রাজু আলাউদ্দিন
গত দুই তিনদিন থেকে কানাঘুষা চলছিল কবি, প্রাবন্ধিক ও সহকারী অধ্যাপক সোহেল হাসান গালিব ঝামেলায় পড়তে পারেন তাঁর একটি কবিতায় রাসুল প্রসঙ্গের কারণে। কিছু লোক অভিযোগ করেছেন ওই কবিতায় তিনি রাসুলকে অপমান করেছেন অশালীন ভাষা ব্যবহার করে। কবিতাটি আমি পড়েছি। ঘটনা কিন্তু মোটেই তা নয়। কবিতায় অনেক সময় কোনো ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় চরিত্রকে চিত্রায়িত করার লক্ষ্যে স্বাধীনতা নেয়া যায়। এই কবিতায় সেই স্বাধীনতাও নেয়া হয়নি। কবিতাটি রাসুলকে আমজনতা কিংবা আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে দাঁড়ায় এই যে নবী মোহাম্মদকে যারা অবমাননা করছে তাদের বিরুদ্ধাচারণ করতে গিয়ে কেউ একজন আঞ্চলিক বা কথ্যভাষায় সেটা বলছেন। গালিব সেই কথ্যভাষাটিকে খুব সুন্দর করে তুলে ধরেছেন। ঘটনা হলো এই কবিতা রাসুল অবমাননা নয়, একদম স্পষ্টভাবেই তিনি অবমাননাকারীদের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থানটি তুলে ধরেছেন। কিন্তু একদল অতিউৎসাহী লোক কবিতাটির একদম বিপরীত অর্থ দাঁড় করিয়ে তার বিরুদ্ধে ফেসবুকে কুৎসা, আপত্তি, গালাগাল ও হুমকি দিতে শুরু করলেন। তারা কবিতাটির অর্থ বোঝা দূরের কথা, এর অভিমুখটাই উল্টে দিয়েছেন। অথচ এটা এমন কোনো জটিল কবিতা নয় যে এর অর্থ উদ্ধারে বা অভিমুখ বুঝতে গলদঘর্ম হতে হবে। খুবই সোজাসাপ্টা একটা কবিতা। কিন্তু তারপরও কেন ওরকম উল্টো অর্থ তারা তৈরি করলেন? আমার অনুমান, কবিতাটিতে স্ল্যাং ( আমি কোনো শব্দকেই স্ল্যাং বলে মনে করি না যখন তা বিশেষ অঞ্চলের কোনো জনগোষ্ঠীর অংশ হয়ে যায়। বরং এসব হচ্ছে এক এক অঞ্চলের মানুষের ভাষাভঙ্গি ও শব্দ ব্যাবহারের স্বাভাবিক রীতি।) ব্যবহারের কারণেই এই বিপত্তি এবং আপত্তিও। ঢাকাইয়া কুট্টিরা যে কথায় কথায়, “আবে হালায় কয় কি!” কিংবা শামসুর রাহমানের ‘এই মাতোয়ালা রাইত’-এর প্রথম পংক্তিটাই যদি ধরি: “হালায় আইজকা নেশা করছি বহুত…” এই যে ‘হালায়’ বলা হলো– সম্পর্কে কেউ শালা না হলেও বলে থাকে, এমনকি গালাগাল হিসেবেও আমরা যে শালা শব্দটি ব্যবহার করি, এখানে সেই অর্থেও হালায় শব্দটি ব্যবহৃত হয়নি। এ হচ্ছে ওই জনগোষ্ঠীর ভাষিক এক বৈশিষ্ট্য। সিলেটের লোকরা নাকি মেয়েদেরকে পুরি বলে। তাদের কাছে গিয়ে একটা পুরি চাইলে তারা রাগ করবেন নিশ্চয়ই। কিন্তু যদি ভাষার নানান চলন ও চল সম্পর্কে তিনি সচেতন থাকেন তাহলে নিশ্চয়ই পুরি চাইলেও তিনি তাতে রাগ করবেন না। আমাদের মতো ছোট্ট আয়তনের এই দেশেই ভাষিক বৈচিত্র অকল্পনীয় রকমের বিপুল। কিন্তু আমরা কোনো অঞ্চলের ভাষায় ব্যবহৃত কোনো শব্দকে গালাগালধর্মী বলে মনে করলেও তাদের কাছে ওটা মোটেই তা নয়। সুতরাং প্রত্যেক অঞ্চলের মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে যদি আমরা শব্দের ওই ব্যাবহার বিবেচনা করি তাহলে কোনো ভাষাতেই আসলে স্ল্যাং বলে কিছু নেই। আপনার কাছে যা স্ল্যাং তাদের কাছে তা নয়।
গালিব এই কবিতায় ‘হালার’, ‘ঠাপায়’ এবং ‘আচোদা’–এরকম তিন চারটি শব্দ ব্যবহার করেছেন। এবং এই শব্দগুলো কিন্তু রাসুলের বৈশিষ্ট্য বুঝাতে ব্যবহৃত হয়নি, হয়েছে ওই বিশেষ ভাষী অঞ্চলের লোকগুলো কোন জবানে কথা বলে এবং তাদের সেই জবানে রসুলের বিরুদ্ধাচারীদের মোকাবেলা করবে, সেটাই বলা হয়েছে। আমার ধারণা, গোল বাঁধিয়েছে ওই শব্দগুলো। কিন্তু ওই শব্দগুলো রাসুল প্রসঙ্গে নয়, রসুলের বিরোধিতাকারীদের বিরুদ্ধে যারা কথা বলছে, এ তাদেরই ভাষাভঙ্গি। ইংরেজিতে যখন শুনতে পাই কেউ বলছেন: Look, what a fucking beauty! বক্তা কি এখানে Fucking শব্দটি চোদা অর্থে ব্যবহার করেছেন? শব্দটা তো Beauty শব্দটির বিশেষণ এবং ভালো বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। আমি কখনো কোনো ইংরেজ বা মার্কিনিকে শব্দের এই ব্যবহারের বিরুদ্ধে কোনদিন আপত্তি করতে শুনিনি। মার্কিনিদের কাছে ওই ব্যবহারটি স্ল্যাং হিসেবে বিবেচিত হয় না। গালিবের কবিতাটিতে যে শব্দগুলো ব্যবহৃত হয়েছে, সেগুলো রাসুলকে অবমাননা করার জন্য তো নয়ই, এমনকি যদি ভাষাতত্ত্বের জায়গা থেকে ভাষিক বৈচিত্র্যের কথাও বিবেচনা করা হয়, তাহলেও এতে আপত্তির কিছু নেই।
কিন্তু তারপরও কেন আপত্তি তোলা হলো? সন্দেহ নেই, ইসলাম, কোরান ও নবীজির ব্যাপারে আমাদের সংবেদনশীলতা অনেক বেশি। সহিষ্ণুতা যত কমেছে, সংবেদনশীলতা ততই বেড়েছে। ঘটনা হলো, কেউ একজন একটা অভিযোগ তুললেই সেটা আমলে নেয়ার আগে পুরো বিষয়টি ভালোভাবে বিচার বিশ্লেষণ করে দেখা উচিত। আর রাষ্ট্রও সেই অভিযোগকে আমলে নেয়ার আগে সে-বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের অভিমত জানা দরকার ছিল না কি? ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন বিষয়ের ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যার সূত্রে গড়ে উঠেছে নানা ধারা উপধারা এবং তারা একটি আরেকটিকে অস্বীকার করে। এরা সবাই নিশ্চয়ই সত্য হতে পারে না। যে-কোনো একটি ধারা সত্য ও মূলানুগ। কিন্তু তারপরও পৃথিবীতে ইসলামের নানাপন্থী লোকজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, কোথাও কোথাও শান্তিপূর্ণভাবেই পরস্পর সহাবস্থান করছে। এই সহাবস্থানের পেছনে কাজ করে সহিষ্ণুতা বোধ। ইসলাম সহিষ্ণুতাকে খুবই গুরুত্ব দিয়েছি। কিন্তু আমরা এই সহিষ্ণুতাকে গুরুত্ব দিচ্ছি কম। গালিবের ঘটনাটি যদি ধর্ম বা নবীকে অবমাননার কারণে হতো, তাহলেও না হয় অসহিষ্ণু অভিযোগকারীদের কথা মেনে নেয়া যেত। কিন্তু আদতে ঘটনা তো তা ছিল না। কাব্যবোধহীন, ভাষাজ্ঞানহীন ও ধর্ম সম্পর্কে অস্বচ্ছ ধারণার অধিকারী কতিপয় লোকের আপত্তির কারণে একজন লেখককে এভাবে গ্রেফতার বরণ করতে হলো। আরও যেটা খারাপ দৃষ্টান্ত তৈরি হলো সেটা হলো এই যে সরকার যে-লেখাটির ভিত্তিতে অভিযোগটি আমলে নিয়েছে, সেই লেখাটি তারা মোটেই বুঝতে পারেনি। এই সরকার ফ্যাসিবাদী শক্তিকে হটিয়ে ক্ষমতায় এসেছে, অথচ গালিবের সাথে এখন যেটা করা হচ্ছে তা ওই ফ্যাসিবাদেরই আরেক ধরন, এ হচ্ছে মব-ফ্যাসিজম। ভাবতে অবাক লাগে এই গালিব আওয়ামী সরকারের ফ্যাসিবাদ ও দুরাচার নিয়ে তখনই সোচ্চার ছিলেন। জুলাই আগস্ট আন্দোলনে তিনি পূর্ণ সমর্থনই কেবল নয়, বহু পোস্ট দিয়েছেন। ছাত্রআন্দোলনকে পুরোপুরি সমর্থন দিয়ে গেছেন। দুর্ভাগ্য হলো এই যে আজ তার সমর্থিত সরকারই তাকে গ্রেফতার করেছে। মব-এর অভিযোগে একজন বিদ্বান, সৃষ্টিশীল ও নিরপরাধ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হলো। বাক-স্বাধীনতার কথা আর না-ইবা বললাম।
কৌতুককর ব্যাপার এও যে বাজারে গালিবের কুখ্যাতি ছিল ‘মৌলবাদী’, ‘ইসলামপন্থী’ আর ‘রাজাকারের বাচ্চা‘ হিসেবে। এর পক্ষে তার একাধিক লেখা তো বটেই, এমনকি তার বইয়ের নামকরণকেও নমুনা হিসেবে হাজির করা হয়, বাদ-মাগরেব কিংবা আমার খুৎবাগুলি। সেই গালিবকে আজ তৌহিদী জনতার অভিযোগে নবী-অবমাননাকারী হিসেবে গ্রেফতার বরণ করতে হলো। গালিবের লেখায় আমি বরং ইসলামী সংস্কৃতির প্রতি পক্ষপাতই লক্ষ্য করেছি বেশি, কিন্তু তাই বলে প্রগতিবিদ্বেষী বলে মনে হয়নি তাঁকে। আরবি ফারসি শব্দ ব্যবহারের প্রতি তাঁর ঝোঁকও রয়েছে এবং আমি তা মোটেই দোষের মনে করি না।
আর ঘটনা কেবল সোহেল হাসান গালিবেই সীমিত নয়। যে-বইটিতে তার ওই কবিতাটি আছে, সেই আমার খুৎবাগুলি-এর প্রকাশক উজানকে বাংলা একাডেমি ও নিরাপত্তাবাহিনীর আনঅফিসিয়াল নির্দেশে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। একটি বই যদি ভিন্নমতের হয়, তবে তা নিষিদ্ধ করে সেই বইটির প্রতি পাঠকদের কৌতূহলকে কেবল বৃদ্ধিই করা হয় না, এমনকি যারা সেই অর্থে পাঠক নন, তারাও নিষিদ্ধ হওয়ার কারণে বইটি সম্পর্কে কৌতূহলী হয়ে ওঠেন এবং অভ্যাসের বাইরে গিয়ে পড়তে শুরু করেন। তার মানে বইটিকে নিষিদ্ধ করতে গিয়ে সেটিকে প্রসিদ্ধ ও বহুলপঠিত করে তোলেন। গালিবের আপাতত লাভ এটুকুই। তিনি এতটা পরিচিত ছিলেন না যে সাধারণ পাঠক তার দিকে ফিরে তাকাবে। কিন্তু এখন গালিব তাদের কাছে পাঠ্য হয়ে উঠলেন। মন্দ নয়। বাংলা একাডেমি ও এই অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে গালিবের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। তবে আসল কৃতজ্ঞতা জানানো উচিত ওই তৌহিদী জনতার প্রতি যাদের বোধের অসঙ্গতি নিয়ে তিনি কবিতাটি লিখেছেন। কারণ তারা অভিযোগ না করলে গালিবের এই খ্যাতি কখনই সম্ভব হতো না।
১৪-০২-২০২৫