আবু জাফর সিকদার
পর্ব- ২
…….
কেউ বুঝতে পারেনি ২০২৪ এর জুলাই মাসটা ৩৬ দিনের হবে! এমন কী শেখ হাসিনাও না!
১৭ জুলাই ২০২৪ থেকে ৫ আগস্ট ২০২৪ মাত্র ২০ দিন!
গনেশ উল্টাতে আর সময়-ই দিলে না। যেন এক ঝাঁক আবাবিল পাখি– কঙ্কর, ইটের টুকরো আর কিছু বাঁশের কঞ্চি নিয়ে রাস্তার মোড়ে-মোড়ে, অলিতে-গলিতে, রাজপথে দাঁড়িয়ে গেল। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসা থেকে যেন পঙ্গপালের মতো বের হয়ে এলো এসব ভ্যানগার্ড ! এলো ছাত্র, এলো ছাত্রী, সাথে নেমে এলো অভিভাবক, শিক্ষক, শিক্ষয়িত্রী, কুলি-মজুর-শ্রমিক, রিক্সা চালক, কৃষক কৃষাণী, কামার কুমার, জেলে- তাঁতি; গ্রাম, শহর একাকার হয়ে গেলো। সবাই এলো কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে।
যেন ৫৫ হাজার বর্গমাইল জুড়ে এক সীসাঢালা প্রাচীর উঠে গেল শেখ হাসিনা ও সকল কায়েমি ও অপশক্তির বিরুদ্ধে। তাইতো তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং আইজিপির কাছে এক পুলিশকে ভীত এবং সন্ত্রস্ত হয়ে ভিডিও দেখাতে দেখাতে বলতে দেখা যায় — “গুলি করি, একটাই মরে, একটাই যায় স্যার। বাকিডি যায় না!’
গুলি, অস্ত্র অকার্যকর হয়ে গেলো, রাতদিন হয়ে গেলো একাকার। এভাবে অভূতপূর্ব নবজাগরণ শুরু হয়ে গেলো। বাংলাদেশে এমন সর্বাত্মক গণঅভ্যুত্থান আগে কখনও কেউ দেখেনি। এ যেন এক নতুন বাংলাদেশ! কেউ বলছেন বিপ্লব, আবার কেউ কেউ বুক ভরে নিশ্বাস নিয়ে উচ্চারণ করছেন- – স্বাধীনতা,স্বাধীনতা!
৭১ এ এক সাগর রক্ত দিয়ে কেনা স্বাধীনতা, পরাধীনতার যাঁতায় পিষ্ট হতে হতে ফিকে হয়ে গিয়েছিলো নাগরিকদের জীবনে! ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতন ও পলায়নের পর যেন সেই ৭১ সালের স্বাধীনতার পূর্ণ স্বাদ পাওয়া গেলো।
চাকুরিতে কোটা বৈষম্যের বিরুদ্ধে জেগে ওঠা আন্দোলন ধীরে-ধীরে দানা বাঁধতে শুরু করলো জুলাইয়ের প্রথম থেকেই। ছাত্রসমাজের কোটা সংস্কারের দাবী ছিলো খুবই ন্যায্য ও যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু তা উপেক্ষা, তুচ্ছতাচ্ছিল্য ও দমনের পথে হাটলো শেখ হাসিনার সরকার।
মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান, তাদের প্রতি যথাযথ সম্মান দিতে হবে এ নিয়ে কোন বিতর্ক নেই কিন্তু তা অবশ্যই ন্যায্যতার ভিত্তিতেই হতে হবে। ৩০% কোটার যৌক্তিকতা ছিলো কি? বাস্তবে যা পূরণ করাই অসম্ভব। বলা হয়েছে, যুক্তি দেখানো হয়েছে, কোটায় পাওয়া যায় না বলে তা মেধা তালিকা থেকে নিয়ে নিয়োগ দেয়া হয়! তাহলে যা পূরণযোগ্য নয়, তা কাগজে কলমে রেখে কোন মহৎকর্মটি সারা হচ্ছিলো? এই অপ্রয়োজনীয় বর্ধিত কোটার শানেনুজুল তাহলে কী? মুক্তিযুদ্ধাদের মাথায় কাঁঠাল রেখে কারা কোয়া তুলে খাচ্ছিলো? সেটা তো আর বুঝতে কারও বাকি ছিলো না।
শেখ হাসিনা তবুও তিলকে তাল বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, কোটার যৌক্তিক দাবি মেনে না নিয়ে ত্যানা প্যাঁচাতেই লাগলেন। আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের উপর পেটোয়াবাহিনী ও ছাত্রলীগ, যুবলীগ সহ ভাড়াটয়া বাহিনী লেলিয়ে দিলেন।
এই সময় শেখ হাসিনার এক সাংবাদিক সম্মেলনে চরম অবমাননাকর মন্তব্যে ফুঁসে ওঠলো পুরো ছাত্র সমাজ। তিনি বডি ল্যাঙ্গুয়েজ এবং মুখের ভাষায় বুঝালেন দেশে কেবল দুটি পক্ষের চাকুরিপ্রার্থী। এক. মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতিপুতি। দুই. রাজাকারের সন্তান ও তাদের নাতিপুতি! তিনি দম্ভভরে, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে বললেন– “মুক্তিযোদ্ধার সন্তান নাতিপুতিরা মেধাবী না? রাজাকারের সন্তান, নাতিপুতিরা যত মেধাবী, তাই না? “
একদিকে মুক্তিযুদ্ধের ছেলে মেয়ে নাতিপুতিরা অন্যদিকে রাজাকারদের ছেলে মেয়ে নাতিপুতিরা? মাঝখানে আর কাউকে তিনি খুঁজে পেলেন না। এটাই ছিলো তার উপহাস ও অবজ্ঞা মিশ্রিত এক অভিনব শ্রেণিবিন্যাস! এ কেমন বিভাজন? দেশকে তিনি ভুয়া ও আসল মিলে শুধু ১ লক্ষ ৯৮ হাজার (মতান্তরে ২ লক্ষ ৩১ হাজার) মুক্তিযোদ্ধা বনাম বাকিদেরকে রাজাকার কোটায় চিহ্নিত করে দিলেন? (যদিও তিনি অবস্থা বেগতিক দেখে তার নিজ মুখে বলা ভাষ্যকে পরে বারবার অস্বীকার করতে চেষ্টা করেছেন কিন্তু তখন বড্ড দেরি হয়ে যায়।) এই মুক্তিযোদ্ধা-রাজাকার ট্রাম্পকার্ডটি খেলতে খেলতে তিনি শেষমেষ অকার্যকর করে ফেলেছিলেন!
সারা দেশের আপামর ছাত্র জনতা যেন বারুদের মতো জ্বলে উঠলো। সবাই একই কণ্ঠে আওয়াজ তুললো–
“তুমি কে,আমি কে?
রাজাকার,রাজাকার!
কে বলেছে, কে বলেছে?
স্বৈরাচার স্বৈরাচার!”
তারপর ১৭ জুলাই ২০২৪ এ দিতে চাইলো মরণকামড়!
কাকতালীয় হলেও সত্য, দিনটি ছিল আরবি মাস মহরমের ১০ তারিখ! পবিত্র আশুরার দিন ছিল এটি। এছাড়া এই দিবসটি আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় পৃথিবীর অনেক বিয়োগান্ত ও পালাবদলের ঐতিহাসিক মুহুর্তগুলোকে। আমরাও যেন এক ঐতিহাসিক যুগসন্ধিক্ষণে এসে উপনীত হলাম। চুড়ান্ত সংঘাত ও রক্তাক্ত সমাধানের পথে হাটলো সরকার, শুরু হলো বিপ্লব ও গণ অভ্যুত্থানের চুড়ান্ত পর্ব।
শুরুটা হলো রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রান্তরে। আবু সাঈদকে পুলিশ ঠান্ডা মাথায় বুকে গানপয়েন্ট নিশানা করে খুব কাছ থেকেই গুলি করলো। দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়লো অসম সাহসী, এক বীরের তেজদীপ্ত রক্তদানের বার্তা! এইদিন ঢাকা, চট্টগ্রাম সহ বিভিন্ন স্থানে ঝরে গেল আরও ৫টি তাজা প্রাণ।
চট্টগ্রামে ওয়াসিম আকরাম (ছাত্রদল নেতা, চট্টগ্রাম কলেজ, বাড়ি– কক্সবাজার), মো. ফারুক (বাড়ি– নোয়াখালী এবং তিনি একটি ফার্নিচারের দোকানে চাকুরি করতেন) এবং ফয়সল আহমদ (ছাত্র, এমইএস ওমরগণি কলেজ)। ছাত্রলীগ-যুবলীগের সরাসরি আক্রমণে চট্টগ্রামে এই হত্যাকাণ্ড ঘটে।
পুলিশ ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের যৌথ মহড়ায় ও এলোপাতাড়ি গুলিতে ঢাকায় শহিদ হলো আরও ২ জন। ঢাকা কলেজের সামনে মো. শাহাজান নামে একজন হকার এবং একজন শহিদ হলো সিটি কলেজের সামনে। শুরু হলো লাশের মিছিল! প্রতিদিন লাশ পড়তে লাগলো। পাখি শিকারের মতো করে ছাত্রছাত্রী-সাধারণ জনতার উপর গুলি চলেছে বিরামহীন। আর মিডিয়াতে এসে শেখ হাসিনা এবং তার সরকারদলীয় নেতামন্ত্রীগণ অনর্গল মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দিয়ে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার ব্যর্থ চেষ্টা করতে লাগলেন। পুলিশ বাহিনী রীতিমতো এক দানব বাহিনী হিসাবে আবির্ভূত হলো, র্যাবও একই মূর্তি ধারণ করলো, নামানো হলো বিজিবি, তলব করা হলো সেনাবাহিনীকেও, জারি করা হলো কারফিউ। বন্ধ করে দেয়া হলো যোগাযোগের যাবতীয় ইন্টারনেট পরিষেবা। জাতিকে ও বিশ্বকে অন্ধকারে রেখে এক অভাবনীয় গণহত্যার নীলনকশা বাস্তবায়নে নামানো হলো হেলিকপ্টার, পানি ছিটানোর নামে হেলিকপ্টার থেকে মুহুর্মুহু গুলিতে ঝাঁঝরা করা হলো শত-শত নিরস্ত্র ছাত্র ছাত্রী, নিহত হলো নিরীহ পথচারি, নিহত হলো নিজেদের বাড়ির ছাদে ঘুরতে যাওয়া বাবার কাঁধের উপর বসা ৬ বছরের অবুঝ শিশু রিয়া গোপ! আরও ৭০ এর অধিক শিশুকিশোরের প্রাণ ঝরে পড়লো। ফাইয়াজ, ইয়ামিন সহ বহু সম্ভাবনাময় তরুণ তরুণী শহিদি মিছিলে যুক্ত হতে লাগলো। ‘মুগ্ধ’ শহিদ হলো আহতদের পানি পান করাতে গিয়ে, যেন এ আরেক কারবালার প্রান্তর! বিশ দিন এভাবে হাজারের উপরে ছাত্র জনতার জীবন প্রদীপ নিভে গেলো, আহত হলো ৩০ হাজারের বেশি, অগুনতি রয়েছে নিখোঁজ। আহতদের থেকে এখনও শহিদি মিছিলে শামিল হচ্ছেন অনেকেই। পঙ্গু হয়েছে অনেকেই,কারও চোখ গেছে, কারও গেছে পা, কারও বা হাত, কারও বুকের পাঁজর আবার কারও বা পিঠ হয়েছে ঝাঁঝরা।
এ এক বীভৎস নির্মমতা, গণহত্যা, বাংলাদেশের ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। এমনকি পৃথিবীর ইতিহাসে এরকম একটি গণহত্যার নজির বিরল।
এত বড় হত্যাযজ্ঞের নেতৃত্ব দিয়ে শেখ হাসিনা শেষ পর্যন্ত ৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখ পালিয়ে যেতে বাধ্য হলো। পতন হলো প্রায় ১৭ বছর ধরে জাতির ঘাড়ে চেপে বসা এক ফ্যাসিবাদী, স্বৈরাচারী এবং অবৈধ ও ডামি আর রাতের ভোটের এক জগদ্দল পাথরের।
না, এটা শুধু শেখ হাসিনার পতনের আলাপ নয়। এটির ভেতর দিয়ে জন্ম দিলো এক নতুন বাংলাদেশ। এই দেশে আর কোনো ফ্যাসিবাদ নয়, নয় আর কোনো স্বৈরাচারী শাসন। নিখাঁদ গণতন্ত্রের পথে নবযাত্রার প্রত্যাশায়, সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায় বিচার এবং দুর্নীতিমুক্ত একটি সমৃদ্ধির আগামি গড়ার দৃঢ় প্রত্যয়ে এগিয়ে যাক প্রজন্মের স্বপ্ন সারথি।
কিন্তু এই বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে হলে বিপ্লবোত্তর পুনর্গঠন জরুরী এবং এই রাষ্ট্রকে সমহিমায় মাথা উচু করে টিকিয়ে রাখতে হলে দীর্ঘমেয়াদি অনেকগুলো সংস্কার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন আসু প্রয়োজন। নিচে তা সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো।
এক – সংবিধানই সকল নাগরিক অধিকারের নিশ্চয়তা বিধান করবে।
তাই সংবিধানকে একবিংশশতাব্দীর সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার উপযোগী করে পুনর্বিন্যাস করতে হবে। এই সংবিধান থেকেই ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরাচারকে চোখে চোখে তাকিয়ে না বলতে শিখবে প্রতিটি নাগরিক।
দুই – গণতন্ত্র সুসংহত ও নিরবচ্ছিন্ন করার জন্য সাংবিধানিক নিরংকুশ ও অব্যর্থ একটা কাঠামো হালনাগাদ করতে হবে।
তিন – শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে, উৎপাদনমুখী এবং কর্মসংস্থান নির্ভর সুযোগ তৈরি করতে হবে। শহর থেকে গ্রামে ছড়িয়ে দিতে হবে সকল কর্মসূচি। (আর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ও নয়, কমপক্ষে একটি ভোকেশনাল এবং টেকনিক্যাল কলেজ/স্কুল করতে হবে প্রতিটি উপজেলা লেভেলে। পাস করে সহজ শর্তে পুঁজির যোগান দিয়ে কর্মসংস্থান, নয়তো সরকারি ব্যবস্থাপনায় দক্ষ কর্মী এবং কর্মকর্তা হিসাবে প্রবাসে প্রেরণের নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে।)
চার– অর্থনৈতিক সংস্কার ম্যাক্রো থেকে মাইক্রো লেভেলে নিয়ে যেতে হবে, প্রান্তিক পর্যায় থেকে উন্নয়নের শুরু নিশ্চিত করতে হবে।
পাঁচ– দুর্নীতি ও দুঃশাসন এর কবর দিতে হবে। সত্যিকার অর্থেই হতে হবে জিরো টলারেন্স।
ছয়– নৈতিকতা ও মূল্যবোধকে শিক্ষার এবং চর্চার মৌলিক কাঠামোয় অপরিহার্য হিসাবে গ্রহণ করতে হবে।
সাত –সকল বিতর্কিত বিভাজনকে পরিহার করে ঐক্যকেই জাতীয় সংহতি, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বের প্রতীক গ্রহণ করতে হবে।
আট– বিদেশ নীতি হবে – সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে শত্রুতা নয়।
নয় – সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার সকল স্তরের নাগরিকের জন্য এক ও অভিন্ন হওয়া নিশ্চিত করতে হবে।
দশ– ধর্মীয়, বিভিন্ন সম্প্রদায় এবং সকল নৃগোষ্ঠীর জনগণকে এক ও অভিন্ন নাগরিক মর্যাদা, নারী পুরুষের বৈষম্য দূরীকরণ এবং প্রতিবন্ধী, তৃতীয়লিঙ্গ, নৃগোষ্ঠীর জন্য সকল ধরণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
…….