spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যমাসুদ খানের 'কুড়িগ্রাম' ও তার হিন্দবাদী রাজনীতি

লিখেছেন : আবু তাহের তারেক

মাসুদ খানের ‘কুড়িগ্রাম’ ও তার হিন্দবাদী রাজনীতি

আবু তাহের তারেক

মাসুদ খানরে ‘মোহাম্মদ আজম একাডেমি’ কবিতায় পুরস্কার দিছেন। মাসুদ খানরে, কবিতার লগে জড়িত, প্রায় সকলেই চিনবেন। উনি আশির দশকের জনপ্রিয় কবি। (কবিদের কাছে বেশী। পাঠকের কাছে অল্প)। একসময় উনার নাম নিয়া অনেক রাইটারই অর্গাজম ঘটাইতেন। কবি হিসাবে তার একটা জায়গা ত বাংলাদেশের সাহিত্যে আছেই। হইলে, এই জায়গাটা কেমন- এইটা নিয়া খুব যে আলোচনা হইছে, তা না। উনারে প্রশংসা, অনেক ক্ষেত্রে, বাতিল করা হইছে। উনারে ক্রিটিকালি এপ্রেশিয়েট করা, খুব একটা হইছে কি!

এই ক্ষেত্রে, আল মাহমুদের নাম নিতেই হয়। তিনি আশির দশকের ‘মাসুদ খান টাইপের’ কবিদের বেপারে খোলাখুলি মত দিছেন। যেইভাবে, তিরিশের দশকের কবিদের বেপারেও মত দিছেন। (তিরিশের কবিদেরকে তিনি ইউরোপীয় কবি বলতেন। আর, ফরহাদ মজহার এদেরকে কেরানী কবি বলেন।) আমরা জানি, আশির কবিতায় ইসথেটিকস বেশী। এই ইস্থেটিকস রেনেসার জনক, ইউরোপ প্রভাবিত। (বেশী করে, কলোনিয়াল কলকাতার আধুনিক সাহিত্য বাহিত।) কলোনিয়াল কলকাতার তথাকথিত আধুনিক সাহিত্যের কিছু বদ-খাসিয়ত আশির কবিদের মজ্জাগত। এসবের কিছু লিস্ট করা যায়-

০১. আমের বিপরীতে যাওয়া-ভাষা, রীতি, চিন্তা ইত্যাদি বেপারে
০২. কলোনাইজড আইডিয়ার ধারক-বাহক হওয়া
০৩. জীদা আর রঠার পলিটিকাল উত্তরাধীকার বহন করা
০৪. দেশ, কাল ও মাটিরে খারিজ করা
০৫. রাষ্ট্রীয় রাজনীতি না আনা।
০৬. হতাশা, সিউডো ইন্টেলেকচুয়ালিটি, শহুরে মধ্যবিত্তপনা নিয়া আসা।
০৭. কলকাতার কলোনাইজারদের সেট করা ভাষারে মান্য করা।
০৮. মহাভারতীয় ধারণারে আপহোল্ড করা।
০৯. ইসলাম ও মুসলমানের নামগন্ধ, যত সম্ভব, বর্জিত থাকতে পারা।

এই লিস্ট সবার ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য নয়। অন এভারেজ, এইগুলা এদের অন্যতম বৈশিষ্ট। আল মাহমুদ এদের গণ-অসম্পৃক্ততার সমালোচনা করছেন। এছাড়া, এদের অনেকেই, যেমন সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ, ইসলামের অনেক ধারণা ও মুসলমানের মুখের শব্দ কবিতায় আনছেন যদিও, গোমেজের কবিতার তেরছা মিনিং খিয়াল করবেন, আর মুসলমানের এজেন্সি আছে কি না, তাও বিবেচনা করবেন।

আশির দশকের কবিদের মক্কা যেহেতু কলোনাইজড কলকাতা আছিল, ফলে, তাদের ভারত-প্রীতি লক্ষণীয়। মাসুদ খানের সবচাইতে জনপ্রিয় কবিতা (তর্কসাপেক্ষে) কুড়িগ্রাম। এইখানে একটা শব্দবন্ধ আছে। ‘নিখিল নভোভারতের রাজ্যে রাজ্যে’। একজন বাংলাদেশী নাগরিকের পক্ষে এইরকম লাইন লেখা অবাস্তব বটে। কিন্তুক, মাসুদ খান ত, কল্পনায় অন্তত, একটা নিখিল নভোভারতেই থাকেন। বাংলাদেশ তারই একটা রাজ্য বটে! তাদের অন্যতম প্রধান পাঠা জমিদার রঠার রাজনীতিও এই- আমরা মহাভারতের বান্দা মাত্র। এদিকে, মিস্টার আজম, ওরফে বর্তমান বাংলা একাডেমি, তান বক্তব্যে কথায় কথায় মহাভারত, বা ভারতবর্ষ বলেন। (কেউ যদি জিজ্ঞেস করতেন উনারে, ‘ভারতবর্ষ’ কথাখান দিয়া উনি কি মিন করেন, এবং কেনই বা এই শব্দখানা উনার এত পছন্দ!)।

মজার কথা, আশির দশকেরই আরেক কবি, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজের (মানে, অলরেডি উনার নাম আগেও নিছি) একটা ইন্টারভিউ আছে। (আপনারা খোজ নিলেই পাইবেন। শুদ্ধস্বরের লগে ইন্টারভিউটা, আই থিংক)। এইখানে তিনি আজাদির জন্য, (উনাদের জবানে, ‘দেশভাগ’) মুসলমানদেরকেও দায়ী করছেন। বলা ভাল, উনার মতে, এই দায় আসলে মুসলমানদেরই। তথাকথিত ‘দেশভাগের’ এই লাইনের আলাপ মোটেও ‘নিখিল নভোভারতের’ লাইনের বাইরের আলাপ নয়।

আইডিয়ার এই লাইনটারে বিস্তৃত করার খাতিরে, নব্বইয়ের একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি, মোস্তাক আহমাদ দীনের কথাও আনতে পারি। তার একখান কবিতা আছে। মহাভারতের রাজ্যে রাজ্যে গমনের কথা বলা আছে সেইখানেও।

(দু:খজনকভাবে, ফরহাদ মজহারও মনে করেন, আমরা নাকি হিন্দু মুসলমান বইলা বইলা দেশটারে ভাগ কইরা ফেলছি! মানে, কলোনি উনাদের কাছে ‘দেশ’!)

আহমদ ছফার ‘বাংগালি মুসলমানের মন’ প্রবন্ধ হইতে বিখ্যাত ঐতিহাসিক মোহাম্মদ রাফিউদ্দিন একটা গুরুত্বপূর্ণ সূত্র পাইছিলেন। তিনি, ছফার মতই, পূঁথি সাহিত্যরে বিশ্লেষণ করছিলেন। যদিও, ছফা পুথি দিয়া মুসলমানদের পশ্চাদপদতার মাপজোক করতেছিলেন। আর, রাফিউদ্দিন পুথির মাধ্যমে ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ সূত্র নির্মাণ করতেছিলেন। হাল জামানায় পুথি নিয়া নয়া নয়া গবেষণার অংশ হিসাবে, ইস্পিতা হালদার, পুথি সাহিত্যকে বিশ্ব সাহিত্যের অংশ হিসাবে প্রতিষ্ঠার প্রয়াস পাইছেন। তো, মুসলমানরা পশ্চাতপদ, এই ধারণার একটা গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র যে ছফা আছিলেন, তা সইত্য বৈকী! (এখন যেমন, ফরহাদ মজহার মুসলমানদের ফিলসফি নাই বলেন।) মাসুদ খানরা তাদের কবিতায়, বলা ভাল, আশির দশকের কবিতায় ছফার এই বয়ান বেশ ভালভাবে প্রয়োগ করা হইছে। মুসলমানের জবান, যাপনের রীতি, কথা বলবার কৌশল ইত্যাদি কিছু এদের কবিতায় গোপন করা হইছে, অথবা, কেউ কেউ, এইসবরে নিয়া ব্যাংগও করছেন।

আমাদের আলাপ মাসুদ খানরে নিয়া। খিয়াল করবেন, উনার ভাষা তথাকথিত আর্যদের ভাষার অনুকারক। সংস্কৃতায়িত শব্দের প্রতি উনার মোহ, মোটেও কাকতালীয় কোন বেপার নায়। এইটা মূলত, কলোনাইজড কলকাতার প্রতি মোহজাত। এছাড়া, পুব বাংলার মানুষের কৃষ্টি ও সাহিত্যের বৈশিষ্ট্যগুলারে উনি যেন বা ইচ্ছা করিই বিতাড়ন করছেন। আমাদের ভাড়ামি, রস, কাম, উইট এন্ড হিউমার, প্রেম, বাৎসল্য, র-নেস ইত্যাদি কিছুই তার কবিতায় সেইভাবে আসে নাই। বস্তুত, কাম, ক্রোধ, উইট এন্ড হিউমার তার কবিতায় প্রায় নাই। একটা মুখস্ত ইউরোপ, বৈদিক ভারত সহযোগে, যেন বা উনার কবিতার অলংকারে, বয়ানে, চিন্তায় হাজির থাকে।

মানে, এর বাইরে যে উনার কবিতায় কিছুই নাই, তা না। একজন কবি অনেক বিষয় নিয়েই কবিতা লেখেন। কিন্তুক, উনি কি, তার মেজাজ কি- এইসব আমরা লেখকের একটা গড় ঝোঁক দিয়া নির্ধারণ করি।

কুড়িগ্রামের বাইরে যে গুরুত্বপূর্ণ কবিতা মাসুদ খানের খুব একটা আছে, তা বলব কি! আমাদের সার্বিক জীবনে এইসব কবিতা কিভাবে আসে, সেই প্রশ্নও কি আমরা করতে পারব না! মাসুদের কবিতায় উত্তরাধুনিক কবিতার অনেক চরিত্রই হাজির আছে। তা স্বত্ত্বেও, উনি সহজ ভাষায় কথা বলতে পারেন কই! আধুনিকদের মতন, শব্দের পর গীতল শব্দ দিয়ে লাইন নির্মাণ কইরা যান তিনি। এদের অনেক বর্ণনাই ক্লিশে বটে। তার উপমা, বা রূপক অল্প ক্ষেত্রেই টাচ করে। মিনিং উৎপাদন করে। যেইসব ইমেইজ তিনি নির্মাণ করতে চান, তা ভাষা এবং বর্ণনাভাংগির কারণে, কষ্টকল্পনাই থাইকা যায়।

তার কবিতায় সায়িন্টিফিক উপাদান, শব্দ, চিন্তা বেশ আসে। সেইগুলা, বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই, নেইম-ড্রপিং হয় মাত্র। কুনু ইমেইজ বা ধারণা তৈয়ারে খুব যে সহায়ক হয়, তা না। বেপারটা বুঝবেন, কাজল শাহনেওয়াজের কবিতার মাধ্যমে। কাজলও, মাসুদের মতন, কবিতায় বেশ মিশিনারী, কলকব্জার কথা আনেন। কাজল এইসব মিশিনারী নামধাম, মাসুদের মতন, আর্যায়িত করেন না। কাজলের মিশিনগুলাও, খনে খনে স্ট্রংলি পারসনিফাইড হইয়া, আমাদের লগে ইন্টারেকশনে লিপ্ত হয়।

এছাড়া, কলকাতার তথাকথিত আধুনিক সাহিত্য তেমন কুনু শহর কল্পনা করতে পারে নাই, ইউরোপের ওয়েস্টল্যান্ডের বাইরে গিয়া। মাসুদ খানদের আধুনিক সাহিত্যেরও লোকেশন নাই- তাদের নিজেদের শহর নাই। এমনকি, দ্যাশ বা রাষ্ট্রও যে আছে, তা বলব কি!

মাসুদ খানদের আশির দশকের সো কলড ইস্থেটিক মারানি সাহিত্যের বিপরীতে, সেই সময় হইতেই, এন্টি সাহিত্য রচিত হইতেছে। (এইটারে এন্টি সাহিত্য না বইলা, মূল ধারার সাহিত্যও বলা যায়)। কাজল শাহনেওয়াজের কবিতা অনেক বেশী ডিকলোনিয়ালাইজড। মানে, নাম নিতে হইলে ত, অনেকেরই নেওয়া লাগবে, তবুও, রাইসু, কামু, জহির, ইমরুলদের কথা বলাই যায়। উনাদের সাহিত্য, বিশ্ব সাহিত্যের লগে লগে, আমাদের অতীতের সাহিত্যেরও একটা কানেকশন ঘটাইতে চায়। এছাড়া, এখানকার মাটি ও মানুষের জবান ও কৃষ্টির প্রতি তাদের একধরণের লিপ্ততাও লক্ষণীয়।

আমাদের সাহিত্যের শূণ্য দশকের অনেক কবি-সাহিত্যিক মাসুদ খানদের ভক্ত ও অনুরক্ত। মাসুদদের মতই, তাদের একটা গড় এজেন্ডা খিয়াল করা যায়। দু:খজনকভাবে, শূণ্য দশকে প্রায় কুনু কবিই তৈয়ার হইল না।

তো, মাসুদ খানরে বাংলা একাডেমি পুরস্কার দিবার পিছনে, এইসব শূণ্য দশকীয় উপদ্রব, ও তাদের লিটলম্যাগীয় পান্ডববাহিনীর যোগসাজস সহজেই আবিস্কার করা যায়।

সে যাই হউক, হজরত মাসুদ খানের কুড়িগ্রাম কবিতাখানা পড়া যাউক-
……

কুড়িগ্রাম

কোনোদিন আমি যাইনি কুড়িগ্রাম।

রাত গভীর হলে আমাদের এই প্রচলিত ভূপৃষ্ঠ থেকে
ঘুমন্ত কুড়িগ্রাম ধীরে ধীরে আলগা হয়ে যায়।
অগ্রাহ্য করে সকল মাধ্যকর্ষণ।
তারপর তার ছোট রাজ্যপাট নিয়ে উড়ে উড়ে
চলে যায় দূর শূন্যলোকে।

আমরা তখন দেখি বসে বসে আকাশ কত-না নীল
ছোট গ্রাম আরো ছোট হয়ে যায় আকাশের মুখে তিল।

অনেকক্ষণ একা-একা ভাসে নিখিল নভোভারতের রাজ্যে রাজ্যে।
দক্ষিণ আকাশে ওই যে একনিষ্ঠ তারাটি,
একসময় কুড়িগ্রাম তার পাশে গিয়ে চিহ্নিত করে তার অবস্থান।

তখন নতুন এই জ্যোতিষ্কের দেহ থেকে মৃদু-মৃদু লালবাষ্প-ঘ্রাণ ভেসে আসে।

সেই দেশে, কুড়িগ্রামে, ওরা মাছরাঙা আর পানকৌড়ি দুই বৈমাত্রেয় ভাই

কুড়িগ্রামের সব নদী শান্ত হয়ে এলে
দুই ভাই নদীবুকে বাসা বাঁধে
স্ত্রীপুত্রকন্যাসহ তারা কলহ করে।

নদী শান্ত হয়ে এলে
শাস্ত্রবাক্যে বাঁধা যত গৃহনারী
প্রাচীর ডিঙিয়ে এসে নদীকূলে করে ভিড়
প্রকাণ্ড স্ফটিকের মতো তারা সপ্রতিভ হয়।

হঠাৎ বয়নসূত্র ভুলে যাওয়া এক নিঃসঙ্গ বাবুই
ঝড়াহত এক প্রাচীন মাস্তুলে ব’সে
দুলতে দুলতে আসে ওই স্বচ্ছ ইস্পাত-পাতের নদীজলে।

কুড়িগ্রাম, আহা কুড়িগ্রাম!

পৃথিবীর যে জায়গাটিতে কুড়িগ্রাম থাকে
এখন সেখানে নিঃস্ব কালো গহ্বর।

কোনোদিন আমি যাইনি কুড়িগ্রাম।
আহা, এ-মরজীবন!
কোনোদিন যাওয়া হবে কি কুড়িগ্রাম?

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

সাদ আব্দুল ওয়ালী on ৩টি কবিতা
নয়ন আহমেদ on ৩টি কবিতা
নয়ন আহমেদ on ৩টি কবিতা
সাদ আব্দুল ওয়ালী on লজ্জাবতী ও অন্যান্য কবিতা
সাদ আব্দুল ওয়ালী on লজ্জাবতী ও অন্যান্য কবিতা
রাবেয়া আখুঞ্জী on লজ্জাবতী ও অন্যান্য কবিতা
সাদ আব্দুল ওয়ালী on লজ্জাবতী ও অন্যান্য কবিতা
সাদ আব্দুল ওয়ালী on লজ্জাবতী ও অন্যান্য কবিতা