spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যসকল ন্যায়সংগত লড়াইয়ের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে বৈষম্যবিরোধী লড়াই

লিখেছেন : এনামূল হক পলাশ

সকল ন্যায়সংগত লড়াইয়ের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে বৈষম্যবিরোধী লড়াই

এনামূল হক পলাশ

বহু প্রাচীন কাল থেকেই মানুষের সাথে মানুষের বৈষম্যমূলক আচরণ আমরা জেনে আসছি। এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকম আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে উঠেছিল। মূলত সব আন্দোলন সংগ্রামই ইতিহাসের সাইনিং পয়েন্ট হিসেবে ধরা দেয় না। আমরা হয়তো কোন এক জায়গা থেকে সেই বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করা শুরু করতে পারি। বৈষম্যবিরোধী লড়াই এক অনন্ত লড়াই যা যুগ যুগ ধরে জারি আছে। আমাদের কথাগুলো উপনিবেশিক আমল থেকে শুরু করব। সে ছিল এমনই এক সময় যখন ইংরেজরা এদেশের মাটি দখল করে দীর্ঘ বৈষম্যমূলক শাসন ব্যবস্থা কায়েম করেছিল। সেই সময়ে ১৮৫৭ সালে এদেশে ঘটে গিয়েছিল এক বিরাট ঘটনা। ১৮৫৭ সালের ১০ মে অধুনা পশ্চিমবঙ্গের ব্যারাকপুরে শুরু হওয়া ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাবাহিনীর সিপাহিদের একটি বিদ্রোহ ছিল এই ঘটনার সূত্রপাত। ক্রমশ এই বিদ্রোহ গোটা উত্তর ও মধ্য ভারতে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই সব অঞ্চলে বিদ্রোহীদের দমন করতে কোম্পানিকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। ১৮৫৮ সালের ২০ জুন গোয়ালিয়রে বিদ্রোহীদের পরাজয়ের পরই একমাত্র বিদ্রোহ দমন করা সম্ভব হয়। সিপাহি বিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ, মহাবিদ্রোহ, ভারতীয় বিদ্রোহ, ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ ও ১৮৫৮ সালের গণ-অভ্যুত্থান নামেও অভিহিত করা হয়ে থাকে। এই বিদ্রোহ দমন করা হয় নির্মমভাবে।

সিপাহি বিদ্রোহের কারণগুলিকে সামরিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ভারতীয় সৈনিকদের সাথে অসম্মানজনক আচরণ এর জন্য প্রধানত দায়ী। তাছাড়া,  ব্রিটিশদের দ্বারা ভারতীয় সৈনিকদের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ। দেশীয় সৈনিকদের বেতন কমিয়ে দেয়া এবং তাদের উপর আরও কঠোর শৃঙ্খলা আরোপ করাটা এই বিদ্রোহের উপর প্রভাব ফেলে। অন্যান্য কারণগুলোর মধ্যে ব্রিটিশ শাসনকালে ব্রিটিশ কর্তৃক ভারতীয়দের সম্পদের অবাধ লুটপাট, ব্রিটিশদের দ্বারা ভারতীয়দের রাজনৈতিক অধিকার হরণ, ব্রিটিশদের দ্বারা ভারতীয়দের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ গুরুত্বপূর্ণ।

সেই সময়ে বৈষম্য দূর করতে বৈষম্যবিরোধীরাই বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেন। সাধারণ পন্থায় বৈষম্য দূর হওয়ার সম্ভাবনা না থাকায় মানুষ অস্ত্র হাতে তুলে নেয়। ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ ছিল বৈষম্য দূর করতে ব্রিটিশ হটিয়ে স্বরাজ কায়েম করার বিদ্রোহ। যদিও তা তখন ব্যর্থ হয়েছিলো তবুও সেটা ছিলো ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রথম এবং বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা গঠনের অনন্ত লড়াইয়ের একটি অংশ। মানুষ ধারণা করেছিল, ব্রিটিশরা এদেশ ছেড়ে চলে গেলেই সকল প্রকার বৈষম্যের অবসান ঘটবে। আপাত দৃষ্টিতে এটি একটি ব্যার্থ লড়াই হিসেবে পরিগণিত হলেও পরবর্তীতে বহু আন্দোলন সংগ্রাম ও লড়াইয়ের ভেতর দিয়ে ইংরেজরা এদেশ ছাড়তে বাধ্য হয়।

১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান এবং ১৫ আগস্ট ভারত নামের দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। কিন্তু বৈষম্য কখনো এ দেশের জনগণের পিছু ছাড়েনি। পাকিস্তান রাষ্ট্রটি দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল। একটি পশ্চিম পাকিস্তান আর একটি পূর্ব পাকিস্তান। পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে ছিল শাসন ক্ষমতার ভার। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সাথে পশ্চিম পাকিস্তানিদের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে কিছু দিনের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে যায় প্রকৃত স্বাধীনতা আসে নি। এর মধ্যে শাসকরা উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিলে পূর্ব বাংলার মানুষ তা প্রত্যাখ্যান করে। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে এ আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে।

কাগমারি সাংস্কৃতিক সম্মেলন ১৯৫৭ সালে অনুষ্ঠিত একটি বিশেষ তাৎপর্যবাহী জাতীয় সম্মেলন যা পরবর্তীতে পাকিস্তানের বিভক্তি এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যূদয়ে বিশেষ ইঙ্গিতবহ ভূমিকা রেখেছিল। ১৯৫৭ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি থেকে ১০ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত টাঙ্গাইল জেলার কাগমারী নামক স্থানে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানটি আরম্ভ হয়। এই সভায় মওলানা ভাসানী তার বক্তৃতায় অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে বলেন, পূর্ববাংলা পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকদের দ্বারা শোষিত হতে থাকলে পূর্ববঙ্গবাসী তাদের সালামু ওয়ালাইকুম জানাতে বাধ্য হবে। এছাড়া কাগমারী সম্মেলনে ভাসানী পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিলের দাবি জানান। প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সেই দাবি প্রত্যাখান করলে ১৮ই মার্চ তিনি আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেন। একই বছর ২৫শে জুলাই তার নেতৃত্বে ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে ‘ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি’ (ন্যাপ) গঠিত হয়। ১৯৫৮-র ৭ই অক্টোবর দেশে সামরিক শাসন জারি হলে মার্শাল আইয়ুব খান ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে সকল রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশের) জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে ১৯৬৯ সালের সর্বাধিক গুরত্বপূর্ণ একটি আন্দোলন সংঘটিত হয়। ইতিহাসে এটি ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান নামে পরিচিত৷ নিপীড়নমূলক সামরিক শাসন, রাজনৈতিক নিপীড়নের  প্রতিবাদে পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে এই অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। সকল গণতান্ত্রিক দল, পেশাজীবী সংগঠন ও মানুষ যার যার অবস্থান থেকে এই আন্দোলনে যুক্ত হয়৷

১৯৭০ সালে পাকিস্তানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়নি। যার প্রেক্ষিতে শুরু হয় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ।

১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল প্রণীত ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ ছিল বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান। ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছিলো, “যেহেতু বাংলাদেশের জনগণ তাদের বীরত্ব, সাহসিকতা ও বিপ্লবী কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশের উপর তাদের কার্যকরি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে; সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যে ম্যান্ডেট দিয়েছেন সে ম্যান্ডেট মোতাবেক আমরা, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, আমাদের সমবায়ে গণপরিষদ গঠন করে পারষ্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র ঘোষণা করছি।”

এখানে মূলনীতি হিসেবে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাকে বেছে নেয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে ১৯৭২ সালে শেখ মুজিবুর রহমান মুজিবনগর সরকারের ঘোষণাপত্রে উল্লেখিত জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার মূলনীতি বাতিল করে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করেছেন।

৫৩ বছর পর ২০২৪ সালে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নামে ১৯৭১ সালের যুদ্ধকালীন বয়ান ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা’র বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা মূলনীতি ভ্রান্ত হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। এগুলো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার বদলে বিভাজনের রাজনীতি এবং কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থার দিকে ধাবিত করেছে।

২০২৪ সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশে যে গণ অভ্যুত্থান ঘটে গেছে তার রাজনৈতিক রূপ নিয়ে নানা মহলে বিতর্ক হচ্ছে। দেশে দেশে গণ অভ্যুত্থান পরিচালিত হয় সুনির্দিষ্ট বা যৌথ রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার মাধ্যমে নিজ নিজ আত্মপরিচয় বজায় রেখে যুগপৎ আন্দোলন বিকশিত হয়েও অভ্যুত্থান হতে পারে। কিন্তু ২০২৪ সালের অভ্যুত্থানের সময় দেশের সকল রাজনৈতিক দলের সদস্য নিজেদের আত্মপরিচয় বাক্সবন্দী করে বৈষম্যবিরোধী পরিচয় গায়ে চাপিয়ে স্বতঃস্ফূর্ত রাজপথে নেমে এসেছে। এখানে প্রশ্ন উঠাটা স্বাভাবিক, কেন রাজনৈতিক দলসমূহের সদস্যগণ নিজেদের আত্মপরিচয় গোপন রেখেছেন? বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলাম, কমিউনিস্ট পার্টি, বাম ঘরানার দলসমূহ, কওমি মাদ্রাসার ছাত্র, ছাত্রদল, ছাত্রশিবির, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফ্রন্ট সহ সকল সংগঠন নিজেদের রাজনৈতিক, হুজুর, কমিউনিস্ট বা অন্যান্য পরিচয় গোপন রেখে বৈষম্যবিরোধী পরিচয় নিয়ে অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করেছেন। বিষয়টি অবাক করার মতো একটি ঘটনা। তাহলে কি এইসমস্ত দলসমূহ বা গোষ্ঠী নিজেদের আত্মপরিচয় দিয়ে লড়াই সংগ্রাম পরিচালনা করার সক্ষমতা বা জনগণের বিশ্বাস অর্জন করতে পারেন নি?

সফল একটা অভ্যুত্থানের পর এই মেসেজটি সকল রাজনৈতিক সংগঠনের গ্রহণ করা উচিত। এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য নিজেদের প্রস্তুত করতে না পারলে হয়তো আরেকটি দূর্যোগের জন্য সবাইকে অপেক্ষা করতে হতে পারে। একটি বিষয় পরিস্কার হয়েছে যে, এই দেশের মানুষ একটি বৈষম্যহীন ব্যবস্থায় মত প্রকাশের স্বাধীনতা চায়। এখন আমাদের দেখার বাকি আছে কারা সেটা বাস্তবায়ন করতে পারবে। আশা করছি সকল রাজনৈতিক দলসমূহ বা গোষ্ঠী সে অনুযায়ী নিজেদেরকে প্রস্তুত করবেন।

বৈষম্যহীন ন্যায় ভিত্তিক গণতান্ত্রিক সমাজব্যাবস্থা প্রতিষ্ঠার বয়ান ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের নামে অন্যান্য যত চেতনার নামে বয়ান আছে তার সবই ভিত্তিহীন বয়ান। মূল বয়ানকে আড়াল করে লুটপাটের অবাধ ক্ষেত্র তৈরির জন্য অপ্রাসঙ্গিক বিষয় যুক্ত করে চেতনা ব্যবসা এই দেশকে অতীতে বিভাজনের দিকে নিয়ে গেছে।

অসাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ, ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট, পক্ষের শক্তি, বিপক্ষের শক্তি, জংগীবাদ  ইত্যাদি বিষয়কে প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং ২০২৪ সালের ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানের মূল লক্ষ্যকে কেউ বা কোনো গোষ্ঠী যাতে বিভ্রান্ত করতে না পারে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।

মনে রাখতে হবে যে, যারাই গণতান্ত্রিক, ন্যায়ভিত্তিক ও বৈষম্যমুক্ত সমাজ গঠন বাদ দিয়ে অন্যান্য বিষয়কে প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করবে তারাই বিজাতীয় শক্তির দালাল, তারাই দেশ ও জনগণের শত্রু।

শাসক শ্রেণি কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ লুট করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া, চাকরিতে বৈষম্য, পশ্চিম পাকিস্তানিদের দ্বারা পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ ইত্যাদি কারণে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন দাবি করা হয়েছিলো। তার ধারাহিকতায় এবং সমস্যাগুলোর যুক্তিযুক্ত সমাধান করতে না পেরে ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ নিজদের অধিকার নিশ্চিত করতে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। এর প্রেক্ষিতে স্বাধীনতা যুদ্ধ সংগঠিত হয়। বাংলাদেশ আমলেও শাসক শ্রেণি কর্তৃক হাজার হাজার ডলার বিদেশে পাচার করা, চাকরিতে বৈষম্য, উন্নয়নের নামে অব্যাহত শোষণ ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশের জনগণ ভেতরে ভেতরে শাসকদের উপর ফুঁসে উঠতেছিলো। ১৯৭১ সালের পূর্ব বাংলার জনগণের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ আর ২০২৪ সালের বাংলাদেশের জনগণের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের কারণ এখানে সমার্থক। উভয় ঘটনার লক্ষ্য জাতীয় মুক্তি, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। এর বাইরে চেতনার ব্যবসা এই জনগোষ্ঠীকে বিভাজনের রাজনীতির দিকে ঠেলে দেয়। যারা ১৯৭১ ও ২০২৪ কে একটি মুক্তি সংগ্রামের ধারাবাহিক প্রক্রিয়া হিসেবে না দেখে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখে তারাই আসলে চেতনা ব্যবসায়ী। এরাই দেশ ও জাতিস্বত্বাকে বিভাজিত করে নিজেদের আখের গোছাতে চায়। ১৯৭১ সালে এবং ২০২৪ সালেই মূলত আপামর ব্যাপক জনসাধারণ যুদ্ধ ও অভ্যুত্থানে অংশ নেয় এবং সমর্থন জানায়। ইতিপূর্বে ১৯৭১ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যবর্তী কিছু ঘটনা জাতীয় রাজনীতিতে সংঘটিত হয়েছে। সংঘটিত বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলো আপামর ব্যাপক জনসাধারণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে ঘটেনি। সে ঘটনাবলীর নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মিলিত আন্দোলন বা কোন একটি গোষ্ঠীর আন্দোলন। এর মধ্যে কিছু ঘটনা ষড়যন্ত্র চক্রান্তের মাধ্যমে বিকশিত হয়েছে।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিলো ন্যায় ভিত্তিক বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের লড়াই। এটি শুধুমাত্র একটি ভূখণ্ডের জন্য যুদ্ধ ছিলো না। আবার ২০২৪ সালের অভ্যুত্থানও ন্যায় ভিত্তিক বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের লক্ষ্যে সংঘটিত হয়েছে। এটি শুধুমাত্র হাসিনাকে সরানোর জন্য ছিল না।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের বয়ান ছিল পাকিস্তানি শাসনের দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়ে একটি গণতান্ত্রিক, ন্যায়ভিত্তিক ও বৈষম্যমুক্ত সমাজ গঠন; যেখানে দেশের প্রতিটি মানুষের মৌলিক চাহিদা ও নাগরিক অধিকার নিশ্চিত হবে।

পরবর্তীতে ন্যায়ভিত্তিক ও বৈষম্যমুক্ত সমাজ গঠন বাদ দিয়ে অসাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ, ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট, পক্ষের শক্তি, বিপক্ষের শক্তি, জংগীবাদ ইত্যাদি বিষয়কে প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে মূলত জাতীয় ঐক্যকে নষ্ট করা হয়েছে।

২০২৪ সালের ছাত্র জনতার অভ্যুত্থান মূলত কর্তৃত্ববাদী শাসনের দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়ে একটি গণতান্ত্রিক, ন্যায়ভিত্তিক ও বৈষম্যমুক্ত সমাজ গঠনের জন্যই সংগঠিত হয়েছে। ভুল রাজনীতির ফাঁদে আটকে যাওয়া দেশ আবার যেন স্বাধীন হয়েছে।

সার্বিক চিন্তা করলে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মূল বয়ান এবং ২০২৪ সালের ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানের মূল বয়ান অভিন্ন।

১৯৭০ সালে জনগণ ভোট দিয়ে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করতে না পারায় গোটা একটা দেশ দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেল। ভোট এবং মত প্রকাশের অধিকার বাস্তবায়ন করতে ১৯৭১ সালে লক্ষ মানুষ রক্ত দিয়েছেন। ২০২৪ সালেও ভোট এবং মত প্রকাশের বিষয়টি সামনে আসে। আমার মনে হয় ১৯৭১ বা ১৯২৪ এর বয়ানে পার্থক্য নাই। ঠিক একই কারণে এই বাজারে চেতনার বয়ান মূল্যহীন। যদি বয়ান দিতেই হয় তাহলে বলতে হবে  ১৯৭১ আর ১৯২৪ এর চেতনা একই। শুধুমাত্র সময় দৃশ্যপট আর শাসক প্রতিস্থাপন হয়েছে। একটি জায়গায় পার্থক্য করা যায় এভাবে যে, ১৯৭১ সালে যুদ্ধের মাধ্যমে ভূখণ্ড আলাদা করে শাসক বিতাড়িত করা হয়েছে আর ২০২৪ সালে ভূখণ্ড ঠিক রেখে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শাসক বিতাড়িত করা হয়েছে। আমরা স্বতস্ফূর্তভাবেই বলতে পারি ১৮৫৭, ১৯৪৭, ১৯৬৯, ১৯৭১, ২০২৪ এর বয়ান পরস্পরিক যোগাযোগ রক্ষা করে। সকল ন্যায়সংগত লড়াইয়ের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে বৈষম্যবিরোধী লড়াই জারি আছে এবং থাকবে।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

সাদ আব্দুল ওয়ালী on ৩টি কবিতা
নয়ন আহমেদ on ৩টি কবিতা
নয়ন আহমেদ on ৩টি কবিতা
সাদ আব্দুল ওয়ালী on লজ্জাবতী ও অন্যান্য কবিতা
সাদ আব্দুল ওয়ালী on লজ্জাবতী ও অন্যান্য কবিতা
রাবেয়া আখুঞ্জী on লজ্জাবতী ও অন্যান্য কবিতা
সাদ আব্দুল ওয়ালী on লজ্জাবতী ও অন্যান্য কবিতা
সাদ আব্দুল ওয়ালী on লজ্জাবতী ও অন্যান্য কবিতা