….
আবু জাফর সিকদার
…
পাখপাখালির কলকালিতে মুখরিত একগুচ্ছ তমালের ছায়া সুনিবিড় নাগরিকতাকে জড়িয়ে;পানশি,ডিঙি ও রবীন্দ্র সরোবরের শান্ত নিস্তরঙ্গ জলের মৌনতাকে আলিঙ্গন করে, ধানমন্ডি লেকের মনোরম ও স্নিগ্ধ পরিবেশের বুক চিরে পূর্ব পশ্চিমে বিস্তৃত একটি সড়কের নাম্বার ছিলো–৩২। ঢাকা মহানগরের অলিগলির আর দশটি সড়কের মতই একটি সড়কই বটে!
ধানমন্ডি পুরো এলাকাটা তখনও বিস্তীর্ণ ধানের মাঠ, খানাখন্দভরা এবং নদী বেষ্টিত নিম্ন অঞ্চল। এখানে ছিলো ধান কেনা বেচার হাট! মাণ্ডি অর্থ হাট। মান্ডি থেকে মন্ডি। ধান ও ধানের হাট থেকে ধানমন্ডি। আজ সেই ধানের মাঠও নেই, সেই হাটও নেই! নেই সেই নদীও। কাওরান ও তুরাগ নদীর অপভ্রংশ মজা নদীটিই আজকের ধানমন্ডি লেক। সময়ের পরিক্রমায় কত কিছুই বদলে যায়। প্রকৃতি, পরিবেশ,সমাজ, রাজনীতি, রাষ্ট্রের আকার-আকৃতি, নিয়ম-কানুন, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি, রাজনীতির গতিপ্রকৃতি, মানচিত্র, পতাকা, সত্য- মিথ্যার বয়ান সব কিছুই পরিবর্তনশীল।
সেই পরিবর্তনের স্বতঃসিদ্ধ ও অমোঘ নিয়মেই এই বত্রিশের বাড়িটির উপর দিয়ে বারবার বয়ে গেছে ভয়াবহ সব সুনামি।
রাজনীতির উত্থান ও পতনের বেলাভূমিতে এই বাড়ির ভাগ্য কখনও সুপ্রসন্ন আবার কখনও বা বিপর্যয় নেমে এসেছে।
তারই সর্বশেষ সুনামি আছড়ে পড়লো গত ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫। ধুলায় মিশেয়ে দেয়া হলো ত্রিতল ভবনটি। শৌর্য-বীর্য, দম্ভ- অহংকার চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেল বুলডোজার আর বিক্ষুব্ধ জনতার হাতুড়ি শাবলের ক্ষোভ ও জিঘাংসার অদম্য উল্লাসে, উচ্ছ্বাসে। কেন এই ঐতিহাসিক বিপর্যয় এই বাড়িটাকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে তা আলোচনা পর্যালোচনার পূর্বে এর জন্মতিথি নিয়ে একটু আলোকপাত করা যাক।
ধানমন্ডি লেকের উভয় পাশের বিশাল এলাকা জুড়ে পিডব্লিউডি কর্তৃক ১৯৫৭ সালে একটি আবাসিক প্রকল্পে ১ বিঘার একটি প্লট বরাদ্দ পান শেখ মুজিবুর রহমান– স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেছার নামে। ৬৭৭ নাম্বারের এই প্লটে ১৯৬১ সালে নির্মিত হয়েছিল একটি তিন রুমের একতলা বাড়ি এবং শেখ পরিবার সেই থেকে এই বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। ১৯৬৬ সালে সেটাকে দোতলা করা হয়।
এবং এই বাড়িটিকে ঘিরে অঙ্কিত হতে থাকে সমকালীন রাজনীতির গতিপথ।
বাড়িটিই হয়ে ওঠে বত্রিশ নাম্বার সড়কের পরিপূরক।
স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্বাপর সময় জুড়ে এই বাড়িটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই। শেখ মুজিব স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এবং ক্ষমতা আরোহনের পর থেকে নানা রকম বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের মধ্যদিয়ে দ্রুত জনপ্রিয়তা হারাতে শুরু করেন। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, দুর্ভিক্ষ, বিরোধী দল-মত দমন পীড়ন, একদলীয় বাকশাল ব্যাবস্থা প্রবর্তনের পর পরিস্থিতিকে বিস্ফোরণোন্মুখ করে তোলেন।
তারপর ঘটে যায় বাংলাদেশের ইতিহাসের ভয়াবহতম রাজনৈতিক বিপর্যয়, শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হলেন। শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা সেসময় দেশের বাইরে থাকার কারণে সৌভাগ্যক্রমে মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যান। এবং ঘটনার অকূল স্থল ছিলো এই ৩২ নাম্বার বাড়ি! ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্তই এই বাড়িটি রক্তমাখা দেয়াল আর ফ্লোর নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। এ যেন ইতিহাসের এক নিরব সাক্ষী!
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এর শাসনামলে শেখ হাসিনা দেশে ফিরলে বিভিন্ন আইনি প্রক্রিয়া
শেষে ৩২ নাম্বার আবারও শেখ পরিবার ফিরে পান।
তারপর ইতিহাসের নদী দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে যায়! ক্ষমতার পালাবদল আর নেতৃত্বের হাতবদল ঘটতে থাকে।
শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালের জাতীয় নির্বাচনে আগের সকল কৃত ভূলত্রুটির জন্য ক্ষমা চেয়ে আর অন্তত একবার সুযোগ দেয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন দেশবাসীকে।
দীর্ঘ ২১ বছর পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতা মসনদে আরোহন করল। অবশ্য তার আগে ১৯৯৪ সালের ১৪ আগস্ট ৩২ নাম্বার বাড়িটিকে ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর’ হিসাবে ঘোষণা করেন শেখ হাসিনা। সেই থেকে এই বাড়িটি জাদুঘর হিসাবে পরিচালিত হয়ে আসছিলো। কাগজে কলমে নতুন হোল্ডিং এ বাড়ি নং-১০, রোড নং – ১১, ধানমন্ডি হলেও এর ৩২ নাম্বার পরিচয় অক্ষুণ্ণ থাকে।
২০০১ এ শেখ হাসিনা আবারও ক্ষমতার ভরকেন্দ্র থেকে ছিটকে পড়লেও ফিরে আসেন ১/১১ কুশীলবদের বদৌলতে। ২০০৯ এ তিনি দুই তৃতীয়াংশের বেশি সংসদীয় আসন কব্জা করে ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করতে সমর্থ হলেন। বের হতে শুরু হলো তার আসল রূপ! নানা ফন্দি ফিকির, ছলচাতুরি ও অপকৌশলের আশ্রয় নিয়ে দীর্ঘ ১৬ বছরের একটি নিপীড়ক রাষ্ট্রনায়ক হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।
নানা সংগ্রাম, চড়াই উৎরাই পেরিয়ে তত্বাবধায়ক ব্যবস্থার হাত ধরে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থা যেটুকু বিকশিত হতে পেরেছিলো শেখ হাসিনা সেই ব্যবস্থাকে সমূলে উৎপাটিত করে ফেললেন! এ যেন যে-ই মই বেয়ে ক্ষমতার চূড়ার আরোহন করলেন সেই মইটিকে তিনি সরিয়ে নিলেন।
তিনি ইতোমধ্যে ক্ষমতার স্বাদ পুরোপুরি পেয়ে গেছেন। তাই ক্ষমতার চেয়ারটিকে আমৃত্যু নিষ্কণ্টক করা শুধু নয়, বংশ পরম্পরায় ভোগ করার এক দুর্দমনীয় লিপ্সা ও অভিপ্রায়ে মত্ত হয়ে গেলেন! পুরো নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়ে বিচার বিভাগ, প্রশাসন ও আইন শৃংখলা বাহিনীকে দলীয় গণ-ফৌজে পরিণত করলেন; ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ অসংখ্য অঙ্গ সংগঠনের দৌরাত্ম্য এবং রাষ্ট্রীয় বিশেষ বাহিনীসমূহেকে ব্যবহার করে গুম-হত্যা দমন পীড়নের লাগামহীন তাণ্ডবের মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে রূপান্তর করলেন। সংবিধানকে ইচ্ছা মতো কেটে ছিঁড়ে নিজের জন্যই বানিয়ে নিলেন।
বিটিভি সহ প্রায় সকল মিডিয়াকে কুক্ষিগত করে শুরু করেন মেকিয়াভেলি প্রচারণা। চললো নজিরবিহীন লুটপাট, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির মোচ্ছব।
বাকশালের ফিরে যাওয়ার ঘোষণা না দিলেও বাস্তবে বাকশালকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন করলেন। নির্বাচনের নামে ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ এ একবার বিরোধী দলবিহীন, একবার দিনের ভোট রাতে নিয়ে আবার একদল এবং সেইদলের ডামি প্রতিদ্বন্দ্বী দাঁড় করিয়ে নিজেরা নিজেরা সংবিধান ও গণতন্ত্রের নামে, ভোটের নামে মহড়া দিয়ে, পৃথিবীর ইতিহাসে এক নজিরবিহীন প্রতারণার নজির স্থাপন করলেন।
এইসব রাজনৈতিক প্রহসন করে ক্ষমতাকে একক কর্তৃত্বে কুক্ষিগত করে নিলেন। উন্নয়নের নামে দমন, নিপীড়নের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করতে লাগলেন। হত্যা, গুম, মামলা সহ নিবর্তনমূলক যা-যা করা যায় তার চেয়েও অনেক ভয়াবহ কায়দায় প্রতিহত করতে লাগলেন বিরোধী দল ও মত কে।
ফ্যাসিবাদের এক নয়া লেডি হিটলার হিসাবেই তার উত্থান হলো। তিনি হয়ে উঠলেন এক অপ্রতিরোধ্য স্বৈরাচারের প্রতিভূ! তার দল হয়ে হয়ে উঠলো তারই এক বরকন্দাজ বাহিনী রূপে। হিটলার, মুসোলিনি ও মেকিয়াভেলির প্রেতাত্মা যেন বাংলাদেশকে গ্রাস করে ফেললো।
তার দম্ভ, অহমিকা, প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের স্পৃহা সকল সীমা অতিক্রম করে পুরো বাংলাদেশকে শোষক ও শাসিত এই দুই শ্রেণিতে বিভক্ত করে দিল। তারই পটভূমিতে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন দানা বেঁধে উঠলো।
জুলাই ২০২৪ হয়ে উঠলো এক অগ্নিগর্ভ বাংলাদেশ! শেখ হাসিনা এখানে এসেও ইতিহাসের পাঠ পড়তে ব্যর্থ হলেন। প্রলম্বিত জুলাই (৩৬ জুলাই হিসাবে খ্যাত) এর গণঅভ্যুত্থানে পালিয়ে যেতে বাধ্য হলেন ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা। তাকে না পেয়ে জনগণ ক্ষোভ, বিক্ষোভে আঁছড়ে পড়লো ৩২ নাম্বার, গণভবন সহ তার ও দলের বিভিন্ন স্থান ও স্থাপনায়। ৩২ নাম্বার আবারও ভাংচুর ও আগুনের জ্বলে পুড়ে অঙ্গার হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো ইতিহাসের নির্মমতার নিদর্শন হয়ে।
এতবড় বিপর্যয়ের পরও শেখ হাসিনার কোন অনুশোচনা নেই, হয়নি কোন বোধোদয়। আগের মতোই দম্ভ ও অহং নিয়ে গত ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ পলাতক অবস্থান থেকে প্রতিশোধ নেয়ার হুংকার ছাড়লেন! খবরটি প্রচার হবার পর থেকে সমগ্র বাংলাদেশ অগ্নিগর্ভ হয়ে ফেটে পড়লো আবারও। খবর শুনে তাৎক্ষণিকভাবে সংগঠিত হয়ে গেলো বিক্ষুব্ধ ছাত্রজনতা।
ঐ দিন সন্ধ্যা থেকে রাতব্যাপী হাজার হাজার ছাত্রজনতা যার হাতো যা ছিলো তাই নিয়ে ভাঙ্গতে শুরু করলো ৩২। পরে যোগ দেয় বুলডোজার এবং এক্সকাভেটর। তিন তলা ভবন এবং পার্শ্ববর্তী নতুন ভবনটিসহ সকাল হতে না হতেই মাটিতে মিশে গেল! এই হলো ইতিহাসের এক নির্মম পরিণতি। আগামীতে এই ভাগ্য বিপর্যয় থেকে রাজনীতিবিদরা আদৌ কোন শিক্ষা নিবেন কিনা বলা মুশকিল। ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেন না এটাও একটা ইতিহাসের শিক্ষা।
….
লালমাটিয়া।ঢাকা
০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫