আমান আবদুহু
একটা আয়নাঘরের দেয়ালে খোদাই করে একজন লিখেছিলো আই লাভ মাই ফ্যামিলি। ২৩০ দিন। নিজের নামও লিখেছিলো, মাসুদ ইব্রাহিম। ড. ইউনুস সে আয়নাঘর ওপেন করার পর ঐ দেয়ালের ছবি ছড়িয়ে পড়ে।
এ সময় জানা যায় ২০১৬ সালে মাদ্রাসা থেকে আলিম (এইচএসসি সমান) পাশ করা ইব্রাহিম নামে একটা কিশোর ছেলেকে ডাইনিটার বাহিনী জঙ্গি বানিয়ে হত্যা করেছিলো। ছেলেটা গান গাইতো। সংস্কৃতিমনা ছিলো। সে ফজরের নামাজ পড়ার জন্য পুরনো ঢাকার মোগলটুলীর বাসা থেকে মসজিদে যাচ্ছিলো, তখন হারিয়ে যায়। দুই মাস পর পুলিশ জানায়, গাজীপুর পাতারটেকে এক জঙ্গি আস্তানায় পুলিশের অভিযানে সে নিহত হয়েছে।
এ ছেলেটার নাম ছিলো ইব্রাহিম বিন আজিম। ইব্রাহিমে যেহেতু মিল পাওয়া গেছে, বেশিরভাগ মানুষ স্বভাবসুলভভাবে আয়নাঘরের মাসুদ ইব্রাহিম হিসেবে তাকে মনে করে নেয়। বাচ্চা ছেলেটার বন্ধুবান্ধব ও পরিচিতজনদের স্মৃতিচারণও এ উপলক্ষে ছড়িয়ে পড়ে। যদিও আয়নাঘরে থাকা এবং দেয়ালে ঐ লেখা খোদাই করা, নির্যাতনের শিকার মাসুদ ইব্রাহিম মরেন নাই। তার ফেইসবুক আইডির নাম এডভোকেট মাসুদ ইব্রাহিম। তিনিও নিজের কথা লিখেছেন। একজন হলো মাসুদ ইব্রাহিম। অন্যদিকে ‘প্রথম আলো’র শিকার হয়েছে ইব্রাহিম বিন আজিম। ইব্রাহিমে মিল আছে কেবল।
‘প্রথম আলো’র শিকার বললাম কেন?
এ ইব্রাহিমকে ঐ ইব্রাহিম মনে করছে বেশিরভাগ মানুষ, সুতরাং তাকে নিয়ে এবং আয়নাঘর, এসব নিয়ে সবাই যখন কথা বলছে, তখন বের হয়ে আসলো ‘প্রথম আলো’ সেই ২০১৬ সালে, পুলিশ যখন ইব্রাহিম বিন আজীম ছেলেটাকে জঙ্গি বানিয়ে হত্যা করেছিলো, হত্যাকান্ডের ঠিক এক সপ্তাহ পরে একটা রিপোর্ট করেছিলো। পত্রপত্রিকাগুলো মাঝে মাঝে ‘মানবিক রিপোর্ট’ বা হিউম্যান স্টোরি করে। ‘প্রথম আলো’র এ রিপোর্টকে বলা যায় ইনহিউম্যান স্টোরি।
“গাজীপুরে নিহত এক জঙ্গির বাবার আক্ষেপ — ‘মোবাইল ফোনই আমার ছেলেকে শেষ করে দিল'” — এই শিরোনামে করা প্রতিবেদনটা আবার সবার নতুন করে পড়া দরকার। আট বছর পর এসে বাংলাদেশ যখন আওয়ামী লীগের জঙ্গি নাটকমুক্ত হয়েছে, এই সময়ে বসে তখনকার এ খবরটা পড়লে এবং বুঝার চেষ্টা করলে, যে কোন মানুষ সুরিয়াল অনুভূতি পাবেন। অনুরোধ করবো, লিংক থেকে এ রিপোর্টের প্রতিটা বাক্য মনযোগ দিয়ে পড়বেন এবং বুঝার চেষ্টা করবেন। তাহলে আর বাকি লম্বা আলাপের দরকারই হবে না। এই জঘন্য অপরাধ নিজেই তার অপরাধের প্রমাণ হওয়ার জন্য যথেষ্ট।
তথাপি অল্প কয়টা বিষয় উল্লেখ করবো। প্রথম আলোর জানোয়ার সাংবাদিক তার এই স্টেট স্পনসর্ড গল্পে যে কয়টা যুক্তি দিতে এবং যেভাবে কনভিন্স করতে চেষ্টা করেছে।
ইব্রাহিমের ভাই তাকে বলেছিলো, অন্যান্য দিন ফজরের সময় মসজিদে যাওয়ার আগে ইব্রাহিম বাসার সবাইকে ঘুম থেকে ডাকতো। যেদিন সে হারিয়ে যায়, সেই দিন সে মা বাবা ভাই বোনদেরকে ঘুম থেকে না ডেকেই বের হয়ে যায়।
সুতরাং বুঝা গেলো, এ দিনটা স্পেশাল ছিলো। অন্যদেরকে না ডেকে মসজিদে চলে গেছে, আমরা বুঝলাম বাচ্চা ছেলেটা অপারেশনে গেছে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী ও ত্রিশ লাখ তত্ত্বে উদ্বুদ্ধ প্রথম আলো এরপর পাঠকদের মনে চলচ্চিত্রের মতো একটা গল্প ফুটিয়ে তুলে। আপনি চোখের সামনে দেখবেন ঘটনা ঘটতেছে। বিশ্বাস করবেন। এখানে তথ্যের বর্ণনার সাথে ইব্রাহিমের বাবা আজিম উদ্দিনের ‘বাসার নিচে নেমে আসার’ একশনকে এক সাথে রেখে তাদের বানানো তথ্যকেও সত্যের পরিধিতে ঠেলে দিয়েছে এই শাহবাগি মানুপুলেটরের দল। গোয়েবলসের সাগরিদ দল এরা।
“সাংবাদিক এসেছেন শুনে বাসার নিচে নেমে আসেন ইব্রাহিমের বাবা আজিম উদ্দিন। এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ওঠেন। তিনি বলেন, ‘মোবাইল ফোনই আমার ছেলেকে শেষ করে দিল। মোবাইল কিনে দেওয়াটাই ভুল ছিল। এই মোবাইলেই সব হয়েছে। সারাক্ষণ ইন্টারনেটে থাকত।’ তিনি বলেন, ‘ছেলেটা ১৮ বছর শেষ করে মাত্র ১৯-এ পড়েছে। এখন বুঝছি ফেসবুক, ইন্টারনেটের মাধ্যমে বাচ্চা ছেলেটাকে বিপথে নিয়ে গেছে ওরা। আমি ওদের (যারা জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করেছে) বিচার চাই।’”
জ্বি। জাফর ইকবাল স্যারের কথা মনে পড়ে গেছে। ইন্টারনেট অনেক খারাপ।
অবশ্য স্বীকার করতে হয়, ফ্যাসিনার অনুসারীদের জন্য ইন্টারনেট খারাপই প্রতিপন্ন হয়েছে শেষ পর্যন্ত। জাফর দূরদর্শী ছিলো।
‘প্রথম আলো’র জানোয়ার সাংবাদিক সবচেয়ে জঘন্য কাজটা করেছে শেষে। “ছেলের লাশ চাইবেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে তো পেশাদার অপরাধী না। একটা বাচ্চা সে। তাকে ভুল পথে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমি শেষবারের মতো দেখার জন্য ছেলের লাশ চাইব।’”
বাকশালীদের যে অমানবিক প্র্যাকটিস ছিলো, মৃতদেহের উপর জুতা মারা, কবরের উপর জুতা মারা, মৃতদেহকেও ডিহিউম্যানাইজ করা, অপরাধীর পরিবার পরিজনকে ডিহিউম্যানাইজ করা — এই প্রসেসটাতে প্রথম আলোর একটিভ পার্টিসিপেশনের দলীল। ‘প্রথম আলো’রাই এ সংস্কৃতি তৈরি করেছিলো। তারাই শেখ হাসিনাকে শিখিয়েছিলো কিভাবে কি করতে হয়।
শেখ হাসিনার সেই সময়ে যার সন্তানকে, যার ভাইকে স্রেফ তুলে নিয়ে গিয়ে ইচ্ছামতো অত্যাচার করে হত্যা করা ডালভাতের মতো সহজ বিষয় ছিলো, সেই বাবা অথবা ভাই দেশের প্রতাপশালী পত্রিকার সাংবাদিককে কি বলতে পারে? তাদের কি বলার ছিলো? তাদের মেয়ে থাকলে তাকেও তো তুলে নিয়ে যাবে। তখন আবার এ সাংবাদিকেই হিউম্যান স্টোরি করতো, মেয়েটা সম্প্রতি রবীন্দ্র সঙ্গীত শোনা বাদ দিয়েছিলো! তার মায়ের ভাষ্যে।
এই প্রতিবেদনের লেখক জানোয়ার সাংবাদিক আহমেদ জয়ীফ এখন আমেরিকার মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটিতে মিডিয়ার উপর পিএইচডি করতেছে। সে আত্মপক্ষ সমর্থন করে লিখেছে, যেখানে এই বাচ্চা ছেলেটাকে হত্যার বিষয়ে বিন্দুমাত্র অনুতাপ বা দুঃখবোধ নেই, বরং সে উল্টা লিখেছে, এ রিপোর্টের প্রতিটা তথ্যকে না কি সে ওউন করে। ওউন তো করতেই হবে। ওয়ার অন টেররের উচ্ছিষ্ট এই পিএইচডি এবং আমেরিকার জীবন তো না হলে উবে যাবে। এইসব সাংবাদিকতা করেই তো সে আমেরিকা যেতে পেরেছে এই ডিগ্রি করার সুযোগ পেয়ে। দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতে বীজগণিতের সূত্র জানতে হয় না।
আয়নাঘরে চেয়ার ঘুরানো, ইলেকট্রিক শক দেয়া, ধর্ষন করা, নির্যাতন করা আর্মি ও পুলিশের অফিসারগুলো যতটুকু অপরাধী, কম্পিউটারের সামনে বসে তাদেরকে বৈধতা ও প্রেক্ষাপট তৈরি করে দেয়া এই ফ্যাশিস্ট এনাবলার আহমদ জায়িফ (আসলে জয়িফ। শাহবাগি কোন জানোয়ার জায়িফ/দাইফ নামের যোগ্য না। এর অর্থ হয় অতিথি, অথবা অতিথিপরায়ণ। বানানের উপর নির্ভর করে। আর জয়িফ মানে হলো দুর্বল। কাওয়ার্ড। যেমন, এই সাংবাদিকটা) সামান্যতম কম অপরাধী না। এটা কোন রেটরিক না। এই সাংবাদিক জানোয়াররা আক্ষরিক অর্থে সাইকোপ্যাথ খুনী এবং নির্যাতনকারী। আপনি যদি একজন মানুষ হন, কিভাবে পারেন এদের সাথে সামাজিক সম্পর্ক রাখতে? কিভাবে পারেন এদের সাথে কথাবার্তা বলতে?