ফয়জুল লতিফ চৌধুরী
আমাদের তরুণ বন্ধু কবি মাসুদ খানকে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার মঞ্জুর করা অতিশয় ন্যায্য হইয়াছে। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে (১৯৮২) তিনি আমাদের সতীর্থ। তাহার জন্ম ২৯ মে ১৯৫৯, জয়পুরহাট জেলার ক্ষেতলালে। তিনি প্রকৌশলবিদ্যায় স্নাতক, ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর। তড়িৎ ও ইলেকট্রন প্রকৌশলী। বসবাস করেন ক্যানাডার টরন্টোতে। শিক্ষকতা করেন টরন্টোর সেন্টেনিয়াল কলেজে।
আগেও তিনি পুরস্কার লাভ করিয়াছেন। যথা: বগুড়া লেখকচক্র পুরস্কার, ১৯৯৪, জীবনানন্দ সাহিত্য পুরস্কার, ২০১৬, বাংলা একাডেমি সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ পুরস্কার, ২০১৭, প্রথম আলো বর্ষসেরা বই পুরস্কার ১৪২৪, ২০১৯। শিরে আরো একখানা পালক যুক্ত হইল।
তাহার প্রকাশিত কাব্যসমূহের তালিকা দিতেছি: পাখিতীর্থদিনে (১৯৯৩, পুনঃপ্রকাশ ২০১৯)—কবিতা, নদীকূলে করি বাস (২০০১), সরাইখানা ও হারানো মানুষ (২০০৬), আঁধারতমা আলোকরূপে তোমায় আমি জানি (২০১১), এই ধীর কমলাপ্রবণ সন্ধ্যায় (২০১৪), প্রসন্ন দ্বীপদেশ (২০১৮), শ্রেষ্ঠ কবিতা (২০১৮), ঊর্মিকুমার ঘাটে (২০২০) এবং দুঃস্বপ্নের মধ্যপর্ব (২০২২)।
তাহার আরও চারিখানা গ্রন্থ রহিয়াছে: গদ্যগুচ্ছ (২০১৮: প্রবন্ধ-নিবন্ধ), পাখপাখালির গান পাগলাঝোরার তান (২০১৯: ছড়াকবিতা), প্রজাপতি ও জংলি ফুলের উপাখ্যান (২০১৬: উপন্যাস) এবং দেহ-অতিরিক্ত জ্বর (২০১৫:গদ্যালেখ্য)।
তাহার কবিতা কী রকম সেই প্রসঙ্গে আরেকদিন বাতচিৎ করিব। আমি তাহার ‘কুড়িগ্রাম’ কবিতাটির ভক্ত। ১৯৯৪ সালে ইহা ইংরাজিতে অনুবাদ করিয়াছিলাম।
………….
কুড়িগ্রাম
……………
কোনোদিন আমি যাইনি কুড়িগ্রাম।
রাত গভীর হলে আমাদের এই প্রচলিত ভূপৃষ্ঠ থেকে
ঘুমন্ত কুড়িগ্রাম ধীরে ধীরে আলগা হয়ে যায়।
অগ্রাহ্য করে সকল মাধ্যকর্ষণ।
তারপর তার ছোট রাজ্যপাট নিয়ে উড়ে উড়ে
চলে যায় দূর শূন্যলোকে।
আমরা তখন দেখি বসে বসে আকাশ কত-না নীল
ছোট গ্রাম আরো ছোট হয়ে যায় আকাশের মুখে তিল।
অনেকক্ষণ একা-একা ভাসে নিখিল নভোভারতের রাজ্যে রাজ্যে।
দক্ষিণ আকাশে ওই যে একনিষ্ঠ তারাটি,
একসময় কুড়িগ্রাম তার পাশে গিয়ে চিহ্নিত করে তার অবস্থান।
তখন নতুন এই জ্যোতিষ্কের দেহ থেকে মৃদু-মৃদু লালবাষ্প-ঘ্রাণ ভেসে আসে।
সেই দেশে, কুড়িগ্রামে, ওরা মাছরাঙা আর পানকৌড়ি দুই বৈমাত্রেয় ভাই
কুড়িগ্রামের সব নদী শান্ত হয়ে এলে
দুই ভাই নদীবুকে বাসা বাঁধে
স্ত্রীপুত্রকন্যাসহ তারা কলহ করে।
নদী শান্ত হয়ে এলে
শাস্ত্রবাক্যে বাঁধা যত গৃহনারী
প্রাচীর ডিঙিয়ে এসে নদীকূলে করে ভিড়
প্রকাণ্ড স্ফটিকের মতো তারা সপ্রতিভ হয়।
হঠাৎ বয়নসূত্র ভুলে যাওয়া এক নিঃসঙ্গ বাবুই
ঝড়াহত এক প্রাচীন মাস্তুলে ব’সে
দুলতে দুলতে আসে ওই স্বচ্ছ ইস্পাত-পাতের নদীজলে।
কুড়িগ্রাম, আহা কুড়িগ্রাম!
পৃথিবীর যে জায়গাটিতে কুড়িগ্রাম থাকে
এখন সেখানে নিঃস্ব কালো গহ্বর।
কোনোদিন আমি যাইনি কুড়িগ্রাম।
আহা, এ-মরজীবন!
কোনোদিন যাওয়া হবে কি কুড়িগ্রাম?