spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদসাম্প্রতিকবিতর্কিত বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ২০২৪

লিখেছেন : মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন

বিতর্কিত বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ২০২৪

মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন

বাংলা একাডেমি বাংলাদেশের ভাষা, সাহিত্য এবং সংস্কৃতির উন্নয়ন ও সংরক্ষণে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। এটি জাতিসত্তার বিকাশে নানাভাবে ভূমিকা পালনের কথা থাকলেও এটি পথিকের মতই পথ হারিয়েছে বহুদিন ধরে। এর অন্যতম কারণ বিগত দিনগুলিতে বিশেষ বিশেষ রাজনৈতিক দলের চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলতে কিছু স্বার্থান্বেষী মহল এর মূল লক্ষ্য থেকে টেনে-হিঁচড়ে অন্যদিক নিয়ে একে রাজনৈতিক দলের মূখপাত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

এ প্রতিষ্ঠানটি ভাষা ও সাহিত্য চর্চার উন্নয়নে বাংলা ভাষার গবেষণা, সাহিত্যকর্ম প্রকাশ এবং শুদ্ধ ব্যবহার নিশ্চিত করার কথা। ভাষার মানদণ্ড প্রতিষ্ঠা, সাহিত্য প্রকাশনা, ও নতুন লেখকদের উৎসাহিত করার কথা থাকলেও এর কোনটিই সাম্প্রতিক সময়ে ঘটেনি। বাংলা একাডেমি ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি সংরক্ষণে বিশেষ ভূমিকা পালন করবে এবং ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, দলিলপত্র এবং প্রাসঙ্গিক গবেষণার জন্য কাজ করবে, কেননা এটি ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

বাংলাদেশের লোকজ ও আধুনিক সংস্কৃতির বিকাশে বাংলা একডেমি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার জন্য বাংলাদেশের ফোকলোর, লোকগান এবং প্রাচীন ঐতিহ্যের সংগ্রহ ও প্রকাশ; এসবের সংরক্ষণ ও বিকাশে সেমিনার, নাটক, কবিতা পাঠের আয়োজন করে জাতির সাংস্কৃতিক পরিচয়কে মজবুত করবে; জাতীয় চেতনার বিকাশে সাহিত্য ও সংস্কৃতির মাধ্যমে স্বাধীনতা আন্দোলনের চেতনাকে তুলে ধরবে। প্রকৃত অর্থে এর কোনটি বিগত দিনগুলোতে কাজ হয়নি। কিছু বই প্রকাশ পেলেও মানহীন এবং ব্যাক্তি ও রাজনৈতিক পরিচয়ের প্রেক্ষাপটে এসব প্রকাশিত হয়েছে।

বাংলা একাডেমি গবেষণা ও জ্ঞানচর্চা প্রসারের জন্য বাংলাদেশ ও বাংলাভাষা সম্পর্কিত গবেষণার ক্ষেত্রে একটি অগ্রগামী ভূমিকা পালন করার কথা। এর জন্য গবেষণা নিবন্ধ, অভিধান, এবং বিশ্বসাহিত্যের অনুবাদ প্রকাশ, ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষার জন্য প্রশিক্ষণ ও কর্মশালা আয়োজন করা, এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রচার-প্রসারে কাজ করা। এ প্রতিষ্ঠানটি তার প্রকাশনা ও কার্যক্রমের মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন আন্দোলন, যেমন স্বাধীনতা সংগ্রাম, নারী অধিকার, এবং মানবাধিকারের চেতনাকে সমর্থন করে।

এসব কাজের মাধ্যমে বাংলা একাডেমি বিভিন্ন প্রজন্মের মধ্যে ঐক্যের সেতুবন্ধন তৈরি করবে। এই সব কাজের স্বীকৃতির জন্য প্রতিবছর সাহিত্য পুরস্কার প্রদান করে লেখকদের অবদানের স্বীকৃতি দেওয়া এবং দেশীয় ও আঞ্চলিক ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে জাতিসত্তার বহুমূখী দিকগুলো তুলে ধরা। বাংলা একডেমি কেবল ভাষা ও সাহিত্যের উন্নয়নেই নয়, বরং জাতীয় ঐতিহ্য, চেতনা, এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের সংরক্ষণে একটি অবিচ্ছেদ্য ভূমিকা পালন করে। এটি বাংলাদেশের জাতিসত্তার বিকাশে একটি শক্তিশালী মঞ্চ হিসেবে কাজ করে আসার কথা। কিন্তু খুব ভালো করে খেয়াল করলে দেখা যায় বাংলা একাডেমি তার সকল দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, রাজনৈতিকরণের মাধ্যমে এমন কিছু করা যা বাংলা একাডেমিকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের অফিসে পরিণত করেছে।

বাংলা একাডেমির পুরস্কার একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বা বিষয় হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অস্বাভাবিকভাবে নানাভাবে পুরস্কার প্রাপ্তির জন্য অনৈতিক ও রাজনৈতিক পথগুলো বেছে নিয়েছেন পুরস্কার গ্রহীতা এবং প্রদানকারীরা। বাংলা একাডেমি বর্তমানে বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে অবদানের জন্য পুরস্কার দেওয়া হয়। একাডেমি গঠিত ‘বিশেষ কমিটি সংশ্লিষ্ট বছর প্রকাশিত বছর প্রকাশিত গ্রন্থগুলো পর্যালোচনা করে। বইগুলো বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে যেমন কবিতা, উপন্যাস, গল্প, অনুবাদ, শিশু সাহিত্য, নাটক, এবং বিজ্ঞান চর্চায় ভাগ করা হয়। ‘বিশেষ কমিটি’র বিশেষজ্ঞরা ঐসব বইয়ের সাহিত্য মান, বিষয়বস্তু, ভাষার শৈলী এবং প্রভাব ইত্যাদি দিক পর্যালোচনা করে গ্রন্থগুলোকে সাহিত্যগুণ বিচার করে তালিকা সংক্ষিপ্ত করে উপস্থাপনা করা। এই কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে অতি গোপনীয়তা রক্ষা কওে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ৷

এই প্রক্রিয়ায় তিনটি মারাত্মক ত্রুটি রয়েছে এবং সেসব ত্রুটিগুলোকে ব্যবহার করেই রাজনৈতিক ও ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করা সহজ হয়। ‘বিশেষ কমিটি’ এবং ‘অতিগোপনীয়তা’ রক্ষা করে ব্যক্তি নির্বাচন করার প্রক্রিয়ার মাধমে কোনো ধরণের দুর্নীতি ও অপতৎপরতা করা সম্ভব। সাধারণ মানুষের কাছে আগ্রহের বিষয় হলো কমিটিটি ‘বিশেষ’ কেন এবং সংশ্লিষ্ট বছরের প্রকাশিত বইগুলো কেন পূর্বেই উল্লেখ করা হয় না। নোবেল পুরস্কার এবং ম্যান বুকার পুরস্কারে প্রাথমিক তালিকা থেকে শুরু করে চূড়ান্ত তালিকা প্রণয়নে স্বচ্চতার পরিচয় দেয় এবং প্রতিটি ধাপের অগ্রগতি জনসম্মুখে প্রকাশ করে। উল্লেখ্য ২০২৪ সালের অবদানের জন্য যাদের পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হলো তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনকে কোনভাবেই মানুষের কাছে পরিচিত নন। অর্থাৎ তাদের যে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ এ পুরস্কার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে সেই বিষয়গুলো, এবং তাদের প্রকাশিত গ্রন্থগুলো ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতিসহ কোনো ক্ষেত্রেই কোন প্রভাব বা অবদান রেখেছে বলে মনে হয়নি। তাহলে তাদের কিসের জন্য এমন সম্মানে ভূষিত করা হলো?

উল্লেখ্য কবিতায় মাসুদ খানকে যে পুরস্কার দেওয়া হলো তার অবদান হিসেবে বিশেষ বিশেষ মতাদর্শিক পত্রিকার বয়ান হাজির করা হয়। যেমন, “আশির দশকে বাংলাদেশের কবিতায় একটি বড় ধরণের পরিবর্তনের সূচনা হয়। বাংলাদেশের কবিতা, বিশেষত পূর্ববাংলায় কবিতা, নিজস্বতা অর্জন করে পঞ্চাশ দশকের কবিদের হাতে।” এখানে প্রশ্ন উঠেছে তিনি আশির দশকে কবিতা লিখা শুরু করেছেন, এটাই তার অবদান?

দ্বিতীয় প্রশ্নটি হলো মোহাম্মদ শাহজাহান এবং ফারুক নওয়াজকে পুরস্কৃত করা নিয়ে। কেননা এ দু’জন নির্লজ্জভাবে বিগত দিনে ফ্যাসিজমের প্রমোশনের জন্য যা করা দরকার এবং মুক্তিযুদ্ধের গবেষণার নামে বিকৃত ইতিহাসের বয়ান তৈরি করা এবং ধর্মনিরপক্ষতার নামে পশ্চিমা ও ভারতীয় বয়ানের বিস্তৃত করেছেন। ফোকলরে সৈয়দ জামিল আহমদের পুরস্কৃত নিয়েও নানা কথা আছে। তিনি নাট্যজন। শিল্পে তার অনেক অবদান আছে। কিন্তু ফোকলোরে তার উল্লেখযোগ্য অবদান? নাটকের মধ্যে এবং টুকটাক কাজ করেছেন ফোকলোর নিয়ে। এই কাজের মাধ্যমে জাতিসত্তার ঐতিহ্য চর্চা ও সংরক্ষণে কী ভূমিকা আছে? এছাড়া তিনি বিগত ফ্যাসিজমের অত্যাচার ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে কোন ভূমিকা কি রেখেছিলেন? বিজ্ঞানে রেজাউর রহমানের অবদান কী? এভাবে ব্যক্তি কর্ম এবং এসব ব্যক্তিবর্গ রাষ্ট্রের জনগণের ওপর বিগত দিনে যে নিপীড়ন ও নির্যাতন হয়েছে, অপসংস্কৃতির যে আগ্রাসী কর্মকাণ্ড চলছিল তার বিরুদ্ধে তাদের অবদান কী?

বাংলা একাডেমির জাতির ভাষা, ইতিহাস, ঐতিহ্য, ও বিভিন্ন নৃ-জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করাই কাজ। কিন্তু এবার পুরস্কার ঘোষণার পর মানুষের ধারণা ফ্যাসিস্ট সরকারের বিতাড়িত প্রধানমন্ত্রীর রুহানি সন্তানেরা তাদের পরিপল্পনার অংশ হিসেবেই এবারের পুরস্কার ঘোষণা করেছেন। জুলাই অভ্যুত্থানের মূল উদ্দেশ্য হলো বিকৃত বয়ানকারীদের এবং ফ্যাসিস্টদের দোসরদের বিচারের সম্মুখীন করা এবং যেকোনো প্রভাবমুক্ত জ্ঞান-অন্বেষণে সুযোগ তৈরি করা। এর প্রেক্ষিতে যদি যোগ্য লোক পাওয়া না যেত, সেক্ষেত্রে পুরস্কার না দেওয়াই শ্রেয় ছিল। কিন্তু সুলিমুল্লাহ খানকে পুরস্কৃত করে একটি অন্যায়কে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। সুতরাং তার উচিৎ এটি প্রত্যাখ্যান করা ।

এ বিষয়ে বলা যায় এখনই এসবকে প্রতিহত করা না গেলে পরাজিত ফ্যাসিস্টরা যেমন নানাভাবে ফিরে আসবে এবং নতুন নতুন ফ্যাসিস্টের জন্ম হবে। এ বিতর্ক এখানেই কবর দেওয়া প্রয়োজন ।

………

( লেখক সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইংরেজি বিভাগ, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ।)

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

নয়ন আহমেদ on কবিতাগুচ্ছ
নয়ন আহমেদ on মা দিবসের কবিতা
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম on শিপা, আমি তোমার বয়ফ্রেন্ড হতে পারিনি
কাজী জহিরুল ইসলাম on কাজী জহিরুল ইসলাম এর কবিতা