রেজা তানভীর
আয়নাঘর সম্পর্কে বাংলাদেশের মানুষ প্রথম জানতে পারে ২০২২ সালে সুইডেনভিত্তিক গণমাধ্যম নেত্র নিউজের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের মাধ্যমে। গণমাধ্যমটি ওই বন্দিশালায় কীভাবে মানুষকে ধরে নিয়ে বন্দি করে রাখা হতো সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানায়। কীভাবে একজন মানুষকে সেখানে বন্দি রেখে দিনের পর দিন প্রহার ও নির্যাতন করা হতো সে সম্পর্কে সাবেক সেনা কর্মকর্তা হাসিনুর রহমান বলেছিলেন নেত্র নিউজকে। ডিজিএফআই পরিচালিত এই বন্দিশালাকে নাম দেয়া হয় আয়নাঘর। যেটির সঠিক অবস্থানও হাসিনুর জানিয়েছিলেন।
শেখ হাসিনার নির্দেশেই চলত এই বন্দিশালা। হাসিনা যাকে তার ক্ষমতার জন্য হুমকি মনে করত তাকেই সেখানে এনে বন্দি করে রাখত। ফ্যাসিবাদের আমলে কাউকে গুম করে রাখার চাইতে যদি গ্রেফতার করে জেলে আটকে রাখা হতো তাহলে ভিক্টিমের পরিবার শুকরিয়া আদায় করত। অন্তত তাকে গুম করা হয়নি। গুম এমনই এক আতঙ্ক ছিলো, গুমের শিকার পরিবার জানত না, তার পরিবারের সদস্যকে কোথায় রাখা হয়েছে, মেরে ফেলা হয়েছে নাকি বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে! দিনের পর দিন গুমের শিকার ব্যক্তির পরিবার অপেক্ষায় থাকত কখন তার প্রিয়জন ফিরে আসবে। অসংখ্য মানুষকে বিগত ফ্যাসিবাদী সরকারের আমলে গুম করে ফেলা হয়েছিল। তাদের অনেককেই মেরে ফেলা হয়েছিল। কাউকে কাউকে আয়নাঘর নামক বন্দিশালায় এনে বন্দি করে রাখা হতো। ৫ ই আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পরই আয়নাঘর ভেঙে দেয়া হয়। একে একে বেরিয়ে আসেন এখানে আটককৃত বন্দিরা। যদিও ৫ আগস্ট পূর্ববর্তী সময়ে আয়নাঘরের ব্যাপারটা ছিলো ওপেন সিক্রেট।
গোপন এ বন্দিশালার কথা সচেতন মানুষ জানত কিন্তু কেউ কিছু বলার সাহস পেতো না। অনেকেই ৫ ই আগস্ট পরবর্তী সময়ে সেখান থেকে বের হয়ে এসে বন্দিশালাটির নির্মমতার গল্প শোনাতে থাকেন। দেশবাসী অবাক হয়। যদিও এর পূর্বে কিছু ঘটনা সাবেক সেনাকর্মকর্তা হাসিনুর রহমানের কাছ থেকে নেত্র নিউজের বরাতে মানুষ জানতে পারে।
বাংলাদেশে গোপন বন্দিশালাটির নাম দেয়া হয়েছিল আয়নাঘর, যেমনটা আমেরিকা করেছিল গুয়ানতানামো বে, সিআইএ ব্ল্যাক সাইট। রাশিয়া করেছিল এফএসবি পরিচালিত গোপন কারাগার, ক্রাইমিয়ার বন্দিশিবির। চীন করেছিল ব্ল্যাক জেল, উইঘুর ডিটেনশন ক্যাম্প। উত্তর কোরিয়া করেছিল বিচারবহির্ভূত বন্দিশিবির।
মিশর করেছিল বিরোধী দমনের জন্য গোপন আটককেন্দ্র। সৌদি আরব ও আমিরাত ইয়েমেন যুদ্ধের সময় গোপন কারাগার। সিরিয়া আসাদ সরকারের অধীনে গোপন বন্দিশিবির। ইসরায়েলের “Facility 1391” নামে পরিচিত গোপন কারাগার।
আয়নাঘরের কয়েকটি শাখায় ড. ইউনূস সম্প্রতি পরিদর্শন করেছেন। ঢাকার আগারগাঁও, কচুক্ষেত ও উত্তরা এলাকায় অবস্থিত আয়নাঘর ও টর্চার সেল পরিদর্শনকালে ইউনূসের সাথে ছিলেন গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের সদস্য, ভুক্তভোগী, দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমের সদস্যরা।
ইউনূস গোপন এই বন্দিশালাটিকে আইয়ামে জাহেলিয়াত বলে অভিহিত করেন। হ্যাঁ, ঠিকই তো সভ্যতার সবচেয়ে উর্বর সময়ে কোনো সরকার মানুষের উপর এমন বর্বর নির্যাতন চালাতে পারে সেটা সুচিন্তিত মানুষের কাছে অকল্পনীয় ব্যাপার। এই সময়ে কোনো সরকার কোনো নাগরিকের উপর নির্যাতন চালানো, কারেন্টের শক দেয়া, গোপন কক্ষে সার্বক্ষণিক নজরদারি করা, ছোট্ট একটি কক্ষে দিনের পর দিন বন্দি করে রাখা, এসব সুস্পষ্ট মানবাধিকার লঙ্ঘন।
ড ইউনূস আরো মনে করেন, সারাদেশে এরকম আয়নাঘরের সংখ্যা ছয় সাতশো হবে। সব ভেঙে দেয়ার জন্য তিনি বলেন।
ড. ইউনূস গোপন বন্দিশালাটি পরিদর্শনে গেলে দেশজুড়ে আবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসে আয়নাঘর। তবে, জাতি যে আয়নাঘর দেখেছে সেটি অনেকটা রেডিমেড। অনেক কিছুই পরিবর্তন করে ফেলা হয়েছে। দেয়ালে রঙ লাগানো হয়েছে কিংবা দেয়াল ভেঙে ফেলা হয়েছে। অনেকের কাছেই প্রশ্ন এসেছে প্রধান উপদেষ্টা ছয় মাস পরে কেন আয়নাঘর দেখতে এলেন? তাকে এতদিন কেন বন্দিশালাটি দেখতে দেয়া হয়নি বা তিনিই বা এত দেরীতে কেন গেলেন সেখানে? আয়নাঘরের অনেক আলামতই নষ্ট করা হয়েছে। তবুও মানুষ দেখেছে, একটা খুপরি ঘর, যেখানে কোনো রকমে একজন মানুষকে গাদাগাদি করে রাখা হতো কিংবা এমন এক চেয়ার যেখানে বন্দিকে বসিয়ে টর্চার করা হতো।
যেসব বন্দিকে এখানে এনে আটক করে রাখা হতো, তাদের কারো অপরাধ ছিলো সামান্য ফেসবুক স্ট্যাটাস।
আয়নাঘর উন্মোচিত হওয়ার পর ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের লোকজনের অশান্তি শুরু হয়েছে। তারা গণমাধ্যমের পেইজগুলোতে আয়নাঘর সম্পর্কিত পোস্টগুলোতে হাহা দেয়া শুরু করেছে। তারা অসংখ্য বট আইডি খুলেছে। তাদের হয়তো হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ আছে, সেখানে বলে দেয়া হয় কোন পোস্টে কী কমেন্ট করতে হবে, কেথায় হা হা দিতে হবে। তারা চিন্তা করছে, তাদের বট কমেন্ট হয়তো মানুষের মধ্যে প্রভাব ফেলতে পারবে। কিন্তু বোকারা জানে না, সত্য কখনো লুকানো থাকে না, সত্যকে যতই চাপা দেয়া হোক সেটা উন্মোচিত হবেই। আবার আওয়ামী লীগের আরেকটা অংশ বলার চেষ্টা করছে, আয়নাঘর ইউনূস নির্মিত একটা নাটক মঞ্চ। তারা এতটাই অমানুষ হয়ে গেছে যে, তাদের জুলুম অত্যাচারকে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করছে। কিন্তু এভাবে মানুষের কাছে আস্থা কিংবা ভালো হওয়া যাবে না।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান বলেছে, ১৭ বছরে (২০০৭-২০২৩) গুমের শিকার হয়েছেন ৬২৯ জন। এর মধ্যে ৭৮ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। অপহরণের পর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে ৬২ জনকে। ৭৩ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। এখনো নিখোঁজ ৩৮৩ জন। ২০১৬ সালে সবচেয়ে বেশি ৯৭ জন গুম হন।
গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের একটি সংগঠনের নাম মায়ের ডাক। সংগঠনটি গুমের শিকার পরিবারদের নিয়ে বিভিন্ন সময় নানা সভা করে থাকেন। তারা তাদের পরিবারের সদস্যদের সন্ধানের জন্য সরকারের কাছে সবসম দাবি জানিয়ে আসছেন। ইউনূস সরকার গঠিত হওয়ার পর গুম কমিশন করেছে। কমিশন গুমের নির্দেশদাতা হিসেবে শেখ হাসিনার জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে এবং গুম কমিশন আরো জানিয়েছে, গুমের সাথে জড়িত কর্মকর্তারা কাজটি এমনভাবে করেছে যাতে এগুলো শনাক্ত করা কঠিন হয়ে যায়। বিভিন্ন ফোর্স নিজেদের মধ্যে ভিকটিম বিনিময় করেছে এবং পরিকল্পনা ভিন্ন ভিন্নভাবে বাস্তবায়ন করেছে।
সভ্যতার এই সময়ে এসে দেশবাসীর প্রত্যাশা গুমের সংস্কৃতি বন্ধ হোক। কেউ অপরাধী হলে তাকে আইনের আওতায় এনে যেন বিচার করা হয়। কিন্তু কাউকে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে কোনো গোপন বন্দিশালায় নিয়ে গিয়ে যেন তার জীবনকে অসহনীয় করা না হয়, যেখানে বন্দি মনে করে নির্যাতন কক্ষ থেকে মরে যাওয়া ঢের ভালো।