spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যশামসুর রাহমানের কাজলরেখা সিন্ড্রোম

লিখেছেন : বদরুজ্জামান আলমগীর

শামসুর রাহমানের কাজলরেখা সিন্ড্রোম

বদরুজ্জামান আলমগীর 

শামসুর রাহমানকে সবসময়ই আমার খুব বড় কবি মনে হয়। সবকিছু মিলে আগে কখনও এতোটা অসহায় বোধ করিনি। ভাবি আহা, মানুষ কতোটাই না পরিপ্রেক্ষিতের দাসসাসী হয়ে উঠতে পারে! কোন কারণ ছাড়া, এমনিই– (এমনিই তো?), অনেক দিগ্বিজয়ী লেখক, কবি, বুদ্ধিজীবীকে দেখি– শামসুর রাহমানকে হেনস্থা করে, অন্য কয়েকজনের নাম বলে তারা– যারা তাদের বিবেচনায় বাংলা ভাষায় দুনিয়ার সেরা কবি! শামসুর রাহমানকে কারো কাছে গৌণ– এমনকী নগণ্য কবি মনে হতেই পারে– তাতে কোন সমস্যা নাই; কিন্তু আসলে মামলাটি অন্য জায়গায়। শামসুর রাহমান একটা অছিলা মাত্র– রাহমানকে সম্মান, কী ছোট করার ভিতর দিয়ে আমরা বুঝতে পারি– আমাদের দেশটাকে তারা সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিকভাবে আসলে কোথায় দেখতে চান। একজন প্রকৃত কবি তাঁর জনপদের উৎকন্ঠা, পাশফেরা, নিমগ্নতা আর আর্তির মাঝখানে বসে লিখবেন– এটিই তো স্বাভাবিক; তা না হলে তিনি কবিতা লিখতে এসছেন কেন?

রাজনীতি ক্ষেত্রেও এতোটা জাজ্জ্বল্যমান প্রমাণ পাওয়া কঠিন হবে, যতোটা কূটনৈতিক হিসাবনিকাশের ভিতর দিয়ে শামসুর রাহমানের নসিব নির্ধারিত হয়েছে। 

তৃতীয় বিশ্ব নামে যে হরিজন রাষ্ট্রগুলো ছিল– তাদের ডাকনাম থাকুক, না থাকুক, তারা কিন্তু ইন রিয়াল লাইফ এখনও আছে। তো ওই দেশগুলোর কাঠামোর মধ্যে কিছু মায়াবী শঠতা আছে– ওখানে জনগণ নেতাদের কাছে তাদের নাগরিক অধিকার হিসাবে কিছু কার্যকর দেখতে চায় না, তারা বরং নেতৃত্বের কাছে দাক্ষিণ্য আশা করে, নানা উন্নয়ন প্রকল্পের আবদার জানায়। 

লেখকদের কাছেও তারা মনন চায় না– চায় মনের খোরাকি, আশা করে নানা কায়দার আঁখিজল মিশানো প্রেমপত্র; প্রত্যাশা করে নিজের উপর প্রতিরক্ষার ছাউনি, প্রতিপক্ষের দিকে বজ্রপাত। কখনও কখনও আছে তীব্র জাতীয়তাবোধ, তার উপর দেশপ্রেমের জগদ্দল ভার।

নানা চড়াই-উতরাই, আগ-পিছ করে বলা যাবে- শামসুর রাহমান সামরিক স্বৈরাচার বিরোধী কবি; পাকিস্তানি স্বৈরাচারে যাত্রারম্ভ, বাঙলাদেশের আভ্যন্তরীণ স্বৈরাচারে তার খ্যাতি, জয়ময় ও বিস্তার। শামসুর রাহমানের সমপর্যায়ে দ্বিতীয় আরেকজন কবির নাম করা যাবে না- যিনি এই জনপদের প্রতিটি পাশ ফেরায়, উত্থানে, বাঁকে, মোড়ে বাতিওয়ালার দিগ্বলয়ে ঠাঁই নির্ঘুম জেগে আছেন!

কিন্তু পরিহাস এখানে যে, তাঁর মৃত্যুর ৪০দিনও পার হয়নি– বাঙলা কবিতার বহু নকশাকার, কবি, সমালোচকদের কাছ থেকে রাহমান নাই হয়ে যান। সাম্প্রতিক কবিতার অনেক সেলেব্রিটি স্টার কবি, উত্তরাধুনিক তাত্ত্বিকের মুখে আল মাহমুদের নাম শুনি, কিন্তু শামসুর রাহমানের কথা বললে বুঝি তাদের মারাত্মক শিল্পবোধের ওজু নষ্ট হয়ে যায়। 

শামসুর রাহমান তাড়াহুড়ো করেছেন, একই কবিতা বারবার লিখেছেন– একথা সত্য, বাহুল্যও আছে লাগামহীন। কিন্তু তিনি এই ঝুঁকিটা নিচ্ছেন– যেখানে কবিতাটা পুরো জনপদ একসাথে বসে পড়া যায়। শামসুর রাহমানের দুর্ভাগ্য এখানেই। তিনি ডকু পোয়েটিকস করেছেন– এমন আর অন্য কবি-কে করতে দেখি না। এই ঝুঁকির মধ্যে একটি নজরুলীয় বিষয়ের মোলাকাত পাই। লেখার সৌকর্যই একমাত্র কথাটি নয়, কথাটি আরো ভিতরে, সময়ের দাবি অঙ্গীভূত করার একটি প্রত্যয় তাঁর কবিতায়, কেবল শামসুর রাহমানের কবিতায় সাক্ষাৎ পাই।

শামসুর রাহমানের যে কবিতার একটা সহজাত ক্ষমতা ছিল– তা কারো পক্ষেই অস্বীকার করা সম্ভব নয়। তাঁর সত্যিকার অসাম্প্রদায়িক মানবিক মূল্যবোধ ও তজ্জনিত মায়া অন্য আরেকজন কবির মধ্যে খুঁজে পাওয়া কার্যতই অসম্ভব। শামসুর রাহমান কেবল কাব্যবিশ্বাসের কবি নন, তিনি বাস্তবিক সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে তাঁর বিশ্বাসটুকুর বাস্তবায়নও দেখতে চাইতেন। শামসুর রাহমানের সততা ও সফলতা এখানে, আবার কবিতার ডিসকোর্সে বিফলতার সূত্রও এখানেই জাগর। 

শামসুর রাহমানের মুছে যাবার একটি বড় কারণ সামরিক স্বৈরাচার হটে যাবার পর গণতান্ত্রিক রাজনীতি সত্যিকার গণতন্ত্রের চর্চা না করা, গণতন্ত্রের নামে লাগাতার একক, বা পারিবারিক অমানবিক দলখোর রাজনৈতিক, সামাজিক প্রক্রিয়া চালু থাকার কুফল।

গণতান্ত্রিক রাজনীতি সামরিক শাসনের উপর তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে পারেনি। স্বৈরাচার বিরোধী লড়াইয়ের অবিসংবাদিত বীর নূর হোসেন, তাজুল ইসলাম, সৈয়দ আমিনুল হুদা টিটো মর্যাদাপূর্ণ তকমায় গৃহীত হতে পারেননি। এটি পুরো জাতিগোষ্ঠীর ওঠানামা, প্রস্তুতির উপর নির্ভর করে; কবি হিসাবে শামসুর রাহমানের গ্রহণ-বর্জনও একই অভিবাদনের জন্য অপেক্ষা করে। সামরিক স্বৈরাচারকে মানুষ অন্তত প্রাণ খুলে গালি দিতে পারতো, কিন্তু গণতন্ত্রের জমানায় তাদের বৈফল্যে অসন্তোষ জানিয়ে দেওয়ার অধিকারটুকুও খোয়া যায়।

আল মাহমুদ খুব ভালো কবি, কেউ কেউ তাঁকে পাথেয় করবেন, কিন্তু শামসুর রাহমান থেকে যাচ্ছেন সদ্য স্বাধীন জনপদের পথের দাবী হিসাবে। লোকজ বাঙলার আনাজপাতি, গান, গীতরঙ্গ পরম মমতায় উঠে আসবে বাঙলা কবিতার হৃদস্পন্দনে, একটা পূর্ব বঙ্গীয় বয়ান ধারা গড়ে উঠবে– এ আমাদের সবারই মনোবাঞ্ছা। 

জনমিতির অঙ্কে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের আয়ু ও মরমিয়া কবিতায় উঠে আসবে, আসতেই হবে। কিন্তু তা বাঙালি ক্ষমাসুন্দর মুসলমানের জীবন ও দুনিয়া, তা কোনভাবেই মধ্যপ্রাচ্যের শেখ সংস্কৃতি হতে পারে না।

এখানেই একটি শঙ্কা দানা বেঁধে ওঠে- কেবল কাব্যগুণের ঘাটতিই শামসুর রাহমান অগৃহীত থাকার সত্যিকার কারণ নয়, এখনকার কবিগণ, কাব্য ব্যাখ্যাকারগণ বাঙলাদেশ জনপদের প্রাণের মন্ত্রটির স্ফূরণ ঘটানোর ঝুঁকি নিতে বারবার পিছিয়ে থাকেন– আসল কারণ সেটি।

সারারাত ধরে প্রতি প্রহরে কুটেকুটে সুই তুলেছেন শামসুর রাহমান, কিন্তু রাজকুমার গ্যাছে অন্য কারো ঘরে।।

আরও পড়তে পারেন

1 COMMENT

  1. ভালো লাগলো। অনেক পরিশীলিত উপস্থাপন!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

কাজী জহিরুল ইসলাম on কবিতার জন্য নির্বাসন
নয়ন আহমেদ on কবিতাগুচ্ছ