তাজ ইসলাম
ধানমণ্ডি বত্রিশের বাড়িটি ভেঙে ফেলেছে বিক্ষুব্ধ জনতা। বত্রিশের বাড়িটির জন্যই বত্রিশ রোডটিও সচেতন সবার কাছে পরিচিত।
বত্রিশ বাড়িটি পতিত পলাতক শেখ হাসিনার পৈতৃক বাড়ি। শেখ মুজিবুর রহমান তার বাবা। আওয়ামীলীগ তার দল। শেখ হাসিনা কোন এক ভাষণে দম্ভ করে বলেছিলেন, ‘এ দেশ তার বাবার’। সে হিসেবে আওয়ামীলীগ তার বাবার দল। আওয়ামীলীগের বয়স কত? এই প্রশ্নের উত্তর একটু জটিল।
টিকাটুলীর কে এম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে জন্ম নেওয়া রাজনৈতিক দলের নাম ‘ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’।
সময় ছিল ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন। ইতিহাস এভাবে লিখিত থাকলে এখানে আওয়ামী লীগ বলতে কোন কিছু বুঝেন? সোজা উত্তর হল ‘ না’।
১৯৪৯ সালের ২৩ জুনে গঠিত দলের নামে
বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ বলে তো কোন দল নাই।
সে দলের নাম ‘ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’।
বাংলাদেশের জন্মই হয়েছে ১৯৭১ সালে। গড়ে পড়তায় ২২/ ২৩ বছর পর।আওয়ামীলীগাররা দাবি করে আওয়ামীলীগের জন্ম ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন। এটা ইতিহাসের গোজামিল।
১৯৫৫ সালে এই দলের নামের সংস্কার হয়ে নাম ধারণ করে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’। নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দ বাদ দেওয়া হয়।
‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ নামের দলটির নতুন নাম হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’। বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ না। মনে রাখতে হবে সংস্কার করা নতুন নামটি।
‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ‘। এই নামের দলটিই পূর্ব পাকিস্তানের বিরোধী দল হিসেবে রাজনীতি করে। ৬৯ এ আন্দোলন করে। ৭০ নির্বাচন করে। তখনও বাংলাদেশের জন্ম হয়নি।সুতরাং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ হওয়ার প্রশ্নই আসে না।
যদি এই নাম ধারণ করতো তাহলে প্রকাশ্য রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা খাইতো।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে উচ্চ কণ্ঠে বলে এই দলটির রাজনীতি দেশ স্বাধীন করার ছিল না।ছিল ক্ষমতায় যাওয়ার রাজনীতি। তাদের মতে শেখ মুজিব চেয়েছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে। পাকিস্তান জন্মের আন্দোলনকারীদের একজন ছিলেন শেখ মুজিব। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন মুজিবের রাজনৈতিক গুরু। কায়দে আযম জিন্নাহ ছিলেন শেখ মুজিবের জাতির পিতা। এটা দোষের কিছু না। সেটাও ছিল ইতিহাসের অংশ। কায়দে আযমকে জাতির পিতা বলে কবিতা লিখেছে অনেক কবি। সুফিয়া কামাল তাদের শীর্ষে।
পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর ভুল ও একরোখা নীতি পরিস্থিতির অবনতি ঘটায়। ভারত এই সুযোগটি যথাযথভাবে কাজে লাগায়। নিজের প্রতিবেশীকে ভেঙে দুর্বল করার সহজ সুযোগটি হাতছাড়া করেনি ভারত। শাষকবর্গ সবসময় ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতেই পছন্দ করে। নির্বাচিত দলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে দমন পীড়নে সমাধান খোঁজে। শুরু হয়– মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লেখায় আমরা হাঁটছি না। আমরা একটা দলের ইতিহাসের গতিপ্রকৃতির কথা বলছি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শুরু হয় শেখ মুজিবের শাসন।
শেখ মুজিবের তখন দলীয় পরিচয় কী? যদি বলেন দলীয় পরিচয় তখন একেবারেই গৌণ। বাস্তবতাও তাই। দলীয় পরিচয়ের চেয়েও বড় পরিসরে তার নাম ছড়িয়ে পড়েছে তখন। শেখ মুজিব একটি প্রতিষ্ঠান, একটি জাতির, একটি রাষ্ট্রের প্রধান।
জানার বিষয় হল তাহলে আওয়ামী লীগের জন্ম কখন?
আওয়ামী লীগারদের দাবি মতে আওয়ামী লীগের জন্ম ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন।
অথচ তখন প্রতিষ্ঠিত দলটির নাম আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি। তাহলে বলা যায়
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম পরিচয়ই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জন্ম কাল।ঠিক আছে, আমাদের মানতে সমস্যা নাই। কিন্তু কথায়তো প্যাঁচ লাগে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ৪৯ সনের জন্মকে গ্রহণ করেন দলের বয়স বাড়ানোর স্বার্থে। স্বাধীনতার ধারাবাহিকতায় ৪৭ এর ইতিহাসকে করেন অস্বীকার। দেশের বয়স হিসাব করেন ৭১ থেকে। তাহলে আওয়ামী লীগের জন্ম কালও তো দেশ যাত্রার শুরু থেকেই হওয়া উচিত।
ইতিহাসের একটা পার্টকে অস্বীকার করবেন।নিজের সুবিধার জন্য গ্রহণ করবেন আরেক পার্ট।এটাতো দ্বিচারিতা। পূর্বের অংশ ( ৪৭) বাদ দিলে আওয়ামী লীগের বয়স শুরু ৭১ থেকেই।
অর্থাৎ বাংলাদেশের যা বয়স আওয়ামী লীগেরও সেই বয়সই।
এইবার বলেন বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ কেমনে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ হল? এটাতো সর্বশেষ ছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’।
এখানে আপনাকে দুটো পদ্ধতির একটাকে গ্রহণ করতে হবে।
১. পূর্বপাকিস্তান যে তরিকায় বাংলাদেশ হয়েছে ঠিক সে তরিকায় পূর্বপাকিস্তান আওয়ামী লীগ হয়ে গেছে বাংলাদেশ আওয়ামীভলীগ। এখানে কোন নিয়ম-নীতি নাই। অটো সিস্টেম কাজ করেছে। যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন হয়ে ধারণ করেছে নতুন নাম। পাকমোটর, বাংলামোটর হয়ে গেছে। পূর্বপাকিস্তান আওয়ামী লীগ অটো হয়ে গেছে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ। দলীয় পদ্ধতিগতভাবে না, তা হয়েছে যুদ্ধোত্তর গতিপ্রবাহে।
একটা অটো দল রাজনীতির জন্য কতটা খারাপ-ভালো তাও বিবেচনার বিষয়।
২. আরেকটা সম্ভাবনা হল শেখ মুজিব ক্ষমতায় এসে ‘ নিজের দলের নাম রাখলেন ‘ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’।
ক্ষমতায় থেকে যে দল করা হয় তাকে রাজনীতির ভাষায় বলে কিংস পার্টি। অর্থাৎ স্বাধীন দেশে প্রথম কিংস পার্টির অভিধা জুটে আওয়ামী লীগের কপালে। কিংস পার্টির জনক হিসেবে চিহ্নিত হন শেখ মুজিব।
যেভাবেই বিশ্লেষণ করেন না কেন? ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসম্বরের আগে যে দলের নেতা ছিলেন শেখ মুজিব তার নাম ‘ পূর্বপাকিস্তান আওয়ামী লীগ’।
আওয়ামী লীগকে অটো দল হিসেবে সাব্যস্ত করলে কিংস পার্টির বদনাম থেকে রক্ষা পায় দল হিসেবে আওয়ামী লীগ।
এই অভিযোগ যুক্ত হয় বাকশালের পাশে।ভএবং এখানেও কিংস পার্টির জনক শেখ মুজিব।
সদ্য স্বাধীন দেশের কিংস পার্টির জনক শেখ মুজিব। দুটো প্রক্রিয়ার কোনটা থেকেই কিংস পার্টির জনক থেকে অব্যাহতি পাননি শেখ মুজিব। স্বাধীন দেশে প্রথম কিংস পার্টির প্রবক্তা মুজিব।
কিংস পার্টি বলে-বলে যে ফেনা তোলা হয় এই কথা-বর্তায় পরবর্তী অন্য কয়েকটি দলের কপালেও। জিয়া ক্ষমতায় থেকে গঠন করেন বিএনপি। এরশাদ জন্ম দেন জাতীয় পার্টির। কিংস পার্টি বলে এককভাবে কাউকে আক্রমণ করার সুযোগ নাই। বাংলাদেশে কিংস পার্টিরই প্রভাব।
এখন ছাত্ররা ক্ষমতায় থেকে এমন আরেকটি দল করার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগকে আবার প্রথম ধাপে চিরতরে বাতিল করে শেখ মুজিব। ১৯৭৫ সালে ২৫ জানুয়ারী আওয়ামী লীগের সকল কার্যক্রম স্থগিত করে জন্ম দেন নতুন দলের। তার দলের নাম রাখেন ‘ বাকশাল’। শেখ মুজিবের হাতে কবর হয় আওয়ামী লীগের।
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ থেকে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারী পর্যন্ত ছিল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের আয়ু। নির্মোহভাবে ব্রাকেটবন্দি সময়টুকুই আওয়ামী লীগের জীবন।
মৃত আওয়ামী লীগ আবার মালেক উকিল, আব্দুর রাজ্জাকের নামে ভাগবাটোয়ারা হয়।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে সেনা অভ্যুত্থানে শেখ মুজিবের মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগ ও বাকশাল দুই দলই পরিত্যক্ত হয়ে যায়। ১৯৭৮ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্র চর্চার সুযোগ করে দেন। বাকশাল ও সাবেক আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা আবারও রাজনীতিতে মাথা তুলে দাঁড়ায়। তার আগে শেখ মুজিবুর রহমান নিজেকে নিজের জাতীর সামনে তিন ভাবে মেলে ধরেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত নেতা শেখ মুজিব। ৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরেন শাসক মুজিব। শাসক মুজিব অল্প সময়ের ব্যবধানে হয়ে পড়েন একনায়ক মুজিব।
এক আদেশে নিষিদ্ধ করে দেন সকল দল, রহিত করেন কথা বলার অধিকার। নিষিদ্ধ করেন মত প্রকাশের সকল মাধ্যম। সদ্য স্বাধীন দেশে এক নায়ক মুজিবের রক্ষীবাহিনী জনতার উপর নেমে আসে জুলুমের দানব হয়ে।
জিয়ার আমলে একত্র হয় সাবেক আওয়ামী লীগ, বাকশালীরা। এই আওয়ামী লীগের দায়িত্ব পান শেখ হাসিনা। ১৯৮১ সাল থেকে হাসিনাই আছেন নতুন আওয়ামী লীগের দায়িত্বে। খোদ আওয়ামী লীগের লোকেরাই স্বীকার করে এই আওয়ামী লীগ শেখ মুজিবের আওয়ামীভলীগ না। এটা হাসিনার আওয়ামীলীগ।
মৃত আওয়ামী লীগ, একনায়কতন্ত্রের বাকশাল, ফ্যাসিস্ট হাসিনার আওয়ামী লীগের আতুর ঘর ধানমণ্ডি বত্রিশ।
বত্রিশের ইতিহাসে দু ধরণের কথা লেখা হবে ভবিষ্যতে।
বত্রিশের ইতিহাসে লেখা থাকবে এই বাড়ির এক পুরুষ শেখ মুজিবুর রহমান এই বাড়িতে বসেই আন্দোলন সংগ্রামের নকশা প্রণয়ন করেছেন।
আবার পরের প্যারাতেই লেখা হবে শেখ মুজিবুর রহমান ২৬ মার্চে তার দেশের নিরস্ত্র জনতাকে কোন রকম দিকনির্দেশনা না দিয়ে কৌশলে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে আত্মসমর্পণ করে নিজে নিরাপদ হয়ে গেছেন।
স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান এই বাড়িতে ফিরে এসে দেশ পরিচালনা করেছেন।
গণতন্ত্র নিহত হয়েছে এই বাড়িতেই।আওয়ামীলীগের মতো একটি ঐতিহ্যবাহী দলের অপমৃত্যুও এই বাড়িতেই ঘটে।
বিতর্কিত রক্ষী বাহিনীর হেডকোয়ার্টার এই বাড়ির গেটেই ছিল।
সব দল নিষিদ্ধ হলে, শেখ মুজিবের একনায়কত্ব ও অন্যান্য কারণে দ্রোহ করে সেনাবাহিনী। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর বুলেটে বিদ্ধ হয় এই বাড়ির দেওয়াল। এরপর কেটে গেছে দীর্ঘ সময়।
৫ আগস্ট হাসিনা পালিয়ে যায়। ভোটের পরাজয়, দুর্নীতির দায়ে জেলে যাওয়া আর একজন শাসকের পলায়ন যোজন-যোজন ফারাক। হাসিনা পালিয়ে গেছে। পৃথিবীর দেশে দেশে পালিয়ে যাওয়া শাসকের বাসভবন গুঁড়িয়ে দেওয়ার ইতিহাস আছে। ৫ আগস্টে বত্রিশের বাড়িটি স্বাভাবিকভাবেই ছিল হুমকির মুখে।
বিক্ষুব্ধ জনতার হাত থেকে অস্তিত্বের লড়াইয়ে টিকে যায় বাড়িটি। তবে নিরাপদ রক্ষা পায়নি বত্রিশ নম্বরের এই বাড়িটি। বিক্ষুব্ধ জনতার দ্রোহ প্রশমিত হয় আগুনে পোড়ানোর পর। ৫ আগস্টে পুড়ে -পুড়ে পোড়া ক্ষত নিয়ে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে।
সুনাম বদনামের টিকাটিপ্পনী নিয়ে ইট পাথরের দেওয়াল নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল স্বৈরাচার ও ফ্যাসিস্টের বাড়িটি। ঠিক ৬ মাস পরে গুড়িয়ে দেওয়া হল এই বাড়ি। ভাঙার পক্ষে-বিপক্ষে দুই দল লোক যুক্তি প্রতিযুক্তি উপস্থাপন করে যাচ্ছেন। আমরা পক্ষে-বিপক্ষে কোন পক্ষেই কথা বলতে আগ্রহী নই। আমরা ভাবছি ৬ মাস পরে কেন বাড়িটি ভাঙনের ক্রোধে পড়ল? কে এমন আবহের জন্ম দিল?
বত্রিশের বাড়ি ভাঙা ঠিক না বেঠিক এই নিয়ে প্রশ্ন তুলে ফ্যাসিজমের পক্ষের লোকেরা। ৫ ফেব্রুয়ারিতে গুড়িয়ে দেওয়ার আগে সেনাদের বুলেটে বিদ্ধ হয় তার দেওয়াল। এর পর দীর্ঘদিন থাকে বত্রিশের সেই বাড়িটি অবরুদ্ধ। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বদান্যতায় মালিকানা ফিরে পায় শেখ পরিবারের মুজিব কন্যা হাসিনা। এক সময় এটি মুজিব যাদুঘর হিসেবে ঘোষিত হয়।তারপর ৫ আগস্টে হাসিনার পলায়নের পর জনতার রুদ্র রোষের লক্ষবস্তুতে পরিণত হয় এই বাড়িটি। অগ্নি সংযোগের পরও দাঁড়িয়েই ছিল।তারপর আবার আক্রান্ত হল জনতা কর্তৃক। শুধু আক্রান্তই হয়নি, ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। স্বভাবতই দুই পক্ষে কথা চলছে। একপক্ষ যারা ভাঙছে তাদের দোষত্রুটি বলছে। বাড়িটির ইতিহাস ঐতিহ্যের দোহাই দিচ্ছে। ভাঙ্গার পর তার যৌক্তিকতা নিয়েও কথা বলছেন একটা অংশ।
পাল্টা যুক্তিতে তারা মঈনুল রোডের বাড়ির কথা হাজির করেন। এটা ত্রুটিপূর্ণ যুক্তি। মঈনুল রোডের বাড়িটি ভাঙা হয়েছে ব্যক্তি হিংসা থেকে। ব্যক্তি হাসিনার প্রতিহিংসা বাস্তবায়ন হয়েছে রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে। একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে উচ্ছেদ করেছেন একজন ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রের বাহিনী নিয়োগ করে।
আর বত্রিশ নাম্বার বাড়িটি ভেঙেছে জনতার দ্রোহ, ক্ষোভের সম্মিলিত শক্তি। দুটোর মধ্যে বস্তুত বিশাল ফারাক। ভাঙা ঠিক হল, কি বেঠিক হল, সে বিষয়টি অন্য প্রসঙ্গ। কেন ভাঙল সে জবাবটির সন্ধান করাই জরুরী।
আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনা নিয়মতান্ত্রিক পরাজিত কোন শক্তি না। বিপ্লব বা গণঅভ্যুত্থানে পদচ্যুত ও পলাতক শক্তি।
পৃথিবীর যেকোনো দেশের স্বৈরাচার, ফ্যাসিস্টের পতনের পর তার চিহ্ন নিশ্চিহ্ন করে ক্রুদ্ধ জনতা। লিবিয়ার গাদ্দাফিকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে প্রতিপক্ষ। সিরিয়ার বাশার আল আসাদের পলায়নের পর তার পিতার মূর্তির পরিণতি নিকটতম নমুনা। স্বৈরাচারের চিহ্নের উপর ক্রুদ্ধ জনতা নিজেদের মনের আক্রোশ ঢালে নানা উপায়ে। শেখ হাসিনার পরিচয় ২৪ এর বিপ্লবে একজন খুনি, ফ্যাসিস্ট, স্বৈরাচার। তার নির্দেশে, তার ক্ষমতাকালে আন্দোলন দমনের নামে হত্যা করা হয়েছে হাজার হাজার ছাত্র জনতা। আহত হয়েছে, পঙ্গু হয়েছে। কার্যত নিজের মসনদ টিকিয়ে রাখতে জনগণের বিরুদ্ধে ঘোষণা করেন অসম যুদ্ধ। নিরীহ ছাত্র-জনতার বুকে তাজা বুলেট ছুঁড়েছেন। সমস্ত নির্মমতা বরণ করেই যুদ্ধ চালিয়ে জয়ী হয়েছেন জনতা। পালিয়ে গেছে সংসদ সদস্য, নেতা, পাতিনেতাসহ খুনি হাসিনা।রাগে, ক্রোধে, উত্তাল জনতা হাসিনার ছবিতে নিক্ষেপ করে ঘৃণার জুতা, থুথু, কালি, ময়লা। ভেঙে ফেলে জায়গায় -জায়গায় তার বাবা মুজিবুর রহমানের মূর্তি। ৫ আগস্টে আগুন দেয় বত্রিশ নাম্বারের বাড়িতে। এই বাড়িতে নির্মম নিহত হয় শেখ পরিবার। সপরিবার হত্যার ঘটনাস্থল হিসেবে হাসিনার কাছে এই বাড়িটি একটি অভিশপ্ত বাড়ি। ৫ আগস্ট আগুনের পর জনতা
নিরব হয়ে গিয়েছিল। হাসিনা বা আওয়ামী লীগের কোন অনুশোচনা নাই, কোন অপরাধবোধ নাই।কোন ক্ষমা চাওয়ার লক্ষণ নাই। ৫ আগস্ট থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি এই সময়টায় হাসিনার কোন অনুতপ্ত ভাব নাই, অনুশোচনা নাই। শহীদের রক্তের দাগ লেগে আছে সারাদেশে। আহতরা কাতরাচ্ছে। হাসিনা ভারতে বসে চক্রান্ত করে যাচ্ছেন ।নানাভাবে ফিরে আসার পায়তারা করছেন। ৫ আগস্টের পর ১৫ আগস্টকে উপলক্ষ করে বত্রিশে জড়ো হওয়ার পরিকল্পনা করে পতিত চক্র। তারপর ভিন্ন-ভিন্ন ইস্যুতে তাদের চক্রান্ত সহজভাবে নেয়নি দেশের সর্বসাধারণ। সবশেষে আওয়ামীলীগের ফেসবুক পেইজে হাসিনা ঔদ্ধত্য দেখায় বক্তব্যে। হাসিনা পলাতক, তার দলের নেতাকর্মীরা আড়ালে। এমন পরিবেশে সোশ্যাল মিডিয়ায় জুলাইর বিপ্লবকে কটাক্ষ করে হাসিনা।আন্দেলনকারীদের হুমকি ও অবজ্ঞা প্রকাশ করেন। ক্ষুব্ধ জনতা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। শত্রু পলাতক। সামনে শত্রুকে পায়নি, উপস্থিত কেবল শত্রু চিহ্ন। সে চিহ্নের প্রথম তালিকায় বত্রিশের বাড়ি।
বত্রিশের বাড়িটিকে ধরে নেয় স্বৈরাচারের আতুরঘর হিসেবে। হাসিনা ধরাছোঁয়ার বাইরে,তার নেতারা লুকিয়ে। হাওয়ার হুংকারের ঢেউয়ের প্রতিক্রিয়া আছড়ে পরে বত্রিশের দেওয়ালে। হাজার-হাজার বিক্ষুব্ধ জনতা জড়ো হয় বত্রিশে।উত্তাল জনতার ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় ধূলিসাৎ হয়ে যায় স্বৈরশাসকের চিহ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বত্রিশের বাড়িটি।
যারা আন্দোলন করেছেন তারা নিজের জীবনকে কুরবানি দিয়েই নেমেছিল রাজপথে। তারা এও জানে হাসিনার প্রত্যাবর্তন মানেই আন্দোলনকারীদের মৃত্যু। দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বের বিনাশ। গণতন্ত্র খতম, স্বৈরতন্ত্র, অবিচার, জুলুমতন্ত্রের প্রত্যাবর্তন। বত্রিশ হল হাসিনালীগের একটি কেন্দ্রবিন্দু। কেন্দ্রবিন্দুকে স্থির করে হাসিনা কথা বলার দুঃসাহস দেখায়। হাসিনার ভাষণকে জনতা ধরে নেয় আন্দোলন, বিজয়কে হুমকি হিসেবে। তারা আবার সংঘবদ্ধ হয়, আবার জেগে ওঠে। বত্রিশ ভাঙার উস্কানি মূলত উস্কে দেয় হাসিনা। হাসিনাই প্ররোচিত করে, বত্রিশ ভাঙার মন্ত্রে দীক্ষিত করে অগোচরে হাসিনা। নিজের গোয়ার্তুমির প্রতিফলে বত্রিশ মিশে যায় ধূলায় ।
হাসিনার সর্বশেষ পরিচয় খুনি হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দেয় জাতিসংঘ। জাতিসংঘের রিপোর্ট মতে হাসিনা মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী ফ্যাসিস্ট ও খুনি। বত্রিশের বাড়িটির ইতিহাস লিখতে হলে ২৪ র জুলাই হাজির হবে বহুমাত্রিক অনুসঙ্গ হয়ে। হাসিনা পরিবারের কাছে বত্রিশ একটি অভিশপ্ত বাড়ি। গণতন্ত্রকামী জনতার কাছে ফ্যাসিস্টের আতুরঘর। ইতিহাস কোন নামে পরিচিত করে বত্রিশকে তা বলবে মহাকাল। হাসিনার নাম বত্রিশের সাথে যুক্ত থাকলে জুলাই বিপ্লবীরা হয়তো বত্রিশকে ফ্যাসিস্ট স্কয়ার নামেও ডাকতে পারে। আমরা কোনকিছুই বলছি না। আমরা মহাকালের যাত্রী।মহাকালের দান ও দায়ের দিকেই আছি অপেক্ষমান।