা ডিম সিদ্ধ। জিয়ার সঙ্গে নাশতার টেবিলে বসেছেন তার বন্ধু ও সহযোদ্ধা জেনারেল মঞ্জুর। জেনারেল মঞ্জুর বিস্মিত হয়ে বললেন, এই আপনার নাশতা? প্রেসিডেন্ট বললেন, হতদরিদ্র একটি দেশের পরিপ্রেক্ষিতে এই নাশতা কি যথেষ্ট না ?

…জিয়াউর রহমানের পাঁচ বছরের শাসনে প্রতি মাঘের শেষে বর্ষন হয়েছিল কিনা তা কেউ হিসাব রাখেনি ,তবে এই পাঁচ বছরে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়নি । অতি বর্ষনের বন্যা না , খরা না , জলোচ্ছাস না । দেশে কাপড়ের অভাব কিছুটা দূর হলো । দ্রব্যমূল্য লাগামছাড়া হলো না। বাংলাদেশের নদীতে প্রচুর ইলিশ মাছ ধরা পড়তে লাগলো। বাংলাদেশের মানুষ মনে করতে লাগলো অনেক দিন পর তারা এমন এক রাষ্ট্রপ্রধান পেয়েছে যিনি সৎ। নিজের জন্য বা নিজের আত্নীয়স্বজনের জন্য টাকা পয়সা লুটপাটের চিন্তা তার মাথায় নেই। বরং তার মাথায় আছে দেশের জন্য চিন্তা । তিনি খাল কেটে দেশ বদলাতে চান। জিয়া মানুষটা সৎ ছিলেন , এতে কোনো সন্দেহ নেই। লোক দেখানো সৎ না , আসলেই সৎ। তার মৃত্যুর পর দেখা গেল জিয়া পরিবারের কোনো সঞ্চয় নেই।
— হুমায়ূন আহমেদ, দেয়াল, পৃঃ ১৮৯, ১৯৩

আজ বাংলাদেশের জনপ্রিয়তম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের জন্মদিন।।

………
২০১৯

……..
লেখক : গবেষক, ব্রেমেন ইউনিভার্সিটি, জার্মানি।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

আমিনুল ইসলাম on কবিতাগুচ্ছ
শিকদার মুহাম্মদ কিব্রিয়াহ on কবিতাগুচ্ছ
নয়ন আহমেদ on কবিতাগুচ্ছ
নয়ন আহমেদ on মা দিবসের কবিতা
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম on শিপা, আমি তোমার বয়ফ্রেন্ড হতে পারিনি