কাজী জহিরুল ইসলাম
বাংলা কবিতায় পঞ্চাশের দশক বেশ উজ্জ্বল। আলাউদ্দীন আল আজাদ, হাসান হাফিজুর রহমান, বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীররা ঢাকায় এই দশকের প্রধান কবি হয়ে উঠেছিলেন। তখন শামসুর রাহমানও তার শক্তিমত্তার পরিচয় দিয়েছিলেন কিন্তু তাকে কোনঠাসা করে রাখার একটি প্রবণতা ছিল। সেই সময়টাতে আল মাহমুদ, ফজল শাহাবুদ্দীন এবং শহীদ কাদরী এই তিনজন মিলে শামসুর রাহমানকে পঞ্চাশের প্রধান কবি করে তোলার জন্য উঠে-পড়ে লাগেন এবং তারা সফলও হন। এলিটদের পেছনে ফেলে শামসুর রাহমান হয়ে ওঠেন পঞ্চাশের প্রধান কবি।
কিন্তু সৈয়দ আলী আহসানের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৬৮ সালে, শামসুর রাহমানের আগেই, আল মাহমুদ বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়ে গেলে শামসুর রাহমান মনক্ষুণ্ন হন। পরের বছরই, ১৯৬৯ সালে, শামসুর রাহমান বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান। সৈয়দ শামসুল হক এবং ওমর আলীও এই দশকের গুরুত্বপূর্ণ কবি।
শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী এবং ফজল শাহাবুদ্দীন এই চারজনকে আদ্যোপান্ত পাঠ করেছি। বেশ গভীরভাবে পড়েছি সৈয়দ শামসুল হককেও। বাকীদের পূর্ণাঙ্গ পাঠ করিনি, বিচ্ছিন্নভাবে পড়েছি তাদের কবিতার ধরণ, ভাষা ও শক্তি বোঝার জন্য।
পশ্চিমবঙ্গের কবিদের মধ্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং শক্তি চট্টোপাধ্যায় পঞ্চাশের গুরুত্বপূর্ণ কবি। তাদের পপুলার কবিতাগুলো পড়েছি, ততোটা নিবিড়ভাবে পড়া হয়ে ওঠেনি। সাহিত্যের ছোটো কাগজ অহনার জন্য গদ্য লিখতে হবে, সম্পাদক জানিয়েছেন, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ এবং শক্তি চট্টোপাধ্যায় এই তিন কবির একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ যেন করি। গত কয়েকদিন ধরে শক্তিকে নিবিড়ভাবে পাঠ করছি। শক্তির লেখায় একটা পাগলামী আছে, যা ইচ্ছে তাই লেখার স্বাধীনতা আছে। তার বেশ কিছু কবিতা, চতুর্দশপদী এবং দীর্ঘকবিতা পড়ে আমি কিছুটা হতাশও হয়েছি। এতোটা ইন্ডিসিপ্লিন, হয়ত এটাই শিল্প, আমার ভালো লাগেনি।
বিভিন্ন সময়ে লেখা চতুর্দশপদীগুলো (সব নয় ১০১টি) এক সঙ্গে করে তিনি “চতুর্দশপদী কবিতাবলী” নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। প্রথম সনেটটি মাইকেল মধুসূদন দত্তকে উৎসর্গ করেছেন, সেটিকে তিনি উৎসর্গপত্র হিসেবেই দেখিয়েছেন, বাকি ১০০টি সনেট শিরোনামহী, সংখ্যানুক্রমিক। কবিতাগুলো ১৩/১৪ বছর ধরে লেখা হলেও বিষয়বস্তুর একটি মিল আছে। বইটি কোনো প্রকাশক বের করতে রাজী হননি, ১৯৭০ সালে তিনি নিজেই ‘কবয়ঃ’ নামে এক প্রকাশনা সংস্থার নাম দিয়ে প্রকাশ করেন। তিনি বলেছেন এটি কবিদের প্রকাশনা সংস্থা। এই বইটি সম্পর্কে শক্তি নিজেই লেখেন, ‘প্রকৃতপক্ষে পদ্যলেখা যখন এবং যেদিন শুরু করি, বিধিবদ্ধ চতুর্দশী দিয়েই করেছিলুম। যতদূর মনে পড়ছে, কাণ্ডজ্ঞানহীন তথাকথিত সেই কবিতা “যম” বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত কবিতা-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল ৫৬-৫৭ সাল নাগাদ। সেকাল থেকে গতকাল পর্যন্ত যতো চতুর্দশপদী লিখেছ, প্রায় সবকটিকেই একত্র বসাবার পরিকল্পনা ছিল। শুধুই চতুর্দশপদী? পাঁচমিশেলি কাব্যসংগ্রহ নয় বলেই ব্যবসায়িক প্রকাশক এটি ছাপতে দ্বিধা দেখিয়েছেন এবং তারই ফলস্বরূপ কবিদের প্রতিষ্ঠান এই কবয়ঃ।’
পৃথিবীতে দুই ধরণের সনেট লেখা হয়। পেট্রার্কান বা ইতালিয় সনেট এবং শেক্সপিয়েরিয়ান বা ইংলিশ সনেট। শুধুমাত্র রাইমিং স্কিম বা অন্ত্যানুপ্রাস ছাড়া অন্য কোনো ক্ষেত্রে এই দুই সনেটের অমিল নেই। ১৪ লাইনের কবিতা, প্রতি লাইনে ১০টি করে সিলেবল, যেটি আমাদের স্বরবৃত্ত ছন্দের দশ মাত্রা। অন্তমিলের ক্ষেত্রে, ইতালিয় সনেটে, প্রথম লাইনের সাথে চতুর্থ লাইন এবং দ্বিতীয় লাইনের সাথে তৃতীয় লাইনের মিল দেয়া হয়। এভাবে প্রথম ৮ লাইন লেখা হয়। শেষের ৬ লাইনের ক্ষেত্রে মিল দেয়া হয় প্রথম লাইনের সাথে চতুর্থ লাইন, দ্বিতীয় লাইনের সাথে পঞ্চম লাইন, তৃতীয় লাইনের সাথে ষষ্ঠ লাইন। তাহলে রাইমিং স্কিমের সূত্রটা দাঁড়ালো: ABBA, CDDC, EFGEFG.
ইংলিশ সনেটে প্রথম লাইনের সাথে তৃতীয় লাইন এবং দ্বিতীয় লাইনের সাথে চতুর্থ লাইনের মিল থাকে। এভাবে ১২ লাইন লেখা হয়। শেষ দুই লাইনের মধ্যে মিল থাকে। অর্থাৎ ABAB, CDCD, EFEF, GG.
বাংলা ভাষায় সনেট আমদানি করেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তিনি ১০ সিলেবলের বদলে মধ্যযুগের কবিদের ১৪ মাত্রার (৮/৬) পয়ারকে গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে অক্ষবৃত্ত ছন্দে ১৮ মাত্রার পয়ার সনেটের ক্ষেত্রে কবিদের কাছে অধিক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
শক্তি তার চতুর্দশপদী কবিতাবলী গ্রন্থের সনেটগুলো, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, ১৮ মাত্রার পয়ারেই লিখেছেন। কিছু কিছু সনেটে তিনি ২২ মাত্রার পয়ার ব্যবহার করেছেন, কেউ কেউ ১৪ মাত্রার চেয়ে বড়ো পয়ারকে মহাপয়ারও বলেন। বলেছিলাম পাগলামীর কথা, হ্যাঁ, এই কবিতাগুলোতেও তা পরিলক্ষিত হয়। চতুর্থ সনেটে তিনি ৩টি লাইন ২২ মাত্রায় লিখেছেন, বাকি ১১ লাইন লিখেছেন ১৮ মাত্রায়। অন্তমিলের ক্ষেত্রে পেট্রার্কান বা শেক্সপিয়েরিয়ান কোনো নীতিই মেনে লেখেননি। সনেট হচ্ছে একটি প্রকরণসিদ্ধ কবিতার ফর্ম। এই ফর্মে লিখতে গেলে প্রকরণ মেনেই লিখতে হবে। তিনি অনেক ক্ষেত্রেই তা করেননি বা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। সনেট, হাইকু, লিমেরিক, রুবাইয়াত এগুলো সুনির্দিষ্ট ফর্মের মধ্য দিয়েই সৃষ্টি। ফর্ম ভাঙা যাবে না তা বলছি না, সেক্ষেত্রে সনেট বা হাইকু না বলে অন্য কিছু বলাই ভালো। জীবনানন্দ দাশ কিছু ১৪ লাইনের কবিতায় ভার্স বা পঙক্তি বড়ো-ছোটো করেছেন, সেগুলো সনেট নয়। তবে কেউ কেউ এই যুক্তি দিতে পারেন যেহেতু ১৪ লাইনের কবিতা কাজেই চতুর্দশপদী বলা ভুল হবে না নিশ্চয়ই। কিন্তু যখন সনেটেরই বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে চতুর্দশপদী শব্দটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে তখন কবিতার ক্ষেত্রে এই শব্দটি তার শাব্দিক অর্থ হারিয়েছে, এটিকে আর তার শাব্দিক অর্থে ব্যবহার করা যাবে না, এতে বিভ্রান্তিই তৈরি হবে।
শক্তির মূল শক্তি হচ্ছে ছন্দে। তিনি ছন্দটা ভালো জানতেন, এ-কথা বলার ঔদ্ধত্য দেখাবো না, বরং বলবো তিনি ছন্দটা ভালো মানতেন। তবে এই মানার মধ্যে যথেষ্ঠ পাগলামী তিনি করেছেন। ব্যক্তিজীবনের পাগলামীর রেশ তার কবিতায় বেশ স্পষ্ট। বুদ্ধদেব বসু বোদলেয়ার অনুবাদ করার পর, শক্তির মধ্যে বোদলেয়ার হবার ইচ্ছে তৈরি হয়, এই ইচ্ছেই তাকে এলোমেলো করে দেয়।
সফল দীর্ঘ কবিতা লেখার জন্য সহজাত কাব্যিক শক্তি থাকতে হয়। দীর্ঘ-কবিতার মধ্যেই একজন কবির শক্তিমত্তার পরিচয় পাওয়া যায়। ‘অনন্ত নক্ষত্রবীথি তুমি, অন্ধকারে’ শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের একটি দীর্ঘ কবিতা, ৬৩২ লাইনের এই কবিতায় তিনি খুব সফলভাবে পারম্পর্য ভেঙে দিয়েই বৃহত্তর ক্যানভাসে নতুন এক পারম্পর্য নির্মাণ করেছেন যা আধুনিক কবিতার একটি বড়ো দাবী। এই কবিতাটি তিনি প্রবহমান অক্ষরবৃত্ত ছন্দে লিখেছেন। আমি যখন শব্দ করে পুরো কবিতাটি কিচেনের আইল্যান্ডে বসে পড়ছিলাম, আমার স্ত্রী মুক্তি জহির তখন ৫০ ফুট দূরে, ওপেন প্ল্যানের লিভিংরুমে, কফি কালারের লেদার সোফায় বসে, গভীর অভিনিবেশের সঙ্গে শুনছিলেন। পড়া শেষ হলে তিনি কাছে আসেন, আমার হাতে আরো এক কাপ ধুমায়িত চা তুলে দিয়ে গ্রন্থের মলাটে চোখ রাখেন। তারপর একটি হাসি দিয়ে বলেন, এতক্ষণ শক্তিকে পড়ছিলে? আমি এই প্রশ্নের কারণ জানি। রহস্যময় একটি পাল্টা হাসি তাকে ফিরিয়ে দিয়ে চোখের দিকে তাকাই। তিনি জানেন আমার দৃষ্টির ভাষা। ঝটপট বলে ফেলেন, আমি তো ভেবেছিলাম জীবনানন্দ দাশ পড়ছিলে। এবার আমার হাসিটা আরো বিস্তৃত হয়।
অক্ষরবৃত্ত ছন্দে দীর্ঘ কবিতা লিখতে গেলে এবং প্রমিত উচ্চারণের মধ্যে গ্রাম বাংলাকে ধারণ করতে গেলে জীবনানন্দ দাশকে এড়ানো প্রায় অসম্ভব। তারপর যদি তারই ব্র্যান্ডেড শব্দ এবং বলার ভঙ্গি ধ্বনিত হয় তাহলে তো মুক্তির মতো সচেতন কাব্য-শ্রোতার সন্দেহ জাগবেই। এই কবিতা থেকে কিছু পঙক্তি তুলে ধরি:
“সোঁদা গন্ধ ওঠে মুচকুন্দ ফুলের/ পাপড়ি ঝরে পড়ে থাকে”,
” পোকার মতো কেউ ভূমণ্ডল মুখে করে চলে যায় বোধি-নিরুদ্দেশে”
“তারার চিতার মতো সে-সবই অসংখ্য আছে পড়ে”
“জীবনের ভাড়াবাড়ি অদ্ভূত আঁধার ছিলো ঠাসা”
“হয়ত মানুষ নয় ওরা কেউ – আকাঙ্খার হাঁস, সরোবরে”
“একের সংস্পর্শ আর চায় নাকো – সবাই পৃথক/ মেয়েমানুষেরা বলে – তারাও পৃথক হতে পারে – পৃথিবীতে তাও হয়/ নাকি তাইই ভবিষ্যতে হবে।”
“কমলালেবুর কাছে বসে আছি – নাকি লেবু বসে আছে পাশে/ জানি না জেনেছে কেউ পৃথিবীতে মানুষের ঘাসে/ নক্ষত্রের প্রয়োজন আছে কিনা?”
“এখানে ফুটেছে কত ক্যামেলিয়া — নানান রঙের মেয়েদের মতো/ উইলোর ডানা থেকে ঝরে পড়ে সন্ধ্যার ভূতের দারুণ রূপালী চুল”
এমনি অসংখ্য পঙক্তি এই কবিতাটিকে আমাদের নিয়ে যায় জীবনানন্দ দাশের কাছে। এটিকে কাব্যবোদ্ধারা একজন কবির দুর্বল দিক হিসেবেই চিহ্নিত করেন কিন্তু আমি, যদিও নিজস্ব কাব্যভাষার দাবীকে শ্রদ্ধা করি, তা সত্বেও এই দুর্বলতাকে ততোটা তীব্র বলি না, যদি কবিতাটি আমাদের আনন্দ দেয়, নতুন কোনো সৌন্দর্যের কাছে নিয়ে যায়।
বেশ কিছু ভালো চিত্রকল্প আমাদের সেই সৌন্দর্যের ইঙ্গিত দেয়। যেমন ‘রহস্যের পণ্যভরা নদী’, ‘বাদুড়ের চাঞ্চল্যে পেয়েছি টের’, ‘কোদালে মেঘের মতো ভেসে চলি’, ‘পাহাড়ের চিন্তা দিয়ে ঢাকা’, ‘নিঃসঙ্গ জঙ্গল এলো কাছে’, ‘সারবন্দী নীল গাই ভেসে চলে মর্যাদা বাড়াতে’, ‘বাঘেদের পাওয়া যেত হরিণের রাশির ভিতরে’, ‘সুপারি-গরাদে ঘেরা এ-অঞ্চলে উড়েছে মোরগ’, ‘চিন্তার ভিতরে কালো কাক করে কাহিনি বিস্তার’ এরকম অসংখ্য ভালো চিত্রকল্প ও শুদ্ধ ছন্দের কারণে, জীবনানন্দ দাশের প্রচণ্ড প্রভাব থাকা সত্বেও “অনন্ত নক্ষত্রবীথি তুমি, অন্ধকারে” একটি উত্তীর্ণ কবিতা হয়ে উঠেছে। এর মর্মমূলে যে আকাশের পৃথিবীতে উঠে যাবার আধ্যাত্মিক চেতনা তা কবিতাটিকে একটি শক্ত মেরুদণ্ডের ওপর দাঁড় করিয়ে রেখেছে।
শক্তির সবচেয়ে জনপ্রিয় কবিতা “অবনী বাড়ি আছো?” সংকলিত হয়েছে “ধর্মে আছো জিরাফেও আছো“ গ্রন্থে। পাঁচ মাত্রার মাত্রাবৃত্ত ছন্দে লেখা একটি অনবদ্য কবিতা এটি। “বৃষ্টি পড়ে এখানে বারোমাস/ এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে/ পরাঙ্মুখ সবুজ নালীঘাস/ দুয়ার চেপে ধরে-/ অবনী বাড়ি আছো?” ঘাস কখন দুয়ার চেপে ধরে? যখন এ-দুয়ার বন্ধ বহুদিন। একটা দারুণ হাহাকার বেজে ওঠে এই পঙক্তিগুচ্ছের উচ্চারণে। “ধর্মে আছো জিরাফেও আছো” এই শিরোনামের কোনো কবিতা বইটিতে না থাকলেও এই নামটি নিয়ে মানুষের কৌতুহল তৈরি হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে এই প্রবাদটি হয়ত চেনাই, কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ এর সঙ্গে তেমন পরিচিত নয়। এই সুযোগে প্রবাদটির পটভূমি ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। জয়পুরের রাজা আফ্রিকা থেকে একটি জিরাফ নিয়ে আসেন। অদ্ভুত দর্শন এই প্রাণী দেখে এলাকাবাসী অবাক। এর আগে কখনো এমন অদ্ভুত প্রাণী তারা দেখেনি। কোনো ধর্মগ্রন্থেই এমন প্রাণীর কথা তারা শোনেনি। কাজেই এটি আল্লাহ বা ভগবানের সৃষ্ট নয়। এটি হলো শয়তানের সৃষ্টি। কাজেই এই প্রাণী দেখাও পাপ। রাজা এটিকে চিড়িয়াখানায় রাখলেন। প্রথমে সবাই ধর্মের কারণে পিছপা হলেও পরে কৌতুহল দমন করতে না পেরে অনেকেই, এমনকী পুরোহিতেরাও, লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতে আসত। তখন লোকে এদেরকে বলতে শুরু করে, এরা ধর্মেও আছে, জিরাফেও আছে।
অক্ষরবৃত্ত ছন্দ বা পয়ারে জীবনানন্দ দাশের পরে সবচেয়ে বেশি দক্ষতা দেখিয়েছেন শামসুর রাহমান। স্বরবৃত্ত এবং মাত্রাবৃত্তে শামসুর রাহমানের কাজ খুব সামান্যই। তিনি সবচেয়ে স্বচ্ছন্দ ছিলেন অক্ষরবৃত্তে। এবং তিনি শুরুতেই বুঝতে পেরেছিলেন এই ছন্দে গ্রাম বাংলাকে তুলে আনতে গেলে জীবনানন্দকে এড়ানো যাবে না, তাই নগর জীবন এবং সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলন তার কবিতার মূল উপজীব্য হয়ে ওঠে।
জীবনানন্দ দাশ এবং শামসুর রাহমান দুজনই অক্ষরবৃত্তের ক্যানভাসে এবং কাগজে অনবদ্য সব ছবি এঁকেছেন। পার্থক্য হলো দুজন দুটো রঙের মিডিয়াম ব্যবহার করেছেন। জীবনানন্দ যদি তেল রঙে আঁকেন তো শামসুর রাহমান এঁকেছেন জলরঙে। এই পার্থক্যটি অনেক ক্ষেত্রেই তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়।
১৯৬০ সালে শামসুর রাহমানের প্রথম কবিতার বই ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে‘ বের হয়। শিরোনাম-কবিতাটিই গ্রন্থের আদিতে সংকলিত হয়েছে। সেখানে কিন্তু ক্ষণে ক্ষণেই, বেশ গোপনে যদিও, জীবনানন্দ উঁকি দিয়েছে। ‘মাটি যার/ সুপুষ্টু স্তনের মত ফাল্গুনের ফুল’, দেখুন, গ্রন্থের দ্বিতীয় লাইনেই জীবনানন্দের কাব্যভাষা বা অন্তর্গত সঙ্গীত ধ্বনিত হয়েছে। দ্বিতীয় প্যারাতে তিনি লেখেন, ‘দেখেছি সমুদ্রতীরে অস্তরাগে একদা হাওয়ায়/ নর্তকী-শিখার মতো সফেদ তরুণ ঘোড়া এক/ মেতেছে খেলায়’। কবিতায় একটা সঙ্গীত আছে। রবার্ট ফ্রস্ট যখন বলেন, অনুবাদের মধ্য দিয়ে যা হারিয়ে যায়, তা-ই কবিতা, তখন আমরা সুস্পষ্টতই বুঝতে পারি, যা হারিয়ে যায় তা হচ্ছে কবিতার অন্তর্গত সঙ্গীত এবং হয়ত ফ্রস্ট ঠিকই বলেছেন, সেটিই কবিতা। এই সঙ্গীতই ঠিক করে দেয় একজন কবির স্বাতন্ত্র্য।
এই গ্রন্থের ‘পূর্বরাগ’ কবিতায় তিনি মাত্রাবৃত্তের আশ্রয় নিয়েছেন। লিখেছেন সাত মাত্রার কিছু পর্ব। কোনো অতিপর্ব বা অপূর্ণ পর্ব না রেখে সাত মাত্রার পূর্ণ পর্বে তৈরি করেছেন প্রবহমানতা, যা তার কবিতাকে একটি নতুন অভীষ্টের দিকে ঠেলে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু সেই দিকে তিনি ধাবিত হননি, তিনি নিজের অভিষ্ট নির্ধারণ করেছেন অক্ষরবৃত্তে। অক্ষরবৃত্তে অজস্র ফ্রি ভার্স লিখে তিনি বাংলা কবিতায় একটি প্রশস্ত এবং দীর্ঘ সড়ক নির্মাণ করেছেন। ফলে উত্তর প্রজন্মের কবিরা নির্বিঘ্নে সেই সড়ক ধরে হেঁটে যেতে পেরেছেন বহুদূর অবধি।
পূর্বরাগ কবিতাটি থেকে কিছু পর্ব, বিন্যাসসহ, তুলে ধরি: জেনেছি কাকে চাই,/ কে এলে চোখে ফোটে/ নিমেষে শরতের/ খুশির জ্যোতিকণা/ কাঁপি না ভয়ে আর/ দ্বিধার নেই দোলা-/ এবার তবে রাতে/ হাজার দ্বীপ জ্বেলে/ সাজাব তার পথ,/ যদি সে হেঁটে আসে।
শামসুর রাহমান বেশ সাবলীলভাবে নগর জীবনকে অক্ষরবৃত্তে বেঁধেছেন। নগর জীবনের ছবি আঁকতে আঁকতে এই জনপদের মানুষের প্রতিটি আন্দোলন–সংগ্রামের চিত্রও তিনি তার তুলির আঁচড়ে তুলে আনেন বেশ দক্ষতার সঙ্গে। স্বাধীনতা তুমি, তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা, ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯, সফেদ পাঞ্জাবি, কী ক’রে লুকাবে?, স্যামসন, গুড মর্নিং বাংলাদেশ, ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাটা, বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়, একজন শহীদের মা বলছেন, আলো ঝরানো ডানা, আসাদের শার্ট প্রভৃতি কবিতায় তিনি সমসাময়িক আন্দোলনকে তুলে এনেছেন। এইসব কবিতা রচনার মধ্য দিয়ে শামসুর রাহমান হয়ে ওঠেন এই জনপদের প্রাণের কবি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, নব্বুইয়ের গণ-আন্দোলন, প্রতিটি ইভেন্টের ওপর শামসুর রাহমানের অজস্র কবিতা আছে। শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের ওপরও কবিতা লিখেছেন শামসুর রাহমান। তিনি চাইলেই যে কোনো বিষয় নিয়ে অক্ষরবৃত্ত ছন্দে পঙক্তির পর পঙক্তি রচনা করতে পারতেন। যে কথাটি আমরা প্রায়শই বলি, কোনো এক স্বর্গীয় অনুভূতির ছোয়া না পেলে কবিতা হয় না, মানে কবিতাকে নাজেল হতে হয়, শামসুর রাহমান সকল সামাজিক বিষয়ের ওপর কবিতা লিখে মোটামুটি তা নাকচ করে দিয়েছেন। তবুও তার কণ্ঠে আমরা শুনেছি, ‘তিনদিন কবিতা লিখতে না পারলে আমি পাগল হয়ে যাই’। তার মানে কবিতা লিখতে না পারার একটা ব্যাপার আছে তাহলে।
দেশ স্বাধীন হবার পর তিনি খুব মিস করছেন শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীকে, এইরকম একটি থিমের ওপর লেখেন “রক্তাক্ত প্রান্তর” কবিতাটি। এই কবিতায় তিনি লেখেন, ” গমগমে/ রাস্তাগুলো সারাক্ষণ উজ্জ্বল বুদ্বুদময়। শুধু আপনাকে,/ হ্যাঁ, আপনাকে মুনীর ভাই,/ ডাইনে অথবা বাঁয়ে, কোথাও পাচ্ছি না খুঁজে আজ।/ আপনার গলার চিহ্নিত স্বর কেন/ এ শহরে প্রকাশ্য উৎসবে/ শুনতে পাব না আর?” শুদ্ধ অক্ষরবৃত্তের চাল কিন্তু অক্ষরবৃত্তে সর্বগ্রাসী জীবনানন্দ দাশ পুরোপুরি অনুপস্থিত এখানে। তিনি ক্রমশ নিজের একটি শক্তিশালী কাব্যভাষা নির্মাণ করতে পেরেছেন। তার নিজস্ব কিছু শব্দও তৈরি হয়েছে, যেমন চাদ্দিক, সফেদ, চৌদিক, চুম্বন, গেরস্থালী, দুদ্দাড় ইত্যাদি। শামসুর রাহমান প্রচুর কবিতা লিখেছেন, যেহেতু তার কবিতাগুলো প্রকরণসিদ্ধ, অধিকাংশই শুদ্ধ অক্ষরবৃত্তে রচিত, এগুলোকে কবিতা হয়নি বলার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু কতটা ভালো কবিতা হয়েছে তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা করা যায়। হাজার হাজার কবিতার মধ্য থেকে চমকে দেবার মতো, পাঠকের মনে স্থায়ী একটি দাগ কাটার মতো লাইন কটি আছে? এটি একটি বিরাট প্রশ্ন। এই জায়গাটিতে শামসুর রাহমান বেশ বড়ো একটি শূন্যতা ছাড়া আর তেমন কিছুই নির্মাণ করতে পারেননি।
সেই দিক থেকে পঞ্চাশের আরেক আধুনিক কবি আল মাহমুদ অনেক বেশি সফল। সোনালী কাবিন গ্রন্থে রচিত সনেটেই তিনি জানান দিয়েছেন তার শক্তিমত্তা। সনেট খুব কঠিন কবিতা, বোদ্ধা পাঠক মজা নিয়ে পড়েন বটে কিন্তু কবিতাকে জনপ্রিয় করার জন্য সনেট উপযুক্ত ফর্ম নয়। সনেট ফর্মের কবিতা খুব একটা মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হয় না। শক্তি কিংবা শামসুর রাহমানও প্রচুর সনেট লিখেছেন কিন্তু তাদের একটি সনেটের কথাও পাঠকের মুখে শোনা যায় না। আল মাহমুদের সোনালি কাবিন এবং সৈয়স শামসুল হকের পরাণের গহীন ভিতর মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হয়েছে, এখনও হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। লোক লোকান্তর, কালের কলস, সোনালী কাবিন এই তিনটি গ্রন্থেই আল মাহমুদ বাংলা ভাষার একজন প্রধান কবি হয়ে উঠেছেন। যে চমকটি তাকে আর সকলের চেয়ে আলাদা করে তুলেছে তা হচ্ছে আধুনিক কবিতায় লোকজ শব্দের যথাযথ প্রয়োগ। বাংলাদেশ মূলত গ্রাম-প্রধান দেশ। যারা শহুরে, তারাও অনেকেই গ্রাম থেকে এসেছেন। গ্রামের একটি শব্দ কবিতায় খুঁজে পেলে তারা যেন নিজেকেই খুঁজে পান, এই গোপন আল মাহমুদের কাছে ধরা দিয়েছিল শুরুতেই। যখন তিনি কবিতায় উচ্চারণ করেন, “গাঙের ঢেউয়ের মতো বলো কন্যা কবুল, কবুল” তখন পাঠক শিহরিত হন লোকজ শব্দের শক্তিতে। দেহজ প্রেম তার কবিতায় ক্ষণে ক্ষণেই এসেছে, এ-প্রসঙ্গে তিনি আমার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, মধ্যযুগের কবিতা কাম আর প্রেমে ভরা, আমি তো তাদেরই উত্তরসূরী, আমার কবিতায় কাম-প্রেম তো আসবেই। আল মাহমুদের আরো একটি বড়ো গুণ হচ্ছে তিনি অসংখ্য অন্তান্যুপ্রাস-সমৃদ্ধ কবিতার একজন সফল স্রষ্টা। তার শিশুতোষ কবিতাগুলোও অতি উঁচু মাপের। তিনি নোলক কবিতায় লিখেছেন, “আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেল শেষে/ হেথায় খুঁজি হোথায় খুঁজি সারা বাংলাদেশে” এবং শেষে গিয়ে যখন বলেন, “এলিয়ে খোঁপা রাত্রি এলেন, ফের বাড়ালাম পা/ আমার মায়ের গয়না ছাড়া ঘরকে যাবো না”। তখন এটি আর কিশোর কবিতা থাকে না। এর ভেতরে লুকিয়ে আছে প্রতিটি নাগরিকের বুকের ভেতরে জ্বলতে থাকা দেশপ্রেম। একুশের ওপর, ঊনসত্তরের গণঅভুত্থানের ওপর অসাধারণ কিছু ছড়া লিখে তিনি বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ের কবি হয়ে উঠেছেন। তিনি যখন বলেন, “ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ/ দুপুর বেলার অক্ত/ বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায়?/ বরকতের রক্ত…প্রভাতফেরী, প্রভাতফেরী/ আমায় নেবে সঙ্গে,/ বাংলা আমার বচন, আমি/ জন্মেছি এই বঙ্গে”। তখন তাকে আমরা অনায়াসেই দাঁড় করিয়ে দিতে পারি রবীন্দ্র, নজরুলের যোগ্য উত্তরসূরীর কাতারে। ঊনসত্তরের গণআন্দোলন চাঙা করেছে যেসব অসাধারণ ছড়া কবিতা তার মধ্যে আল মাহমুদের ঊনসত্তরের ছড়াগুচ্ছ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। একটি ছড়া এখানে তুলে দিচ্ছি:
ট্রাক ! ট্রাক ! ট্রাক !
শুয়োরমুখো ট্রাক আসবে
দুয়োর বেঁধে রাখ।
কেন বাঁধবো দোর জানালা
তুলবো কেন খিল ?
আসাদ গেছে মিছিল নিয়ে
ফিরবে সে মিছিল।
ট্রাক ! ট্রাক ! ট্রাক !
ট্রাকের মুখে আগুন দিতে
মতিয়ুরকে ডাক।
কোথায় পাবো মতিয়ুরকে
ঘুমিয়ে আছে সে !
তোরাই তবে সোনামানিক
আগুন জ্বেলে দে।
[ঊনসত্তরের ছড়া – ১]
আল মাহমুদের ব্যক্তি-জীবন নিয়ে অনেক কথা আছে। আজ কবিতার আলোচনায় সেইসব নিয়ে আলোচনা না করাই ভালো হবে। বড়ো সংসার, দারিদ্র ইত্যাদির কারণে তার ব্যক্তিজীবনের পদস্খলন দিয়ে কবিজীবনকে কালিমালিপ্ত করা যাবে না। যেমন যায়নি এজরা পাউন্ডের কবিজীবনকে। আমেরিকার মানুষ এজরা পাউন্ডকে শাস্তি দিয়েছিল কিন্তু তার কবিতাকে কখনো শাস্তি দেয়নি। এজরা পাউন্ড আজও আমেরিকার প্রধান আধুনিক কবি।
হলিসউড, নিউইয়র্ক।
সাহিত্যের রাজনীতির এসব ঘটনা জানলাম।যদিও আলাউদ্দিন আল আজাদ স্যার চবিতে সরাসরি আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক।
শক্তির কবিতায় উত্তর আধুনিক বা নতুন কবিতার লক্ষ্মণ আছে।তাঁর কবিতায় কিছু খামখেয়ালিপনা লক্ষ্য করা যায়।তবে শক্তির মতো শক্তিমান কবিতো আলমাহমুদকে সাহিত্য নৈতিক সাপোর্ট দিয়েছেন।
অনেক সমৃদ্ধ লেখা কাজী জহির ভাইয়ের।নিরন্তর ধন্যবাদ নিরপেক্ষ কবি- সমালোচক।
অনেক ধন্যবাদ গাজী গিয়াস উদ্দিন ভাই। শুভকামনা জানবেন।
জহির ভাই একজন স্বাধীনচেতা লেখক। তাঁর লেখার নানাকৌণিক সাহসী বিশ্লেষণ ভাল লাগলো।
অনেক ধন্যবাদ আজাদ। শুভকামনা
লেখাটি পড়ে খুবই ভালো লেগেছে। অনেক অনেক ভালোবাসা জহির ভাই।
অনেক ধন্যবাদ কবি। ভালোবাসা রইল